এই মহা ক্রান্তিকাল মানুষ অতিক্রম করবেই - ঝন্টু চন্দ্র ওঝা
করোনা ভাইরাস থেকে উদ্ভূত সমস্যা বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চরম আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীর বহু দেশে এ ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি এখন বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন করোনা ভাইরাস প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত হয়ে ইঁদুর, বিড়াল, স্তন্যপায়ী প্রাণী, গবাদিপশু ইত্যাদি নির্দিষ্ট কিছু পশু-পাখির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়ে থাকতে পারে। তবে চীন থেকে এ ভাইরাস-এর উৎপত্তি স্তন্যপায়ী প্রাণী বাদুড় থেকে হয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে জানিয়েছে। এই করোনা ভাইরাস-এর কারণে অগণিত মানুষ এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে এবং কয়েক লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আর দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। তাই এটি এখন সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করা পৃথিবীর সব মানুষের প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের কোনো মানুষ আজ আর নিরাপদে নেই। ঘরে-বাইরে কোথাও কারো স্বস্তি নেই। পৃথিবীর বহু দেশে মাসের পর মাস মানুষ গৃহবন্দী হয়ে আছে। পেটে ক্ষুধা অথচ বেশির ভাগ মানুষের ঘরে খাদ্য নেই। বহু দেশে অফিস, কারখানা, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, শিক্ষালয় সবকিছু অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। অনেকে বেকার হয়ে ঘরে বসে আছে। কাজ-কর্ম নেই, বেতন নেই। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে বাড়ছে মানুষের রোগ-ব্যাধি। প্রকৃত চিকিৎসা-সেবা নেই। তার উপর রয়েছে অস্বস্তিকর লকডাউন ও অনাকাঙ্ক্ষিত কোয়ারেন্টাইনের অবিশ্বাস্য নিগ্রহ। ভাবাই যায় না, লক্ষ লক্ষ প্রাণ অকালে ঝরে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আর কত দিন এরকম পরিস্থিতি চলবে- তা কেউ জানে না। কী মর্মান্তিক এবং দুঃসহ ঘটনা! ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
আসলে আজ বেশিরভাগ মানুষ যেমন লোভী, প্রতিহিংসাপরায়ণ তেমনই অসংবেদনশীল ও পরশ্রীকাতর। বিদ্বেষ, হানাহানি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি যেমন বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে অবৈধ উপায়ে সম্পত্তি দখল ও অর্থ উপার্জন করার প্রবণতা। দিন-দিন প্রকৃতিপ্রেমী না হয়ে বরং প্রকৃতিকে মানুষ ধ্বংস করে যাচ্ছে। তাই বোধ হয় প্রকৃতির খড়্গ বারংবার নেমে আসছে মানুষের উপর। বিশ্বব্যাপী প্রকৃতির তাণ্ডব শুরু হয়েছে দোর্দণ্ড প্রতাপে। দিন-দিন ভূমিকম্প, বজ্রপাত বাড়ছে। আইলা, সিডর, সুনামীর মতো আরও কত অজানা তাণ্ডব আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে- কে জানে?
অনেক মানুষের আহার-বিহারের ভেদাভেদ যেমন নেই, তেমনই অসংখ্য মানুষ সদাচার পালনেও অভ্যস্ত নয়। স্বাস্থ্য ও সদাচার বিষয়ক জ্ঞান মানুষের যেমন সীমিত, তেমনই এ সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেও তা মানুষ যথাযথভাবে মেনে চলে না। এই করোনা ভাইরাস-এর কারণে ঘন্টায় ঘন্টায় সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে বিশ্বব্যাপী সকলকে আজ সদাচার পালন করা শেখানো হচ্ছে। সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে বিশ্বব্যাপী সকলকে খাবার খেতে বলা হচ্ছে। যেখানে-সেখানে কফ, থুথু, নাকের শ্লেষ্মা ইত্যাদি ত্যাগ করতে নিষেধ করা হচ্ছে। হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় রুমাল ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। বাইরে চলা-ফেরার সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। টিভি, রেডিওতে প্রচারণা ও পত্রিকায় লেখালেখির কল্যাণে মানুষ এ ব্যাপারে এখন অনেক সচেতন হবার সুযোগ পাচ্ছে।
তাই আজ অন্তত কিছু মানুষ যেভাবেই হোক এই নিয়ম-কানুনগুলো প্রতিপালনের চেষ্টা করছে। যা’রা এই নিয়মাচারগুলো যথাযথভাবে পরিপোষণের চেষ্টা করছে, সত্যিই তা’রা অশেষ ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। এটি বর্তমান সময়ে নিঃসন্দেহে জনগণের একটি প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। কিন্তু এই করোনা ভাইরাস-এর প্রাদুর্ভাব যখন সারা বিশ্ব থেকে চলে যাবে তখন হয়তো অনেক মানুষ সাবান দিয়ে হাত না ধুয়েই আগের মতো খাবার খেতে বসে যাবে। শিষ্টাচার কিংবা সদাচার পালন করার কথা ভুলে গিয়ে পূর্বের বদ-অভ্যাসে আবার তা’রা অভ্যস্ত হবে। কিন্তু সদাচার হচ্ছে সুস্বাস্থ্য ও ধর্মের অঙ্গ- যা সারা জীবনের জন্য পালন করা প্রয়োজন। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেছেন, ‘সদাচারে রত নয়, পদে-পদে তার ভয়।’ অতএব, শিষ্টাচার ও সদাচার ক্ষণিকের জন্যও মানুষের ত্যাগ করা উচিত নয়। তাহলে বিপর্যয় আবার যেকোনো সময় ফিরে আসতে পারে; যেমন- এক সময় পৃথিবীতে মহামারী কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটে। সদাচারের ব্যত্যয় ঘটলে এখনও তা ঘুরেফিরে আসে এবং মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সদাচার পরিপালনের বিষয়টি অবশ্যই আমাদেরকে স্মরণে রাখতে হবে। কারণ বিধির নিয়ম, অনুশাসনবাদ এবং বিজ্ঞানকে আমাদের যেমন জানতে হবে তেমনি সেগুলো মানতেও হবে।
যাই হোক, কোভিড ’১৯-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখনও চলছে বিশ্বজুড়ে। এ যুদ্ধ চালিয়ে নিতে হবে আমাদের। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘ওঠ, জাগো, আর ঘুমিয়ো না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের নিজেদের ভেতর রয়েছে - এ কথা বিশ্বাস কর, তাহলেই শক্তি জেগে উঠবে।’ তাই ঝিমিয়ে পড়লে কিংবা থেমে গেলে চলবে না। শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে মানুষেরই জয় হবে। আর মানুষের জয় হলেই তমসা কেটে যাবে, আলোর দীপ্তি আবার ফুটে উঠবে সমগ্র বিশ্বে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর একটি গান আছে, ‘তুমি যতই দহ না দুঃখের অনলে আছে এর শেষ আছে।’ সত্যিই তাই, এর শেষ একদিন হবেই। আর সেই অনাগত অনিন্দ্যসুন্দর দিনের প্রতীক্ষায় আমরা সবাই চেয়ে থাকব ভবিতব্যের দিকে।
আজ এই দুঃসময়ে কত মানুষ আর্ত-পীড়িতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তার যথাযথ হিসেব আমাদের কারো পক্ষেই অবগত হওয়া সম্ভব নয়। যেটুকু জানা আছে, স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প পরিসরে কতটুকু তা লেখা সম্ভব? তদুপরি অতি সংক্ষেপে হলেও কিছু মানুষের কথা না বললেই নয়।
করোনা’র এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্বের বিভিন্ন হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা কর্মে জড়িত অনেকেই নিজ নিজ জীবনের মায়া ত্যাগ করে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। সরকার এবং বিত্তশালী অনেকে সমাজের অসহায় মানুষের জন্য সেবা ও ত্রাণ দিচ্ছেন, কেউবা নিজ উদ্যোগে রান্না করে খাওয়াচ্ছেন। এছাড়া করোনা’র দুর্বিষহ পরিস্থিতির কারণে যারা হাসপাতালে কিংবা বাসা-বাড়িতে প্রয়াত হয়েছে, তাদের শবদেহ তুলে নিয়ে দাফন ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের ভীতি ও অনাগ্রহ দেখা গেছে। এমনকি মৃতব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরাও এ কাজে এগিয়ে আসেনি। দিনের পর দিন অনেক মৃতদেহ হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত একাজে এগিয়ে এসেছেন কিছু দায়িত্বশীল নির্ভীক মানুষ। তারা মৃত্যুকে পরোয়া না করে সকল সম্প্রদায়ের মৃতদেহ সৎকারের জন্য স্বেচ্ছায় সমাধিস্থলে পৌঁছে দিচ্ছেন। কখনো তারা নিজেরাই লাশ দাফন করছেন। তাই এরকম পূণ্য-ক্রিয়ায় যারা স্বতঃস্বেচ্ছ অংশ নিচ্ছেন, তাদেরকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা। মূলতঃ এরাই প্রকৃত মানব-দরদী। এরাই সত্যিকারের দেশবন্ধু। এদেরেকে জাতি সারাজীবন সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণে রাখবে।
আর একটি হৃদয়স্পর্শী ঘটনার কথা বলতে হয়। গত কয়েক মাস করোনা সমস্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত কঠিন সময় পার করেছে। বিশেষ করে নিউইয়র্কে খুবই ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করেছে। এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও নিউইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী আমার অত্যন্ত সুহৃদ রতন কুমার মণ্ডল ও সুমিতা বিশ্বাস নামে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এক দম্পতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি রতনবাবু তার বাড়িতে ভাড়া থাকা একজন প্রসূতি মাকে প্রসবের ঠিক কিছুক্ষণ পূর্বে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালিয়ে করোনামুক্ত দূরবর্তী একটি হাসপাতালে পৌঁছে দেন। হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকদের সহায়তায় উক্ত প্রসূতি মায়ের গর্ভস্থ সন্তান নিরাপদে ভূমিষ্ঠ হয়। এর ফলে মা ও শিশু দু’জনেরই জীবন রক্ষা পায়। যেখানে মানুষ মাসের পর মাস গৃহবন্দী, অতি প্রয়োজনেও কেউ ঘর থেকে বের হয়নি, সেখানে এ রকম মহৎ কর্মের দৃষ্টান্ত খুবই বিরল একটি ঘটনা।
প্রসূতি মা ও তার অনাগত সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিউইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত দম্পতি রতন বাবু ও সুমিতা দেবীর এই শুভদ উদ্যোগ সত্যিই প্রসংশনীয়। মানব কল্যাণের জন্য অসীম মমত্ব ও অমিয় ভালোবাসা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সহজাত বৈশিষ্ট্য ও চিরায়ত স্বভাব রয়েছে বাঙালি সত্তায়। বাঙালির গভীর অন্তঃকরণে রয়েছে অফুরান প্রীতি, রয়েছে সুধামাখা অসীম মমতা। এভাবেই বাঙালি হৃদয়ের লোক-কল্যাণী অফুরন্ত ভালোবাসা সমগ্র বিশ্বে প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাক। এভাবেই যুগে যুগে মানবতার শুভসুন্দর জয় হোক।
ঝন্টু চন্দ্র ওঝা
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট,
ঢাকা, বাংলাদেশ।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
09-07-2020
-
-