অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
“নদীর ও পিতা-মাতা আছে- হাইকোর্ট” - দিদার আলম কল্লোল

     কয়েক দিন ধরে আমাদের ছোট ছেলে আনানে'র বন্ধুর মা-বাবা তাঁদের নারায়নগঞ্জের শীতলক্ষা নদীর নিকটবর্তী বাড়িতে যাবার নিমন্ত্রন দিয়ে আসছিলেন।  সময়- সমন্নয় করা এখন বেশ কঠিন। যাহোক সময় বের করে গেল বছরের প্রথমদিকে আমরা তিন-চার পরিবার গেলাম। আনানের বন্ধুর বাবা মেহেদী সাহেব বেশ বড় ব‌্যবসায়ী, টাকা পয়সার অভাব নেই। ধুমধামে খাওয়া দাওয়া হলো, জম্পেশ আড্ডা ও হলো। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার বিস্তৃত ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য ও দেখালেন। এ পর্যন্ত বেশ ভালই লাগছিল। একপেশে নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা ও কোলাহল থেকে দূরে কোথাও গ্ৰামীন আবহ ও নির্জনতায় কিছুটা সময় কাটাতে কার না মন চায়। আমাদেরও ভাল লাগছিল, বাচ্চাদের হইহুল্লোড় আর মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছুটে চলা দেখে দেখে আমরাও যেন অতীতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। বিকেলে হোষ্ট  আমাদের নদীর পারে নিয়ে যাবেন, শুনে মনে মনে খুব খুশী হয়েছিলাম। আমি কুশিয়ারা নদী পাড়ের মানুষ। নদীর জলে যায় যে কন্যা জল আনিতে, ঐ রূপসীর সচকিত দেখা এখন আর পাওয়া না গেলেও স্রোতস্বিণী নদীর ঢেউ, নদী পাড়ের নজরকাড়া শশ্য শ্যামল দৃশ্য আর বালুচরে আনমনে বালির বাঁধ ও দুর্গ নির্মাণ জাতীয় বাল্যখেলার স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোর কথা ভেবে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিলাম। কিন্তু শীতলক্ষা পাড়ে যেতে না যেতেই ঐ সুখস্মৃতি যেন নিমিষেই কর্পূরের মত উবে গেল। ভাবতেই পারিনি‌, শীতলক্ষা নদীর ওপারে যাবার জন্য নৌকায় উঠার আগেই ভয়াবহ দুর্গন্ধে আমাদের বমি হওয়ার যোগাড়। দূষণে দূষণে পানির রং কালো হয়ে যে দুর্গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তা অসহনীয় এবং এককথায় অবর্ণনীয়। এ যে বুড়িগঙ্গার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পানি না মবিল বুঝা দায়। সেই সাথে নদী দখলের যে চিত্র দেখলাম তার সাথে একমাত্র তুরাগেরই তুলনা চলে।
     যাহোক, মুখে কুলুপ এঁটে নদীর ওপারে গিয়ে বিস্তীর্ণ ফুলের বাগান দেখে মনঃকষ্ট কিছুটা দুর হয়েছিল। আগে ঢাকায় যশোর থেকে ফুল আসত এখন দেখছি নারায়নগঞ্জেও বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। আরো ভাল লেগেছিল সন্ধ্যার পর শীতলক্ষা নদীতে থিতু জাহাজের ভিতরে জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ফাঁকে ফাঁকে ভুরিভোজনে। মেহেদী সাহেব আগে ভাগেই তা আয়োজন করে রেখেছিলেন। 
     কে জানত ঠিক ঐ সময়টাতে ঢাকার অদূরে অবস্থিত তুরাগ নদীকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য আমাদের উচ্চ আদালতে লড়াই চলছে। এডভোকেট মনজীল মোরশেদ তুরাগ বাঁচাতে জনস্বার্থে একটি রীট করেছিলেন। এ রীটের চুড়ান্ত শুনানি শেষে গেল বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের হাইকোর্ট নদী রক্ষায় একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়। এ ল্যান্ডমার্ক জাজমেন্ট বা যুগান্তকারী রায়ে আমাদের হাইকোর্ট ১৭ দফা নির্দেশনা দেন।
     তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
ক) নদী পাড়ের জায়গা দখলকারী বা নদী দূষণকারী যাতে নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারে এ মর্মে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
 খ) নদী দখলকারী ও দূষণকারী যাতে ব্যাংক ঋন না পায় সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। 
গ) নদীপাড়ের সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জরীপ করে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে স্থায়ী সীমান্ত পিলার স্থাপন করার নির্দেশ দিলেন। 
 ঘ) সকল পাবলিক প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার একঘন্টা নদী ও পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্লাস নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কে নির্দেশ দিয়েছেন। একইভাবে শিল্প মালিক ও শ্রমিকরা যাতে শিল্প ও গৃহস্থালি বৈর্জ্য নদী, ড্রেন ও জলাশয়ে না ফেলে সেজন্য তাদের মাঝে সচেতনতামূলক ক্লাস চালু করতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন।
ঙ) সকল নদী দখলকারী ও দূষণকারীর তালিকা প্রস্তুত করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন।
চ) নদী দূষণ ও দখল ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি।
     এছাড়াও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, নদী কমিশন, জেলা প্রশাসক, সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নদী ও জলাশয়কে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
     এ রায়ের পর্যবেক্ষণে নদী রক্ষার অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে বিচারপতিগন বলেন একটি নদীকে হত্যা করা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হত্যা করার শামিল।
     তবে এ রায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও চমকপ্রদ দিক হলো এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের এতিম নদীগুলো তাদের পিতামাতা বা অভিভাবক ফিরে ‌পেল। অর্থাৎ এখন নদীকে আর লা-ওয়ারিশ ভাবার কোন সুযোগ নেই। এ রায়ের মধ্য দিয়ে হাইকোর্ট ঘোষনা করেছেন All the rivers are 'Person in Loco Parentis' and they have ‘living entities’ as well as ‘legal persons অর্থাৎ নদীর ও পিতা মাতা আছে এবং তার একটি জীবন্তসত্তা ও পৃথক আইনীসত্তা রয়েছে। আর সেই অভিভাবক হচ্ছে দেশের আপামর জনতা এবং এই অভিবাবকত্ত্ব নদী কমিশনের মাধ্যমেই প্রযুক্ত হবে।'লকো পেরেনটিসে'র কিতাবি ধারনাটি এতদিনে এদেশে আলোর মুখ দেখলো। এ ধরনের রায় দিতে যথেষ্ট জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়। মাননীয় বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও মাননীয় বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের দ্বৈত বেঞ্চ এ সময়োপযোগী অসাধারণ রায়টি দেন। 
     বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী মাত্র চার/পাচ মাস হয় অবসরে গেছেন। কিন্তু তিনি সবার স্মৃতিতে থাকবেন বহুদিন। ইতিপূর্বে তিনি আরও অনেক যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। আইনজীবীদের প্রতি কোন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরন না করে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে আইন ও সংবিধানকে সামনে রেখে ন্যায় ও সুবিচার করার চেষ্টা করেছেন, দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন একথা সর্বজনবিদিত। তাঁর মত ন্যায়নিষ্ট ও উচ্চমানসম্পন্ন ষ্টার জাজ যে কোন বিচারাঙ্গনের জন্য আশির্বাদস্বরূপ। তিনি সততা ও সাহসিকতার সাথে তাঁর উপর ন্যস্ত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন, একথা অনেকের মুখে আজও শুনা যায়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর কোর্টে অনেক মামলা করার। এর মধ্যে একটি মামলা রিপোর্টেড হয়েছিল। বাংলাদেশের নদীগুলো হয়ত বেঁচে থাকবে বিচারপতিদের কল্যানে আর বিচারপতি ‌মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামাল সাহেবরা বেঁচে থাকবেন তাঁদের যুগান্তকারী জনহিতকর রায়ের মধ্য দিয়ে। মাননীয় বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর অবসরের দিনগুলো ভাল কাটুক, দীর্ঘজীবি হউন‌, বিলল্বিত এ শুভকামনা নিরন্তর।

 দিদার আলম কল্লোল
এডভোকেট
 বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
 তারিখঃ ২৩/০৭/২০২০ ইং