অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আলো আঁধারের খেলা - খোরশেদ আলম বিপ্লব

পৃথিবীর সব মানুষের একটি ব্যক্তিগত সত্তা থাকে, যা আমারও আছে। বিশেষ মানুষ আর বিশ্ব মানুষ আমার কাছে সবচেয়ে বড় সত্য। পারিবারিক মানুষেরা এই দুইয়ের মাঝখানে একটা বেড়াজাল এর মতই। আমি আল্লাহকে মানি। যুক্তিহীন বিশ্বাসের প্রতি আমার মন কখনো সায় দেয় না। অতীত ও বর্তমানের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতকে সংযত করতে হয়। বর্তমান কাল ছুটছে বলেই স্তব্ধ অতীতের এত মূল্য।
আমার জন্ম তো আমার ইচ্ছাধীন নয়, আমার জীবনের পরিবেশ ইচ্ছাধীন নয়। তবে পৃথিবীর লীলাটা ইচ্ছাধীন কেনইবা হবে? এই বয়সে এসে অনেক কিছু শিখলাম, কত কিছু দেখলাম, শুধু অনুভব করি স্বার্থের শৃংখলে সবই বাঁধা। সেখানে একটু টান পড়লেই কর্কশ শব্দে বেজে উঠবে-জোরের যেখানে ভীত কম -সেখানেই তো মুখের আস্ফালন। সকল প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ ও আত্ম বিকাশের চেষ্টার নামইতো জীবন। উদ্বেগবিহীন প্রচেষ্টায় অনেক বেশি সাফল্য আনতে সক্ষম।
যে মূঢ়তা সরল তার একটা সৌন্দর্য আছে, কিন্তু যে মূঢ়তা কুটিল এবং উদ্ধত্ তাকে সহ্য করা যায় না। মনে নানা প্রশ্ন জাগে-আমাদের জীবন আজ নানা ভাবে বিপর্যস্ত। যেখানে কর্মের সঙ্গে কর্মীর কোন সম্বন্ধ নেই। যেখানে স্বভাবের সঙ্গে কর্মের যোগ বিচ্ছিন্ন-সেখানে সৃষ্টির আনন্দ নেই, মনের মিল নেই। বিরোধ মাত্রই একটি শক্তির ব্যয়। আমার আত্মমর্যাদা বোধে যদি কেউ আঘাত করে তাহলে আমি সেই কাজে এগোতে পারিনা। যেখানে সহায়তা নেই, কৃতজ্ঞতা নেই, মমতা নেই, সেখানে কাজের উৎসাহ ও নেই। রাতের অন্ধকারের একটা সম্মোহনী শক্তি আছে। রাত কত অলীক ভাবনা ভাবায় মানুষকে। আর দিন! বড় কঠিন বাস্তব। বহু সময় আবেগ মানুষের দৃষ্টিকে ও ঘোলাটে করে দেয়।
ধর্মের অন্ধত্বতা, ভূগোলের প্রাদেশিকতা, বর্ণগত উন্নাসিকতা প্রভৃতি সামাজিকতা-এসব সামাজিক পাপ। পরস্পরকে কেবল বিচ্ছিন্ন করছে, শুধু এই নয় পরস্পর বিরোধী করেও তুলছে। যে মানুষ খালি অর্থ কে ভালবাসে, তার অর্থই শুধু বেড়ে চলে। আয়োজনের মাঝেই সময় কেটে যায় উপভোগের সময় তার থাকেনা। অর্থ মানুষকে সৃষ্টির চেয়ে নষ্টই বেশি করে। অর্থকে জীবন্ত রাখতে গেলে ত্যাগের প্রয়োজন। মানুষের ব্যক্তিসত্তা কি বিকৃত, সে আজ কি নিখুঁতভাবে যন্ত্রে পরিণত। বাহিরের অর্থ-সম্পদ অপেক্ষা অন্তরের সম্পদের মূল্য অনেক বেশি, মানুষ একদিন তা বুঝতে পারবে।
ক্ষমতার স্বাদ যারা পায়নি কোন কালে অযোগ্যতা বলে, হঠাৎ ক্ষমতা হাতে পেলে তারা যে স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে এ এমন নতুন কথা কি? সমাজ পাল্টাচ্ছে এক অদ্ভুত বিচিত্র পরিবেশে আজ আমরা এসে দাঁড়িয়েছি। যখন সংসার উত্তাল তরঙ্গে উদ্বেল তখন তারা সেই ঝড়কে না থামিয়ে রাজা-উজিরকে মারছে। বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি- আজকের পৃথিবীর দুরন্ত কর্মচক্রের দুর্বার গতির তাড়নের মাঝে, কি অসাড় হয়ে সুখি মানুষকে অসুখী করার তাড়নায় মেতে উঠছে ওরা। এই নাকি আভিজাত্য এরাই নাকি জগতের কাঠামো।
অন্তরে যখন অসহ্য চঞ্চলতা অনুভব করি পালিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু, পালাবো কোথায় কোলাহল থেকে নির্জনতায়? নির্জনতার একটা শর্ত আছে সে সত্য অলৌকিক সুন্দর। কিছু অসামাজিক মানুষ যারা নিজেরা সুখী হয়নি বলে অপরকে সুখী হতে দেয় না। যারা পরম ও বুঝেনা চরম ও বুঝে না। যুক্তি আর হৃদয় এ দুটো নিয়েই তো মানুষের মন। কিছু মানুষকে দেখি যারা জড়বস্তুর দাস। বস্তুতঃ যাদের চরম আনন্দে দিন কাটে তারা কি ত্যাগ করবে? স্বার্থান্ধ এই পৃথিবীতে বহু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে অনেকেই। বহু অসৎ মানুষকে অন্যেরা ভক্তি ও আরম্ভ করে। বহু মানুষের মৃত্যুর কাছে হার মেনে গেছে খ্যাতি প্রতিষ্ঠা আর অন্যায়ে গড়া প্রতিপত্তি।
জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে মানুষকে ভালোবেসে কিছু করা উচিত। মনের বিশ্বাস মানুষকে সঠিক পথের পৌঁছাতে সহায়তা করে। মনের দ্বারা সমস্ত জগতের সঙ্গে যুক্ত হয় মানুষ। যে অর্থ মিথ্যে দিয়ে জড়িয়ে থাকে সে অর্থে না জড়ানোই উচিত। আমার মনে হয় এটা কলিযুগের প্রায় শেষ অবস্থান। যারা পাপ করে এবং তার ফল এর জন্য তাকে পরজন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগে না এজন্মেই ফল পেয়ে যায়। এমনি করেই এক রাজত্ব যায় অন্য রাজত্ব আসে, বাড়িতে নতুন নতুন নিয়মের উত্থান হয়। মোহে আসক্ত না হয়ে় মুক্তি ঘটাতে হবে। সংসারের ভুল মানদন্ড গুলোকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাওয়া উচিত। যার যত চেতনা তার বেদনা ও তত বেশি। সীমা জানবার আগ্রহ যার, যত বেশি বাঁধা সর্বদায় তার‌ই তত বেশি। ভীড়ের মধ্যে সকলেই সকলকে ঠেলে ধাক্কা খায়- ধাক্কা দেয়, আর তা খেতেই হবে, অসামঞ্জস্য জটিলতা অনিবার্য এই সব জেনেও এগিয়ে যেতে হবে।
যে সত্য আমার কাছে বাইরের জগত কে স্পষ্ট করে তোলে, সেখানে আমি মুক্তির স্বাদ পাই। যে কর্মে, যে প্রার্থনায় নেই কোন জন কল্যাণ, যেখানে মানবতাবোধ অনুপস্থিত আর যাই হোক, সে কর্মকে তো আর নিশ্চয়ই সমর্থন করা যায় না। জগৎ দেখার স্বাদ থাকা উচিত কিন্তু যে জগৎ ভুলে ভরা সে জগতে পা না ফেলাই শ্রেয় এবং আরাধনার ফল ও বটে। প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে চারপাশ অনিয়মের শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে স্বপ্নাহত মানুষ গুলো গুমরে গুমরে কাঁদে। কি নিদারুন তাদের সেই অন্তরকান্নাঁ, দেখা যায় না বাক স্বাধীনতায় ও স্তব্ধতার ছাপ সুস্পষ্ট শুধু মাত্র বুকে বয়ে বেড়ানো ছাড়া আর কিছু নেই। আগত প্রজন্মের কাছে জবাবহীন মুখখানি আড়াল করতে হয় নতমস্তকে। লোভ ক্ষমতার অন্ধ গ্রাসে নিমজ্জিত সমাজের চালিকাশক্তি, মাথাগোঁজার মতো ঠাঁই আর প্রাণখোলা অক্সিজেন নেয়ার মতো বিলুপ্ত সবুজ অভয়ারণ্য। কিভাবে বেঁচে ওঠবে ভবিষ্যত স্বপ্ন গুলো তাহলে কি অপমৃত্যু অনিবার্য?
কিন্তু গোটা জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে কারো কি কোন দায়বদ্ধতা নেই? কিছু মানুষের ভালবাসায় আলো আঁধারের খেলায় পেঁয়াজ বাজারে স্থিতিশীলতা আর ক্যাসিনোর উর্দ্ধমুখী উন্নয়ন ঠেকানো কতটা সম্ভব। যতদিন ঘুমন্ত বিবেক আর মনুষ্যত্ব আদায়ের খর্গটা সঠিক ভাবে জেগে না ওঠবে ততদিন অন্যায়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হবে নিরপরাধ আত্মাগুলো। বৃথা মিথ্যে কথার ঝুরি না দেখিয়ে স্বপ্নকে দিতে হবে অকালে কবর। নতুবা আলোকবর্তিকা হয়ে জাতির কল্যাণে হাল ধরতে হবে সঠিক মাঝিকে যে বৈতরণী পার করে নিয়ে যাবে গন্তব্যে। অনিশ্চিত যাত্রা থেকে নিশ্চয় কূলের দিশা পাবে নিপীড়িত, আর সৃষ্টিকর্তা তার ছায়াতলে আশ্রয় করে দেবেন তার অসীম ভালোবাসা আর সৃষ্টির কল্যাণে।
ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত চারপাশ দেখে হেসে ওঠবে সদ্য প্রস্ফুটিত ভবিষ্যত প্রজন্ম। মমতাময়ীর ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে বেড়াবে,আর  স্বপ্ন বঞ্চিত মা অশ্রু মুছে আকাশ পানে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে চিৎকার করে বলবে- "বাছা আমার তোর হাতে রেখে গেলাম আমার স্বপ্ন আর শেষ প্রার্থনার ইচ্ছে গুলো। যে অবিচার আর অন্যায়ের রোষানলে তোর পুর্ব আত্মাগুলো নির্বাক হয়ে চোখের জলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য চিরতরে চলে গেছে। সেই ইচ্ছে গুলো তোর পদার্পণে শান্তির বার্তা নিয়ে আসবি সব মায়ের কোলে। তবেই আমি মাতৃত্বের স্বাদ আর স্রষ্টার সৃষ্টিতে ওপারে ভালো থাকবো ।
স্রষ্টার সৃষ্টিত্ব না ভুলে আহ্বানে, কর্মে আর প্রার্থনায় জাগিয়ে তুলতে হবে মানবতাবোধ, বিবেক আর মনুষ্যত্বে ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে নিতে হবে পরিবার তথা গোটা সমাজ কে। তবেই মুক্তি, তবেই শান্তি, তবেই সাফল্য, যে সাফল্যে পরপারের দ্বার উম্মুক্ত হয়ে যাবে ঠাঁই পাবার বাসনায় মহান সৃষ্টিকর্তার পদতলে।

খোরশেদ আলম বিপ্লব,
লেখক ও মানবাধিকার কর্মী,
ঢাকা, বাংলাদেশ।