মহাদেব সাহার যুদ্ধ, স্বাধীনতা ও স্বদেশ ভাবনা - আবু আফজাল সালেহ
‘...এই বাড়িতে সময় এসে হঠাৎ কেমন থমকে আছে/এই বাড়িটি বাংলাদেশের প্রাণের ভিতর মর্মরিত,/এই বাড়িতে শহীদমিনার, এই বাড়িতে ফেব্রুয়ারি/এই বাড়িটি স্বাধীনতা, এই বাড়িটি বাংলাদেশ/এই বাড়িটি ধলেশ্বরী, এই বাড়িটি পদ্মাতীর/এই বাড়িটি শেখ মুজিবের, এই বাড়িটি বাঙালীর!(সংক্ষেপিত, তোমারবাড়ি, তোমার পায়ের শব্দ)। অসম্ভব সুন্দর, আমাদের অস্তিত্ব ও চেতনাগুলোকে নিয়ে লেখা এমনই একটি কবিতাংশ নিয়ে আলোচনা শুরু করছি। এটা কবি মহাদেব সাহার কবিতাংশ। এ কবিতাটিই তাঁর কবিতাগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করছে বলে মনে করি। এটি কাব্যের ‘তোমারবাড়ি’ নামীয় কবিতা থেকে নেওয়া। যুদ্ধ, স্বাধীনতা, মুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে কলম ধরেছেন কবি মহাদেব সাহা। এরকম কবিতার আধিক্য নিয়ে আজকের আলোচনা। এসব কথা নিয়ে সমৃদ্ধ ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস, এই গৃহ, এই সন্নাস ও তোমার পায়ের শব্দ নামীয় কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো আলোচনায় আনব।
স্বাধীনতা অর্জনই বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় অর্জন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিবেশের বর্ণনাও পায় মহাদেব সাহার কবিতায়। নয়মাস যুদ্ধকালীন রোমহর্ষক বর্ণনা ও পাকিস্থানহানাদারদের বর্বরতার পরিবেশ তুলে ধরেছেন কবিতায়। এমনই একটি কবিতা: ‘কতোদিন কোথাও ফোটে না ফুল, দেখি শুধু/অস্ত্রের উল্লাস/দেখি মার্চপাস্ট, লেফট রাইট, কুচকাওয়াজ;/স্বর্ণচাঁপার বদলে দেখি মাথা উঁচু করে আছে হেলমেট/ফুলের কুঁড়ির কোনো চিহ্ন নেই, গাছের আড়ালে থেকে/উঁকি দেয় চকচকে নল,/...পাতার প্রতীক তাই ভুলে গেছি দেখে দেখে অস্ত্রের মডেল!/খেলনার দোকানগুলিতে একটিও গিটার, পুতুল কিংবা/ফুল পাখি নেই/শিশুদের জন্য শো-কেসে সাজানো শুধু অস্ত্রের সঞ্চার/বাইরেবাতাস শ্বাসদুদ্ধকর, রাজপথে সারি সারি বুট,/সব কিছু চেয়ে আছে অস্ত্রেরই বিশাল ডালপালা;/কোথাও ফোটে না ফুল, কোথাও শুনি না আর/হৃদয়ের ভাষা,/কেবল তাকিয়ে দেখি মার্চপাস্ট, কুচকাওয়াজ, লেফট রাইট/এই রক্তাক্ত মাটিতে আর ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস।’(ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস, ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস)।
আমরা মহাদেব সাহাকে প্রেমের কবি বলি। রোমান্টিজমে ভরপুর তাঁর কবিতাবলিতে। এসবের পাশাপাশি অন্যপিঠে হতাশা নিয়ে লিখেছেন। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট টেনেছেন। সমাজতন্ত্রবাদের ন্যায় সাম্যতায় বিশ্বাসী তিনি। প্রকৃত স্বাধীনতা নিয়েও হতাশ তিনি। আবার স্বাধীনতার যথেচ্ছা ব্যবহার নিয়েও শঙ্কিত। রুশোর মতোই বলতে চেয়েছেন, মানুষ স্বাধীন, তবে সর্বদায় শৃঙখলে বাঁধা। মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা নেই। আমরা স্বাধীনতার আসল স্বাদ নিতে পারিনি বা পাচ্ছি না। অকপটে বলেছেন এসব। স্বাধীনতা শুধুমাত্র ঘোষণায় বা কাগজে কলমে। তিনি বলতে চান, যখন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে তখন বুঝি এ দেশ স্বাধীন। তাছাড়া দৈনন্দিন কাজকর্মে বা পররাষ্ট্রনীতিতে আমাদের স্বাধীনতা খুব কমই প্রয়োগ করতে পারি। এক্ষেত্রে নাগরিক হিসাবে আমরাও কম দায়ী নয়। কবি মহাদেব সাহার কথায় বলি: ‘তোমাকে যাইনি ছেড়ে আম-জাম/কাঁঠালের বন,/অশ্বত্থ-হিজল-বট, ঘুঘু-ডাকা চৈত্রের দুপুর-/এই খেয়াঘাট পার হয়ে কতো আত্মীয়-বান্ধব/চলে গেছে,/এই গাঁয়ের হালট ধরে চলে গেছে নয়াদা/ও রাঙা বৌদি/আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে/কাকিমা ও তার কিশোরী মেয়েটি;/...একুশের বইমেলা, শহীদ মিনার,/পয়লা বৈশাখের বটমূল, রমনার মাঠ-/আমার কতো যে প্রিয় তুমি এই বঙ্গোপসাগর,/করতোয়া, ফুলজোড়, অথই উদাস বির,/পুকুরের শাদা রাজহাঁস,/নিবিড় বটের ছায়া, ঘন বাঁশবন।/...তোমাকে কেমন করে ছেড়ে যাই ধানক্ষেত, মেঠোপথ,/স্বদেশের সবুজ মানচিত্র,/তোমাকে কেমন করে ছেড়ে যাই প্রিয় নদী,/প্রিয় ঘাস, ফুল।’ (তোমাকে যাইনি ছেড়ে)
স্বাধীনতা কথাটি আপেক্ষিক। আপেক্ষিক বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতা। মানুষ স্বাধীন হলেও আদতে মানুষ স্বাধীন নয়। সবসময় শৃঙখলে আবদ্ধ। সবসময় স্বাধীনতা চায়, স্বাধীনতা চায় বলে অস্থির থাকে। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই। তবুও মানুষ চায়। এক্ষেত্রে মানুষ বড়ই অসহায়। কবি মহাদেব সাহাও তাই মনে করেন। উচ্চারণ করেন কবিতার ছত্রে।'ফিরে দাও রাজবংশ' বা 'একেক সময় মানুষ এতো অসহায়' কবিতায় এমনই উচ্চারণ। ‘দূতাবাসে উড়ছে পতাকা/অর্থাৎ স্বাধীন আমরা এ-কথা মানতেই/হয়,রাষ্ট্রীয় সনদ আছে দেশে/দেশে আমরা স্বাধীন;/তবু মনে হয় এ যুগে কোথাও কোনো স্বাধীনতা/নেই, বরং এ যুগে মানুষ যেন/পোষমানা দুর্বল মহিষ,/...তাই কি আমরা এই প্রজাতন্ত্রে এমন বন্দী স্বাধীন?/তাহলে কি আমরা সবাই আজ বাস/করি পাথরের ঘরে... ’(ফিরে দাও রাজবংশ, এই গৃহ এই সন্ন্যাস)
স্বাধীনতাকে প্রেয়সীর মুখ হিসাবেই দেখেছেন মহাদেব সাহা। প্রেয়সী ও স্বাধীনতাকে পরিপূরক হিসাবেই দেখে লিখেছেন, '... তোমাকে ডাকবো আমি নির্লজ্জ গেঁয়োর মতো/সমবেত অগ্রজের মুখোমুখি বসে-/দীর্ঘদিন বলি না প্রেমিকা,/বলি না গোলাপ/... কতদিন তোমাকে আনি না মুখে প্রেম,/প্রিয় স্বাধীনতা, রম্য গোলাপ/যুদ্ধক্ষেত্রে গ্রেনেডের শব্দে, মাইনের মুখর সঙ্গীতে/... যেন প্রিয়ার হাতে রডোডেনড্রনচ্ছ/আজ এ বৎসরের শেষ রবিবারে, যুদ্ধ শেষে/তোমাকে ডাকার স্বাধীনতা/প্রিয়তমা প্রেমিকা আমার!'-(সংক্ষেপিত, তোমাকে ডাকার স্বাধীনতা)। এমন আরও একটি কবিতা: ‘তোমার জন্য জয় করেছি একটি যুদ্ধ/একটি দেশের স্বাধীনতা,/তোমার হাসি, তোমার মুখের শব্দগুলি/সেই নিরালা দূর বিদেশে আমার ছিলো/সঙ্গী এমন,/অস্ত্র কিংবা যুদ্ধজাহাজ ছিলো না তো সেসব কিছুই/ছিলো তোমার ভালোবাসার রাঙা গোলাপ/আমার হাতে/ছিলো তোমার খোঁপা থেকে মধ্যরাতে খুলে নেয়া/ভালোবাসার সবুজ গ্রেনেড, গুপ্ত মাইন/স্বর্ণচাপা কিংবা ছিলো বক্ষ থেকে তুলে নেয়া/তোমার ভালোবাসার দেশে আমি স্বাধীন/পরাক্রান্ত।/আমার কাছে ছিলো তোমার ভালোবাসার নীল অবরোধ/তোমার জন্য জয় করেছি একটি যুদ্ধ/একটি দেশের স্বাধীনতা!’ (তোমার জন্য, তোমার পায়ের শব্দ)
শহরের যানজট নিত্যদিনের সঙ্গী। কলকারখানা থেকে দূষিত উপাদানে বিষাক্ত করছে আমাদের নির্মল পরিবেশ। বায়ু ও অন্যান্য দূষণ হারহামেশায় চলছে। আধুনিক সভ্যতার নামে হতাশাই চলে আসছে বেশি। প্রকৃতিও প্রতিশোধ নিচ্ছে। বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। মহামারি রূপ নিচ্ছে। আমারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাচ্ছি। ফলে প্রকৃতিও প্রতিশোধের সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু নাগরিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। এসব বিষয়েও উঠে এসেছে কবি মহাদেব সাহার কবিতায়। ‘...এই ঢাকা শহর ভীষণ রুক্ষ মনে হয়/কাউকি ডাকলে সাড়া দেয় না, সবাই আমার বিরুদ্ধাচরণ করে/তুমি না থাকলে এই বাড়িঘর শহরের লোকজন/সম্পূর্ণ আমার অপরিচিত মনে হয়/নিজেকেই নিজের অচেনা লাগে/মনে হয় দীর্ঘ দিন থেকে আমি যেন কোনো অজ্ঞাত অসুখে ভুগছি/তুমি না থাকলে বাস্তবিক আমি বড়ো কষ্টে পড়ি/বড়োই কষ্ট হয়।’(তোমাকে ছাড়া, এই গৃহ এই সন্ন্যাস)
দালালী, হিংসা-বিদ্বেষ,হানাহানি প্রভৃতি আজ স্বাভাবিক। ঠক ও প্রতারণা করতে আমরা একটুও ভাবি না। বিবেকবোধ কমে যাচ্ছে দিন দিন।স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে চান কবি। ‘আমার স্বপ্নকে কারা রাত্রিদিন এমন পাহারা দিয়ে ফেরে/মনে হচ্ছে এই একগুচ্ছ স্বপ্নকে নিয়ে তারা অধিক চিন্তিত/শলা-পরামর্শে ব্যস্ত, গেরিলারও চেয়ে বেশি ভীত/আমার স্বপ্নকে নিয়ে তারা;/মাইনেরও চেয়ে বেশি ক্ষতিকর একগুচ্ছ সোনালি স্বপ্নের ডালপালা/তাই তারা সর্বদা শঙ্কিত এই বক্ষলগ্ন স্বর্ণচাঁপাগুলিকে নিয়েই।/তারাও কি জানে এই স্বপ্নগুচ্ছ হয়তো একদা নকশীকাঁথার মতো/দেশজুড়ে আঁকবে একটি নাম,... আমার স্বপ্নের পিছে/লেলিয়ে দিয়েছে এতো সশস্ত্র প্রহরী/বুটের আওয়াজ/...আমার স্বপ্নের মধ্যে কখন ঢুকেছে এই/বিশাল বেদনা/তাই তাকে দিয়েছে ব্যঞ্জনা সেই একটি নামের /স্বপ্নেরও অধিক সেই স্বপ্নভেদী নাম, /স্বপ্ন ভেদ করে আমার হৃদয়ও ভেদ করে সেই মৌন মগ্ন এপিটাফ!’ (স্বপ্নপ্রোথিত সত্তা, তোমার পায়ের শব্দ )
আজীবন প্রেমিক কবি মহাদেব সাহা। তাঁর কবিতায় প্রেম আছে। বিরহও আছে। নান্দনিক সুরে এসব নিয়ে পসরা সাজিয়েছেন কবিতায়। অনেক কবিতার অংশবিশেষ স্বদেশভাবনা নিয়েই। এসবক্ষেত্রে তাঁর উচ্চারণগুলো হয়েছে সাহসী ও রক্তজবার মতো টগবগে। কিন্তু, সাহিত্যের শিল্পগুণ খোয়াননি তিনি। বরং দক্ষতার সাথেই কবিতায় শব্দাবলি সাজিয়েছেন। সবসময় তিনি মুক্তিকামী মানুষের পাশে থেকেছেন। সেটা বাংলাদেশ-কানাডা বা বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের স্বাধীনতা/মুক্তিকামী মানুষই হোক না কেন। এমন একটি উচ্চারণ, ‘আমার এই কবিতা, গোলাপ ও স্বর্ণচাঁপার প্রতি যার/বিশেষ দুর্বলতা ছিলো/যার তন্ময়তা ছিলো পাখি, ফুল ও প্রজাপতির দিকে/সে এখন প্যালেস্টাইনী গেরিলাদের কানে স্বাধীনতার/গান গাইছে;/...যে-হাতে গোলাপ কুড়াতো সেই হাতেই সে এখন/প্যালেস্টাইন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিচ্ছে মেশিনগান,/বুকে বাংলাদেশের নয় কোটি মানুষের উষ্ণ ভালোবাসা নিয়ে/আমার এই কবিতাটি এখন সারারাত জেগে আছে অবরুদ্ধ/গেরিলাদের পাশে।’(স্বাধীন প্যালেস্টাইন তোমার জন্য এই কবিতা, ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস)
মানবতাবোধ জাগ্রত হোক। নির্যাতিত প্যালেস্টাইনবাসীর জন্য প্রায় সব কবি-লেখকই লিখেছেন। মুক্তিকামীদের যৌক্তিক সংগ্রামে সমর্থন ও সাহস যুগিয়েছেন। কবি মহাদেব সাহাও সময়কে এড়িয়ে যেতে পারেননি। সময়কে এড়িয়ে কালোর্ত্তীর্ণ লেখক হওয়া সম্ভব নয়। মুক্তিকামী ফিলিস্তিনবাসীর জন্য শক্ত উচ্চারণ করলেন এভাবে, ‘আমার এই কবিতা, গোলাপ ও স্বর্ণচাঁপার প্রতি যার/বিশেষ দুর্বলতা ছিলো/যার তন্ময়তা ছিলো পাখি, ফুল ও প্রজাপতির দিকে/সে এখন প্যালেস্টাইনী গেরিলাদের কানে স্বাধীনতার/গান গাইছে;/...যে-হাতে গোলাপ কুড়াতো সেই হাতেই সে এখন/প্যালেস্টাইন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিচ্ছে মেশিনগান,/বুকে বাংলাদেশের নয় কোটি মানুষের উষ্ণ ভালোবাসা নিয়ে/আমার এই কবিতাটি এখন সারারাত জেগে আছে অবরুদ্ধ/গেরিলাদের পাশে।’(স্বাধীন প্যালেস্টাইন তোমার জন্য এই কবিতা, ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস)
কবি মহাদেব সাহা সমতা ও সাম্যে বিশ্বাসী। শেখ মুজিবকে নিয়ে সমগ্র বাংলাদেশকেই কল্পনা করেছেন। বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি শেখ মুজিবকেই বিবেচনা করা হয়। আলোচনার শুরুতেই কবিতাংশটি উল্লেখ করেছি। তাছাড়া লেনিন নাম নিয়ে শক্তি সঞ্চার করতে চান। সাহসী উচ্চারণ, ‘লেনিন, এই নাম উচ্চারিত হলে/রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে প্রাণ;/দেখি ভলগা থেকে নেমে আসে মানবিক উৎসধারা/আমাদের বঙ্গোপসাগরে/আমাদের পদ্মা-মেঘনা ছেয়ে যায় প্রাণের বন্যায়;/...তোমার আগে কখনো তা কেউ দেখায়নি, কমরেড লেনিন।/তুমিই প্রথম পৃথিবীর মাটিতে উড়িয়ে দিলে সাম্যের পতাকা/...সেই চিহ্ন সুদুর বাংলায় আজো মানচিত্রের শরীরে ব্যাপক/আরো বহু দেশে মানুষের এই চরম নিগ্রহ;/তাই যখন তোমার দিকে ফিরে চাই কমরেড লেনিন/মনে হয় আর কোনো ভয় নেই-/শোষণের দিন শেষ পৃথিবীতে মেহনতী মানুষ জেগেছে!/লেনিন এনেছে পৃথিবীতে নবযুগ... ’(লেলিন, এইনাম উচ্চারিত হলে, ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস)
'এই গৃহ এই সন্নাস'(১৯৭২) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার পরপরই আলোচনায় আসেন কবি মহাদেব সাহা। স্বাধীনতা পরবর্তী এক কবিপ্রতিভার নাম তিনি। সমাজের আশেপাশের শব্দাবলির প্রয়োগ তাঁকে করেছে জনপ্রিয়। কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার তাঁকে আলাদা করা যায় সহজেই। জীবিত বাঙালি কবিদের মধ্যে তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় ভিন্নধরণের আমেজ। কবির কবিতায় ভিত্তি তৈরি করেছিলেন মূলত ষাট দশকেই। জল, নদী, বৃষ্টি, সমুদ্র, পাহাড়, বৃষ্টিধারাসহ শ্যামল বাংলার রূপের বিভিন্ন উপাদান নিয়েই কবিতার ডালি সাজিয়েছেন। নির্মাণ করছেন কবিতায় শক্ত ভিত। মহাদেব সাহা ১৯৪৪ সালের ৫ আগস্ট পাবনা জেলার ধানঘরা গ্রামে পৈতৃক বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বগদাধর সাহা এবং মাতা বিরাজমোহিনী। কবি মহাদেব সাহার নব্বইয়ের বেশি গ্রন্থ। একত্রে সব গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিছু কবিতার উদাহরণ দিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিলেই বোঝা যায় তাঁর কবিত্ব শক্তি। মহাদেব সাহার উচ্চারণ কুসুমকোমল কিন্তু রক্তজবার মতো সাহসী। তাঁর ঠোঁটকাটা কথাবার্তা। সত্য বলতে কুণ্ঠিত নন তিনি। তুলে ধরেছেন সমাজের বিভিন্ন রূপ; নান্দনিকতার পাশাপাশি কদার্য রূপ। কবিতায় তাঁর ইতিহাসসচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন ঐতিহ্যজ্ঞ্যান পরিলক্ষিত হয়। তার মানে কবি পাঠক হিসাবেও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। পড়তে ভালোবাসেন তিনি। তাই সহজেই ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিভিন্ন অনুসঙ্গ তাঁর কবিতায় ধরা দেয়। আনমনেই ধরা দেয়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সম্মিলনের এমন কবিতা বাঙলাকবিতা সাহিত্যে খুব কমই আছে। কবি মহাদেব সাহা ভালোবাসার চোখে স্বদেশ দেখার চেষ্টা করেছেন। কবি ২০১৬ সালে কানাডাপ্রবাসী হন। কিন্তু স্বদেশের কথা ভুলে যাননি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'কপোতাক্ষ নদ' কবিতার মতোই লিখলেন স্বদেশের কথা। তবে ভিন্নভাবে, প্রেমিকার আয়নায়। 'তোমার দূরত্ব' কবিতায় লিখলেন, ‘তোমার ভালোবাসার দূরত্বের চেয়ে এমন আর কি/দূরত্ব আছে আমার, এমন আর কি/মাইল মাইল দূরত্ব সে তো একখানি মাত্র টিকিটের ব্যবধান/...তুমি ফিরে তাকাতেই আমি দেখতে পাবো ঢাকা এয়ারপোর্টে/চক্কর দিচ্ছে আমার বিমান/হ্যালো বাংলাদেশ! আমার চিরসবুজ বাংলাদেশ!’ (তোমার দূরত্ব, ধূলোমাটির মানুষ)
আবু আফজাল সালেহ। চুয়াডাঙ্গা
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
-
নিবন্ধ // মতামত
-
05-08-2020
-
-