অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ-এর ব্রহ্মসঙ্গীত - ঝন্টু চন্দ্র ওঝা

    বিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অপরিণত বয়স থেকেই ব্রহ্মসঙ্গীত শ্রবণ, গায়ন ও রচনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি তাঁর লৌকিক জীবনের সাধনলব্ধ শ্রেষ্ঠ ধন পরম ব্রহ্মের নামে অকৃপণভাবে উদারচিত্তে উৎসর্গ করেছেন। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘প্রিয়জনে যাহা দিতে পারি তাই দিই দেবতায়’।
     ১২৮৯ বঙ্গাব্দে নবকান্ত চট্টোপাধ্যায় ‘সঙ্গীত সংগ্রহ’ নামক বৃহৎ গীতসংকলনে যখন বিধিবদ্ধভাবে ব্রহ্মসঙ্গীত সংকলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, তখন তিনি ভূমিকায় লিখেছেনঃ ‘ব্রাহ্মধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে বিশুদ্ধ ব্রহ্মসঙ্গীত প্রচারিত হইয়াছে। এইক্ষণ বঙ্গদেশে বোধ হয় এমন পল্লী নাই যেখানে ব্রাহ্মধর্ম প্রতিপাদ্য প্রেমভক্তি ও বৈরাগ্যের উচ্ছ্বাসপূর্ণ দু’একটিও কেহ জানে না। অতএব বঙ্গভূমি এই সম্পদের জন্য ব্রাহ্মসমাজের নিকট ঋণগ্রস্ত। অনেকগুলি ব্রহ্মসঙ্গীত এমন উন্নতভাব ও সুকবিত্বপূর্ণ যে, উহাদিগকে বঙ্গসাহিত্যের কণ্ঠমালা বলিয়া নির্দেশ করিলেও অত্যুক্তি হয় না ।’
  ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ আদি ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত।  রবীন্দ্রনাথের কৈশোর বয়স থেকে ব্রাহ্মসমাজের জন্য রচিত ব্রহ্মসঙ্গীতের তালিকা এই পত্রিকা থেকে মোটামুটি লাভ করা যায়। তারই আলোকে ১২৮৭ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’ পূর্ব অর্থাৎ ১৩১৬ সাল পর্যন্ত মাঘোৎসব উপলক্ষে রচিত বা গীত কিছু  ব্রহ্মসঙ্গীতের নাম উল্লেখ করছি। যেমন-
১২৮৭ ।। ‘তুমি কি গো পিতা আমাদের।
 ওই-যে নেহারি মুখ অতুল স্নেহের।।’
১২৮৯ ।। ‘আজি শুভ দিনে পিতার ভবনে       অমৃত সদনে চলো যাই,
চলো চলো, চলো ভাই।।’
১২৯০ ।। ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে,
 শোনো শোনো পিতা।’
১২৯১ ।। ‘দুয়ারে বসে আছি প্রভু সারাবেলা’
১২৯২ ।। ‘কী গাব আমি কী শুনাব, আজি আনন্দধামে।’
১২৯৩ ।। ‘অনেক দিয়েছ নাথ’
১২৯৪ ।। ‘তোমারই ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী।’
১২৯৮ ।। ‘শূন্যপ্রাণ কাঁদে সদা’
১২৯৯ ।। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’
১৩০০ ।। ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে।’
১৩০১ ।। ‘নিত্য নব সত্য তব।’
১৩০২ ।। ‘পাদপ্রান্তে রাখো সেবকে।’
১৩০৩ ।। ‘কে যায় অমৃতধাম যাত্রী’
১৩০৪ ।। ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’
১৩০৫ ।। ‘পিপাসা হায় নাহি মিটিল’
১৩০৬ ।। ‘আজি প্রণমি তোমারে চলিব নাথ সংসার কাজে।’
১৩০৭ ।। ‘তোমারই রাগিণী জীবনকুঞ্জে’
১৩০৮ ।। ‘আমি কী বলে করিব নিবেদন’
১৩০৯ ।। ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে’
১৩১১ ।। ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে’
১৩১২ ।। ‘ভুবনেশ্বর হে’
১৩১৩ ।। ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’
১৩১৪ ।। ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’
১৩১৫ ।। ‘তুমি নব নব রূপে এসো’
১৩১৬ ।। ‘যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু’

     ১২৮৭ থেকে ১৩১৬ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছেন, সেগুলোর একটি একটি শিরোনাম এই তালিকাতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘রবিচ্ছায়া’(১৮৮৫), ‘গানের বহি ও বাল্মীকি প্রতিভা’(১৮৯৩), ‘কাব্য গ্রন্থাবলী’(১৮৯৬), ‘গান’(১৯০৮) প্রভৃতি সংকলনে পৃথকভাবে ব্রহ্মসঙ্গীতের তালিকা আরও বিপুল।
     উল্লেখ্য যে, ‘রবিচ্ছায়া’-য় ব্রহ্মসঙ্গীতের সংখ্যা ৭৪, ‘গানের বহি’-তে ১৫০, ‘কাব্যগ্রন্থাবলী’-তে ১৬২ এবং হিতবাদী সংস্করণ রবীন্দ্রগ্রন্থাবলী’-তে ব্রহ্মসঙ্গীতের সংখ্যা ১৪৯+১টি । রবীন্দ্রনাথের লেখা মোট গানের সংখ্যা ২২২৫ মতান্তরে ২২৩২ টি। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান কিংবা ব্রহ্মসঙ্গীতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয়শত। এ পর্যায়েই রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে অধিক সংখ্যক গান (ব্রহ্মসঙ্গীত) রচনা করেন।
     রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২- ১৮৩৩) ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে সঙ্গীতকে উপাসনার অঙ্গরূপে ব্যবহার করেন এবং তিনি নিজেই ধর্মসঙ্গীত রচনা করেন। রাজা রামমোহন রায়-এর মৃত্যুর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের হাল ধরে নিরাকার ব্রহ্মের স্তবগীতি রচনায় রবীন্দ্রনাথকে উৎসাহ যোগাতে থাকেন। তাই রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেক বাঙালি সঙ্গীত রচয়িতাই ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেন। তবে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীতের মধ্যেই সুর ও বাণীর রসসম্মত ধারার অপূর্ব সম্মিলন বিশেষভাবে  লক্ষ্য করা যায়।

ঝন্টু চন্দ্র ওঝা
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট,
ঢাকা, বাংলাদেশ