অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
সাহিত্যবিশারদের কর্মময় জীবন - হামীম রায়হান

     রবীন্দ্র ও রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে একক আদিপত্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ফলে তখনকার সাহিত্যিকরা কোন না কোনভাবে তাঁর আলোকিত বা তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর আলোর বাইরে যাওয়া এক প্রকার অসম্ভব ছিল। তাঁর আলোর বাইরে গিয়ে যে কজন সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে নিজেদের নাম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ।
     ১৯৪০ সালে পটিয়ায় বিরাটভাবে এক রবীন্দ্র জয়ন্তী আয়োজিত হয়। মহাকুমা মুন্সেফ শৈলেন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন উক্ত অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা। শৈলেন্দ্রনাথ ছিলেন কবিতার মানুষ। ফলে তিনি সাহিত্যবিশারদকে তেমন চিনতেন না। বিশ্বভারতীর অধ্যক্ষ ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীকে আনা হয় অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে। ক্ষিতিমোহন পটিয়া এসেই সাহিত্যবিশারদের সাথে দেখা করার জন্য উগ্রীব হয়ে পড়েন। শৈলেন্দ্রমোহন সাহিত্যবিশারদকে ডেকে আনার কথা বললে ক্ষিতিমোহন রেগে যান। তিনি বলেন, ‘ কি বললে, তাঁকে ডেকে আনাবে! তিনি আমাদের অগ্রণী, আমাদের নমস্য, তাঁকে ডেকে আনবে কি, আমরাই তাঁর কাছে যাব!’ ক্ষিতিমোহন সাহিত্যবিশারদকে দেখে বলেন, ‘উনি ব্যক্তি মাত্র নহেন, উনি একটা প্রতিষ্ঠান।’
     সত্যিই সাহিত্যবিশারদ কেবল ব্যক্তি মাত্র ছিলেন না, তিনি একটা প্রতিষ্ঠানই ছিলেন। তাঁর একক চেষ্টায় একটা হারিয়ে যাওয়া সাহিত্য ইতিহাস দিব্যালোকে আসে তখন তাঁকে ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান বলায় শ্রেয়। কারণ তাঁর এমন কাজ কোন একক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কোন প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। তাই তিনি ব্যক্তি মাত্র নন, তিনি প্রতিষ্ঠানই।
     চট্টগ্রামের পটিয়া একটি উর্বরভূমি। যেখানে জন্ম হয়েছে অনেক ইতিহাস বিখ্যাত মনীষির। এই ভূমিতে জন্ম হয়েছে মাস্টার দা সূর্যসেন কিংবা অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দারের মত বিপ্লবীর। আবার আছেন আহমদ শরীফ, আবদুর রহমানের মত বিদ্ধগ্ধ জ্ঞানীর। যাঁদের আলোয় আলোকিত আজ পটিয়া।১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর পটিয়ার সুচক্রদন্ডী গ্রামে পিতা মুনশী নুরউদ্দীন ও মাতা মিসরীজান বিবির গর্ভে জন্ম নেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। শৈশব থেকেই তাঁর ছিল লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ। জন্মের পূর্বেই তিনি আবদুল করিম পিতাকে হারান। অভাবের মাঝেই তিনি তাঁর দাদার আগ্রহে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। কর্ণফুলি নদীর পূর্ববর্তী থেকে টেকনাফ অবধি প্রাক্তন চট্টগ্রাম জেলার অর্ধাংশে ১৮৯৩ সালে তিনিই ছিলেন একমাত্র এন্ট্রান্স পাস করা মুসলিম ছাত্র। আর শৈশবেই তিনি তাঁর দাদার সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন পুথিগুলো পড়ার চেষ্টা করতেন। ফলে পুথির প্রতি তাঁর আগ্রহটা পারিবারীকভাবেই তৈরি হয়। বাড়িতে নিয়মিতই পুথি পাঠের আসর বসত। সেই আসরে আবদুল করিম ছিলেন নিয়মিত শ্রোতা।
     এফএ ক্লাসে পড়াকালীন পারিবারীক অস্বচ্ছলতা ও শারিরীক অসুস্থতার কারণে তিনি আর লেখাপড়া এগিয়ে নিতে পারেননি। চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন। চাকরি করার পাশাপাশি তিনি চালিয়ে যান তাঁর পুথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পাঠোদ্ধারের কাজ।
     ১৩০২ বঙ্গাব্দে আবদুল করিম ‘পূণির্মা’ পত্রিকায় ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলি’ প্রকাশ করেন। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম। এটি প্রকাশ হওয়ার পর মহাকবি নবীনচন্দ্র সেন আকৃষ্ট হন। এবং আবদুল করিমের সাথে যোগাযোগ করেন। পরে নবীন সেন আবদুল করিমকে সিভিল কোটে কেরানির পদে চাকরি দেন। তখন নবীনচন্দ্র কমিশনারের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতেন। নবীনচন্দ্র আবদুল করিমকে তাঁর লোকসাহিত্য সংগ্রহের ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। একদিন সাহিত্যবিশারদ তাঁর স্বগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘জ্যোতিঃ’ পত্রিকায় পুথি সংগ্রহ করে দেয়ার বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। এই বিজ্ঞাপন তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তিনি সরকারি চাকরিচ্যুত হন, এমন কী সরকারি চাকরি করার অধিকারও হারান। এমন ধাক্কাতে তিনি ভেঙে পরেননি। তাঁর সাধনা থেকেও পিছপা হননি।
     পরবর্তীতে তিনি আনোয়ারার এম এ স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মূলত এই সময়টাকেই তাঁর সাহিত্য জীবনের উবর্র সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
     সারাদিন শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি পুথির খোঁজও চালিয়ে যেতেন। একদিন এক কৃষকের ঘরে তিনি একটি পুথির খবর পান। ঐ পুথি যতক্ষণ হস্তগত করতে পারছেন না, ততক্ষণ যেন তাঁর চোখের ঘুম নেই। অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে তিনি কৃষকের হাত থেকে সেই পুথিখানা উদ্ধার করেন। এ যেন সাত রাজার ধন পাওয়া! এরপর তিনি লেগে যান এ পুথির পাঠোদ্ধারের চেষ্টায়। অনেক চেষ্টার পর জানা গেল এটি মহাকবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের পাণ্ডুলিপি! আরো জানা গেল এটি সপ্তদশ শতকের! এ যেন এক বিস্ময়কর আবিষ্কার! এ আবিষ্কারে পাল্টে গেল পুরো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস! বদলে গেল বাংলা মুসলিম সাহিত্যের ইতিহাস। যে আলাওলকে ভাবা হতো তিনি হয়ত কয়েক দশক বা শতক আগের কবি কিন্তু তাঁর এ পুথি আবিষ্কারের পর দেখা গেল তিনি কয়েকশ বছর আগের কবি। অর্থাৎ তিনি ষোড়শ শতকের কবি। যে মুসলমানরা ভাবত অতীতে তাদের কোন সাহিত্যকর্ম নেই, আজ সেই মুসলমানরা আলাওলকে নিয়ে গর্ব করতে থাকে। তাঁর কাব্য প্রতিভা এতই গভীর ছিল যে, সাহিত্যবিশারদ তাঁকে ষোলশ শতকের রবীন্দ্রনাথ বলে উল্লেখ করেন। সাহিত্যবিশারদের এই আবিষ্কার বাংলার মুসলমানদের হীনমান্যতা মুছে দিল।
    আলাওল ছিল সাহিত্যবিশারদের দুর্ভলতার জায়গা। তিনি আলাওলকে নিয়ে ৪১ টির বেশি প্রবন্ধ লিখেন। এসব প্রবন্ধে তিনি আলাওল ও তাঁর সাহিত্য, জন্ম, জীবন নিয়ে নানাবিধ আলোচনা করেন। আলাওলকে তিনি চট্টগ্রামে জনপ্রিয় করে তুলেন। আলাওলের ‘পদ্মাবতী’র পুথির একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ তিনি তৈরি করেন। ইচ্ছে ছিল এটিকে প্রকাশ করবেন। এজন্য তিনি নানা জনের কাছে, নানা প্রতিষ্ঠানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু কেউ তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এবং তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটি বই আকারে প্রকাশ করে যেতে পারেননি। এই একটি দুঃখ নিয়ে তিনি মারা যান। অবশ্য মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে এই পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করা হয়।
     প্রাচীন সাহিত্যের আলোচনায় তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল। আর তা তিনি সারাজীবনই করে গেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে বাংলায় যে জাগরণ শুরু হয়েছিল তা মূলত বাংলার হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলার মুসলমানরা এ জাগরণে সামিল হতে পারেনি। তার কারণ তাদের মধ্যে এক প্রকারের ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা কাজ করছিল। মুসলমানরা ইংরেজিকে খ্রিষ্টানদের ভাষা আর বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল। আর হিন্দু সমাজের সর্বত্র বাংলা ও ইংরেজির প্রচলনের ফলে তারা অনেক এগিয়ে যায় মুসলমানদের থেকে। ফলে তখন যে জাগরণ বাংলার ইতিহাসে দেখা দিয়েছিল তা মূলত ছিল বাংলার হিন্দুদের জাগরণ। সমগ্র বাংলার জাগরণ বলা যায় না।
     সেই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে জাগরণ দেখা যায়। সৃষ্টি হয় মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হক পরবর্তীতে শেখ আবদুর রহিম, মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, বেগম রোকেয়ার মত সমাজ সংস্কারক লেখকদ্বয়ের। সাহিত্যবিশারদের আর্বিভাব এমন সময়ে। তবে তিনি ছিলেন অন্যদের থেকে ভিন্ন পথের পথিক। তিনি নিজের সর্ম্পকে বলেছেন, ‘পাল হইতে পালাতক’। অর্থাৎ সবাই যখন সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল কাজে লিপ্ত, তিনি তখন মানুষের ঘরে ঘরে খুঁজতে থাকেন প্রাচীন ইতিহাস, হারিয়ে যাওয়া গৌরবের।
     শাহ মুহাম্মদ সগীর থেকে মহাকবি আলাওল হয়ে তাঁর পরবর্তী ইংরেজ আগমনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলায় মুসলমানদের রয়েছে প্রায় ছয়শ বছরের গৌরবময় সাহিত্য ইতিহাস। এই ইতিহাস আমাদের সামনে আসার একমাত্র কারিগর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। ঊনবিংশ শতকের যে জাগরণ মুসলমানদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল তা কখনোই পূর্ণতা পেত না যদি সাহিত্যবিশারদ ইতিহাসে খনি থেকে এসব রত্নাজী তুলে না আনতেন। মুসলমানদের জাগরণ পেল একটি শক্ত ভীত্তি। মুসলমানরা বুঝতে পারল তারা ইতিহাসহীন, সাহিত্যহীন নয়।

     তিনি যে কেবল মুসলমানদের পুথিই সংগ্রহ করেছেন এমনটা নয়। তিনি হিন্দু মুসলমান সবার পুথিই সমান গুরুত্ব দিয়ে সংগ্রহ করেছেন। কারণ তাঁর কাছে পুথি হল কঙ্খালের মত। এর মাঝে তিনি হাজার বছরের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের প্রবাহধ্বনি শুনতে পেতেন। এটার প্রমাণ অবশ্য তাঁর প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ের নাম থেকে বুঝা যায়। আবার তিনি পুথি সংগ্রহ করতে গিয়ে কী পরিমাণ কষ্ট স্বীকার করেছেন তা আজ কারো অজানা নয়। তিনি মুসলমান আর পুথি সংগ্রহ করা আছে কোন হিন্দু ঘরে। হিন্দুদের ঘরে মুসলমানের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। তারপরও তিনি ভিখারির মত তাদের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাদের অপমাণ সাহিত্যবিশারদ গায়ে মাখতেন না। হিন্দুর সংরক্ষিত পুথি তারা দূর থেকে মেলে ধরত আর সাহিত্যবিশারদ তা না ছুয়ে নোট লিখে নিতেন। তাঁর প্রকাশিত বইসমূহ হলঃ
১/ নরোত্তম ঠাকুর রচিত ‘রাধিকার মানভঙ্গ’
২/ বাঙালা প্রাচীন পুথির বিবরণ ১ম খণ্ড
৩/ বাঙালা প্রাচীন পুথির বিবরণ ২য় খণ্ড
৪/ দ্বিজ রতিদেব রচিত ‘মৃগলুদ্ধ’
৫/ কবি বল্লব রচিত ‘সত্য নারায়ণের পুথি’
৬/ রামরাজা রচিত ‘মৃগলুদ্ধ’
৭/ আলী রাজা রচিত ‘জ্ঞানসাগর’
৮/ বাসুদেব ঘোষ রচিত ‘শ্রী গৌরঙ্গ সন্ন্যাস’
৯/ মুক্তরাম সেন রচিত ‘সারদা মঙ্গল’
১০/ শেখ ফয়জুল্লা রচিত ‘গোরক্ষ বিজয়’

     তাঁর সম্পাদনার দক্ষতাকে শ্রী হরপ্রসাদশাস্ত্রী জার্মান এডিটারের সাথে তুলনা করেন। আহমেদ শরীফ সংকলিত সাহিত্যবিশারদের ‘রচনা ও গ্রন্থপঞ্জি’ থেকে জানা যায়, তিনি প্রায় ৪০৬ টি প্রবন্ধ ও বিভিন্ন বিষয়ে অভিভাষণ প্রধান করেন। তবে এর সংখ্যা আরো বেশিও হতে পারে। তাঁর প্রবন্ধ গুলো তৎকালীন বিখ্যাত প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাধনা, কোহিনূর, নবনূর, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, এডুকেশন গ্রেজেট, ভারতবর্ষ, নারায়ণ, বঙ্গদর্শন, মানসী, ভারতী, সাওগাত ইত্যাদি পত্রিকা। তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সংগ্রাহকও ছিলেন। তাঁর সংগৃহিত তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকার সংগ্রহ এখনো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের  সংগ্রহশালায় সংগৃহিত আছে। যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
     এক অভিভাষণে তিনি ১১২ জন মুসলমান ও ৭৭ জন হিন্দু কবির নাম ও তাঁদের রচিত গ্রন্থাবলীর নাম উল্লেখ করেন। যাঁরা হয়ত হারিয়ে যেত ইতিহাসের অতলে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ১/ আলাওল- পদ্মাবতী, ছয়ফল মুলুক, সতীময়না, রাগনামা, ২/ দৌলতউজীর- লায়লীমজনু, ৩/ দৌলতকাজী- সতীময়না, লোরচন্দ্রানী, ৪/ মুজাফর- হানিফার পত্রের উত্তর, ইনান দেশের পুথি, ৫/ সৈয়দ সুলতান- জ্ঞানপ্রদীপ, সবে মেরাজ, ৬/ নছরউল্লাখান- জঞ্জনামা ৭/ আলিরাজা ওরফে কানুফকির- জ্ঞানসাগর, ধ্যানমালা  ৮/ চাম্পাগাজি পণ্ডিত- বৈষ্ণব কবিতা, ৯/ শেখ ফয়েজউল্লা- গোরক্ষবিজয়, ১০/ আবদুল হাকিম- ইউসূফ জুলেখা ১১/ শঙ্খর দাস- জাগরণ ১২/ মুক্তারাম সেন- সারদা মঙ্গল ১৩/ ভক্তরাম দাস- গোকুলমঙ্গল ১৪/ দ্বীজ রতীদেব- মৃগমুগ্ধ  ১৫/ রামজীবন বিদ্যাভূষণ- মনসামঙ্গল, সূর্যব্রত পাঁচালী ১৬/ নিধিরাম আচার্য কবিরত্ন- কালিকমঙ্গল নামক বিদ্যাসুন্দর, ১৭/ কবীন্দ্র পরমেশ্বর- মহাভারতের বঙ্গানুবাদ, ১৮/ কবিরাজ ষষ্ঠীচরণ মজুমদার- শনিচরিত্র, শুকাখ্যান লহরী ১৯/ কৃষ্ণরাম দত্ত- রাধিকামঙ্গল ২০/ ফকিরচাঁদ দাস- মনসার পাচালী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
     আজ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যে ভীতের উপর দাঁড়িয়ে তার প্রকাণ্ড একটা স্তম্ভ হলো আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের আবিষ্কার। যেগুলো না হলে আমরা হয়ত প্রকৃত ইতিহাস কখনোই জানতাম না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানতে হলে বার বার যেতে হবে সাহিত্যবিশারদের  কাছে। তাই তো সাহিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯০৯ সালে চট্টল ধর্মমণ্ডলী তাকে ‘সাহিত্যবিশারদ’ আর নদীয়ার সাহিত্য সমাজ ‘সাহিত্যসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে সম্মানিত করে। তাছাড়া তিনি তৎকালীন সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তিনি তাঁর গ্রামের সুচক্রদণ্ডী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব পালন করেন।
     তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৯৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী  বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘স্বাধীনতা দিবস পুরষ্কার’ দিয়ে সম্মানিত করে। তাঁর ১২৬ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে  বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তাঁর ছবি সম্বলিত স্মারক ডাক প্রকাশ করে।
     ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, স্ত্রী বিয়োগের ছয়মাস পরে তিনি সকালে লিখারত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৮২ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের একটি বড় অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়। আসলেই কী তাই? না, ড. এনামুল হক বলেন, ‘মাস্টার আবদুল করিম মারা গেছেন, কেরানি আবদুল করিম দেহ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু সাহিত্যবিশারদ মরেননি। তিনি মরতে পারেন না।....’ সত্যিই সাহিত্যবিশারদ মরেননি। তিনি বেঁচে আছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পাতা জুড়ে। তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবন আমাদের জন্য এক বড় প্রাপ্তি। তাঁর কাজগুলো আমাদেরকে পথ দেখাই নতুন আলোর।
     সুচক্রদণ্ডী গ্রামে নিজ পাড়ার মসজিদের পাশের কবরস্থানে তিনি শায়িত আছেন। প্রতি বছর হাজার হাজার সাহিত্যপ্রেমি লোক তাঁর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এই কলম্বাসের আত্মাকে অনুভববের চেষ্টা করে। সাহিত্যবিশারদ বেঁচে আছেন এভাবেই!

হামীম রায়হান। পটিয়া, চট্টগ্রাম