অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
তিনটি ঝরে-যাওয়া ফুল: পর্ব এক - জান্নাতুল পারভীন

     জ তটিনীর মন বড্ড খারাপ। মা কিছুতেই বান্ধবীর বাসায় যেতে দিলেন না। অনেক অভিমান মার সাথে - যেনো আকাশ ভরা কালো মেঘ জমেছে, এই বুঝি বৃষ্টি ঝরবে। হাজার প্রশ্ন­উত্তর অজানা রয়ে গেছে তটিনীর মনে সেই ছোটবেলা থেকে। কেন তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়া হয় - ‘তুমি মেয়ে’! অনেক কিছু মন চাইলেও মা-বাবার কড়া নিষেধের কারণে হয়ে ওঠে না। জীবনের ‘না’ শব্দের সাথে মিলেমিশে থাকে তটিনীর জীবন। মেনে নিতে নিতে ভুলে যেতে থাকে নিজের ভালোলাগা মন্দলাগাগুলো। হঠাৎ ভাবনার ঘোর কাটে  মায়ের  ডাকে - ‘তনু এদিকে আয়তো একটু মামনি। সব কাজ পড়ে আছে, তোর পড়ালেখা শেষ হলো?’ তনুকে সব কাজ গুছিয়ে রাখতে হয়। মায়ের কোন শাড়িটি ধুয়ে ইস্ত্রি করে আলমারিতে রাখতে হবে, বাবার অফিসে যাবার সময় লান্স গুছিয়ে দেয়া, ছোট ভাইকে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি করে দেয়া, মাকে রান্নাঘরে যাবতীয় কুটাবাছা কাজে সহযোগিতা করা - মোট কথা ঘরে সকলকিছু পরিপাটি রাখাই তনুর কাজ। তারপর নিজের কলেজ যাবার জন্য অস্থির গতিতে ছুটে যাওয়া। তনু সবেমাত্র  এসএসসি পাশ করে কলেজে পা দিয়েছে। ইচ্ছে ছিল সায়েন্স নিয়ে পড়ার। কিন্তু বাবা-মায়ের একটাই চিন্তা - মেয়েমানুষের পিছনে অর্থ ব্যয় করা মানে অপচয়। মা নিজেও একজন  নারী হয়ে তাই মনে করেন। মা শুধু তনু নামটা ডেকেই শান্তি পায়। কন্যার নামটা মায়ের দেয়া আর ছোট ভাই তন্ময়ের নামটি রেখেছে বাবা। 
     এক কাপ চা বানিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে চুপ করে দাড়িঁয়ে থেকে বলতে চাওয়া কথাটা কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না তনু। মায়ের  হাতের আঙুলের চঞ্চল নাড়াচাড়ার ভঙ্গি দেখে সে। 
  - ‘কিরে তোর কি হলো? কিছু বলবি?’
  - ‘না! মানে হ্যা বলছিলাম’...  বলে আবার চুপ করে থাকে। মা বলে ওঠে - ‘থামলি  কেন?  বল কী  বলবি।’ একটু অপরাধী কণ্ঠে বলা শুরু করে তনু - ‘জানো মা, আমাদের কলেজ থেকে নৌবিহারে যাবে সবাই। আমিও যেতে চাই। বাবাকে একটু বলো না, আমি যেতে চাই।’  
     মা বললেন - ‘অসম্ভব। তোর  বাবা যেতে দেবে না। আর আমিও চাই না। মেয়েদের এত স্বাধীনতা ভালো না।’
     তনু জানতো মা তাকে চিরচেনা এই বাক্যগুলো শোনাবে। তবুও মনের ইচ্ছাটাকে মেরে ফেলতে পারে না। বারবার মনের গহীন থেকে ইচ্ছাগুলো জেগে ওঠে একটু একটু করে। মনে মধ্যে প্রশ্ন জাগে - আমার ক্লাসের অনেকে যাবে, শুধু আমি যেতে পারবো না? 
     মায়ের কথা শোনার পর তনুর আর পড়তে বসতে ইচ্ছে করে না। চা খেতে খেতে বেলকনিতে নিরবে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে থাকে। মিষ্টি বাতাসের আলিঙনে নিজেকে বড্ড একা লাগে। আনমনে তাকিয়ে থাকে তন্ময়ের দিকে - কী আনন্দ নিয়ে ছবি আঁকছে! 
     তন্ময় বলে ওঠে - ‘আপু আমার বর্ষাকালের ছবি আঁকাটা হচ্ছে না। দেখিয়ে দাও না আপু!’
     তনুর ভেতরটায় তখন বর্ষাকালের মতো টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছিলো। যেনে প্রকাাশ পেলো তন্ময়ের অঙ্কন খাতায়। রঙতুলির আঁচড়ে স্থান করে নিলো তনুর সব কষ্ট, অনুভবগুলো। রঙতুলির মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে নিজেকে ভুলে যেতে থাকলো পড়ন্ত বিকেলে। হঠাৎ বেজে ওঠে কলিংবেলটা। তনুর বুঝতে পারে, বাবা এসেছে। মা ডাকে - ‘তনু, দরজাটা খুলে দে।’
     আজানের ধ্বনিতে সন্ধ্যা নেমে আসে। তনু নামাজে চলে যায়। দোয়া মাছুরা শেষে সালাম ফিরিয়ে মনে পড়ে যায় নৌবিহারের কথা। মা কি বাবাকে বলবে? বাবা কি রাজি হবে? হাজার মনের প্রশ্নের মাঝে আশ্রয় মিলে হতাশা। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমুতে যায় তনু। কিন্তু না পাবার বেদনায় কিছুইতেই ঘুম আসে না। রবিঠাকুরের উপন্যাসের বইটি হাতে নিতেই বাবার কন্ঠ - ‘তনু মা ঘুমিয়ে পড়ছো?’ বলতে বলতে ঘরে আসে। বলে - ‘অনেক রাত হয়ে গিয়েছে ঘুমাবে না? শুনলাম, তোর মা বললো, তোদের কলেজ থেকে নাকি চাঁদপুরে নৌবিহারে যাবে?’ তনু নিচুস্বরে বলে - ‘হুম।’
     - তনু শোন, তোর এসবে যাবার দরকার নাই। তাছাড়া  এখন তুই বড় হয়েছিস। সব কিছুর মধ্যে যেতে হবে না। আমরা তোর চাচাতো বোনের বিয়েতে যাবো কয়েকদিন পরে। তোর চাচা আজকে ফোন করেছিলো।’ বাবার কথা শেষ না হতেই, মা ঘরে ঢুকে বলে ওঠে - ‘হ্যাঁরে তনু, তোর চাচাতো বোন মনির বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমরা ওখানে যাবো।’
     সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে - ‘তনু, তনু বেলা হয়ে গেল। ওঠ।’ চোখ মেলে জানালার দিকে তাকায় তনু। মিষ্টি রৌদ্দুর পর্দার আড়ালে  উঁকি মারছে। উঠে গিয়ে জানালার কার্নিশ ধরে প্রকৃতির কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আহ্বানে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। মা আবার  ডাকে - ‘তনু, তনু।’ ছুটে চলে মায়ের ডাকে। রান্নাঘরে মাকে সাহায্য করতে রুটি বানাতে লেগে পড়ে। কিছুক্ষণ পর বাবার ডাক কানে আসে - ‘তনু, আমার ঘড়িটা দেতো মা। আর হ্যাঁ ছাতাটাও দিবি। আজকাল যখন তখন বৃষ্টি চলে আসে।’ নিয়মমাফিক বাবা তন্ময়কে স্কুলে নামিয়ে দেয় প্রতিদিন। আজও তন্ময়কে সাথে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন।
     আজ বৃহস্পতিবার। তনুকে কলেজ যেতে হবে না। নৌবিহারে সবাই ছুটে চলেছে চাঁদপুরে। কলেজ আগামি শনিবারে খুলবে। তনু আজ ঘরের কোনে বসে বসে জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটির মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টায় রত। সামনে ক্লাসটেস্ট। সেটাও মাথায় বারবার ঘূরপাক খাচ্ছে। প্রতি চুমুকে লেবু চায়ের গন্ধে মিশে যাচ্ছে তনুর ভাবনাগুলো। খুব কাছের বান্ধবী যুথি ফোনে অনেকবার বলেছিলো - ‘তোর বাবাকে আমরা বলি।’  কিন্তু তনু বলতে মানা করেছিলো। কারণ কিছু অভিমান, কিছু কষ্ট, শুধু নিজের সাথে নিজের, তা অন্যের সাহায্য নিতে  চায় না তনু।
     কয়েকদিন পরের কথা। তনুর কলেজে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। রাতজেগে পড়া আর মনের ভিতরে ভয় জাগে - প্রশ্নপত্র কেমন হবে? নতুন টেনশনে যোগ হয় মনের মাঝে। কখনও ঘুমের মধ্যে ‘প্রশ্ন কমন আসেনি’ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় তনুর। আজ পরিসংখান পরীক্ষা শেষে মা শপিং করার জন্য কলেজ গেটে অপেক্ষা করছিলো। বের হয়ে মাকে দেখে অবাক হয়ে যায় তনু। মা তনুকে নিয়ে মার্কেটে যায় - অনেক সুন্দর থ্রিপিস কিনে দেয়। তন্ময়ের জন্য গেঞ্জি আর বিয়ে বাড়ির উপহারও কেনে। বাড়ি ফেরার পথে, মা বলে - ‘তোর মনি আপুর শাড়িটা কেমন হয়েছে তনু?’ রিক্সার ঝাকুনিতে নিজেকে সামলে নিতে নিতে তনু বলে - ‘মা বাসায় গিয়ে বলি।’ তারপর মাা বলে - ‘কিরে তনু, পরীক্ষা কেমন হলো?”- ‘ভালো।’
  - ‘খুব  ক্লান্ত লাগছে?’
  - ‘হুম। মা, খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’
  - ‘এই তো চলে এসেছি। বাসায় গিয়ে তন্ময় আর তোর ব্যাগ গুছিয়ে রাখিস। আমরা শনিবারে রাঙ্গামাটি তোর চাচার বাড়ি চলে যাবো। 
     শুক্রবারে খুব ভোরে তনুর ঘুম ভেঙে যায়। জানালায় দাঁড়িয়ে বেলীফুলের গাছটির দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বাগানের পরিচর্চা করতে করতে তনু গাছগুলোর সাথে মাঝে মাঝে মনের সুখ-দুঃখগুলো শেয়ার করে। আজ নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ওদের ছেড়ে দূরে চলে  যেতে হবে। বেলীগাছে আলতো হাত বুলিয়ে তনু বিরবির করে বলে ওঠে - ‘চিন্তা  করিস না। চলে আসবো!’ চায়ের কেতলিতে টগবগ জলের মধ্যে আদা দিয়ে তনু মনে মনে ভাবছে আদা দিয়ে দুধচা বাবা খুব পছন্দ করে। মা রান্না ঘরে এসে তনুকে বলে - ‘তনু, হাত চালু কর। তোর বাবা নাস্তা করে বাজারে যাবে।’
  - ‘কেন?’
  - ‘তন্ময় বায়না ধরেছে - আজ শুক্রবার মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসে  গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাবে।’
     অমনি তন্ময় আনন্দে বলতে শুরু করে - ‘কী মজা, কী মজা!’
     মা-মেয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ঢলে পড়ে।
     শনিবার সকালে ফজরের নামাজ পড়ে তনুরা সবাই মিলে কমলাপুর স্টেশনের দিকে রওয়ানা দেয়। সাতটায় ছাড়বে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে পথে মা বলে - ‘কিরে, তোর বাবার  ঔষধ  ঠিকমতো  নিয়েছিলি?’
  - ‘নিয়েছি।’
     কিছুক্ষণ নিরবতার পরেই রেলস্টেশনের সামনে ট্যাক্সি থামে। ওয়েটিংরুমে কিছু মানুষের আনাগোনা আর হকারের ভিড়। কখন আসবে ট্রেন! - উৎসুক হয়ে বসে থাকে তনু। একঘন্টা বিলম্বে ট্রেন ছাড়ে। তনু ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরের সকালের সুন্দর প্রকৃতি উপভোগ করে। তন্ময় ট্রেনে উঠেই দিয়েছে টানা ঘুম। বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেন থামতেই তনুর বাবা একডজন কমলা কিনল। সবাই মিলে কমলা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলো। তনুর কাছে কমলা লেবুটা অনেক মজা লাগছিলো। মাকে আরেকটা দিতে বলে। ট্রেন ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে। তন্ময় দুষ্টমি করে আপুর গায়ে কমলার খোসা ছুড়ে মারছিলো। বাহিরের মিষ্টি রোদ্দুরের সাথে প্রকৃতির মিশে থাকা সৌন্দর্য আর কেবিনের ভেতর ভাই-বোনের দুষ্টমিতে এক মধূর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিলো।
     মনি আপুর মন খারাপ। আজ তার গায়ে হলুদ। অনেকদিন পর তনুকে পেয়ে মনি অনেকটা হালকা অনুভব  করে। দুজনের অনেক কথা  জমে আছে। একে অপরের হাত ছাড়ছিলো না। লেকের পাশে মনিদের বাড়ি। তনু এখানে এলে লেকের পাশে বসে থাকে দিনের বেশির ভাগ সময়। প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করে তনু। চাচি ভিতর থেকে ডাকছে - ‘তনু, ঘরে আয়। খাবি না?’ তন্ময় বলে বসলো - ‘গোসল করবো। আপু, চলো লেকে গোসল করি।’ কোনো কিছু চিন্তা না করেই তনু তন্ময়কে সাথে নিয়ে নেমে পড়ে লেকের নীল জলে। দুজনের পাগলামি দেখতে এসে মা চিৎকার করে বলে - ‘পানি  থেকে ওঠ তাড়াতাড়ি। দুপুরের খাবার  খাবি না? ’ এমন সময় হঠাৎ তনুর চিৎকারে মা ছুটে আসে। তনু চিৎকারা করে বলতে থাকে - ‘মা, বাচাও! আমি ডুবে যাচ্ছি।’ মা ঝাঁপিয়ে পানিতে নেমে তনুকে টানতে থাকে আর চিৎকার করে বলতে থাকে - ‘কে আছো, বাঁচাও।’ মায়ের এক হাতে তনু আরেক হাতে তন্ময়। মাকে তনু বলে - ‘মা কিসে যেনো আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।’ মা কাকে ছাড়বে আর কাকে ধরবে! অবশেষে তনুকে ইচ্ছে করে ছেড়ে দিলে তনু চিৎকার করে বলে ওঠে - ‘মা মা মা!’ তন্ময়ের হাত ধরে টেনে তোলে মা। তারপর সারাবিকেল, সারারাত ধরে ডুবুরিদের অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তনুর প্রাণহীন লাশটা মিলে। যেন মৃত্যুই তনুকে টেনে নিয়ে এসেছিলো রাঙামাটিতে। নিরব হয়ে যায় বিয়ে বাড়ি। বাড়ির পাশে কবরে শুইয়ে রেখে আসে আপনজনেরা।
     তনুর জীবনের শেষ ইচ্ছা - বেঁচে থাকার আকুতি না রাখতে পারা আর ইচ্ছে করে মেয়ের হাত ছেড়ে দেবার যন্ত্রণায় মা পাগলের মতো শুধু ‘তনু, আমার তনু’ বলে বিড়বিড় করে চোখের নোনাজলে ভেসে চলেছে। তনুর রাঙামাটিতে নিয়ে যাওয়া ব্যাগটি থেকে মোবাইল বের করে মা। তনু ট্রেনে চুপচাপ জানালায় বসে কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছিলো আর কমলালেবু খাচ্ছিলো। হঠাৎ হাতের টান লেগে মোবাইল  থেকে হেডফোনের সংযোগ খুলে গেলে বেজে ওঠে রবীন্দ্র সংগীত... ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোন শোন পিতা।/কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।/ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।/যা কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত¡না।’... 

জান্নাতুল পারভীন
ঢাকা, বাংলাদেশ।