অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
সুখ কি দুর্লভ কোন বস্তু - তামান্না আফরিন

    সুখ কোন বস্তুগত জিনিস নয়। সুখ বাজারে বিক্রি হয় না। একে ধরা যায় না কিংবা ছুয়েঁ দেখা যায় না। শুধু নিজের ভিতরে উপলবদ্ধি করা যায়। সুখ হলো মনের একটা ইতিবাচক অবস্থা বা অনুভূতি। যা আনন্দ বা উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা, তৃপ্তি বা প্রাপ্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মান্না দে-র গানের ভাষায় বলতে পারি যে, সবাই তো সুখী হতে চায়, তবু কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না। এবার চলুন দেখা যাক কেন কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না?
     বৈজ্ঞানিক গবেষণানুযায়ী, মানুষের ৫০ শতাংশ সুখ জিনগতভাবে নির্ধারিত হয়, ১০ শতাংশ জীবনের চলমান পরিস্থিতি এবং অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ সুখ আত্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়। এটা অনেকটা মানুষের কোলেস্টেরল লেভেলের মতো, যা জেনেটিক্যালি প্রভাবান্বিত, আবার অনেকাংশেই মানুষের আচার-আচরণ বা লাইফস্টাইল এবং খাদ্যাভ্যাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুখ বিষয়টিও সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি মানুষটির ওপর নির্ভরশীল। একজন ব্যক্তি কী চায়? তার সন্তুষ্টি ও পরিতৃপ্তি কোথায়? সে তার জীবনকে কীভাবে দেখতে চায়? কীভাবে উপভোগ করতে চায় তার উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ সুখও অনেকাংশেই মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অনুভূতি। বাইরের বস্তু , ঘটনা বা চলমান পরিস্থিতি আসলে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এরা মস্তিস্ককে উত্তেজিত করে। মনে আনন্দ বা হতাশার জন্ম দেয়। যেমনঃ ধন-সম্পদ, জয়-পরাজয়, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা, ঘৃণা, মৃত্যু এই জাতীয় সমস্ত উদ্দীপকই আমাদের চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটায় যা চিরন্তন সত্য বা বাস্তবতাকে মেনে নিতে বিঘ্নতা ঘটায়। পৃথিবীর কোন মানুষই দিনের ২৪ ঘন্টা বা জীবনের সবটুকু সময় সুখী থাকে না বা হয় না। সুখী মানুষের জীবনেও হতাশা, দুঃখ-কষ্ট আসে জীবনের নিয়মে। পার্থক্য হল সুখী মানুষরা হতাশা, দুঃখ-কষ্টকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। অন্যরা তা পারে না।
     মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, সুখ দুই প্রকার। যথাঃ ১) হেডোনিক বা স্বল্পমেয়াদী সুখ এবং ২) ইউডাইমোনিক বা দীর্ঘমেয়াদী সুখ। হেডোনিক বা স্বল্পমেয়াদী সুখ হচ্ছে এমন সুখ যা আমোদ-প্রমোদ বা আনন্দদায়ক ঘটনা থেকে পাওয়া যায়। এই ধরণের সুখ আমরা সব সময় চাই। হেডোনিক সুখ স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তা আমাদের জীবনটাকে সুন্দর করে তোলে, উন্নত করে। ভাললাগার  মুহুর্তগুলোকে উপভোগ করার সুযোগ দেয়। ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি করে , জীবনে পরিতৃপ্ত থাকতে শেখায়, নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। তাছাড়া নেতিবাচক অনুভূতি কমানো, চিন্তা ও হতাশা দূর করতেও এই সুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর ইউডাইমোনিক বা দীর্ঘমেয়াদী সুখ হলো কোনো অর্থবহ ঘটনা , অভিজ্ঞতা কিংবা নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য থেকে প্রাপ্ত সুখ। অর্থাৎ সাধনা ও প্রচেষ্টার ফলে অর্জিত সুখই হলো ইউডাইমোনিক বা দীর্ঘমেয়াদী সুখ। আমাদের জীবনে দু’ধরণের সুখেরই প্রয়োজন রয়েছে।
     হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানী ড্যান গিলবার্ট বলেন, তোমার সুখ তোমাকেই সংশ্লেষণ (synthesize) করতে হবে। তোমার শরীরে মনস্তাত্তিক একটা 'ইম্মিউন সিস্টেম' রয়েছে যা তোমার পারিপার্শ্বিকতা বা তোমার বিশ্বকে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করার মাধ্যমে তোমাকে সুখী করে তুলবে। নতুন নতুন কিংবা দামী দামী কাপড়- চোপড় কেনা কিংবা অগাধ টাকা অর্জন জীবনের সব দুঃখ দূর করে দিয়ে অনাবিল আনন্দ ও সুখ বয়ে আনবে, এ ধরণের কল্পনা মানুষের চিন্তা শক্তিকে ভুল পথে পরিচালিত করে।
     এই প্রথিবীতে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি  মানুষ আছে। এই সাড়ে ৭০০ কোটি  মানুষ প্রত্যেকে নিজ নিজ চোখে পৃথিবীকে দেখে থাকে। সবার চোখেই রয়েছে আলাদা আলাদা ফিল্টার। একই ঘটনা এক এক জন এক এক ভাবে দেখে নিজ নিজ ফিল্টার দিয়ে। দেখা গেছে একই জায়গায়, একই পরিস্থিতিতে কেউ সুখ পাচ্ছে আবার কেউ যন্ত্রণায় বিদ্ধ হচ্ছে, কষ্টে তারঁ বুকের ভেতরটা জ্বলছে। এর কারণ আপনার ভিতরের সৃষ্ট জগত। সবাই নিজের মত করে নিজের জগত তৈরী করে। অনেকটা সৌরজগতের মত। সৌরজগতে সুর্য হলো কেন্দ্র বিন্দু। আর মানুষ তার নিজের জগতে নিজেই কেন্দ্র। অন্যরা যাদের সাথে তারঁ সম্পর্ক রয়েছে তারা তারঁ চারপাশে ঘিরে থাকে। মানুষের নিজস্ব এই জগতে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে প্রতিদিন। এর কোন কোনটা ব্যক্তিগত। যেমনঃ পদোন্নতি বা বিয়ে করা। কোনটি আবার নিজের জগতের সবার সাথে ঘটে। যেমনঃ ভাই-বোন বা বন্ধুর চাকুরি প্রাপ্তি, বিয়ে। আর কোনটি অন্য জগতকেও স্পর্শ করে। যেমনঃ নানান দুর্যোগ, মহামারী। এই ঘটনাগুলোকে আমরা আমাদের নিজের জীবনের বই-এর এক একটা পৃষ্ঠার মত মনে করতে পারি। ঘটনাটা টাইটেল হলে, সব ঘটনার নিয়ন্ত্রণ সব সময় আমাদের হাতে থাকে না। কিন্তু নিজ জীবনের পৃষ্ঠার মাঝে কি লিখব বা কিভাবে লিখব তা আমাদের হাতে। অর্থাৎ আমরা একটা ঘটনাকে কিভাবে গ্রহণ করছি তার উপরই নির্ভর করে আমাদের সুখ। 
     আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, মানুষ যতটা সুখী হতে চায়, ততটাই সুখী হতে পারে। সুখের কোনো পরিসীমা নেই। ইচ্ছে করলেই সুখকে আমরা আকাশ অভিসারী করে তুলতে পারি। কেননা আমাদের অন্তর মহলেই তার অবস্থান। নিজের জগতের মাঝে, নিজের বিশ্বাস, বুদ্ধি এবং এক্সপেকটেশন-এর মাঝেই সুখ বিদ্যমান থাকে। তাই নিজের জগতটা এমনভাবে তৈরী করতে হবে যাতে নিজের সুখের চাবি অন্যের কাছে চলে না য়ায়। খুজেঁ বের করতে হবে কি কাজ করলে ভাললাগে এবং কোনটা করলে খারাপ লাগে। যা করতে ভাললাগে তা করলেই হয় যদি না সেটা অন্যায় হয়। আর এই জন্য সুখের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সততা। 
     বর্তমানে মানুষের মন খারাপ থাকার বা সুখে না থাকার অন্যতম কারণ হলো চলমান ঘটনা প্রবাহে আশে-পাশের মানুষের ব্যবহার এবং কটু কথা। আপনি ভাল অথবা খারাপ  যেমনই হোন না কেন মানুষ আপনাকে নিয়ে নানান কথা বলবেই। আপনি সবার মনের মত হতে পারবেন না। কিন্তু আপনি যদি বুঝতে পারেন যে, তারা নিজ নিজ ফিল্টারে আপনাকে দেখছে এবং নিজের হীনমন্যতার জন্য এমন করছে তাহলে তাদের আচরণে কিংবা তাদের কথায় আপনি কষ্ট পাবেন না। বরং আপনার কাছে ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হবে। অন্য একজনের অকারণ আস্ফালন কিংবা নির্বোধ চিন্তা আপনার জগতকে স্পর্শ করবে না। আপনার জগতে যদি ১০০ জন মানুষ থাকে এবং এর মাঝে ৭০ জন আপনাকে সাপোর্ট দেয় তাহলে এটা যথেষ্ট। বাকী ৩০ জনকে  আপনি কোনভাবেই খুশি করতে পারবেন না। কেননা তারা তাদের জগতকে কষ্ট দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। তাদের ভিতরের আনন্দ তারা হারিয়ে ফেরেছে। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন দেখলে তারা সুখ পাবে।
     বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক সুখকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় শরীরই শ্রেষ্ঠতম সুখের আকর। গোলাপের পাপড়ির ওপর লক্ষ বছর শুয়ে থেকে, মধুরতম দ্রাক্ষার সুরা কোটি বছর পান করে , শ্রেষ্ঠতম সঙ্গীত সহস্র বছর উপভোগ করে যতোখানি সুখ পাওয়া যায়, তার চেয়ে অর্বুদগুণ বেশি সুখ মেলে কয়েক মুহুর্ত শরীর মন্থন করে। কিন্তু আমাদের শরীর শুধু রক্ত-মাংসে গড়া কোনো জড়বস্তু নয়। আমাদের আত্মা আছে যা শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবেগ-অনুভূতি আমাদের শরীরের ওপর প্রচন্ড প্রভাব ফেলে থাকে। বস্তু জগতে কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা, মোহ, মাৎসর্য, ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, অপ্রয়োজনে অন্যের দোষ ধরা আমাদের সুখ-শান্তি ধ্বংসের মূল কারণ। আমরা আমাদের সততা, সৎকর্ম, আত্মবিশ্বাস ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি সন্তুষ্টির দ্বারা উক্ত বদগুণগুলো থেকে নিজেদের দূরে রেখে, পজিটিভ চিন্তার মাধ্যমে, অন্যের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা না করে বরং নিজের উপর নির্ভরশীল থেকে এই পার্থিব জীবনেই পরম স্বর্গসুখের স্বাদ লাভ করতে পারি।

তামান্না আফরিন
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।