অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ম্যাক্সিম গোর্কির রচনায় দুনিয়ার মজদুর - পার্থ প্রতিম হালদার

রাশিয়ার এক সর্বহারা পরিবারে ১৮৬৮ সালে ম্যাক্সিম গোর্কির জন্ম হয়। আর এমন দারিদ্র্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে মাত্র ৮ বছর বয়স থেকেই তিনি জীবিকা অর্জনের তাগিদে রাস্তায় বের হন। যার ফলে এত অল্প বয়সেই পথে ঘাটে থাকা চোর, ভবঘুরে, অকর্মণ্য, পরিশ্রমী, বেশ্যা প্রভৃতি চরিত্রের সঙ্গে তিনি পরিচিত হতে শুরু করেণ। সব থেকে বড় কথা, এত কম বয়সে এমন নিষ্ঠুর বাস্তবকে প্রতক্ষ করে বা এমন বঞ্চিত, অবহেলিত, পদদলিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত, সর্বহারা, দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদেরকে দেখে হতাশ হয়ে গিয়ে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি সফল হননি। উল্টে তাঁর শ্বাসযন্ত্রে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে -  কিন্তু ভগবান তাঁকে মারেননি। তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কারণ হয়তো দুনিয়াকে 'মাদার' উপন্যাসটি উপহার দেওয়ার জন্য বা দুনিয়ায় মজদুরদের অবস্থানটা সচেতন ভদ্র সমাজের কাছে তথা বুর্জোয়া সমাজের কাছে সুন্দর করে তুলে ধরার জন্য। আর যা তিনি তাঁর সমস্ত সাহিত্য কর্মে দেখিয়েওছেন। তাছাড়া তাঁর জীবনীটা যদি আমরা ভালো করে পড়ি তাহলে দেখতে পাবো ছোট থেকেই তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল সাধারণ দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ তথা শ্রমিক শ্রেণীর পাশে দাঁড়ানো - যা আমরা তাঁর বিভিন্ন লেখালেখি পড়েও বুঝতে পারি।

১৯০৬ সালে তাঁর সবথেকে জনপ্রিয় উপন্যাস 'মা' প্রকাশিত হয়েছিল।  এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নিলভ্না যিনি কিনা অসংখ্য সন্তানের জননী। বা শত শত মায়ের মতো করে তাঁর চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এমনকি একজন মেয়েও  যে প্রতিবাদী বিপ্লবী হয়ে উঠতে পারে তার জলন্ত উদাহরণ এই 'মাদার' উপন্যাসের পাভেলের মা নিলভ্না। শুধু তাই নয়, আলোচ্য উপন্যাসে মা নিলভ্নার বিপ্লব সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে যেন সীমাবদ্ধ থাকে নি - তাঁর বিপ্লবের পথ শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবে উপনীত হবার পথ হয়ে উঠেছিল। যে কারণে নিলভ্না শুধু পাভেলের মা হয়ে থাকেনি - তিনি হয়ে উঠেছেন সমস্ত কমরেডদের মা। যা আলোচ্য উপন্যাসে পাভেলের বন্ধু কমরেড আন্ত্রেই নাখদকারের কথাতে বোঝা যায় - ' আমরা সব এক মায়ের ছেলে - সেই মা হল একই দুর্নিবার ভাবনা, সারা দুনিয়ার শ্রমিক ভাই ভাই। ' সেই সঙ্গে মার্কসবাদের প্রভাবে আলোচ্য উপন্যাসে বিপ্লবী সংগ্রামের কথা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে কিভাবে সংগ্রাম করলে মানুষের আত্মিক নবজন্ম ঘটে বা কিভাবে তার ভেতরটা বদলে যায় - তা এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু -
'আমরা সমাজতন্ত্রী। তার মানে আমরা ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধী। জনতার হাতে ক্ষমতা চাই, সবাই কে খেটে খেতে হবে।'

এছাড়া মার্কসবাদের প্রভাবে তাঁর বিভিন্ন রচনাতে উঠে এসেছে বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিষাক্ত আবহাওয়া , দূর্নীতি আর বুর্জোয়া দের অধঃপতনের চিত্র। এই বুর্জোয়া বা ধনতান্ত্রিক সমাজের নগ্ন রূপকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তিনি যেন আসন্ন বিদ্রোহের পূর্বাভাসটা জনসমক্ষে নিয়ে আসলেন। তাই তাঁর সমস্ত রচনাতে শ্রমিক শ্রেণীর উত্থানের চিত্র পাওয়া যাবে। এমন ধরণের গল্প গুলোর মধ্যে ' মাকার চুদ্রা',  ' আমরা ছাব্বিশ জন মেয়ে' , 'কোলুষা' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

 'আমরা ছাব্বিশ জন মেয়ে' গল্পে লেখক দেখিয়েছেন নীচু তলার মানুষ দের জীবন যেন জীবন্ত মেশিনের মতো। আর নীচু তলার মানুষের জীবনকে জীবন্ত মেশিন করে দেখানোর মধ্য দিয়ে তিনি যেন খেটে খাওয়া মানুষ গুলোর মধ্যে দিয়ে  বের করে আনলেন যন্ত্রের ন্যায় তীব্র নির্ঘোষ। কারণ যে শ্রমিক শ্রেণী যারা কিনা সমাজের চালিকা শক্তি তারাই পশুর মতো জীবন যাপন করছে। তাই তাদের মুক্তি কামী চিন্তাকে মেশিনের মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরতে চাইলেন। যা তাঁর ' আলোছায়া' , 'বহুরূপী' , ' অকাল - বসন্ত' গল্পে দেখতে পাওয়া যাবে শ্রমিক শ্রেণীর যাপন চিত্র। আর এই যাপন চিত্র থেকে উত্তরণের পথ ও তিনি বের করেছেন 'হঠাৎ কুয়াশা' গল্পে। এই গল্পে সমস্ত শ্রেণীর মানুষ হঠাৎ একসঙ্গে যে বিক্ষুব্ধ ক্রোধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে তার চিত্র আছে। সোচ্চার কন্ঠে তারা তাদের অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্যে দাবী জানাচ্ছে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের স্বার্থে লড়াই করতে প্রস্তুত হচ্ছে। যেন হঠাৎ একটা কিছু পাওয়ার নেশায় একেবারে তারা মাতাল হয়ে উঠেছে। এমন চিত্র কিন্তু তাঁর বিভিন্ন রচনাতে ধরা পড়বে।

১৮৯৯ সালের 'ফোমা গর্দেয়ভ' উপন্যাসে বুর্জোয়া দের প্রতিনিধি হিসেবে ইয়াকভ মাইয়াকিন নামক এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯০০ সালে 'ত্রয়ী'উপন্যাসে শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে গ্রাচায়েভের জীবন সংগ্রামের চিত্র তিনি খুব সুন্দর করে অঙ্কন করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতার মতো তিনি ১৯০১ সালে এক উদ্দীপনাময় কবিতা রচনা করেন - তা হল 'ঝঞ্ঝাদূতের গান'। এটি এতটাই উদ্দীপনা মূলক কবিতা ছিল যা পড়ে তৎকালীন রাশিয়ার সরকার কবিতাটিকে বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। এই কবিতাটি 'ঝিজন' নামক মার্কসবাদী পার্টির মুখপত্রতে প্রকাশিত হয়েছিল - কবিতাটির ভাব অনেকটা এমনই - 'ঝড় আসছে! এখুনি উঠবে ভীষণ ঝড়। তবু সেই অরণ্যের পাখি একা অরণ্য ভেদ করে উড়ে যায় সাগরের বুকে। আগামী চূড়ান্ত বিজয়ের নিশ্চিন্ত বাণী। ঝড় উঠুক, ভয়ানক ঝড় নেমে আসুক।'  এ তো শুধু কবিতা নয়, এ যেন বিপ্লবের মন্ত্র। যার ফলে তাঁকে আটক করা হলো। কিন্তু রাশিয়ার অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ লেখককে আটক করাতে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। এমনকি এই প্রতিবাদে এগিয়ে এসে ছিলেন জনপ্রিয় লেখক, বিখ্যাত লেখক তলস্তয়। যার ফলে জারের কর্মচারী রা তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আর এর পর থেকেই গোর্কি লেনিনের আদর্শে মতাদর্শে ধীরে ধীরে অনুপ্রাণিত হতে শুরু করেন। যে কারণে রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের ছাপ তাঁর ১৯০১ সালের 'কূপমণ্ডুক' নাটকেও দেখতে পাওয়া যাবে। এরপর ১৯০৬ সালে তিনি লেখেন 'মা'বা 'মাদার' উপন্যাস। এই উপন্যাস সম্পর্কে লেনিন বলেছেন -
'এটি একটি দরকারি বই, বহু মজুর বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল অচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে, এবার 'মা' পড়ে তাদের মহা উপকার হবে। খুবই যুগোপযোগী বই।'

এমনকি তাঁর  আত্মজীবনী মূলক রচনা (' আমার ছেলেবেলা' ( ১৯১৩ ), ' পৃথিবীর পথে' ( ১৯১৫ ) গ্রন্থেও) একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে সমাজের নিচুতলা থেকে সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতার শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছে যান তারই বর্ণনা আছে। এছাড়াও তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস 'ক্লিম সামগিনের জীবনকথা ' উপন্যাসে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার চিত্র খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা জানি তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন  শ্রমিক পরিবারে। সমগ্র জীবন তিনি কাটিয়েছিলেন শ্রমিক মানুষের মধ্যে, শ্রমিকের মতো জীবন যাপন করে। যার ফলে তাঁর সমস্ত রচনাতে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাস খুঁজে পাওয়া যাবে। তাই তাঁর সমস্ত রচনাই যেন শ্রমিক মানুষের জীবন নাট্য - 'সময় আসবে যখন প্রতিটি মানুষ আর সকলের কাছে তারার মতো হয়ে উঠবে - কারোর মনে দ্বেষ হিংসা থাকবে না। জীবন রূপ পাবে মানুষের সেবায় - মানুষের মূর্তি পাবে স্বর্গের দেউল। কিছুই মানুষের আয়ত্তের বাইরে নয়। মানুষ যেদিন সুন্দর হবে, সত্য ও সুন্দরের মুক্তি পাবে সে তার বীজ মন্ত্র।'  তাই তিনি তাঁর  The Three  উপন্যাসে নতুন পৃথিবীর একটা আভাস দিয়েছিলেন - There'll be wars.. . We must be prepared!' যে কারণে রোমা রঁল্যা একটি চিঠিতে গোর্কিকে বলেছিলেন - এক শীতের ভাঁটার টানে আপনার আবির্ভাব,  জীর্ণ পুরাতন পৃথিবীতে জন্মেও নতুন বিশ্বের সংকেত - ঝড়ে আপনি ক্রমবর্ধমান হয়েছেন। অতীত ও বর্তমান - দুই পৃথিবীর যোগসূত্রে দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘ এক সেতুর মতো। আমি সেতুটিকে অভিনন্দন জানাই। এ সেতু আকাশ মুখী। আমাদের নতুন প্রজন্ম শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ে এই সেতুর দিকে তাকিয়ে থাকবে. ....।

পার্থ প্রতিম হালদার
অতিথি অধ্যাপক, স্বামী বিবেকানন্দ কলেজ, করিমগঞ্জ,আসাম।