অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
ধূসর আঁচলে বকুলের ঘ্রাণ - মনজুর শামস

     মাজানের আগুনের আঁচ থেকে বাঁচতে লম্বা উড়াল দিল ওরা। ওরা মানে আমাজানের সবচেয়ে সুন্দর পাখি স্কারলেট ম্যাকাউ। বাপের জন্মেও ওরা এতো লম্বা উড়াল দেয়নি। এক্কবারে দুনিয়ার ওই মাথা থেকে এই মাথার অস্ট্রেলিয়ার গহীন অরণ্যে। দেবে না-ই-বা কেন? জান বাঁচানো দিয়ে কথা! কিন্তু বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকেই আসে। মানুষের মতো ওদেরও যে- তা এবার প্রমাণিত হয়ে গেল। অস্ট্রেলিয়ার অরণ্যে ওরা এসে বসেছে কি বসেনি; অমনি সেখানেও দাউদাউ করে জ্বলে উঠল দাবানল। আর তার উত্তাপ আমাজানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ক্লান্ত-শ্রান্ত-বেদিশা স্কারলেট ম্যাকাউয়ের এই ঝাঁকটি তখন দেহের সমস্ত শক্তি নিংড়ে উড়াল দিল ইন্দোনেশিয়ার বনে। গনগনে আগুন সেখানেও তাদের পিছু ধাওয়া করল। আর এ আগুনের ধোঁয়া এতোটাই গাঢ়- আশপাশের দেশও চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করল। অগত্যা তারা চোখ বন্ধ করে আসমানের দিকে উড়তে শুরু করল। উড়তে উড়তে, উড়তে উড়তে, উড়তে উড়তে এক সময় তারা পৃথিবীর মায়া ছিঁড়ে উঠে গেল মহাশূন্যে। তারপর যে কোথায় হারিয়ে গেল- মহাকাশে ভেসে বেড়াতে থাকা বিশ্বের সব স্যাটেলাইট দিয়ে অনেক খুঁজেও তাদের আর টিকিটিরও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না... ... ...
     এমনই এক দৃশ্যকল্প মগজের ভেতরে খেলাতে খেলাতে বাসে উঠে পড়লাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। পকেটে থাকা অল্প কয়েকটি টাকা নানা ধরনের হিসেব দাখিল করে দাঁত কামড়ে পকেটেই পড়ে থাকতে চাইছিল। কিছুতেই খরচের হাঁড়িকাঠে মাথা গলাতে চাইছিল না। তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে আমিও কম খরুচে উপায় হাতড়াচ্ছিলাম। হিসেব মিলিয়ে দেখছিলাম কোন বাসে উঠলে ব্যয়টা মিত হবে। কিন্তু আমার ঘরে ফেরার পথের সে ধরনের প্রতিটি বাসেই গিসগিসে ভিড়। উঠতে পারছিলাম না। শেষমেশ বাড়ি ফেরার আগে গলির মুখে মোড়ের দোকান থেকে যে এক কাপ চা খেয়ে ঢুকতাম, আজকের জন্য সেটি বাদ দেব বলে ঠিক করে একটি সিটিংবাসে উঠতে পড়লাম। 
     নামে ও দামেই সিটিং, এসব বাসে দাঁড় করিয়েও যাত্রী তোলা হয়। প্রথম প্রথম যাত্রীরা ঝোড়ো প্রতিবাদ করত। তাতে কয়েকজন কন্ডাক্টর এবং দু-একজন ড্রাইভার হালকা ধোলাই খেয়েছে- আর কোনো লাভ হয়নি। বাস মালিকদের বিরুদ্ধে কথা বলে খোদ সড়ক পরিবহনমন্ত্রী শেষমেশ প্রকাশ্যেই অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন। স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা পথে নেমে পুলিশের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পর্যন্ত- কী করে এদের শায়েস্তা করা যায়। কিন্তু তাদের দু চোখের কোণে পুঁজির পুঁজ এতো গাঢ়-মৌতাত-বুনটে জমাট আস্তরণ ফেলে রেখেছে যে, সাধ্য কার তা সাফ করে দৃষ্টিকে স্বচ্ছ করতে পারে?
     অফিস ছুটির পর এখন ঘরমুখো মানুষের ঢল। সরু নদীতে বন্যার সময় পানির প্রবল তোড়ের মতো। এ সময় রাস্তায় গাড়ির ভীষণ চাপ থাকে। বাড়ি ফিরতে যেখানে আটটি ট্রাফিক সিগন্যালে বাড়তি সময়ের ধকল সয়েও বড়জোর দেড়ঘণ্টা লাগার কথা, সেখানে এ সময়ে এখান থেকে বাসে উঠলে আমার কখনো কখনো তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টাও লেগে যায়। চাকরি হওয়ার আগে এ সময়টায় পারতপক্ষে পথে বেরুতাম না। পাঁচ বছর টিউশনি করে নিজের খরচ চালিয়েছি। তখন এ সময়টাতে টিউশনিও রাখতাম না। আহ্, কী সময়টাই না গেছে তখন! বেকার জীবনের কী যে মাহাত্ম্য! ওভাবে অতদিন বেকার পড়ে থাকতে না হলে জানতেই পারতাম না বিড়ম্বতার উল্টোপিঠে লেখা অবাধ আনন্দের সেই ডানপিঠে আনন্দ পাঠ। তৃণাও তখন বেশি সময় দিত। 
     বাপের হোটেলে খাও-দাও আর ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াও। খাবার খেতে আর রাতে ঘুমুতে বাড়ি ঢুকলে অবশ্য কথার ঝাঁজালো টর্নেডো ধেয়ে আসতে থাকে চৌদিক থেকে। কই পরোয়া নেহি। প্রথম প্রথম অবশ্য ভীষণ কষ্ট পেতাম। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকা অন্ত্রের গভীর থেকে তেতো পিত্তরস উঠে আসতে থাকত গলা বেয়ে। আহত অভিমান বিছুটি পাতা ঘষে দিতে থাকত আকাঙ্ক্ষার প্রতিটি পরতে। বেকার জীবনটা যতই লম্বা হতে থাকল ততই সয়ে আসতে থাকল কথার খোঁচা। গণ্ডারের মতো মোটা হয়ে যেতে থাকল গায়ের চামড়া। শেষের দিকে কথার শত তীক্ষ্ণ খোঁচাও তাতে বিঁধতে পারত না।
     এখন খুব আফসোস হয়। আহ্, কী অফুরান বুনো-ইচ্ছে-তেপান্তর! ইচ্ছেমতো চষে বেড়াও- শুধু সময়মতো চোখ ও কান বন্ধ রাখতে হবে। চাকরিটা জুটে যাওয়ার পর অবশ্য একেবারেই উবে গিয়েছিল সেসব হুজ্জতেপনা। ডালপালা মেলতে শুরু করেছিল নানা বরণের স্বপ্ন। কিন্তু সেসব স্বপ্ন ধূসর হয়ে আসতে খুব বেশি একটা সময় লাগেনি। 
     ফ্যাশনদুরস্ত কর্পোরেট উলুবনে মূর্খ উচ্ছ্বাসের প্রলয়ঝড়ে তখনো আমার উৎসুক ডানাগুলো খসে পড়তে শুরু করেনি। নতুন চাকরি। এতদিন যিনি ঝাড়ি ছাড়া কথা বলতেন না, সেই মাই ডিয়ার বাবা নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে জামা-প্যান্ট আর জুতো কিনে দিয়েছিলেন অফিস করার জন্য। তো সেই জুতো জোড়ায় তখনো কালি-ব্রাশের ছোঁয়া লাগেনি। অফিস ছুটি হওয়ার পর সোজা চলে গেলাম তৃণার বাসায়। সেদিন ওদের ড্রয়িংরুমে ঢুকেছিলাম গটগটিয়ে, বুক চিতিয়ে, আগের সেই চোরের মতো পা টিপে টিপে নয়। তৃণা এসে বসার পর গলগলিয়ে বলে যাচ্ছিলাম ওর আর আমার আগামী দিনের পরিকল্পনাগুলো। ও একটা একটা করে শুনছিল আর নাকচ করে দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে ওর মা এসে ঢুকেছিলেন চা-নাশতা নিয়ে। শেষমেশ সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তৃণার সাথে ঘর বেঁধেছিলাম এর প্রায় মাস ছয়েক পরে। ততদিনে তৃণাও একটি চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিল পাড়ারই একটি ফ্যাশন শপের আউটলেটে। তখন আমাদের স্বপ্ন কোনো গণ্ডি, কোনো ছকে বাঁধা ছিল না।
     সুখের সেই পুষ্পরথ বছর পাঁচেক পরেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। আমাদের মহল্লাতেই একটি বই ও স্টেশনারির দোকান চালাতেন বাবা। দুই ভাইয়ের মধ্যে আমিই বড়। ছোট ভাইটি তখন সবে কলেজে যেতে শুরু করেছে। একমাত্র বোনটার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বছর তিনের আগে। একদিন রাতে দোকান বন্ধ করার সময় হওয়ার একটু আগে বুকে হঠাৎ মোচড় দিয়ে তার হৃদয়টা চিরদিনের জন্য নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। পুরো সংসারের ভার এসে পড়ল আমার ঘাড়ে। তৃণা তার কিন্ডারগার্টেন ছুটি হয়ে যাওয়ার পর দোকানে গিয়ে বসতে শুরু করেছিল। বছরখানেক পরেই মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যা জটিল হতে থাকল। কিডনি সমস্যা এমন স্তরে পৌঁছে গেল যে মাসে একবার ডাইলিসিস করাতে হয়। কলেজে পড়া ভাইটি লেখা-পড়ায় বেশ ভালো ছিল। তৃণা গোঁ ধরে বসল- তুমি আর আমি তো আসলে কেরানির গণ্ডিই পেরুতে পারিনি। কিন্তু ও ঠিক পারবে। খাই না খাই ওর পড়াশোনার জন্য যত যা-ই করা দরকার করব। সেই থেকে শুরু হয়েছে আমাদের দুজনের কৃচ্ছ্রতার লড়াই। 
     ভীষণ কষ্ট হলেও সিগারেটের অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছি। বাড়তি আয়ের জন্য একটা প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রুফ দেখতে শুরু করেছি। বিদ্যেটা কলেজজীবনে লিটল ম্যাগ বের করার সময়ই শিখে নিয়েছিলাম। ব্যাগে করে পাণ্ডুলিপি ও প্রুফ নিয়ে আসি। বাসে রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কাছের ছিটটা খালি হওয়ামাত্র জোরজবরদস্তি করে হলেও বসে পড়ি। যানজটের অসহ্য যন্ত্রণায় অন্যরা যখন হাঁসফাঁস করতে থাকে, আমি তখন বাসের সিটে বসেই প্রুফ দেখতে থাকি। কে কী ভাবলো তার কোনো তোয়াক্কা করি না। যেভাবেই হোক সংসারটা আমাকে দাঁড় করাতেই হবে। ছোট ভাইটাকে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে, মায়ের যত্নেও কোনো খুঁত রাখা যাবে না। জগতের আর কোনোদিকে তাকানোর কোনো ফুরসত নেই আমার। 
     একটু পরেই আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই বেশ ভদ্র চেহারার এক বুড়ো ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। ভেবেছিলাম- না, না, ভেবেছিলাম না- আশা করছিলাম তরুণ বয়সী কেউ উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বসার জায়গা করে দেবে। বাসে যাতায়াতের সময় এমনটি দেখেছিও বেশ কয়েকবার। কিন্তু আমার সে প্রত্যাশা মাঠে মারা গেলো। কেউ-ই উঠে দাঁড়াল না। কেন উঠে দাঁড়াবে, কে উঠে দাঁড়াবে? যে দেশে পথের পাশে কেউ কাউকে মেরে-কেটে কিছু ছিনিয়ে নিলে কেউ ফিরেও তাকায় না, হেল্পার বাস থেকে ধাক্কা মেরে চাকায় পিষে মানুষ মারলেও বাসের লোকেরা মুখে কলুপ এঁটে থাকে, ক্লাস টু-এর প্রশ্নপত্র ফাঁস করেও যে দেশে টাকা কামায় নচ্ছার বদমায়েশেরা, ক্লাবগুলোর ক্যাসিনোতে ওড়ে কোটি কোটি কালো টাকা- সেই দেশে আমি এমন সদাচার কেন আশা করব?
     মনের ভেতর যখন এইসব খেদ চুলোয় ফুটন্ত পানির মতো টগবগ করছিল, প্রচণ্ড মাথাব্যথার সময় কপালের দু পাশের রগের মতো দাপাদাপি করছিলো, ঠিক তখনই মাঝ বয়েসী এক মহিলা তার সিট থেকে উঠে দাঁড়ালেন। পরম সম্ভ্রমে সেই বৃদ্ধের হাত ধরে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলেন নিজের সিটে। ভারী লেডিস ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে মাথার উপরের রড ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন। ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছিলো পরীক্ষার খাতা। বোঝাই যাচ্ছিলো কোনো এক স্কুলের শিক্ষিকা তিনি। নির্লজ্জের মতো বসে থাকা পুরুষদের, হামেশাই নারী-বিদ্বেষী রসালো আলাপে মেতে ওঠা বাসযাত্রীদের মুখে যেন ঝাঁমা ঘষে দিলেন তিনি। 
     কিছুদূর যাওয়ার পর এক স্টপেজে এক লোক নেমে গেলে তিনি সেই খালি সিটটাতে বসে পড়লেন। আরেকটু পরে তার পাশের সিটটি খালি হলে আমি দ্রুত গিয়ে বসে পড়লাম। হয়তো একটু তাকিয়ে দেখতাম অন্য কেউ বসার আছে কিনা, কিন্তু আমার সেদিন প্রুফ দেখার খুব তাড়া ছিল। বসেই ব্যাগ থেকে প্রুফের প্যাকেটটি বের করলাম। লাল কলমটা এই প্যাকেটেই রাখি। কিন্তু অনেক খুঁজেও এটি তখন আর পাওয়া গেল না। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে বাইরে উদাসদৃষ্টি মেলে তাকাতে যাব, ঠিক তখনই কাঁধে মৃদু ছোঁয়া অনুভব করলাম। তাকাতেই তিনি তার ব্যাগ থেকে একটি লাল কলম বের করে দিয়ে বললেন, ‘এই নিন, এটিতে চলবে তো কাজ?’
     চরম বিস্মিত হয়েছিলাম নাকি আপ্লুত হয়েছিলাম বলতে পারব না। হয়তো দুটোই। ধন্যবাদ জানিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে আমি প্রুফ দেখতে থাকলাম। আমার গন্তব্যের কয়েক স্টেশন আগে তিনি নেমে গেলেন, অনেক সেধেও তাকে তার কলমটা ফেরত দিতে পারলাম না। সবুজ পাড়ের ধূসর হয়ে যাওয়া শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে তিনি গটগটিয়ে নেমে গেলেন। বহুদিন পর আমি তার ধূসর আঁচলে বকুলের ঘ্রাণ পেলাম। 

মনজুর শামস
গোপীবাগ, ঢাকা