অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
দেশপ্রেমিক চেনার উপায় কি? - দিদার আলম কল্লোল

     দেশপ্রেম মাপার কোন যন্ত্র অদ্যবদি আবিষ্কার হয়নি এবং হবেও না কোনদিন। দেশপ্রেমের সুনির্দিষ্ট কোন বিধিবদ্ধ সংজ্ঞা যদিও নেই, তবে কে দেশপ্রেমিক আর কে দেশপ্রেমিক না তা বুঝার কিছু উপায় আছে।
     আপনি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক কিনা তা আপনার আচরণে ও অনুভবে এমনিই প্রকাশ পাবে, গলা ফাটিয়ে বলতে গেলে উল্টো মানুষ ভাববে, চোরের মা'র বড় গলা। কারো কাছে দেশপ্রেমের পরীক্ষাও দিতে হয় না। দেশপ্রেমের টেষ্টে কোন কিট ও লাগে না। কোন ধরনের পয়সা খরচ ছাড়াই নিজের টেষ্ট নিজেই করে নিতে পারেন। যেমন, দেশের কোন ভাল খবর শুনলে যদি আপনার মন আনন্দে নেচে উঠে, অনুভূতিগুলো চঞ্চল হয়ে উঠে, তাহলে বুঝবেন আপনার মধ্যে দেশপ্রেমের দীপশিখাটি জ্বল জ্বল করছে। তদ্রূপ দেশের দুর্দিনে ও দুঃসংবাদে যদি ব্যথিত ও কাতর হন, তাহলে বুঝে নিবেন আপনি পথভ্রষ্ট হননি, দেশপ্রেমের জোনাকি পোকাটি এখনো আপনাকে পথ দেখাচ্ছে।
     কিংবা জাতীয় সঙ্গীত শুনার সময় গ্ৰাম বাংলার সবুজ শ্যামল প্রান্তর, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে কৃষকের খালি গা, ফসলের ঘ্রান, রাখালের বাঁশির সুর তথা প্রিয় জন্মভূমির মানচিত্রটি যদি আপনার মানসপটে মূর্ত হয়ে ফুটে উঠে, মনে দোলা দেয়, তাহলে ধরে নিতে পারেন আপনি খাঁটি নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক। কারন আপনি দেশের মাটি, প্রকৃতি ও মানুষকে ভালবাসেন। করোনা টেষ্টের মত দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষার দীর্ঘ লাইনেও আপনাকে দাঁড়াতে হবে না যদি আপনি মন থেকে স্বজাতির তরে জীবন উৎসর্গকারী স্বাধীনতার মহানায়কদের ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের ইতিহাসকে সযত্মে বুকে ধারণ করেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তাঁদের বীরত্ত্ব ও যুদ্ধ জয়ের গল্প শুনতে ভালবাসেন এবং জীবিত জাতীয় বীর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলে ভক্তিতে মাথা হেঁট হয়ে যায়, স্যালুট দিতে ইচ্ছে করে, তাহলে হলফ করে বলা যায় দেশপ্রেমের দীক্ষা আপনার শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। আপনি দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করবেন না এবং আপনার দ্বারা কোন অপকর্ম ও হবে না।
     ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা আইসিসি ট্রফি জিতে যেদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করল, গোটা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল, তখন নিশ্চয় ঐ বিরল আনন্দঘন মুহূর্তে আপনিও উচ্ছসিত হয়েছিলেন দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে। তদ্রূপ ২০০৬ সালে যখন বাংলাদেশ প্রথমবারের মত নবেল বিজয়ী দেশ হল, ড: ইউনুস দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনলেন, সেদিন আনন্দে আত্মহারা জাতীর সাথে আপনিও একাত্ত্ব হতে পেরেছিলেন, গর্বিত জাতি হিসেবে সেদিন নিশ্চয় আমাদের বক্ষদেশ একটু স্ফীত হয়ে গিয়েছিল বৈকি। এই যে দেশ ও মানুষের সব ভালো'র সাথে নিজের ভাললাগা একাকার হয়ে যাওয়া, এরি নাম দেশপ্রেম। দেশপ্রেম উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় না কিংবা কোন হাসপাতালের অসৎ মালিকের কাছ থেকে ভুয়া সার্টিফিকেটের মত দেশপ্রেমের কোন সার্টিফিকেটও সংগ্ৰহ করা যায়না। ভুলে গেলে চলবে না দেশপ্রেমের বীজ অঙ্কুরে রোপণ করতে হয় আর দুর্নীতি মহিরুহ হওয়ার আগেই এর মূলোৎপাঠন করতে হয়।
     চলতি বছরের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের খনিজসম্পদ অনুসন্ধান, আহরন ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান 'বাপেক্স' টেংরাটিলা গ্যাস বিস্ফোরণে কানাডিয়ান তেল কোম্পানি 'নাইকোর' সাথে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে আইনী লড়াই করে এক বিলিয়ন ইউএস ডলার ক্ষতিপূরনের রায় পেল, ২০১০ সালে ড. কামাল হোসেন আমেরিকান তেল কোম্পানি 'স্যাভরনের' বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা লড়ে বাংলাদেশের পক্ষে জয় এনে দিলেন। ২০১২ সালে মায়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলায় বাংলাদেশ জয়লাভ করে ১৯,৪৬৭ বর্গফুটের সমুদ্র সীমায় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের অবারিত সুযোগলাভ করে। দেশের এত বড় বড় অর্জনে দেশপ্রেমের জায়গা থেকে সারা দেশের মানুষ গর্ববোধ করলেও শাহেদ ও শহীদুলদের মত নষ্ট লোকেরা তখন হয়ত নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিল অথবা তাদের ভাবখানা ছিল  'তাতে আমার কি লাভ'। তাদের লোলুপ দৃষ্টি সর্বদাই ছিল বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষদের পকেটে।
     রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক শাহেদ এই মহামারীর সময়েও জাল- জালিয়াতি ও প্রচারনার আশ্রয় নিয়ে কোন পরীক্ষা ছাড়াই করোনার পজিটিভ নিগেটিভ সার্টিফিকেট বাণিজ্য বেশ ভালই চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কিভাবে জানি সব গোলমাল হয়ে গেল। ঐ রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে করোনার ভুয়া নিগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে বিদেশগামী বিমান যাত্রীদের মধ্যে করোনা রুগী ধরা পড়ায় জাপান, কোরিয়া ও ইটালী ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে বিমানের সব ফ্লাইট তাঁদের দেশে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছে। বেরিয়ে আসতে থাকে শাহেদের প্রচারনার চাঞ্চল্যকর সব কাহিনী।  করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার ৩ থেকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছে, প্রতারক চক্রটি দেখল এইতো সু্যোগ। করোনা হউক বা না হউক করোনার পজিটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি করে মোটা অংকের টাকা কামানো যাবে। রিজেন্ট হাসপাতাল তাই করল। অসৎ লোকদের কাছে উচ্চমূল্যে শত শত ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করল। করোনা টেষ্টের নামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসহায় মানুষদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিল। সরকারি অর্থ লুটেপুটে খাওয়ার কুমতলবে এই প্রতারক প্রতিষ্ঠানটি করোনা চিকিৎসার জন্য আগবাড়িয়েই সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। ম্যাজিষ্ট্রেট সরওয়ার আলম বলেছেন এটি কোন হাসপাতালই না, চিকিৎসার আড়ালে মানুষের সাথে প্রতারনা করছে। এখন শুনা যাচ্ছে এই হাসপাতালের নাকি লাইসেন্সই নেই। মেট্রিক পাস এই শাহেদ নাকি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, টক'শর নিয়মিত আলোচক যেখানে তার দেশপ্রেম উপচে পড়ে। হায় খোদা এত অসৎ মানুষ এদেশে পয়দা হল কোত্থেকে।
     শহীদুল ইসলাম পাপুল নামক বাংলাদেশের একজন স্বতন্ত্র এমপিকে আদমপাচার, অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগে কুয়েত সরকার আটক করে রিমান্ডে নেয়ার পর আরো জানা গেল ঐ দেশে তার ১৩৮ কোটি টাকা জব্দ হয়েছে, সে এখন বিদেশের মাটিতে আদালতের কাঠগড়ায়। বিচারের সম্মুখীন। এর চেয়ে লজ্জাজনক সংবাদ আর কি হতে পারে। এরকম একটি খবরে দেশপ্রেমিক ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোন মানুষ বিচলিত না হয়ে পারে না। ইয়াবা বদির চেয়েও বদ এ লোকটি যদি এমপি'র মর্যাদা বুঝত, তার মধ্যে দেশপ্রেমের বিন্দুবিসর্গও থাকতো তাহলে দেশের মান সম্মান ও ভাবমূর্তি নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলত না। মানুষের কর্ম ও অভিব্যক্তিই বলে দেয় সে ভাল না খারাপ, দেশপ্রেমিক নাকি রাজাকারের ঘৃন্য প্রেতাত্মা। সত্যি বলতে কি যার কোন নীতি নৈতিকতা ও সততা ও ত্যাগের আদর্শ নেই, তার দেশপ্রেম নেই। আর যার মধ্যে দেশপ্রেম নেই তার এদেশে থাকার কোন অধিকার নেই।
     ব্যাংক লুটপাটকারী তানভীর, হাই-দের কিংবা বালিশ পর্দা কেলেঙ্কারির ঘটনার দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। বলা হয়ে থাকে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় এক'শ এর মধ্যে নিরান্নব্বই পেলেও উত্তীর্ণ হওয়া যায় না, এক'শ তে এক'শ ই পেতে হয়। যেমনটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য; এক'শ তে এক'শ না পেলে কোন বৈজ্ঞানিক সত্যের স্বীকৃতি মিলে না। বাংলাদেশী বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, জামাল নজরুল ইসলাম, মাকসুদুল আলম, বিজন কুমার শীল, আসিফ মাহমুদসহ দেশে বিদেশে কীর্তিমান বাঙালিদের নিয়ে আমাদের গর্ব হয়, কারন আমরা দেশকে ভালবাসি। এইতো সেদিন করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সাফল্য বর্ননা করার সময় তরুণ বিজ্ঞানী আসিফের আনন্দাশ্রুর সাথে দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষের চোখে জল ছলছল করলেও ক্যাসিনো শামীমদের করেনি, তারা এসবে স্বস্থিবোধ করেনি, কারন দেশপ্রেম তাদের অভিধানে নেই। এই শ্রেণীর লোকেরা চোখে টাকা ছাড়া আর কিছু দেখে না, দেশপ্রেম তো চোখে দেখা যায় না, এহেন বায়বীয় কোন জিনিসে তাদের বিশ্বাস নেই, তবে তাদের ধর্ম বিশ্বাস খুব প্রবল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ না হয়ে যদি ঈমানের অঙ্গ দেশপ্রেম হত, তাহলে নেক দেশপ্রেমিকের সংখ্যা হয়ত আরো বাড়তো আর দুর্নীতিবাজদের পাল্লাটাও একটু হালকা হত।
     শাহেদ শহিদুলরা রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে চীনের মহাপ্রাচীরের চেয়েও দুর্নীতির যে শক্ত প্রাচির গড়ে তুলেছে, তা যেকোন মূল্যে ভাংতেই হবে, অন্যতায় আমাদের সব উদ্দ্যেগ, আয়োজন ও অর্জন ভেস্তে যাবে। অলরেডি তারা সরকারের ভাবমূর্তির পোনে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এরা তো একদিনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয় নাই। রাজনৈতিক দুষ্টচক্র, প্রশাসনের ঘুষখোর কর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়ার কতিপয় দুষ্টু লোকের প্ররোচনা, আনুকূল্য, পৃষ্ঠপোষকতা ও ছত্রছায়ায় তারা আজ মহিরুহ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি শুধু এদের মগ ডালটা ভেঙ্গে দেন। দেখবেন তাদের বুকে কম্পন শুরু হয়ে গেছে। প্রতিটি ঘটনায় মানুষ একশন দেখছে, এটা সত্য, তবে তা ঘটনা ঘটার আগেই যদি নেয়া হত তাহলে হয়তবা চোরেরা দেশের এতগুলো টাকা বিদেশে পাচার করার, দেশে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ার, দেশের মান মর্যাদা ভুলন্ঠিত করার সুযোগ ও সাহস পেত না। এখনো সময় আছে ওদের বিরুদ্ধে কার্যকর অর্থে জিরো টলারেন্স দেখানোর, তা না হলে দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত এ জাতিকে নিয়ে আগামী বাংলাদেশ গড়ার ডেল্টা প্লান-২১০০ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আপনার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

দিদার আলম কল্লোল
এডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট