অনুবাদের আলোয় সুমনের গান - অমিতায়ু চক্রবর্তী
সাহিত্যের আধুনিক ধারণা অনুসারে গানকে সাহিত্যের অঙ্গ হিসেবে ভেবে নিতে একটু অস্বস্তি হলেও সুরবর্জিত গান যে কবিতা বৈ আর কিছু নয়, তা অস্বীকার করার উপায় সম্ভবত নেই। আর সেই কবিতা যে সাহিত্যের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা এ বিষয়েও আজ আর কোন সংশয়ের অবকাশ নেই। প্রাচীন কাল থেকেই সাহিত্যের বিশ্বজনীনতার প্রয়োজনে বারবার এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে সাহিত্য। বলা যায়, অনুবাদের মাধ্যমেই সাহিত্য বিশেষ থেকে নির্বিশেষের হয়ে উঠেছে। আর সেই কারণেই সাহিত্যের অনুষঙ্গ হিসেবে গানের অনুবাদ নিয়ে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তার লিরিকই প্রাধান্য পাবে, সুরের প্রসঙ্গ এলেও তা আসবে গৌণরূপে।
কবীর সুমন ১৯৯০ এর দশক থেকে বাংলা জীবনমুখী গানের ধারায় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিপুল প্রভাব নিয়ে আসেন। দীর্ঘদিন চাকরি সূত্রে পাশ্চাত্যে থাকা ও সমসাময়িক বিভিন্ন সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য তাকে ও তার চিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছিল। সেই উদার চিন্তা ও তার অধীত সাঙ্গীতিক জ্ঞানকে কাজ লাগিয়ে সুমন একটি নতুন ধারায় গান লিখতে ও গাইতে আরম্ভ করেন। পাশ্চাত্য ধারার সঙ্গীত ও তাতে জীবন ও যাপনের স্পষ্টতর ছোঁয়া সুমন বাংলা ভাষায় পৌঁছে দেন শ্রোতা মহলে। বলা যেতে পারে পাশ্চাত্য জীবনমুখী গানের আদলে বাঙালি শ্রোতাকে অভ্যস্ত করে তোলেন সুমন। বিশ্ব সঙ্গীতের সঙ্গে বাংলা গানের সাবেকি উঠোনকে জুড়ে দেবার কাজটি অত্যন্ত সুচারু ও সাবলীল ভঙ্গীতে সুমন সমাধা করেছেন।
মূল আলোচনা শুরু করার আগে তাই অবধারিতভাবেই অনুবাদের কয়েকটি অপরিহার্য প্রসঙ্গকে স্মরণ করা প্রয়োজন। ইউরোপীয় মিথ অনুযায়ী, ব্যাবেল টাওয়ার বানানোর সময় ঈশ্বর একদিন প্রত্যেকের ভাষা বদলে দেন যাতে কেউ কারও কথা বুঝতে না পারে এবং ব্যাবেল টাওয়ারের নির্মাণ যাতে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেই দিন থেকেই একে অন্যের ভাষাকে বুঝবার প্রয়োজনে অনুবাদের জন্ম হয়। অনুবাদ নিয়ে ভাবনা চিন্তা অনেক আগে থেকেই শুরু হলেও তা তত্ত্বের আকার ও সম্মান লাভ করে বিংশ শতকের সত্তরের দশক নাগাদ। ইতিহাসের হিসেবে মোটামুটিভাবে এই সময় থেকেই অনুবাদতত্ত্ব বিকাশলাভ করে। অনুবাদতত্ত্ব মূলত অনুবাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধানগুলি নিয়ে আলোচনা করে। এই আলোচনার নিরিখেই সাহিত্যিক অনুবাদ বা literary translation কে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। রোমান ইয়াকবসন অনুবাদকে তার ধর্মের ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করেছেন, যথা- সমভাষিক, ভাষান্তর ও সংরূপান্তর। বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে অনুবাদকে ভাষার গন্ডির বাইরে বের করে এই আলোচনা করেছেন ইয়াকবসন। আবার অনুবাদের মূলানুগত্যের প্রেক্ষিতে অনুবাদের তিনটি মডেলকে সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে মান্যতা দেওয়া হয়েছে যথা- Jerome model, Horace model ও Schlelermacher model।
সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন মনে করা হয় কবিতার অনুবাদকে। কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘a poem cannot be translated, it can only be re-lived in a different atmosphere’ অর্থাৎ কবিতার ক্ষেত্রে যা সম্ভব তা অনুবাদ নয় অনুসৃজন। সেই অনুসৃজন দেশ, কাল ও সময়ের নিক্তিতে কখনও প্রাসঙ্গিক বা গ্রহণযোগ্য হয় আবার কখনও সে তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। মূলের প্রতি আনুগত্যকে স্বীকার করেও যদি অনুবাদ দেশ ও কালের গন্ডি অতিক্রম করে সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে, তবেই তা সার্থক সৃজন। আলোচ্য পাঁচটি গান বা সুরযুক্ত কবিতাকেও এই মাপকাঠিতেই বিশ্লেষণ করা হবে এই আলোচনায়।
সুমন চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৬ই অক্টোবর ওড়িশার কটক শহরে। ছোটবেলা থেকেই গান শেখা ও গান গাওয়া শুরু করলেও তাঁর বাবা চাননি সুমন গানকেই নিজের পেশ হিসেবে বেছে নিন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষায় স্নাতক সুমন ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় ডিপ্লোমা করে কিছুদিন অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্কে চাকরি করার পর ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি গুয়াতেমালায় চলে যান। এরপর প্রায় দু-দফায় (১৯৭৫-১৯৭৯ ও ১৯৮০-১৯৮৬) পাশ্চাত্যের দুটি দেশে (জার্মানি ও আমেরিকা) বেতার সাংবাদিক হিসেবে চাকরি করেন। পরবর্তী জীবনের বহু সাক্ষাৎকারে সুমন বলেছেন ঠিক কিভাবে সত্তর সালের উত্তাল রাজনীতির সঙ্গে সহবাসকালে তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল তাঁর আবাল্য শেখা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। প্রচলিত সংস্কৃতির সঙ্গে সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে মেলাতে না পেরে তাঁর রেডিওতে গান গাওয়া ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন সুমন। ১৯৭৫ সাল নাগাদ ভয়েস অফ জার্মানিতে যোগ দেন সুমন। এই সময়েই তাঁর আলাপ হয় বব ডিলান ও তার গানের সঙ্গে। জীবনমুখী গানের ধারা যা ঐতিহ্যের পরিবর্তে গড়ে ওঠে সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটকে ভিত্তি করে, সেই গান সুমনের গান সংক্রান্ত চিরায়ত ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত করে। ক্রমশই এমন গান বাংলা ভাষায় লিখবার প্রয়োজন অনুভব করতে থাকেন তিনি। এই গান লেখার তাগিদে অনেক সময়েই বিদেশী গায়কের কথা ও সুরকে পাথেয় করেছেন সুমন। তাদের কথাকে তিনি বলেছেন, গেয়েছেন তার নিজের ভাষায়। তাই দেখা যায় ডিলানের গান অনুবাদ করতে গিয়ে সেখানে ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতিকে মিশিয়ে ফেলেছেন সুমন। অনুবাদতত্ত্বের ভাষায় যাকে Domestication বলা হয়, তা বারবার সুমনের এই অনুবাদগুলিতে দেখা যায়। আদর্শের বা বক্তব্যের মূল ভাবটিকে সযত্নে রক্ষা করে, সেই ফ্রেমেই বা সেই চালচিত্রেই সুমন বারবার এঁকেছেন একটি স্বতন্ত্র চিত্র।
১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মত প্রবাস শেষ করে সুমন কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় ফিরে তিনি গান লেখা ও গাওয়ার চেষ্টা করলেও তাতে খুব একটা কৃতকার্য হননি। কেননা জার্মান সংস্কৃতি ডিলানের গানের সঙ্গে পরিচিত হলেও বাঙালি তখনও ততখানি তৈরি হতে পারেনি সুমনের নবলব্ধ জীবনমুখী গানের ধারার সঙ্গে একাত্ম হতে। তাই বছরখানেক কলকাতায় কাটিয়ে ১৯৮০ সালে সুমন আবারও বিদেশে পাড়ি দেন। দ্বিতীয়বারে তার গন্তব্য ছিল আমেরিকা। সেখানে ভয়েস অফ আমেরিকার সিনিয়র জার্নালিস্ট হিসেবে সুমন কাজে যোগ দেন। এখানে থাকাকালীন তিনি পিট সিগার, মায়া এঞ্জেলো প্রমুখ প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তির সাহচর্যে আসেন এবং এতে তাঁর চিন্তাশীলতা ও প্রতিবাদী স্বত্ত্বার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। অনুমান করা যেতে পারে জার্মানিতে সুমন গানের যে নতুন ধারার সন্ধান পেয়েছিলেন, আমেরিকায় থাকাকালীন তিনি সেই নতুনের শিকড়কে খুঁজে পেলেন। তিনি নিজের গানে ঠিক কি চাইছেন এবং কোন পথে তাঁর ভাবনা প্রবাহিত হওয়া উচিত, সে বিষয়ে স্পষ্টতর ধারণা নিয়ে সুমন ১৯৮৯ সালে আমেরিকার চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। এর মধ্যে ১৯৮৫ সালে সুমন নিকারাগুয়ায় স্যান্ডিনিস্টা আন্দোলনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং তৎকালীন নিকারাগুয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রী আর্নেস্ট কার্ডেনালের সঙ্গে পিট সিগারের সৌজন্যে আলাপ হয় সুমনের। তিনি কার্ডেনালের আমন্ত্রণে নিকারাগুয়ায় যান এবং সেখানকার রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে তিনি লেখেন ‘মুক্ত নিকারাগুয়া’। যা মায়া এঞ্জেলো ইংরেজি ভাষায় ছাপতে চাইলেও সুমন তাতে রাজি হননি। এক্ষেত্রে একটি বিষয় বারবার চোখে পড়ে, তা হল, সুমন পাশ্চাত্য ধারার সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হলেও কখনই তাতে সম্পূর্ণ মিশে যেতে চাননি বরং সেই সংস্কৃতির নির্যাসটুকুকে তিনি তার নিজের ভাষায় এনে সেই ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধতর করতে চেয়েছিলেন। তার অনুবাদিত গানের মধ্যেও তার এই চেষ্টা বারবার লক্ষ্য করা যায়। ভাবের ক্ষেত্রে মূলের প্রতি অনুগত থাকলেও সুমন বারবার গানগুলিকে বাংলা ও তার প্রতিবেশের সঙ্গে একাত্ম করে তুলতে চেয়েছেন।
মানুষের যা কিছু আদিম তাই দেশ ও কালকে ছাপিয়ে বিশ্বজনীন হতে পেরেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল প্রেম, দেশ কাল সময় বদলে গেলেও প্রেম বদলায় না। সেই বাসনা, আকাঙ্খা বিশ্বজনীনভাবে এক ও অদ্বিতীয়। সুমনের গানেও এই প্রেম হয়ে উঠেছে তার বিশ্বভ্রমণের বাহন, সারা পৃথিবীকে একসঙ্গে গেঁথে ফেলার সুতো। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এই বাক্যটি পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষায় অনুদিত হয়েছে, কারণ এর আবেদন, এর প্রয়োজনীয়তা সব ভাষায় এক ও অভিন্ন, বা তাকে বলা যায় beyond space and time। এই ভালোবাসাই সুমনের গানে নিহিত করে রাখে সেই উপাদান যা অবলীলায় পৃথিবীর যে কোন একজনের থেকে সবার হয়ে উঠতে পারে দেশ-কাল-সংস্কৃতির দূরত্বকে অস্বীকার করে। সুমন তাই একজন গীতিকার বা অনুবাদকমাত্র নন, যিনি একান্ত পাঠকের প্রয়োজনে সাহিত্যের ভাষান্তর করেন, সুমন সেই সেতুটির মত যা বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গমে আমাদের বাংলার উঠোনকে জুড়ে দিয়েছে। সুমনের অনুবাদ তাই যতখানি শব্দের অনুবাদ, ব্যক্ত-এর অনুবাদ, ঠিক ততখানিই হৃদয়ের অনুবাদ, অব্যক্তের অনুবাদ।
“Blowin’ in the winds” থেকে “কতটা পথ পেরোলে”
২৭ মে, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পায় বব ডিলানের একটি কালজয়ী গান “Blowin’ in the wind”। সুমন চট্টোপাধ্যায় (বর্তমানে কবীর সুমন) এই গানটির একটি বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করেন “কতটা পত পেরোলে তবে পথিক বলা যায়” এই শিরোনামে। এই বাংলা সংস্করণটিকে অনেকেই ডিলানের গানের অনুবাদ বলে দাবি করলেও এই বাংলা গানটিকে বেশ কিছু কারণের জন্যে সরাসরি অনুবাদ না বলে অনুসৃজন বলা যেতে পারে। এই মন্তব্যের কারণগুলি এক্ষেত্রে আলোচনা করা যেতে পারে।
গানের প্রথম লাইনে ডিলান যেখানে লিখেছেন, “How many roads must a man walk down” সেখানেই সুমন লিখেছেন “কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়”। এক্ষত্রে লক্ষণীয় যে সুমন বাংলা গানের ক্ষেত্রে MAN শব্দটিকে পথিক শব্দের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছেন। যেহেতু পথের সঙ্গে পথিক শব্দটি মানুষ শব্দের থেকে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে সুমন word to word translation এর বদলে শব্দের পারস্পরিক সামঞ্জস্য বিধানের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। গানের দ্বিতীয় লাইনে ডিলান যেখানে লিখছেন “How many seas must a white dove sail, before she sleeps in the sand”, সেখানে সুমন পাখির বিশেষ পরিচিতিকে মান্যতা না দিয়ে তাকে শুধু একটি পাখি হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। মনে করা যেতে পারে বাংলার আকাশে সমুদ্রের ওপর থেকে উড়ে যাওয়া হাঁসের ঝাঁকের দৃশ্যটি তেমন সুলভ নয়। আর তাই হাঁসের সমুদ্র অভিযান সুমন পথেই সীমাবদ্ধ রাখলেন তাঁর গানে। এর পরের লাইনে ডিলান লিখেছেন “How many times must the cannon balls fly, before they’re forever banned” সুমন তাঁর বাংলা অনুবাদে এই লাইনটিকে স্থান দেননি বরং সেখানে তিনি লিখেছেন “কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়”। এক্ষত্রে মনে করা যেতে পারে ইচ্ছাকৃত ভাবেই সুমন এই অনুবাদে আমেরিকার Civil War এর প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন, কেননা ভারতের সমাজ তথা রাজনীতিতে আমেরিকার সেই গৃহযুদ্ধের কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েনি। ইংরেজি গানের মধ্যে ধুয়ো বলা যায় যে লাইনটিকে “The answer my friend is blowin’ in the wind”, সুমন এই লাইনটির মূল ভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখে তার গঠন বদলে দিয়েছেন অনেকখানি। তিনি লিখেছেন “প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তা জানা”। বলা বাহুল্য যে এতে বক্তব্যের মূল ভা অক্ষুণ্ণ থাকলেও বক্তার দৃষ্টিভঙ্গীর ও বক্তব্যের লক্ষ্যের একটি বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটছে এক্ষেত্রে।
গানের পরবর্তী অনুচ্ছেদে দেখতে পাওয়া যায় সুমন ভাষান্তর করার সময় Target Language এর স্বকীয় ভঙ্গীকে অত্যন্ত সুচারুভাবে ব্যবহার করেছেন। উদাহরণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে ডিলান যেখানে লিখছেন “How many years can a mountain exist before it’s washed to see”, সেখানে সুমন ভাষান্তরে লিখছেন “কত বছর পাহাড় বাঁচে ভেঙে যাওয়ার আগে”। বস্তুত পাহাড়ের বেঁচে থাকার কাব্যিকতা বাংলা ভাষা ও অনুসৃজকের নিজস্ব কেরামতি। একই কাজ আবারও সুমন করছেন সেই স্তবকের তৃতীয় লাইনে, যেখানে ডিলানের “pretend that he just doesn’t see” সুমনের কলমে বদলে যায় “অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগ”এ। এভাবেই গানটি শুধুমাত্র ভাষান্তর না হয়ে সমভাব অনুসারী একটি পৃথক সৃজন বা অনুসৃজন হয়ে উঠেছে- একথা বলা যেতে পারে।
প্রতিটি ভাষার নিজস্ব কিছু মাধুর্য থাকে। ভাবের বিশেষ প্রকাশ থাকে। একজন দক্ষ অনুবাদক তাই শব্দের সঙ্গে ভাবেরও অনুবাদ করেন এবং কিছুক্ষেত্রে অভিধান মিলিয়ে সমার্থক শব্দের বদলে সমার্থক ভাবের প্রতিস্থাপনে তিনি বেশি যত্নশীল হন। সুমন এই গানটির অনুবাদের ক্ষেত্রেও বারবার এই কাজ করেছেন, তা দেখতে পাওয়া যায়। যেমন গানের শেষ স্তবকে যেখানে ডিলান লিখেছেন “How many ears must one man have” তাকেই সুমন অনুবাদ করতে গিয়ে লিখেছেন, “কতটা কান পাতলে”। বস্তুত কান পাতা সম্পূর্ণভাবেই বাংলার বাক্যরীতি। ইংরেজি ভাষায় কান পাতা জাতীয় কোন শব্দবন্ধ সাধারণত শোনা যায় না। কিন্তু সুমন এক্ষত্রে শব্দের অনুবাদ না করে ভাবের অনুবাদের ওপরেই বেশি গুরুত্ব আরোপ করলেন। তেমনি গানের শেষ লাইনে ডিলান মানুষের মৃত্যুকে সুমন বাংলার একটি আটপৌরে শব্দ “বানের জলে ভেসে” শব্দবন্ধের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করেছেন।
অতঃপর বলা যেতে পারে, ডিলানের ভাবানুসারী এই বাংলা গান, একটি অনুবাদমাত্র নয়, বরং তা একটি স্বতন্ত্র সৃজন যা একটি বিজাতীয় ভাষার গানের ভাবের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি তার দেশ-কাল-সময়কেও স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং একটি বিশ্বজনীন ইতিহাসকে ধারণ করছে। ফলে অনুদিত গানটি আর নির্দিষ্ট দেশ ও কালের বেড়া টপকে অনির্দেশ্য হয়ে উঠছে। তাই একথা বলা যেতে পারে, এই গান ভাষার অনুবাদ কথার অনুবাদ নয়, তা ভাবের অনুবাদ, হৃদয়ের অনুবাদ, সৃষ্টির অনুবাদ তথা অনুসৃজন (Transcreation)।
‘Farewell Angelina’ ও ‘বিদায় পরিচিতা’
Farewell Angelina গানটি বিংশ শতকের অন্যতম জনপ্রিয় গায়িকা Joan Baez এর গলায় মূলত পরিচিতি লাভ করলেও গানটির রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন তাঁরই সতীর্থ ও একসময়ের প্রেমিক বব ডিলান। গানটি মুক্তি পায় ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে। এই গানটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯৭ সালে কবীর সুমন তৈরি করেন ‘বিদায় পরিচিতা’ গানটি। এই গানটি মুক্তি পায় তার ‘জাতিস্মর’ অ্যালবামে। এই গানটির অনুবাদের ক্ষেত্রেও সুমন শব্দের তুলনায় ভাবের ভাষান্তরকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইংরেজি মূল গান ও বাংলা অনুবাদ দুটিতেই স্তবক সংখ্যা ৬। তবে অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেক জায়গাতেই বদলে গিয়েছে গানের অর্থ ও বক্তব্য। বিশ্লেষণ শুরু করার আগেই একটি বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া যাক, গবেষণাপত্রে আলোচ্য পাঁচটি গানের মধ্যে এই গানের অনুবাদেই domestication এর প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্ট। অন্যভাবে বলা যায় আলোচ্য পাঁচটি গানের মধ্যে এই গানটিকেই সুমন সবচেয়ে বেশি দেশীয় সংস্কৃতিতে আত্মীকরণ করেছেন। তাই এই গানের আলোচনা অন্য গানগুলির মত করে করা সম্ভব নয় বা তা করলেও সে বিশ্লেষণ সুখপাঠ্য হবে না। তাই এই গানকে স্তবক অনুসারে ভাগ করে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
গানের প্রথম স্তবক থেকেই এই Domestication এর ছাপ স্পষ্ট। ডিলান যেখানে সমগ্র গান জুড়ে Angelina নাম্নী একটি নারীর প্রসঙ্গ এনেছেন, সুমন তার অনুবাদে এই নারীকে অনির্দিষ্ট করে তুলেছেন। তিনি নামের পরিবর্তে ‘পরিচিতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। Angelina একটি পাশ্চাত্যের নাম, সুমন বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে সেই নারীর একটি বাংলা নাম দিতেই পারতেন তবে মনে হয় তিনি সেই নারীকে কোন অঞ্চলের গন্ডিতে বাঁধতে চাননি। ভালোবাসার আদিম শর্ত যে নারী, তা ভালোবাসার মতই আদিম। তাই সুমন তাকে বিশেষ থেকে ইচ্ছে করেই নির্বিশেষ করে তুলতে চেয়েছেন বলে মনে হয়।
গানের প্রথম স্তবকে ডিলান যেখানে বলেছেন ‘bells of the crown/ are being stolen by bandits’, সেখানে সুমন লিখেছেন, ‘বিদায় পরিচিতা এই বিদায়ের সুর/চুপিচুপি ডাকে দূর বহুদূর’। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে জলদস্যুর আক্রমণে গির্জার ঘন্টা চুরি যাওয়ার দৃশ্যটি বাংলার চেনা প্রতিবেশের পক্ষে বড্ড বেমানান শোনায়। পরবর্তী লাইনে ডিলানের ‘triangle tingles and the trumpets play slow’ সুমনের অনুবাদে বাদ পড়েছে। এর কারণ হিসেবেও আঞ্চলিকতাকেই মনে করা যেতে পারে। প্রথম স্তবকের শেষ লাইনে ডিলান যেখানে লিখেছেন, ‘the sky is on fire’, সুমন তারই অনুবাদ করেছেন ‘আকাশ নিঃসঙ্গ’, এই অনুবাদের কারণ সত্যিই আন্দাজ করা কঠিন। কেননা এই দুটি শব্দের অর্থ অনেকখানিই আলাদা। এই দুটিকে বিকল্প শব্দ বা ক্ষতিপূরক শব্দ কিছুই বলা চলে না।
গানের দ্বিতীয় স্তবকে অনুবাদ অনেকখানিই মূলানুগত। তৃতীয় লাইনে ডিলানের ‘Table standing empty by the edge of the sea’ সুমনের অনুবাদে বদলে হয় ‘জনহীন সৈকতে ওড়ে সিগারেটের ছাই’। অনুবাদে বক্তব্যের এই বদল লক্ষ্য করার মত। মনে করা যেতে পারে ছন্দ, মিল ও কাব্যগুণ রক্ষার অনুরোধেই সুমন এই বদল ঘটিয়েছেন।
গানের তৃতীয় স্তবকের সব অংশেই সুমন Domestication এর স্পষ্ট ছাপ রেখেছেন। jacks and queens, courtyard, fifty two gypsies, deuce and ace প্রভৃতি পাশ্চাত্যের লোকায়ত সংস্কৃতির শব্দগুলিকে সুমন কুশীলব, গোলাম-চোর, ও দেশীয় রাজনৈতিক পালাবদলের প্রসঙ্গে অনুবাদ করেছেন। এই গানটির তৃতীয় স্তবকে সুমন Domestication এর স্পষ্টতর স্বাক্ষর রেখেছেন।
চতুর্থ স্তবকে যুদ্ধবাজের যে উল্লাসের কথা লিখেছেন ডিলান, সুমন তাকেই দেশীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেছেন তার অনুবাদে। সমসাময়িক যুগের যুদ্ধবাদী মনোবৃত্তি ও বৃহত্তর জনগণের তার প্রতি নির্বোধ সমর্থনের যে ছবি ডিলান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এঁকেছেন, তার মূল ভাবটি অবিকৃত রেখে সুমন দেশীয় রঙ তুলিতে একটি ছবি আঁকতে চেয়েছেন।
পঞ্চম স্তবকেও এই domestication এর লক্ষণগুলি বেশ স্পষ্ট। king kong, little elves on the rooftop, valentino-type tangos প্রভৃতি লোকায়ত শব্দগুলিকে সুমন সত্তরের দশকের অতি বাম রাজনীতির প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেছেন। পঞ্চম স্তবকের তৃতীয় লাইনে ডিলান লেখেন, ‘shut the eyes of the dead not to embarrass anyone’, সুমন তার অনুবাদ করেন, ‘খুন হওয়া স্বপ্নের লাশ ঢেকে দেওয়া চাই’। এই অনুবাদ সত্তর দশকের স্মৃতিকেই যেন উসকে দেয়, যা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত ও টানাপোড়েন সুমনকে তার শৈশবের সঙ্গীত শিক্ষার ধারাকে অস্বীকার করতে বাধ্য করে এবং যে অস্থির সময়ের সঙ্গে নিজেকে ও নিজের গানকে মেলাতে না পেরে সুমন সাময়িকভাবে গান গাওয়া বন্ধ করে দেন।
ষষ্ঠ ও অন্তিম স্তবকে সুমন মূল অনুবাদ থেকে সরে এসে ডিলানকে তার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সুমন লেখেন, ‘কি হবে গান লিখে, তবু লিখি গান,/ বয়স হল আমার বুড়ো হলেন ডিলান’। সেখানে মূল গানে ডিলান অন্তিম চরণে অস্ত্রের হুংকারে বিপর্যস্ত জীবনের কথা বলেছেন- ‘the machine guns are roaring, the puppet heave rocks’। অন্তিম স্তবকের শেষে ডিলান যেখানে লেখেন, ‘call me any name you like, I will never deny it’, সুমন তার অনুবাদ করেন, ‘তুমি শোন বা না শোন, শুধু তোমাকে শোনাই’। বলা বাহুল্য যে, দুটি বক্তব্যের অর্থ বেশ খানিকটা আলাদা। মনে করা যেতে পারে, সুমন মিলের অনুরোধে বা কাব্য সৌন্দর্য রক্ষার স্বার্থে লাইনিটির এরকম অনুবাদ করেছেন।
অতঃপর এই অনুবাদ থেকে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, সুমন ডিলানের গানের অনুবাদে গানের মূল ভাবটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে তার সমগ্র খোলনলচে বদলে ফেলেছেন দেশীয় সংস্কৃতির আদলে। এই গানটির অনুবাদে সুমন domestication এর স্পষ্টতর ছাপ রেখেছেন। word to word translation এর বদলে sense to sense translation এ স্বদেশিকরণের মাধ্যমে ডিলানের আঁকা ছবির একটি স্পষ্ট জলছাপে একটি স্বতন্ত্র ছবি এঁকেছেন সুমন।
‘Mr. Tambourine man’ থেকে ‘ও গানওয়ালা’
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত গানওয়ালা অ্যালবামে প্রকাশিত ‘গানওয়ালা’ গানটি বব ডিলানের Mr. Tamoburine man গানটি থেকে অনুপ্রাণিত। এই গানটি আলোচিত বাকি গানগুলির তুলনায় একটু বাড়তি আলোচনার দাবি রাখে এই কারণে যে, এই গানটি বস্তুত তথাকথিত অনুবাদ নয়। সুমন এই গানের মূল ভাবনার ছাঁচ ও মূল গানের সুরটিকে কেবল তার বাংলা গানে ব্যবহার করেছেন। ফলে গানের লাইন ধরে ধরে অনুবাদ এখানে পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায়, তা হলে সামগ্রিক ভাবের অনুবাদ। ডিলান একজন ভবঘুরে ট্যামবুরিন বাজানো লোকের কথা বলেছেন তার গানে, বলেছেন সেই ভবঘুরের জীবন আদর্শের কথা। সেই ভবঘুরে উদাস যন্ত্রশিল্পীর প্রতি ডিলানের মনোভাব খানিকটা রবীন্দ্রনাথের বাউল কবিতাটির সঙ্গে সমভাবাপন্ন। ডিলান সেই উদাস শিল্পীর জীবনকে ঈর্ষা করেছেন তার গানে, চেয়েছেন সেই শিল্পীর জীবনাদর্শকে আত্মস্থ করতে। তিনি চেয়েছেন সেই শিল্পীর সঙ্গে হারিয়ে যেতে অনির্দেশ্যের পথে। চেয়েছেন একসঙ্গে আদিম প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ উপভোগ করতে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য বাউল কবিতার কয়েকটি লাইন, ‘নেবে আমায় সাথে, এসব পন্ডিতেরই হাতে আমায় কেন সবাই মারো!/ ভুলিয়ে দিয়ে পড়া আমায় শেখাও সুরে গড়া, তোমার তালা ভাঙার পাঠ/ আর কিছু না চাই, যেন আকাশখানা পাই আর পালিয়ে যাবার মাঠ’।
সুমন তার বাংলা গানটিতে মূলত ডিলানের গানের প্রথম কয়েকটি লাইনের ভাষান্তরকেই ব্যবহার করেছেন শুধু। বাকি গানের ভাবনা বা বক্তব্য তার নিজের। ট্যাম্বুরিন একটি বিশেষ ধরণের লোকায়ত তালবাদ্য। ভবগুরে জিপসির দলে মূলত এই বাজনার চল রয়েছে। কিন্তু ভারতে জিপসি বা ট্যাম্বুরিন বাজানো ভবঘুরে শিল্পী সুলভ নয়। তাই সুমনের অনুবাদে tambourine man হয়ে যান ‘গানওয়ালা’, কখনও বা ‘বেহালা বাজানো লোকটা’। ডিলানের গানের মূল বক্তব্য যেখানে ভবঘুরে জীবনের প্রতি আকর্ষণ অন্যদিকে সুমন আক্ষেপ করেছেন তার ফেলে আসা ছেলবেলা নিয়ে। দুটি বিষয় বাহ্যত পৃথক হলেও আক্ষেপের সুরে ডিলান আর সুমন কখনও কখনও একাকার হয়ে যান। ডিলান ট্যাম্বুরিন বাদকের কাছে আবদার করেন গানের, কেননা সেই গানের সুরেই তিনি ধরতে চান তার অধরা জীবনকে, একইভাবে সুমনও সেই একই আবদার করেন তার ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি ঝালিয়ে নিতে। দেশ কাল ভাষার বেড়া জাল টপকে একাকার হয়ে যায় সুর, আকুতি আর ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস। ডিলান গেয়ে চলেন, “Hey Mr. Tambourineman, play a song for me,/ I’m not sleepy and there is no place I’m going to...’, প্রত্যুত্তরে সুমন গেয়ে ওঠেন, ‘ও গানওয়ালা, আর একটা গান গাও,/ আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই...’।
Where have all the flowers gone- কোথায় গেল তারা
পীট সিগারের একট কালজয়ী গান “where have all the flowers gone”। সুমন এই গানটিকে অনুবাদ করেন মূলত তিনটি পর্যায়ে। তাঁর নিজের বক্তব্য থেকেই একথা জানা যায়। এই গানের বাংলা অনুবাদ সুমন লেখেন ১৯৬৮ সাল নাগাদ, তাতে সুরারোপ করেন ১৯৯৫ সালে ও গানটি রেকর্ড হয় ২০১১ সালে। গানটি তৈরি হওয়ার এই দীর্ঘসূত্রতার ফলে গানের অনুবাদে বেশ কিছু বিশেষ লক্ষণ প্রতিভাত হয়। এই গানটির অনুবাদের ক্ষেত্রে সুমন মূল গানের বক্তব্যকে অক্ষুণ্ণ রাখলেও সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছেন তার উপস্থাপন ভঙ্গী। ফলত, এই গানের অনুবাদ ও তার বিশ্লেষণ অপেক্ষাকৃত জটিল হয়ে গিয়েছে অন্য গানগুলির তুলনায়। আলোচিত অন্যান্য গানগুলির তুলনায় যেহেতু অনেক পরে প্রকাশিত, তাই এই গানের লিরিক্স, সুর, গায়কী এমনকি যন্ত্রানুষঙ্গকেও অনেক বেশি পরিণত বলে মনে হয়। সিগার তাঁর গানে যে ফুল, যুবতী ও যুবকেরা হারিয়ে গিয়েছে যুদ্ধের কবলে, তাদের খুঁজতে চেয়েছেন আর জনসাধারণের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার আর্তি জানিয়েছেন। সুমন তার অনুবাদে গানটির শুধু যে domestication করেছেন তাই নয়, বরং তার বাচনভঙ্গীতেও এনেছেন অনেকখানি স্বদেশি ছোঁয়া। মূল গানের প্রতি স্তবকের শেষে জনসাধারণের বোধোদয় নিয়ে যে সরাসরি খোঁচা পীট দিয়েছেন, সুমনের গানে সেই শ্লেষ নেই। বরং তাতে আছে একটি একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখবোধ, যা সকলের নয়, তা গায়কের একান্ত নিজের। বলা যেতে পারে পীট তার গানে একটি গৌণ নির্দেশাত্মক ভূমিকা নিয়েছেন, কিন্তু সুমন সমস্ত ঘটনাকে প্রতিস্থাপিত করেছেন নৈর্ব্যক্তিক ও নিরাপদ দূরত্ব থেকে। ফলে গানের বাচ্যে একটি serious change চোখে পড়ে। পীট তার গানটিকে মোট পাঁচটি স্তবকে ভাগ করেছেন। প্রতিটি স্তবকে তিনি একেকটি ভিন্ন কিন্তু পরস্পর সংযুক্ত বস্তুকে পীট খুঁজতে চেয়েছেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এবং প্রতি স্তবকের শেষে ভাববাচ্যে একটি করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন স্রোতাদের উদ্দেশ্যে- “when will they ever learn”, এবং অন্তিম স্তবকে এসে তার প্রশ্ন হয়েছে সরাসরি। সর্বনাম পদটি তাই they থেকে we হয়ে গিয়েছে।
পীটের এই গানের সুর ও বক্তব্যের ধরণে খানিকটা একঘেয়েমি আছে একথা অনস্বীকার্য। সুমন তার অনুবাদে এই একঘেয়েমি রাখলেন না। বরং সুমনের এই গানের মেজাজ বেশ খানিকটা গল্পের মত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই গানে ছেলেদের জঙ্গী পোশাকে সৈন্য হবার কথা লিখেছেন সুমন। যা মূল গানে নেই। মনে করা যেতে পারে, সমসাময়িক নাশকতা মূলক কাজ ও তাতে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের উস্কানি দেখে সুমন এই দুটি ছবিকে সমার্থক বলে মনে করতে পেরেছিলেন। পীট ফুল থেকে শুরু করে যুবতী, যুবক থেকে সৈনিক ও কবরের সন্ধান করে শেষ করেছেন তার গান। অর্থাৎ, তার গানের গতি একমুখী। সুমন তা করেননি। তার বক্তব্য একটি বৃত্তাকার পথে তার পরিক্রমা শেষ করেছে। তাই তিনি যে মেয়েদের কোমল আঙুলের প্রসঙ্গে ফুলের কথা লিখেছিলেন, সেই মেয়েদের চোখের জলেই মিশিয়ে দেন তার নিজের কান্নাকে, তার নিজের হতাশাকে। বস্তুত হয়ে উঠতে চান তাদেরই একজন। পীটের মত জনশিক্ষার বা জনমানসকে জাগিয়ে তোলার দায় সুমন পালন করেননি। তাই তার গান সংলাপধর্মী না হয়ে হয়েছে গল্পধর্মী, কোথাও বা কাব্যধর্মী।
“Dream Variations” থেকে “আমার মত কালো”
সুমন তাঁর গায়ক জীবনে অনেক বিদেশী গায়কের গানের ভাষান্তর করেছেন এবং বাংলা শ্রোতামহলের কাছে তাঁদের নিজের ভাষায় এনে দিয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের জীবনমুখী গানের স্বাদ। যে গানটির দ্বারা এই আলোচনার সমাপ্তি হতে পারে, তা হল ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা’ অ্যালবামের “আমার মত কালো’ গানটি। এই গানটিকে আলোচনার শেষে রাখার অন্যতম কারণ এই গবেষণাপত্র উল্লিখিত বাকি চারটি গান বিদেশী গানের অনুবাদ হলেও এটি একটি কবিতার অনুবাদ, যা তার নিজের ভাষায় গান হিসেবে পরিচিত নয়। গানের লিরিক্স মূলত কবিতা হলেও এই দুই সংরূপের কিছু বিভেদ আছে। যখন একটি গান অনুদিত হয়ে আর একটি গান হয় তখন আর ভাষা বদলে গেলেও তার গায়কী, সুরের ধাঁচ বা শব্দের বা বাক্যের দ্বিত্ব সাধারণত অবিকৃত থাকে। কেননা গীতিকার গানের মধ্যে যে ভাবটিকে অধিকতর পরিস্ফূট করে তুলতে চান, সেই লাইনটিকে তিনি বারবার ব্যবহার করেন। কাজেই অনুবাদেও সেই বিশেষ ভাবের প্রাধান্যটিকে বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। এছাড়াও গানের ধরতাই বা মুখড়া ও অন্তরার যে ভাবগত স্বাতন্ত্র্য তা গানের লিরিক্সে বজায় রাখার একটি দায় থেকে যায় গীতিকারের কিন্তু কইতার ক্ষেত্রে কবির এই ধরণের কোন দায় থাকে না। এই গানটি সুমনের নিজের কথাতেই Langston Hughes এর Dream Variations কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত।
সুমনের অন্যান্য অনুবাদের ক্ষেত্রে একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল শব্দের তুলনায় ভাবের অনুয়াদের ওপরে বেশি গুরুত্ব আরোপ। ভাবের এই প্রাধান্যের কারণে অনেক সময় শব্দের বা বাক্যের approach বদলে দিয়েছেন সুমন। এমনকি শব্দের অর্থেরও আংশিক বদলকে তিনি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এই গানটির ক্ষেত্রে সুমনের অনুবাদকে সেই তুলনায় অনেক বেশি faithful to the source বলে মনে হয়।
গানের শুরুর অংশে সুমনের অনুবাদ একেবারেই মূলানুগত বলে মনে হয়। অন্বয়গত পরিবর্তন ছাড়া আর কোন পরিবর্তন সুমন করেননি। যে কারণেই হয়ত অন্যান্য গানের তুলনায় এই গানের অনুবাদ কিছুক্ষেত্রে খানিকটা ফ্যাকাশে বলে মনে হয়, মনে হয় আর একটু অন্যরকম করে লিখলে তা হয়ত আর একটু সুখপাঠ্য হত। ল্যাংস্টন whirl শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন তার কবিতায়, সুমন এই গানের অনুবাদে তাকে ‘পাক খাওয়া’ বলে অভিহিত করেছেন, এই শব্দ অনেকাংশে মূলানুগত হলেও বাংলা গানটির ভাবের সঙ্গে কোথাও যেন অসঙ্গত বলে বোধ হয়। বাংলা গানের তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনে সুমন মূলানুগত থাকলেও বক্তব্যের ধারার সামান্য বদল ঘটিয়েছেন বলে মনে হয়। ল্যাংস্টন যেখানে লেখেন, ‘then rest at cool evening/beneath a tall tree’, সেখানে সুমন অনুবাদ করেন, ‘শান্ত ধূসর সন্ধ্যে, তন্বী গাছের ছায়াই ভাল’। বোঝা যাচ্ছে যে ল্যাংস্টন যেখানে অনেক বেশি নির্দেশক সেখানে সুমনের বাচনভঙ্গী অনেকখানি নির্লিপ্ত। চতুর্থ ও অষ্টম লাইনে সুমন ‘রাত্রি নামবে’ ও ‘রাত্রি নেমেছে’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন যা বস্তুত কালভেদে একই ক্রিয়াপদের রূপভেদ, কিন্তু ল্যাংস্টন তাঁর কবিতায় সেই দুটি জায়গায় দুটি ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন- প্রথমবারে ‘night comes on gently’ ও দ্বিতীয়বারে ‘night coming tenderly’। খুব সহজেই লক্ষ্যণীয় সুমনের অনুবাদের সঙ্গে মূল কবিতার ক্রিয়ার কাল মিলছে না। এই অমিল যদি সচেতন হয়, তবে সেটি শুধুমাত্র ছন্দ ও মিলের অনুরোধে বলেই মনে করা যেতে পারে।
বাংলা গানটির ষষ্ঠ লাইনে সুমন quick day শব্দটিকে অনুবাদ করে দুরন্ত দিন লিখেছেন। এই বিশেষ শদটিতে বাংলা গানের ক্ষেত্রে আলাদা করে কোন সৌকর্য বা কোন কাব্যিক ব্যঞ্জনা সাধিত হয়েছে বলে মনে হয় না আবার অন্যদিকে ইংরেজি শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবেও শব্দটিকে যথেষ্ট উপযোগী বলা যায় না। ইংরেজি কবিতায় ব্যবহৃত rest শদটিও এই একইভাবে অনুদিত হয়ে ‘শান্ত’ হয়েছে অনুবাদে যার সঠিক বা উপযোগী কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে সুমন অনায়াসেই অন্য কোন প্রতিশদ ব্যবহার করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। ল্যাংস্টন তার কবিতায় কোন exclamatory word ব্যবহার করেননি অথচ সুমন অযাচিতভাবেই ‘আহা’ শদটি ব্যবহার করেছেন গানের সপ্তম লাইনে। এই ব্যবহারের একমাত্র কারণ হতে পারে মিলের বা মাত্রাগত সামঞ্জস্য রক্ষার অনুরোধ, যা হয়ত গান হিসেবে গাওয়া হবে বলেই সুমন এড়িয়ে যেতে পারেননি। গানের শেষ লাইনে সুমন লিখছেন ‘রাত্রি নেমেছে আমার মতই, কালোর চলেছে নাচ’। কবিতায় সেখানে ল্যাংস্টন লিখেছিলেন, ‘night coming tenderly/black like me’। অতএব বোঝা যাচ্ছে যে ‘কালোর চলেছে নাচ’ এই অংশটি মূল কবিতায় নেই, সুমন শুধুমাত্র মিলের অনুরোধ অথবা কালোর জয়ের প্রতীক হিসেবে এই অংশটুকুকে জুড়েছেন তার অনুবাদে। বলা যেতে পারে যে, সুমনের অন্যান্য অনুবাদিত গানের তুলনায় এই গানটির অনুবাদ চরিত্রগতভাবে কিছুটা ভিন্ন যা বস্তুত একটি এক্সপেরিমেন্ট হিসেবেও মনে করা যেতে পারে অথবা একজন শক্তিমান শিল্পীর একটি দুর্বল শিল্পকর্ম হিসেবে।
উপরোক্ত আলোচনা তথা বিশ্লেষণ থেকে একথা বলা যেতে পারে যে, সুমন তার গানের অনুবাদের ক্ষেত্রে শুধু ভাষান্তর করেননি। অনুবাদ করেছেন তার অন্তর্নিহিত সংরূপগত ধর্মকেও। এভাবেই সুমন তার অনুবাদিত গানে শুধু ভাষাকে বদলে ফেলেননি। বদলে ফেলেছেন, তার বিদেশী চলনকেও। সত্যি অর্থেই যেন মনে হয় সুমনের কলমের ও ভাবনার গুণে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণরূপে অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল এই গানগুলিকে। বিদেশী ভাষায় ও প্রতিবেশ রচিত গানগুলি যেন কেমন করে আমাদের ঘরের কথা বলতে শুরু করেছিল। অনুবাদ শুধু ভাষার হয়নি, হয়েছে সংস্কৃতির, হয়েছে ঐতিহ্যের, হয়েছে বোধের। মূলের ছাঁচটুকু অক্ষুণ্ণ রেখে, অনুবাদে domestication এর সফলতর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন সুমন। Sense to Sense অনুবাদ করেও তাকে মূলানুগত করে রাখতে পারা অনুবাদকের পক্ষে বিশেষ কৃতিত্বের। ভাবকে মূল প্রাধান্য দিয়েও কেমন করে অনুদিত গানকেও প্রাণের কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়, এ ব্যাপারে সুমন নিঃসন্দেহে একজন মূল কান্ডারি। অনুবাদের ধারা বা পদ্ধতিগত যতই বিভাজন করা হোক না কেন, প্রয়োজন অনুসারে ফর্মকে ভাঙতে ও নতুন ফর্ম তৈরি করতে পারলেই একমাত্র সফল অনুবাদ করা সম্ভব, এই কথাটিই বারবার স্মরণে আসে কবীর সুমনের অনুবাদিত গানগুলি পড়তে পড়তে। তা গানের ধর্ম থেকেও চ্যুত হয়নি অথচ অনুবাদের ধর্মকেও সে বজায় রাখছে। প্রয়োজন অনুসারে বারবার বদলে গিয়েছে আনুগত্যের প্রাধান্য, মিলেমিধে গিয়েছে নানা ফর্ম। তারপরেও সেই অনুবাদ হয়েছে সুখপাঠ্য। এটিই একজন দক্ষ অনুবাদক ও স্রষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করে কবীর সুমন-কে। (সমাপ্ত)
অমিতায়ু চক্রবর্তী।
৮৫, মানিকডাঙ্গা রোড
ঘোলা, সোদপুর
কলকাতা ৭০০১১১
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
02-08-2020
-
-