একটা দুপুর দাদাদের ডেরায় - বেবী কারফরমা
আমাদের পারিবারিক ইন্টিরিওর ডেকোরেশন এর ব্যবস্যা আছে। সাধারনতঃ আমরা স্বামীস্ত্রী যৌথভাবে আমাদের ব্যবস্যা দেখাশুনা করি।
বছর কুড়ি আগেকার কথা। ডি .এল. খান. রোডের একটা কোম্পানির গেস্ট হাউসে কাজ চলছে। সকাল সকাল বেড়িয়ে গেছি সাইট ভিজিটিংএ। স্পটে পৌঁছেও গেছি, গাড়িতেই আছি গেট দিয়ে ঢুকতে যাবো এমন সময় ড্রাইভার দেখিয়ে দিলো আগের দিন যার সাথে আমার মিস্টার এর ঝামেলা হয়েছিল তাকে।
ডাইভারকে ভিতরে গাড়ি রাখতে বলে গাড়ি থেকে নেমে আমি এগিয়ে গেলাম সেই লোকটির কাছে। শ্যামবর্ণ, দীর্ঘকায়, কিছুটা স্থূল প্রকৃতির, বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ এর আশপাশে হবে, নাম তপন সিং (আসল নাম নয়)। আমাকে তার কাছাকাছি আসতে দেখে কিছুটা ইতস্তত বোধ করল। আমি তার সামনে গিয়ে ‘নমস্কার’ বলে নিজের পরিচয় দিলাম। দেখে বুঝতে পারলাম খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। সে কিছু বলার আগেই আমি বলে বসলাম ‘আপনার বাড়ি গিয়ে, আপনার মায়ের হাতের এককাপ চা খেতে চাই। চূড়ান্ত অপ্রস্তুত কাকে বলে তার মুখ দেখেই টের পেলাম। অনিচ্ছা সত্বেও কিছুটা গররাজি হয়ে তার বাড়ী নিয়ে গেলো, তারই বাইকে করে।
বাইকটা বড়ো রাস্তা অতিক্রম করে একটা গলি ধরল। বেশ বড়ো গলিটা, তারপর একটা তস্য গলি, একধারে হাই ড্রেন। একটু ভয় যে হয়নি তা নয় তবুও খানিকটা নির্লিপ্ত হবার ভান করে বাইকের পিছনে বসে রইলাম। বাইকটা যেখানে এসে দাঁড়াল, সেই জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। চারপাশে কাঁটা জাতীয় ছোট ছোট ঝোপে ভর্তি।
খোলা জায়গায় কয়েকটা মাত্র ঘর, সব ঘরেরই বাসিন্দাই আলাদা এক একটা পরিবার। অর্ধেক ইট অর্ধেক বাঁশের বেড়া দেওয়া তার উপর টালির ছাউনি, কোথাও আবার টিনের ছাউনি। বোঝা যাচ্ছে জবরদখল এরিয়া।
বেলা বাড়ছে, রোদের তাপ কিছুটা বেশি মনে হল হয়ত ফাঁকা জায়গা বলে। আমি বাইক থেকে নামতেই চারিদিক থেকে একটা কৌতুহলী দৃষ্টি আগুন্তক এর প্রতি ধেয়ে এলো। বেশ কিছু ছানাপোনা এসে আমায় এমন ভাবে ঘিরে ধরলো যে আমি যেন ব্যারিকেড হয়ে গেলাম, এগোবার জায়গা নেই। যাইহোক নিজেকে কোন রকম ভাবে বের করে, তপনের আহ্বানে ভিতরে প্রবেশ করলাম। বাচ্চা গুলোও আমার পিছন নিলো। উঠানের মতো ফাঁকা জায়গায় আমাকে একটা চেয়ারে বসতে দিলো। ছানাপোনা গুলোও আমার সামনে এসে আমাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে সারিবন্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর নিজেদের মধ্যে একটা ঠ্যালাঠেলিও শুরু করে দিলো, কে আগে দাঁড়াবে।
তপনেরও একটা ঘর, কিন্ত সদস্য সংখ্যা অনেক। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। একজন মহিলা একটু ফাঁকা জায়গায় বিড়ি বাঁধছেন বসে বসে, মনেহয় তপনের মা হবেন। একজন বয়স্ক লোকের মাথাটা হাঁটুর কাছে ঝুঁকে গেছে, তিনি বসে বসে অনর্গল কেশেই চলেছেন হয়তো বাবা হবেন। আর অতি বৃদ্ধ একজন লোক রোদে নারকেল দড়ি দিয়ে তৈরি একটা খাটিয়ায় শুয়ে আছেন, এনার পরিচয় ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না।
মনে মনে ভাবলাম এদের এই দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো নিজেদের সুবিধার্থে এদের ব্যবহার করে। আর এরাও পলিটিক্যাল পার্টির ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে বড় বড় ব্যবসায়ীদেরকে নিজেদের সমকক্ষ মনে করে। পরিশ্রম করবে না, রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হবে।
কিছুক্ষণ এর মধ্যেই তপনের বউ এক মুখ হাসি নিয়ে, একটা স্টিলের গ্লাসে চা দিয়ে গেলো। বহু পুরানো চায়ের কষগুলো গেলাসটাকে আস্টেপৃষ্টে চেপে ধরেছে, অ্যাসিড দিয়ে ধুলেও সেই কষ যাবার নয় বুঝতে পারলাম। তাছাড়া গ্লাসটা ছানাপোনাদের বেশ কয়েকবার লক্ষ্যভেদ করার কাজেও লেগেছিল বলে মনে হল, কেননা স্মৃতি চিহ্ন গুলো বেশ প্রকট। বোধহয় ঘরে একটাও কাপ নেই, লক্ষ্যভেদের কাজে তারাও আগেই দেহ রেখেছে মনেহয়। গেলাস মলিন হলেও চা কিন্তু বেশ খাসা। তপনের বউকে দেশের মেয়ে বলেই মনে হল তাই হয়ত রান্নাবান্নায় পটুই। ভিন রাজ্যের কোন এক অজ গ্রামের মেয়ে হয়ত, বিয়ে হয়েছে খাস কলকাতায়, একেবারে ভরা সংসার, এইত অনেক, আর কিছু চায়না সে।
আস্তে আস্তে ভিড় বেশ বাড়তে লাগলো। ভিড়ের মধ্যে সনুকেও দেখতে পেলাম। যে পাড়ায় আমার কাজ চলছে সেই পাড়ারই ছেলে, তার উপর বেকার, তাই সারাদিন খৈতান হাউসের গাড়ী রাখার গ্যারেজে শুয়ে বসে কাটায় (যেখানে আমি গাড়ি রাখি)। খুবই নিরীহ ও ভালো ছেলে তাই কেউ কিছু বলে না।
যাই হোক আমি ডাইরেক্ট তপন সিংকে জিজ্ঞেস করলাম কি চাও বলো? বাকিরা (ক্লাবের অন্য সদস্যরা, আমি এসেছি শুনে সব চলে এসেছে) বলে উঠলো বৌদি এখানে কাজ করতে হলে এক লাখ টাকা দিতে হবে। আমি বললাম দু লাখ টাকার কাজই নয়, ত এক লাখ টাকা কোথা থেকে দেবো? এমন সময় ‘সনু’ বলে উঠলো ঠিক মোট কত টাকার কাজ। বুঝতে পারলাম একটা অসহায় ইমেজ তৈরি করে, কৃত্রিম ভাল মানুষের আড়ালে , এরাই আসলে খবর দেওয়া নেওয়ার কাজ করে।
যাইহোক তাদের সাথে অনেক দর কষাকষির পর, সুষ্ঠ ভাবে কাজ করার জন্য শেষ পর্যন্ত রফা হলো, ক্লাবকে একটা videocon bazuka টিভি দিতে হবে। নিজে থেকেই তপনের তিন ছেলেমেয়ের হাতে তিনশ টাকা হাতে দিলাম।
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, এবার উঠতেই হবে। আমার মিস্টার আর কোম্পানির লোকজনেরা যদি জানতে পারেন যে, আমি এখানে এসেছি, তাহলে সবাই ভীষণ রাগারাগি করবেন আমার উপর।
উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় কোথা থেকে তপনের বউ এসে হঠাৎ করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসলো। কোলে একটা বাচ্চা, বাকি দুটো পাশে দাঁড়িয়ে। আমি বেশ অপ্রস্তুতএ পড়ে গেলাম।
কি জানি, আমাকে সে 'কে' ভেবেছে, জানি না। বাংলা একদমই বোঝে না, তাই এতক্ষণ কথোপকথন এর কিছুই বোঝেনি সে । সেতো জানে না, মাত্র একদিন আগেই তার স্বামী আমার স্বামীর বুকে বন্দুক ধরেছিলো, তোলা না দিলে কাজ করতে দেবে না বলে।
কি আশীর্বাদ করবো, তোমার সিঁথি উজ্জ্বল হোক, না আমার সিঁথি ভরা থাকুক ...?
নিস্পাপ বধূ টিকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম .....
বেবী কারফরমা
কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
08-07-2020
-
-