অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
ভুডুইজম - আশিস চক্রবর্তী

     কি জানো একটা অতিপ্রাকৃত জগৎ আমাদের সাধারণ জগতের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকে। তাকে অনুভব করার জন্য চাই সজাগ ইন্দ্রিয় আর চর্চা। -- এই টুকু বলে খানিক থামলো বড়ুয়া। আমি বরাবরই পাঠকের স্বার্থে আমার হিন্দিভাষী বন্ধু বড়ুয়ার কথা গুলো বঙ্গানুবাদ করেই তুলে ধরি।
     আমি বললাম হঠাৎ এই সব প্রসঙ্গ, কিছু প্রমান পেয়েছো নাকি?
     প্রমান কিনা জানি না, তবে সে সবের দোরগোড়ায় একবার পৌঁছে গিয়েছিলাম বলতে পারি। এখনো খানিকটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছি। এসব কথা তোমার মোটেও সইবে না? -- বললো বড়ুয়া।      বিশ্বাস অবিশ্বাস এর ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আর তা ছাড়া সত্যি যদি একটা অন্য জগৎ থেকেই থাকে, আমার মানা বা না মানাতে তার ব্যপ্তি তো থেমে থাকবে না। কি বলো?
     বড়ুয়া কোনো ভূমিকা না রেখেই নিজের জায়গায় থেকে উঠে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো।
     বছরটা ভূমিকম্পের। ছোট বড় মাঝারি আলোড়নে কেঁপে উঠছে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান। সকালে ঘুম থেকে উঠে নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের খবরটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। হঠাৎ কাগজের  নিচে ছোট করে একটা বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ পড়ল। মোটা হরফে লেখা দুষ্প্রাপ্য পুরোনো বই বিক্রি আছে। যোগাযোগ বলে একটা ফোন নাম্বার দেয়া, ব্যাস এইটুকু। লোভ সামলাতে পারিনি। মনটা আটকে গেলো পুরোনো আর দুষ্প্রাপ্য এই শব্দ দুটোতে। তৎক্ষণাৎ ফোন। ওপাশ থেকে ভারি গলার কন্ঠস্বর। বিজ্ঞাপন এর ব্যাপারে বলতেই ভদ্রলোক বললেন সাক্ষাতে কথা হবে। ফোনে কিছু বলতে চান না। ঠিকানা দিলেন। বিকেলের দিকে পৌঁছে গেলাম। তখন তোমার সাথে এতোটা আলাপ ছিলোনা। না হলে সঙ্গে নিতাম।
     আমি মাঝ খানে থামিয়ে বললাম- কিন্তু গেলেটা কোথায়?
     কোচবিহার- বললো বড়ুয়া।
     বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বসত ভিটে। জমিদার বাড়ি বললে কম হয়না। ভদ্র লোকের নাম সোমেশ্বর রায়। বয়স আন্দাজ সত্তর। চেহারায় শুকনো ছাপ। আমাকে একটা ঘরে বসতে দিয়ে ভদ্র লোক খানিক বাদে একটা কাঁচের গ্লাসে শরবত নিয়ে ফিরে এলেন। গ্লাসটা রাখবার মতো কোন জায়গা না থাকায় আমার হাতে ধরিয়ে উল্টো দিকের চেয়ারে বসলেন। কিছু বলতে যাবো, সেই মুহূর্তে উনি ইশারায় শরবতটা শেষ করতে বললেন।
     কথা শুরু হলো। আমার নাম ঠিকানা, কি করি, বয়েস সমস্ত কিছু জানার পর হাসি মুখে বললেন-
     এখনকার জেনারেশন তাহলে বই এর কদর বোঝে!!
     আমি মৃদু হাসলে' উনি বললেন যাও আগে দেখে এসো আমার বিজ্ঞাপন সত্যি কিনা?
     পাশের ঘরের রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।
     ভেতরে প্রবেশ করেই আমি ভীষণভাবে হতাশ হই। টেবিলে গোটা দশেক বই ধুলোতে ঢাকা ছাড়া আর কিছু নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতে তুলে দেখি সর্বনাশ, এতো রীতিমতো গুপ্তধন।
     ব্রিটিশ পিরিয়ড এর লেখা। বাকি গুলোও ওর আসে পাশের। আর প্রত্যেকটার লেখক এক  জন করে সাহেব। এর মূল্য আর আমার ক্ষমতা এই দুই আন্দাজ করে, বেড়িয়ে এসে ভদ্রলোক কে বললাম -- আমি মনে হয় ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। এসব কেনার সাধ্য আমার নেই। নমস্কার জানিয়ে ফিরে আসবো মনেমনে করছি ভদ্রলোক বসতে বললেন।
     তুমি ছাড়াও কয়েকটা প্রকাশক ওই বিজ্ঞাপন এ সাড়া দিয়ে আমাকে মোটা অংকের টাকা অফার করে। অবশ্য বই সম্পর্কে না জেনেই। ব্যবসায়ী বুঝলে- বললেন সোমেশ্বর বাবু।
     আমি বললাম- দিলেন না কেন?  খারাপ কিছু তো বলেনি। এ বই বাজারে এলে শোরগোল পরে যাবে। এটা একটা নতুন যুগের সূচনা করবে। সাহিত্যের একটা মিশিং লিংক বলে আমার মনে হয়। এই বই বাড়িতে রেখে আপনি অনেক পাঠককে বঞ্চিত করছেন। এতো মুল্যবান বই আপনার কাছে এলো কিভাবে??
     এই বই তো আর শুধু বই না কোনো একজনের পারিশ্রমিক- বললেন সোমেশ্বর বাবু। রাজা বাদশাদের খামখেয়ালি পনার কথা জানো নিশ্চয়। আমাদের দেশের জমিদার বাবুরাও কম জাননা। তা সে শিকারই বলো, আর সংকেত দিয়ে গুপ্তধন লোকানো বলো। এরা জীবনটাকে উপভোগ করে চলতেন। আমার বংশের পূর্বপুরুষ ছিলেন জমিদারের নায়েব। জমিদার শ্রীমান আদিত্য নারায়ণ রায় মহাশয়ের জীবনী লিখে এই বইগুলি আর এই ভিটে বাড়ি খানি পারিশ্রমিক পান নায়েব মশায়। ভাবো একটি জীবনী নায়েব মশায় এর জীবন গড়ে তোলে। এই বই আমি ছাড়া কেউ কোনো দিন খুলেও দেখেনি।
     আমি কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম -বই গুলি আপনি পড়েছেন?
     পড়েছি বৈকি, উপভোগ করে এক একটা পরখ করে দেখছি, -বললেন তিনি।
     মানে?-
     মানেটা সহজ ওই বই মিথ্যা বলেনা। সমস্ত রহস্য ওতে বন্দি হয়ে আছে। খুললেই ম্যাজিক। আরো গভীরভাবে বললে পৃথিবীর খোলনলচে বদলে যেতে পারে। কি বিশ্বাস হয়না তো!! আমাকে কেউ বিশ্বাস করেনি বলেই তো এই বিশাল অট্টালিকায় আমি আজকে একা। - বললেন সোমেশ্বর বাবু।
     এতোক্ষণ যা ঘটছিল,  স্বাভাবিক। এবারে ভদ্রলোককে আমার ঠিক অন্যরকম মনে হতে লাগলো। ব্যক্তব্য স্পষ্ট নয়। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসছে। বাড়ি ফিরতে হবে মনে আসতেই বললাম- আসি, এই বই কেনার সাধ্য আমার নেই, আপনি ওই প্রকাশকদের অফার গ্রহণ করতে পারেন।
     সোমেশ্বর বাবুর চাহনি আলাদা। প্রচন্ড অখুশি। হটাৎ বললেন - তুমি উইচ ক্রাফট, মান্যা, টোটেম,  প্ল্যান চেট, ট্যাবু এসব ব্যাপারে কিছু নলেজ রাখো।
     এরকম প্রশ্ন হঠাৎ করে এসে যাওয়ায় খানিকটা অবাক লাগলেও বললাম- গল্প উপন্যাস অব্দি সীমাবদ্ধ। এর বেশি কিছু জানি না।
     আর ভুডুইজম? জানতে চাইলেন সোমেশ্বর বাবু।
     বললাম- প্রথম শুনলাম।
     সোমেশ্বর বাবুর চোখে একটা আগ্রহ দেখলাম। সেটা আমাকে ভুডুইজম এর সাথে পরিচয় করানোর। আমাকে বসতে বলে ঘরে চলে গেলেন। চারিদিকে আলো কমে এসেছে। খানিক বাদে ফিরে এলেন একটা বাক্স হাতে। চেয়ারে বসে পড়ে, বললেন-
     ভুডু কথার অর্থ হলো বিরাট কোনো আত্মা। সেই আত্মাকে দিয়ে ভালো খারাপ অনেক কিছুই করানো যায়। এর সাথে মিশে আছে আফ্রিকার এক বিশেষ প্রজাতির ধর্মীয় বিশ্বাস। যারা এই ভুডু বিদ্যার চর্চা করত তারা একাধারে চিকিৎসক, পুরোহিত এবং জাদুকর হন। এর সাথে নরবলি কিংবা রক্তপান বিষয়টিও জড়িত। সহজ ভাবে বলতে গেলে এই বিদ্যায় উদ্দিষ্ট ব্যক্তির বিপদ আপদ রোগ এর মুক্তিও হতে পারে। আবার তার শরীর থেকে নখ, চামড়া, চুল এরম কিছু উপকরণ নিয়ে মাটিতে পুঁতে ভুডু বিদ্যার বলে অনিষ্ট করা অতি সহজ ব্যাপার।
     আমি হাসি সংবরণ করতে না পেরে উচ্চস্বরে ফেটে পড়ি। আসে পাশের ঘর গুলিই যেন সেই শব্দে কেঁপে ওঠে। কোন মতে সামলে বলি- আপনি কোন শতাব্দীতে বাস করছেন মশায়। যত সব আজগুবি মনগড়া আদি বাসি কালচার এর লেখা পড়ে আঁকড়ে বসে আছেন। ওকে, আমি উঠলাম। আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। ওঠার উপক্রম হলে উনি বললেন- দাঁড়াও। তোমার বয়েসে, বিজ্ঞানের ওপর অতি মাত্রায় ভরসায় এই ভুল আমিও করে ছিলাম। মনের অন্ধকার দূর করবার জন্য অনুসন্ধান এর শেষ রাখিনি। কৌতূহল এর অবসান ঘটে পোল্যান্ড এর ইউনিভার্সিটি অফ উইজর্ডিতে। এই বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান আর মন্ত্র পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটিতে হাতে কলমে ভুডু ডল বানিয়ে তা প্রয়োগ প্রক্রিয়া আয়ত্ত করে দেশে ফিরে আসি। এই ভুডুডল ভুডুইজম এর আসল খেলনা। পুতুলকে তুমি যার নামে প্রয়োগ করবে তার আত্মা, শরীর এতে অধিষ্ঠিত হবে। এমনকি পুতুলের শরীরে ক্ষত বা আঁচড় পড়লে সেই মানুষের শরীরে রক্তপাত হবে।
     আমার বিরক্তি শেষ পর্যায়ে পৌঁছায়। ভদ্র লোককে এখানেই থামিয়ে  বললাম- আপনার গল্প আর নেওয়া যাচ্ছে না। আপনার আসল উদ্দেশ্য কি বলুন তো। বই বিক্রি নয় নিশ্চয়। এসবের মানে কি। আফ্রিকার কোন জন জাতির ব্ল্যাক ম্যাজিক নিশ্চয় আমি শিখতে আসিনি। আপনার বয়সটার একটা খেয়াল করুন, এই বয়সে ইনিয়ে বিনিয়ে এতোগুলো মিথ্যা গল্প না শোনালেই নয়!!!! আর আমিই বা এতো কথা শুনেছি কেন।
     আমার এত কথা বলার মাঝে ভদ্র লোক সঙ্গে আনা বাক্স খুলে একটা অদ্ভুত রকমের পুতুল বের করে ডান হাতে ধরলেন। সঙ্গে একটা আলপিন। এরকম বীভৎস, কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর পুতুল আমি জীবনেও দেখিনি। অনেকটা ক্রস চিহ্নের মতো খড় আর চটের তৈরি। দু দিকে দু হাত ছড়ানো পুতুলটার। চোখের ওপরে  দুটো শার্টের বোতাম লাগানো। মাথা থেকে অগোছালো কালো চুল। মুখটা সেলাই করে বন্ধ করা। এবারে সোমেশ্বর বাবু যেন আমার কোনো কোথায় শুনতে পাচ্ছেন না। বিড়বিড় করে চোখের মণি উল্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন  একনাগাড়ে বলে চলেছেন। আমি একেবারে অপ্রস্তুত। ঝট করে হাওয়ার বেগে উঠে আমার মাথার কাছে এসে এক গোছা চুল একেবারে ছিঁড়ে তুলে নিলেন। আমি ব্যাপার বেগতিক দেখে চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে সরে যাই। তাড়াহুড়োয় শরবতের কাঁচের গ্লাসটা আমার ডান পায়ের তলায় চাপা পড়ে ভেঙে একটুকরো গেঁথে যায়। প্রচন্ড আর্তনাদে কুঁকড়ে মেঝেতে পরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ি।
     সোমেশ্বর বাবু আর বড়ুয়ার এই ব্যাপারগুলো কোনোটাই আমার কাছে অতিপ্রাকৃত বলে মনে হয়নি। বরং আজগুবি বোরিং,  একটা মস্তিস্ক বিকৃত মানুষের সাথে সময়, অর্থ, স্বাস্থ্য হানিকর মিটিং বলেই মনে হচ্ছে। তাই বড়ুয়াকে বললাম সোমেশ্বর বাবুর ভূতুরে হাবভাব দেখে  কাঁচে তোমার পা টাই কেটে ফেললে?  ভয় থেকে আত্ম সমর্পণ মানে বিশ্বাস জন্মে গেছে বলো?
     বড়ুয়া শান্ত ভাবে বললো - ভয় পেয়ে নয়, সোমেশ্বর বাবু ভুডু ডল এর ডান পায়ে আলপিনটা গেঁথেছিলো, যেটা আমার শরীরের উপকরণ মানে চুল দ্বারা মন্ত্রপুত করেছিলেন। আর গ্লাসের ভাঙা কাঁচটাও গেঁথে ছিল ওই ডান পায়েই।

আশিস চক্রবর্তী
ভারত বর্ষ