অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা - পার্থ প্রতিম হালদার

     প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম পুরস্কৃত হয়েছিলেন তিনি হলেন ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী তথা বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। এপার বাংলা-ওপার বাংলার মানুষের কাছে তিনি অভিনয়ের গুনে মহানায়িকা হয়ে আছেন, কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে আজও সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন। বিশেষ করে উত্তম-সুচিত্রার সেই রোমান্টিক জুটি আজও দর্শকদের মনে সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে। ১৯৫২ সালে 'শেষ কোথায়' ছবির মধ্য দিয়ে তিনি অভিনয় শুরু করেছিলেন। তারপর নায়িকা হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি ছিল 'সাত নম্বর কয়েদি' যা ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন।  ১৯৬৩ সালে তিনি মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস জয় করেন- 'সাত পাকে বাঁধা' ছবির জন্য। ভারত সরকার তাঁকে ১৯৭২ সালে পদ্মশ্রী প্রদান করেন আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১২ সালে তাঁকে বাংলার সর্বোচ্চ সম্মান বঙ্গবিভূষণ  প্রদান করেন। হিন্দি ছবি 'দেবদাস' তে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য ১৯৫২ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন। এটি ছিল তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি। তিনি সর্বমোট ৬৩ টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন- তার মধ্যে ৫৬টি বাংলা ছবি আর ৭টি হিন্দি ছবি। এমনই একজন কিংবদন্তি অভিনেত্রী তথা বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকার ৮৯ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো না করোনা ভাইরাসের কারণে। প্রতি বছর যেখানে নানান কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে পালিত হয়, উৎসবের ও আয়োজন করা হয়, কলকাতার রবীন্দ্র সদনে নন্দন সিনেমা হলে টানা ১৫ দিন উত্তম-সুচিত্রার ছবি চালানো হয়- এবারে কিছুই হলো না করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে।
     মহানায়িকা সুচিত্রা সেন ১৯৩১ সালে ৬ই এপ্রিল বাংলাদেশের পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেণ। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। তিনি ছিলেন কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী। ১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট শিল্পপতি দিবানাথ সেনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। সুচিত্রা সেনের কন্যা মুনমুন সেন একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। সেই সঙ্গে তাঁর দুই নাতনী অর্থাৎ মুনমুন সেনের দুই মেয়ে রাইমা সেন ও রিয়া সেন হিন্দি ও বাংলা ছবির জনপ্রিয় অভিনেত্রী। সুচিত্রা সেন শুধু রোমান্টিক নায়িকা বা মহানায়িকা ছিলেন না- তিনি ছিলেন অভিমানী এবং রহস্যময়ী। তাই তো কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনি স্বামীর সঙ্গে না থেকে বালিগঞ্জের ফ্লাটে একাকি দিনযাপন করতেন। একটা কথা ঠিকই তিনি স্বামীর আপত্তি সত্ত্বেও নিজের জেদে  বা মনের তাগিদে অভিনয় করে গেছেন বছরের পর বছর। এমনই এক রহস্যময়ী অভিমানী স্বপ্নসুন্দরী মহানায়িকা ছিলেন সুচিত্রা সেন। যিনি ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমারের স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা- 'আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে সাত সাগরার তেরো নদীর পারে ময়ূরপঙ্খী ভিড়িয়ে দিয়ে সেথা দেখে এলেম তারে।' মহানায়িকা সুচিত্রা সেন ২০১৪ সালে ১৭ই জানুয়ারি কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
     তিনি মহানায়ক উত্তম কুমারকে মনে প্রাণে চাইতেন, তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে শ্রদ্ধা করতেন, তাঁর সঙ্গে স্বপ্নের দেশে হারিয়ে যেতে চাইতেন। যদিও তাঁদের এই সম্পর্কটাকে প্রেম বললে ভুল হবে, একটা অসাধারণ আন্ডারস্ট্যান্ডিং, মধুর সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল তাঁদের মধ্যে। তাই বোধ হয় বাংলা চলচ্চিত্রে এমন রোমান্টিক জুটি খুঁজে পাওয়া আজও দুষ্কর। মহানায়কের দিকে তাঁর সেই তাকানোর ভঙ্গি, সেই অসাধারণ হাসি, মন ছুঁয়ে যাওয়া চাউনি দর্শকদেরকে আজও পাগল করে তোলে। 'অগ্নিপরীক্ষা' ছবি থেকেই দর্শকদের কাছে রোমান্টিক জুটি হিসেবে তাঁরা পরিচিত হয়ে গেছিল। এরপরে 'হারানো সুর' আরও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে এই মুহুর্তে যে ছবিটির কথা না বলে পারছি না তা হলো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে ১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'সপ্তপদী' ছবি। সাংবাদিকদের বিচারে এই ছবি করার পর উত্তম কুমার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার তথা নায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই ছবির উত্তম সুচিত্রার সেই রোমান্টিক অভিনয়, বাইকে উঠে স্বপ্নের দেশে হারিয়ে  যাওয়ার অভিনয় দর্শককে পাগল করে। সেই সঙ্গে পাগল করে তোলে সুচিত্রা সেনের সেই অসাধারণ ডায়ালগ যা নায়কের উদ্যমকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, কঠিন পরিস্থিতিতেও স্বপ্ন দেখার জন্য ভাবিয়ে তুলেছিল তা হলো- 'কৃষ্ণেন্দু তুমি মস্ত বড় ডাক্তার হবে।'  আবার এই ছবিতে  Shakespeare  এর  'ওথেলো' নাটকের সেই ডায়ালগ, সেই অন্ধকার দৃশ্য, সুন্দরী নায়িকার সুন্দর গলাতে হাত দিয়ে গলা টিপে হত্যা করার অভিনয় করা, সেই প্রথম নায়িকার প্রেমে পড়া, নায়কের প্রতি ভালোলাগা বাড়তে শুরু হওয়া, নায়িকার সুন্দর মুখখানা তুলে চুমু খাওয়া- সব কিছু মিলিয়ে এক রোমান্টিক চিত্রকল্প তৈরি করা হয়েছে- 'It is the cause, it is the cause, my soul... Yet she must die, else she. Betray more men. Put out the light and then put out the light.' আর এই অভিনয়টি করার পরই দুজনে দুজনকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন এই 'সপ্তপদী' সিনেমাতে।
     চলচ্চিত্র জগতে তাঁরা যে খুব রোমান্টিক জুটি তা আমরা জানি। সুচিত্রা সেন একটি অভিনয়তে উত্তম কুমারের উদ্দেশ্যে বলছেন- আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি মোর নিশীথ বাসর সজ্জায় মন বলে ভালোবেসেছি আঁখি বলিতে পারেনি লজ্জায়। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তাঁদের সম্পর্কটা কেমন ছিল তা একটু দেখা যেতে পারে। ব্যক্তিগত জীবনে  তাঁরা একে অপরকে কতটাই বা ভালোবাসতো সিনেমার থেকে বেশি না কম তা দেখা যাক। ব্যক্তিগত জীবনে উত্তম কুমারের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের এতটাই ভালো সম্পর্ক ছিল যে, মহানায়ক উত্তম কুমারের প্রয়াণের পর সুচিত্রা সেন আর কোনো নায়কের সঙ্গে অভিনয় করার কথা ভাবতেই পারেন নি। এর থেকে বোঝা যায় তিনি মহানায়কের প্রতি কতটা আকৃষ্ট ছিলেন। আর একটা কথা হলো দুজনেই কিন্তু দুজনের অভিনয়কে প্রশংসা করতেন শ্রদ্ধা করতেন। দুজন দুজনকে না দেখে থাকতেই পারতেন না এমনই ছিল তাঁদের মধুর সম্পর্ক। তাই তাঁদের এতটা মধুর সম্পর্ক নিয়ে তৎকালীন সময়ে মানুষের মনেও কিন্তু সন্দেহের দানা বেঁধে ছিল। যেমন করে আজকের দিনেও আমরা তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠি। তবে যতটা জানা যায়, সুচিত্রা সেন উত্তম কুমারকে যতটা পছন্দ করতেন, ঠিক ততটাই উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনকে পছন্দ করতেন। একসঙ্গে পার্কে বেড়াতে যেতেন, গল্প করতেন, সময় কাটাতেন। মহানায়ক নিজেও একবার বলেছেন, তিনি সুচিত্রা সেনকে ভালোবাসেন তবে তা কিনা 'প্লেটোনিক লাভ' যেখানে কোন প্রকার কামের সম্পর্ক বা শরীরি সম্পর্ক ছিল না। তবে সুচিত্রা সেনের আগমনে নায়কের জীবনটা যে অনেকটা যে বদলে গেছে তা কিন্তু ঠিক। তা চলচ্চিত্র জগতে হতে পারে বা ব্যক্তিগত জীবনেও হতে পারে। তবে এঁদের ভালোবাসা যে কেমন ছিল তা বোধ হয় গুছিয়ে বলা সম্ভব নয়।  তাঁরা দুজন দুজনকে যে খুব ভালোবাসতেন এটা কিন্তু ঠিক। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, সুচিত্রা সেনও বিবাহিতা আর উত্তম কুমারও বিবাহিত তা সত্ত্বেও কিন্তু তাঁদের দুজনের প্রেম বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোন সমস্যা হয়নি। সুচিত্রা সেন কখনও সবার সামনে উত্তম কুমারকে জড়িয়ে ধরতেন, আবার কখনও সুপ্রিয়া দেবী (উত্তম কুমারের স্ত্রী)কে ফোন করে বলতেন যে উত্তম কুমারকে খুব চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। সত্যি মহানায়ক উত্তম কুমারের প্রতি সুচিত্রা সেনের ভালোলাগা ভালোবাসা এক অন্য মাত্রার ছিল যা ভাষাতে ব্যাখ্যা করা যায় না। সত্যিই তো সুচিত্রা সেন উত্তম কুমারের জীবনে আসাতে তিনিই প্রথম এত ভালো করে রোমান্টিক চোখে নায়িকাকে দেখেছিলেন, এত ভালোবেসেছিলেন- তাই বোধ হয় আমরা সর্বকালের বাংলা চলচ্চিত্রের এমন রোমান্টিক জুটি পেয়েছিলাম। সুচিত্রা সেন নিজেই বলেছেন- 'অন্য সমস্ত অভিনেতাকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। কিন্তু আমি উত্তমকে ভালোবাসি। ওর মতো এমন রোমান্টিক নায়ক বাংলা ছবিতে আর আসবে কিনা সন্দেহ।' বাংলা ছবিতে উত্তম কুমারের মতো রোমান্টিক অভিনেতা আর আসবে কিনা আমরা জানি না, তবে এটা জানি যে- মহানায়িকার জীবনে উত্তম কুমারের মতো এমন রোমান্টিক নায়ক আর আসেনি। তাইতো মহানায়কের মহাপ্রয়াণের পরেও মহানায়িকা তাঁকে একটু দেখার আশায়, তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার আশায় দিন গুনেছিলেন- ' বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি কতকাল দেখিনি তোমায় একবার তোমায় দেখি। আমার এ অন্ধকারে কত রাত কেটে গেল আমি আঁধারেই রয়ে গেলাম। তবুও ভোরের স্বপ্ন থেকে সেই ছবি যাই এঁকে রঙে রঙে, সুরে সুরে। ওরা যদি গান হয়ে যায়। কতকাল দেখিনি তোমায় একবার তোমায় দেখি।'


পার্থ প্রতিম হালদার। আসাম