অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
রহস্যের মায়াজাল (সাত) - সুজিত বসাক

     দক্ষিণের বনাঞ্চল লাগোয়া ছোট্ট একটি গ্রাম ঝিল্লি। সেই গ্রামে কদিন ধরে একটা চিতা বাঘ খুব উৎপাত করে যাচ্ছে। গৃহপালিত পশু তুলে নিয়ে যাচ্ছে সুযোগ পেলেই। গ্রামবাসী অতিষ্ঠ ও আতংকিত। মহারাজের কানে খবরটা পৌঁছুতেই ডেকে পাঠালেন রাকিবকে। অনুরোধ করে বললেন –“ ঘটনাটি শুনেছেন নিশ্চয়ই। মানুষকে আক্রমণ করার আগেই কিছু একটা বিহিত করতে হবে। আপনার জঙ্গলের অভিজ্ঞতা রয়েছে। যাবেন নাকি আমার সাথে? ”
     রাকিব বলল –“ যদিও শিকার করা আমি পছন্দ করি না, তবুও যাব। গ্রামের লোকগুলোর কথা ভেবে। ” 
     মহারাজা বীরেন্দ্র প্রতাপ আর রাকিব পরের দিন সকালেই রওনা দিলেন ঝিল্লির উদ্দেশ্যে। সমতলের শেষ মাথায় গিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিতে হল। এরপরে পাহাড়ি বনপথ, গাড়ি চলার মতো রাস্তা নেই। ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ঝিল্লি গ্রামেরই একজন পথ প্রদর্শক। 
     জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। যেমন সুন্দর নাম তেমনি তার রূপ। রাকিব মুগ্ধ হয়ে গেল। 
     বীরেন্দ্র প্রতাপ বললেন –“ এটা কুঞ্জ বিহারের নতুন কোন সমস্যা নয় রাকিব। আমার বাবা শিকারে খুব দক্ষ ছিলেন। বাবার দক্ষতা আমি কিছুটা পেয়েছি। আর পেয়েছে আমার মেয়ে রাজকুমারী শুভ্রাজিতা। ও এখন মায়ের সাথে মামার বাড়িতে। ও থাকলে আপনাকে কষ্ট দিতাম না। স্মিথ সাহেবও  বেপাত্তা। উনিও শিকারে দক্ষ। ”
     রাকিব অবাক হয়ে বলল –“ উনি আবার কোথায় গেলেন  ? ”
     হাসলেন বীরেন্দ্র প্রতাপ –“ ওর কথা ছাড়ুন। হয়তো কোন বনে বাদারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আজব এক মানুষ। মাঝে মাঝে অতিথি হয়ে আসেন। ইচ্ছে মতো থাকেন। বছর দশেক হল এভাবেই চলছে। ” 
     রাকিব মুখ ফসকে বলে ফেলল –“ উনি ইংরেজদের চর নন তো  । ” 
     গম্ভীর হলেন মহারাজা –“ কথাটা আমার মাথাতেও এসেছিল। ইংরেজরা ভীষণ ধূর্ত জাতি। ওদের অসম্ভব কিছু নেই। তবে স্মিথ সাহেবকে অনেক বাজিয়ে দেখেছি। তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। লন্ডনের রয়্যাল কলেজে পড়ান। বিদ্বান মানুষ। এই রাজ্যের নদ নদী, পাহাড়, বন এসব নাকি তাকে পাগল করে দেয়। তাই বারবার ফিরে আসেন এসবের টানে। ” 
  -“ এভাবে না বলে কয়ে বেড়িয়ে পড়েন…  যদি কোন বিপদ হয়? বৃটিশ সরকার কী আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে  ? ” 
  -“ সে কথা আমি অনেক বার বলেছি। হেসে বলেন, ভয় নেই  আমি মলে আপনাকে কেউ দোষারোপ করবে না।  আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।  কী ব্যবস্থা… . সে ব্যাপারে অবশ্য কোনদিন কিছু বলেননি। আমিও আর জিজ্ঞেস করিনি। ” 
     তিন দিন পর ট্রাপে পা দিল চিতা বাঘটি। বীরেন্দ্র প্রতাপ তার ৩৭৫ ম্যানলিকার দিয়ে অব্যর্থ নিশানায় ধরাশায়ী করে ফেললেন। গ্রামবাসী দারুণ খুশি। তারা উৎসবে মেতে উঠল। রাতটা কাটিয়ে পরের দিন ভোরেই ওরা আবার রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। 
     ফেরার পথে গাড়িতে রাকিবের মনে হল এই সুযোগ। রাজবাড়িতে মহারাজাকে একান্তে পাওয়া খুব মুস্কিল। 
  -“ কিছু মনে করবেন না মহারাজা। একটা অনভিপ্রেত প্রশ্ন করব…  যদি অভয় দেন। ” একটু অবাক হলেও হেসে বললেন –“ এখন আমি রিলাক্সড মুডে আছি। কী জানতে চান বলুন। সবসময় রাজা সেজে থাকতে ভাল লাগে না। ” 
  -“ সত্যি কী রাজবাড়িতে গুপ্তধন আছে? ” 
     থমকালেন মহারাজা। অবাক হয়ে বললেন –“ হঠাৎ এসব প্রশ্নের মানে? ” 
  -“ কারণ আছে। সেটা পরে বলব। আগে আপনি বলুন এবিষয়ে আপনার কিছু জানা আছে কী? ” 
     রাকিবের সিরিয়াস মুখ দেখে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারলেন না মহারাজা। 
     বললেন –“ না। সেরকম কিছু জানা নেই। রাজবাড়ি বা পুরানা কিলা দেখে কিছু মানুষ কল্পনায় এসব কনসেপ্ট এনে ফেলে। আপনাকে নিশ্চয়ই কেউ বোকা বানিয়ে এসব গল্প বলেছে। ” 
     রাকিব গম্ভীর মুখে বলল –“ গল্প কিনা জানিনা। তবে সম্ভবত এই গুপ্তধনের কারণেই আপনার ভাই ধীরেন্দ্র প্রতাপের খুন হয়েছেন।” 
     চমকে উঠলেন মহারাজা –“ কী যা তা বলছেন? ডাক্তারি রিপোর্ট এ পরিস্কার উল্লেখ ছিল ধীরুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। আপনার কথার কোন প্রমাণ আছে  ? ” 
  -“ অবশ্যই আছে। গুপ্তধন থাকা না থাকাটা মিথ্যে হতে পারে। কিন্তু ধীরেন্দ্র প্রতাপের খুন নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আপনি কী চান হত্যাকারী ধরা পড়ুক  ? ” 
  -“ আলবত চাই। আপনি জানেন না ধীরুকে আমি ভালোবাসি। ” 
     দোর্দণ্ড প্রতাপ মহারাজার চোখে জল।  রাকিব সান্ত্বনা দিয়ে বলল –“ এমন ভাবে ঘটনাটা সাজানো হয়েছিল যে, কেউ হত্যা বলে ভাবতে পারেনি। কিন্তু একজন  নিজের চোখে দেখে ফেলেছিল সেই ঘটনা। ”
  -“ কে? ”
 -“ নামটা এখন নাই বা শুনলেন। সে দেখেছিল বটে, কিন্তু মুখোশের আড়ালে থাকা আততায়ীকে চিনতে পারেনি। ” 
 -“ তবে এতদিন পরে কী করে বেরুবে আসল সত্য? ” 
 -“ সত্যকে কখনো চাপা দেওয়া যায় না। তিন বছর আগের ঘটনা কেমন প্রকৃতি র   নিয়মে উঠে আসছে দেখুন। আপনি একটু সাহায্য করলে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। 
 -“ আপনি! এসব তো পুলিশের কাজ, আপনি পারবেন  ? ” 
 -“ পারব কিনা জানিনা। আমি পুলিশ নই…  গোয়েন্দা নই…  নিজের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে যতটা সম্ভব চেষ্টা করব। কিন্তু সবার আগে আপনার পারমিশন দরকার। ” 
 -“ আমি পারমিশন দিলাম। যদি সত্যি ধীরু খুন হয়ে থাকে এবং আপনি সেই সত্যটা তুলে আনতে পারেন, সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আপনাকে সব ধরনের সাহায্য আমি করব। ” 
 -“ আপাতত শুধু রাজবাড়ির কটা ঘর অনুসন্ধানের অনুমতি দিতে হবে। তবে আমার উদ্দেশ্যটা যেন কেউ ঘূণাক্ষরেও টের না পায়। ” 
 -“ বেশ তাই হবে। আমার ভাইদের মধ্যে ধীরু ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকমের। সহজ সরল লাজুক স্বভাবের। কখনো আমাকে কিছু খুলে বলত না। ” 
 -“ আপনি কী কাউকে সন্দেহ করেন? ” 
 -“ হ্যাঁ, এখন তো সন্দেহ হচ্ছেই। তখনও হয়েছিল। কিন্তু মেডিকেল রিপোর্ট দেখার পর সন্দেহ মনেই থেকে যায়। আমার বাবা দুটো বিয়ে করেছিলেন। আমি, ধীরু আর মাধু আগের পক্ষের সন্তান। আমার মা বিষাক্ত সাপের দংশনে অকালে মারা যান। আপনি যাকে এখন রাজমাতা হিসেবে দেখছেন, তিনি আমার সৎমা। ভীষণ লোভী আর হিংসুটে মহিলা। আমার সিংহাসনে বসা, খেলোয়াড় হিসেবে ধীরুর দেশ বিদেশের সন্মান… . এসব কোন দিনই  সহ্য হয়নি তার। আমাকে সরিয়ে জীতুকে সিংহাসনে বসানোর জন্য তিনি গোপনে ইংরেজদের সাথে যোগাযোগও করেছিলেন। ইংরেজ রেসিডেন্ট টনি লুইসকে মোটা টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন। কিন্তু পারেন নি একটা মানুষের জন্য। ” 
 -“ কে সে? ” 
 -“ অ্যালান স্মিথ। তিনি  আমার হয়ে মহারানীর কাছে দরবার করেছিলেন। ওকে দেখে আমার মনে হয়েছে, সব ইংরেজ খারাপ নয়। ” 
 -“ আমিও কথা বলতে চাই ওর সাথে। ” 
 -“ আমার মনে হয় উনি আপনাকে সাহায্য করবেন। কারণ উনি ধীরুকে ভীষণ ভালবাসতেন। ধীরু যখন লন্ডনে খেলতে গিয়েছিল ওর বাড়িতেই উঠেছিল। নিজের সন্তানের মতো যত্ন করেছিলেন। ” 
 -“ আচ্ছা, আপনাদের প্রাসাদটা কবে তৈরি করা হয়েছিল জানেন ? ” 
 -“ প্রায় দুশো বছর আগে। ” 
 -“ তৈরির সময়কার কোন নক্সা  নেই ? ” 
 -“ ছিল। তবে এখন কোথায় আছে বলতে পারব না। পারস্যের একজন মুসলিম স্থপতি এই রাজপ্রাসাদের নক্সা তৈরি করেছিলেন বলে শুনেছি। এটাও শুনেছি এই প্রাসাদে এমন কিছু গোপন ব্যাপার আছে যেটা বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না। ” 
     রাকিব হেসে বলল –“ হারানো নক্সাটা কোথায় আছে জানেন? ” 
 -“ না। কোথায় ? ” 
 -“ বর্তমানে আমার কাছে। ” 
 -“ আপনার কাছে ? আপনি কেমন করে পেলেন  ? ” 
 -“ সেটাও অদ্ভুত সংযোগ। তাই তো  এই রহস্যের শেষ না দেখে যেতে মন চাইছে না। সম্ভবত আপনাদের পরিবারের টাকার লোভে নক্সাটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন একজন ইংরেজ সাহেবকে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, সেই নক্সা আবার ফিরে আসে আপনাদেরই পরিবারের এক সদস্যের হাত ধরে। গল্পের মতো শোনালেও এর মধ্যে এতটুকু কাল্পনিক কিছু নেই। ” 
     বীরেন্দ্র প্রতাপ হতভম্বের মতো মুখ করে বললেন –“ স্ট্রেঞ্জ  ! আপনি তো সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছেন। এতসব ইনফরমেশন আপনি কোথায় পেলেন  ? ” 
     রাকিব বলল –“ আপনার ভাই ধীরেন্দ্র প্রতাপের ডায়েরি থেকে। ধীরেন্দ্র প্রতাপ লন্ডনে স্মিথ সাহেবের বাড়িতে ওটা দেখতে পেয়েছিলেন। সম্ভবত তার সন্দেহ হয়েছিল। লন্ডন থেকে ফেরার সময় ওটা হাতিয়ে নিয়ে আসেন। ওই নক্সার সঙ্গে গুপ্তধনের কোন সম্পর্ক অবশ্যই আছে। ফেরার পর ধীরেন্দ্র প্রতাপ ওই নক্সা নিয়ে পড়ে যান। ” 
 -“ তবে কী  স্মিথ সাহেব প্রতিশোধ নিতে… ” 
 -“ সেটা বলা বোধহয় এখনই ঠিক হবে না। ডায়েরিটা অসম্পূর্ণ। লেখা চলাকালীনই মারা যান ধীরেন্দ্র প্রতাপ। শেষের দিকের লেখা পড়লে মনে হয়, কিছু একটার সন্ধান তিনি অবশ্যই পেয়েছিলেন। লেখার মধ্যে বহু সাংকেতিক শব্দ ও চিহ্ন ব্যবহার করেছেন। মনে হয় শত্রুদের এড়ানোর জন্য। তিনি যে খুন হয়ে যেতে পারেন সেই আশংকাও ব্যক্ত করেছেন অনেক জায়গায়। এটুকু বলতে পারি স্মিথ সাহেব একেবারে নির্ভেজাল নন। রহস্যময় চরিত্র। ” 
 -“ আপনি কী বলেন…  স্মিথকে ধরব  ? ” 
 -“  না মহারাজ  ওসব করতে যাবেন না এখনই। কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর আগে জানা দরকার। প্রথম প্রশ্ন, স্মিথ সাহেবকে নক্সাটা বিক্রি করেছিল কে  ? দ্বিতীয় প্রশ্ন, মৃত্যুর আগে ধীরেন্দ্র প্রতাপকে চিরকুটটা লিখেছিল কে  ? ” 
 -“ সম্ভবত মৃত্যুর দিন সকালে একটা চিরকুট পেয়েছিলেন ধীরেন্দ্র প্রতাপ। তাতে লেখা ছিল “ লাল গোলাপের রহস্য আমি জানি। দীপঝিলের পশ্চিম ধারে দেখা করুন। ” চিরকুটটা ধীরেন্দ্র প্রতাপ ইচ্ছে করেই হোক বা ভুল করেই হোক ডায়েরির মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ধীরেন্দ্র প্রতাপ দীপঝিলের পশ্চিম দিকে কেন গিয়েছিলেন? ওকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ” 
 -“ এই লাল গোলাপের রহস্যটা আবার কী? ” 
 -“ জানি না। হয়তো গুপ্তধন সংক্রান্ত কোন রহস্য। আবার এমনও হতে পারে ওটা নেহাতই একটা প্রলোভন… ধীরেন্দ্র প্রতাপকে ফাঁদে ফেলার।” 
     গাড়ি রাজবাড়িতে ঢুকল। গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে যাওয়ার পথে রাকিব চাপা স্বরে বলল –“ একটা জিনিস খেয়াল করেছেন রাজাবাবু? ” 
     বীরেন্দ্র প্রতাপ অবাক হয়ে বললেন –“ কী  ? ” 
 -“ গাড়ির চালক কেমন উদগ্র কৌতূহল নিয়ে আমাদের কথা শুনে যাচ্ছিল? অবশ্য একদিক থেকে ভালই… . যদি ইনি ষড়যন্ত্রের পার্ট হয়ে থাকেন। ” 
     মহারাজা কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন রাকিবের মুখের যদিকে। চলবে...

সুজিত বসাক। দিনহাটা, কুচবিহার