অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
একুশ শতকের সংকট এবং সম্ভাবনার পথ (এক) - দীপিকা ঘোষ

ভারসাম্যহীন পৃথিবীঃ
৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে নাসা (NASA) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মহাকাশ গবেষণা বিভিন্ন পথ ধরে এগিয়েছে। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নেরও উত্তর জানার চেষ্টা চলেছে, পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও জীবের অস্তিত্ব রয়েছে কিনা। কিংবা জীবের বসবাসযোগ্য অনুকূল পরিবেশ একদিন মহাবিশ্বের অন্য কোনো গ্রহে ছিল কিনা। এই অনুসন্ধানের কারণ কেবল বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসার কৌতূহল নিবারণের জন্য নয়। মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনেও। কারণ বিজ্ঞানীরা ধরেই নিয়েছেন, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সুদূর ভবিষ্যতে বসুন্ধরা পৃথিবী ছেড়ে মানুষকে মহাবিশ্বের অন্য কোনো সৌরজগতে যেতেই হবে।  ১‘We are in danger of destroying ourselves by our greed and stupidity. We cannot remain looking inwards at ourselves on a small and increasingly polluted and overcrowded planet,’(http://www.brainyquote.com/authors/ Stephen-hawking-quotes).

নব্বইয়ের দশকে নাসার স্পেস টেলিস্কোপে অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্রের ছবি ধরা দিয়েছিল। কোনো কোনো গ্রহ বার বার বিজ্ঞানীদের মনে প্রত্যাশার আলো জ্বালিয়েছিল জীবের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু তারপরও প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। কারণ সব গবেষণার ফলাফল এখনও অবধি এটাই জানিয়ে দিচ্ছে, হাজার হাজার গ্যালাক্সি এবং সৌরজগৎ থাকলেও অসীম মহাবিশ্বে পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে সর্বজীবের উপযোগী সব রকম পারিপার্শ্বিকতা বিরাজমান।  জীবের অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্য যে যে রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজন তার সবই মজুদ রয়েছে পৃথিবীর আবহমণ্ডলে।  তার পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিকতায়। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে জীবের জীবন ধারণযোগ্য  পরিবেশ বজায় থাকলেও বর্তমান শতাব্দীতে নানা ব্যত্যয়ের ফলে পৃথিবী আজ চূড়ান্ত সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে পারিপার্শ্বিক ভারসাম্যতা হারিয়ে যাওয়ার ফলে।

পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে কয়েক যুগ ধরেই মুখর হয়েছেন বিশ্বের সচেতন পণ্ডিতসমাজ। একুশ শতকের সংকট এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ কতটা অভূতপূর্ব এবং অপ্রতিরোধ্য দ্রুতগতিতে জীব আর জগতকে সংকটাপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে, সে সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্যগবেষণার নানা দিক নিয়ে আলোচনা বিশ্লেষণ করেছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা।  সেসব আলোচনার অনেকটাই সাধারণ মানুষের অনুভবযোগ্য। শতাব্দীর তীব্র সমস্যাগুলো সাধারণের সাদামাটা চোখেও এখন দৃশ্যমান। কিন্তু তার মানে এই নয়, দৃশ্যমান বলেই বিশ্বের তাবৎ মানবসমাজ সভ্যতার বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েছেন।  অতএব পৃথিবীর অস্তিত্ব রক্ষায় তাদের করণীয় কাজগুলো তারা যথাযথভাবে করবেন। বাস্তবতা মোটেই সে রকম নয়। এমনকি একুশ শতকের সমস্যা কিংবা সংকট সম্পর্কে কিছুটা যাদের ধারণা রয়েছে, তারাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্তমান বাস্তবতার প্রতি নির্মমভাবে ভ্রূক্ষেপহীন। কারণ আধুনিক যুগের বিজ্ঞানপ্রযুক্তি সভ্যতায় সিংহভাগ মানুষ এতটাই অভ্যস্ত, এতটাই নির্ভরশীল এবং ব্যক্তিস্বার্থে এতটাই কেন্দ্রাতিগ যে মানুষ বিস্মৃত হয়েছে, বসুন্ধরা পৃথিবীকে চাইলেই অফুরানভাবে ভোগ করা সম্ভব নয়। এমনকি তাকে এককভাবে ভোগ করার অধিকারও মানবজাতির নেই।

কেননা বসুধা জননীর স্নেহময় মাতৃকোলে বসবাসের অধিকার উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, পশুপাখিসহ প্রত্যেক পৃথিবীবাসীর।  সবাই তার আপন সন্তান। ঈশ্বরের জগতের প্রত্যেকটি সৃষ্টি তাই পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো পরস্পর সম্পর্কিত। সুতরাং উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ কিংবা পশুপাখীর বিলুপ্তি ঘটিয়ে পৃথিবীতে এককভাবে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এছাড়াও দ্রুতগতিতে বিশাল হতে থাকা মানবজাতির লাগামহীন চাহিদা পূরণের ক্ষমতাও বসুন্ধরা পৃথিবীর নেই। তাই যন্ত্রনায়-যন্ত্রনায়, আঘাতে-আঘাতে নিষ্পেষিত সে। চরমভাবে জর্জরিত আধুনিক সভ্যতার নিরন্তর অভিশাপে। কিন্তু কেন আধুনিক সভ্যতার কারণে পৃথিবী নিষ্পেষিত আজ? কেন আঘাতে-আঘাতে চরমভাবে জর্জরিত সে? কারণ বর্তমান সভ্যতার প্রভাবে এর স্বাভাবিক পারিপার্শ্বিকতা বদলে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। যে কারণে এখনও পর্যন্ত পৃথিবী বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত, সেটা তার সব ধরনের জীবের উপযোগী পরিবেশ থাকার কারণেই। কিন্তু এই পরিবেশ অস্বাভাবিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণে। মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে মারাত্মকভাবে দূষিত হওয়ার ফলে।

পরিবর্তনশীলতা চলমান জগতের স্বাভাবিক নিয়ম। মানুষের জীবনে যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবনসংস্কৃতি, খ্যাদ্যভ্যাস কিংবা প্রযুক্তির নানা আবিষ্কারে নিয়মিত বদল ঘটছে, তেমনি পৃথিবীর চেহারায় আর পারিপার্শ্বিকতাতেও আদিকাল থেকে ঘটে চলেছে পরিবর্তনের ধারা। ৪৬০ কোটি বছর আগে সোলার সিস্টেমে পৃথিবীসহ আরও যত গ্রহ-উপগ্রহের জন্ম হয়েছিল, মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তনের ধারা। আজকের পৃথিবীও তাই তার আদিম চেহারায় টিকে নেই।  কিন্তু সেই পরিবর্তন এসেছে ধীরে ধীরে মহাকালের সুনির্দিষ্ট পথ ধরে। প্রকৃতির আপন স্বভাবের স্বাভাবিক এবং অভ্রান্ত নিয়মে। এই নিয়ম পরিচালিত হয়েছে সর্ব জীবের উপযোগী আবহ তৈরীর উদ্দেশ্যেই। সেখানে তাই লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পরিবর্তিত অবস্থার মধ্যেও সুগভীর সামঞ্জস্যতা বজায় ছিল।

কিন্তু আপাতত পৃথিবীর ইকোসিস্টেমে পরিবর্তনের যে তীব্রতা তাতে সামঞ্জস্যসাধন নয়, বিশৃঙ্খলার দিকটাই কেবল ভয়ালভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এই নেতিবাচক পরিস্থিতির জন্যই কয়েক যুগ ধরে মহাকাশবিজ্ঞানী, নৃতাত্ত্বিক, পরিবেশবিদ, জনতত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী এবং সাস্কৃতিক বিশেষজ্ঞরা বিপুলভাবে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। কারণ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এই অবস্থা এক বিরাট হুমকি। বলা বাহুল্য, বর্তমান শতাব্দীর কোনো সমস্যা ও সংকটই কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন বিপর্যয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না।  যে কারণে পৃথিবীর পরিবেশ দূষিত এবং জলবায়ু দ্রুতগতিতে বার্ধক্যগ্রস্ত হচ্ছে, তার প্রত্যেকটির সঙ্গেই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে সমাজ-সভ্যতার সব রকম সংকটের কারণগুলোও। একুশ শতকের পৃথিবীতে পরিবর্তনের দুই বিপরীত মেরু দ্রুত ভারসাম্যহীন হওয়ায় প্রকৃতির সুস্থির অবস্থাকে বিপজ্জনকভাবে ব্যাহত করছে। অবশ্য সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টাও চালানো হচ্ছে নানাভাবে। কিন্তু তার সফলতার সম্ভাবনা কতখানি, সে সম্পর্কেই সমাজসভ্যতা এবং পরিবেশ বাস্তবতার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবার বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার সময় এসেছে।

শুরুতেই একুশ শতকের সংকট ও সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য এদের আলাদা আলাদাভাবে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হলো। এক: জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। দুই: খাদ্যসংকট ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা।  তিন: জল সংকট।  চার: জলবায়ু ও পরিবেশ দূষণ।  পাঁচ: বৈশ্বিক উষ্ণতা।  ছয়: প্রাকৃতিক দুর্যোগ।  সাত: সামাজিক অপরাধ।  আট: সাইবার অপরাধ।  নয়: রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক  জটিলতা।  দশ: ধর্মীয় সংঘাত।  এগারো: আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ।  বারো: সংর্ঘর্ষ, যুদ্ধ এবং গণহত্যা।  তেরো: উদ্বাস্তু, শরণার্থী এবং মাইগ্রেশন সমস্যা।  চৌদ্দ: একুশ শতকের ব্যাধি ও মহামারি।  পনেরো: ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া।  ষোলো: মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। চলবে...  

দীপিকা ঘোষ। ওহাইয়ো, যুক্তরাষ্ট্র