অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
পুভার বন - মমতা বিশ্বাস

শ্বেতশুভ্র'শ্রী সিরিডি সাঁই বাবার মন্দির' দর্শন করে গাড়িতে ওঠার পর ড্রাইভার উপযাচক হয়ে বললেন, “আপনাদের আজ  যে যে  স্থান দেখার প্যাকেজ আছে; সেখান থেকে  আর পনেরো কিলোমিটার গেলেই কেরালার সুন্দর একটা জায়গায় ঘোরা হয়ে যাবে।” ৫০০টাকা বাড়তি দিতে হবে। মেঘলা আকাশ। ফলে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ‘থিড়াপ্পু জলপ্রপাত' দেখতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই  উঠে এসে গাড়িতে  বসতে হল। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ায়; বৃষ্টির জল স়ংরক্ষণ করে  ধরে রাখার জলাধার দেখার জন্য নামতেই পারলাম না। গাড়িতে বসে ড্রাইভারের মুখেই শোনা গেল, এই অঞ্চলের মানুষের সারা বছরের জলের যোগান দেয় এই জলাধার। কাজেই গাড়িওয়ালার কথাতেই রাজি হয়ে গেলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল কেরলের অভিমুখে। মাঝে একটা হোটেলে উত্তর ভারতীয় থালিতে মধ্যাহ্ন ভোজন  সেরে নেওয়া হল। বৃষ্টি থেমে গেছে আগেই। রোদের মুখ ও দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। জনবহুল জনপদ পেরিয়ে নারকেল গাছ,রাবার গাছ, কফি গাছের বনের মধ্য দিয়ে চলেছি  চন্দন কাঠ,মশলা ও হাতির দাঁতের পুরনো বানিজ্য কেন্দ্র ‘পুভার'। পুভার কেরালার তিরুবনন্তপুরম জেলায় অবস্থিত। মৎস্যজীবিদের সংখ্যায় বেশি; সেই সঙ্গে অধিবাসীদের আয়ের আর একটি উৎস হল পর্যটন।

নারকেল গাছের সুনীবিড় ছায়ায় ঘেরা 'সী ওয়াটার বোটিং পার্ক' ’পুভাব বন'। এই গ্রামের সৈকত পর্যটকদের সারাবছরই আকর্ষণ করে। পকেট ভারী থাকলে ‘পুভাব দ্বীপে’র পাঁচ তারা হোটেল বা সুসজ্জিত  কেরালিয়ান ধাঁচে তৈরী ছোটো-বড়ো কটেজ কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে দু'চারদিন। নিরিবিলিতে প্রকৃতির শান্ত-স্নিগ্ধ  ছোঁয়ার অনাবিল আনন্দ উপলব্ধি করার উপযুক্ত পরিবেশ। বুক ভ’রে অক্সিজেন নিয়ে ফিরে আসতে পারবেন কর্মব্যস্ত জীবন আঙিনায়।

প্রকৃতি ও মানুষের তৈরী খাড়িতে - ”ওয়াটার বোটিং পার্কে” অপেক্ষারত ছোটো ছোটো রঙিন  বোটে ভেসে পড়ুন। অপ্রশস্ত খাড়ির দু’পাশে  নারকেল গাছের বাগান ও ম্যানগ্রোভ গাছের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় একটু গা-ছমছমে সিরসিরানি অনুভূতি হবেই। নৌকা বিহারের নির্মল আনন্দ দেওয়ার জন্য নাম জানা,অজানা  পাখিদের আনাগোনা;  কলতানে চতুর্দিক মুখর। নারকেল পাতার ছাউনির নীচে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বা ‘সোনালী বিচ ‘ঘুরে ফেরা  বিদেশি-বিদেশিনীদের সহাস্য  হাত নাড়ার প্রত্যুত্তর দিতে আপনার হাতটিও উঁচুতে উঠে আসবে অনায়াসে। তৃষ্ণা পেলে কুচপরোয়া নেই; নৌকায় ডাব নিয়ে  হাত বাড়িয়েই আছে ডাবওয়ালা।  খাড়ির ঘোলাটে জল দেখে প্রথমে মনটা খুঁতখুঁত করবে; মাথা পিছু ৭০০ টাকা ব্যয় অহেতুক মনে হবে। নৌকা নইয়া নদীর স্বচ্ছ জলে পড়লেই মেজাজ একদম ফুরফুরে হয়ে যাবে। মাথার উপরে উন্মুক্ত আকাশ। কখনো  নীল ঝকঝকে আকাশকে মেঘের দল এসে আড়াল করবে, চলবে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা। নদীর পাড় বরাবর সারিবদ্ধ ভাবে নারিকেল গাছের ছায়ায় সারসার  হাউজ বোট; দূর থেকে ভেসে আসা আরব সাগরের গম্ভীর গর্জন। সঙ্গের শিশুটির মতো আপনিও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবেন। ‘পুভার’ ভ্রমণের মূল আকর্ষণ আরব সাগর আর নইয়া নদী বেষ্টিত 'গোল্ডেন বীচ' বা ‘সোনালী বালির সৈকত'। 

নৌকার মাঝি সময় বেধে  নামিয়ে দেবে পাড়ে। নইয়া আর একটু এগিয়ে গিয়ে আরব সাগরের বুকে মাথা রেখেছে। রোদ পড়ে সোনালী বালি চকচক করছে। নইয়ার তীর থেকে আরব সাগরের বেলাভূমির দিকে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার সময় সামুদ্রিক মাছের লোভনীয় রেসিপি,তরল পানীয়,ফাস্টফুডের দোকানদারদের কাছ থেকে খাবার কিনে ;সমুদ্র-হাওয়ায় বাড়িয়ে দেওয়া খিদে মিটিয়ে নেওয়া যেতেই পারে। দড়ি দিয়ে ঘেরা  নিরাপদ বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে; যত খুশি মুঠোযন্ত্রে, ক্যামেরায়, মনের পর্দায় ছবি বন্দি কর। তির্যক রবিরশ্মির মেঘের বুক ফুঁড়ে নেমে আসা মনে হবে - সূর্যদেব দু'হাত উজাড় করে সোনা ঢেলে দিচ্ছেন আবরসাগরের ফুঁসতে ফুঁসতে আসাড়ে পড়া বেলাভূমির  সাদা ফেনায় ঢাকা সোনালী বালুকাবেলায়। প্রকৃতি তার দৃশ্যপটের বদল ঘটাবে প্রতিটি মুহূর্তে; যা ছেড়ে একমুহূর্ত ও আসতে ইচ্ছা করবে না। 

পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য কড়া পুলিশি পাহারা রয়েছে। এখানে সমুদ্র স্নানের অনুমতি নেই। তবে আপনার অজান্তে ঢেউ এসে পায়ের পাতা ভিজিয়ে ও দিতে পারে। তটরেখা বেশ খাড়া। অনেকে সমুদ্রের হাতছানি উপেক্ষা করতে  পারে না; পাহারাওয়ালার চোখ এড়িয়ে সাগরকে একটু ছোঁয়ার জন্য নেমে পড়ে জলে। জেলে ডিঙি ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে দূর সমুদ্রে পাড়ি দেয়। মুহূর্তের মধ্যে ছোটো হতে হতে মিলিয়ে যায়। পশ্চিম দিগন্ত রক্তিম হয়ে উঠলে মাঝিদের তাগাদায়  নৌকায় এসে বসতে হবে।ফেরার পথ আলাদা। নৌকা এগিয়ে যাবে তার গন্তব্যে। ছোটো ছোটো নারকেল বনের দ্বীপ আড়াল করে দেবে ‘সোনালী সৈকত'কে। দিনের আলোয় পর্যটকদের আগমণে মুখরিত সৈকত  দিবাবসনে অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে হয়ে পড়বে নির্জন। কপালকুণ্ডলার নবকুমারের মতো বলতেই হবে “আহা! কী দেখিলাম জন্ম জন্মান্তরে ও ভুলিব না।”
কিভাবে যাবেনঃ  ট্রেন বা বিমান যোগে তিরুবনন্তপুরম; তারপর ভাড়ার গাড়ি করে 'পুভার বন'।

মমতা বিশ্বাস
নবদ্বীপ রোড়, কৃষ্ণনগর,
নদিয়া
ছবি -: নিজস্ব