অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
এক বিকেলে - মেহেনাজ পারভীন মেঘলা

জ মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। যতদূর চোখ যায় ফাঁকা রাস্তা। কয়েকটা কাক বিদ্যুতের খুঁটিগুলোর উপর চক্কর মারতে মারতে কা কা করে ডাকছে। নীলার বোন অসুস্থ। তাই নীলা হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। বোনকে ঔষুধ খাইয়ে শুইয়ে  দিয়েছে। বৃষ্টি দেখতে ওর ভালো লাগে। আজ মনটা কেমন যেন করছে। অস্থির লাগছে আর পায়চারি করছে। হঠাৎ একটা ভ্যান দেখতে পেল। হাসপাতালের দিকে আসছে। উপরে নীল পলিথিন দিয়ে ঢাকা একজন শুয়ে আছেন। পা দুটো দেখা যাচ্ছে। পা দুটো ঢাকেনি কেন! গোড়ালি দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। পা-এর পাতার উপরের অংশে ও আঙুলের লোম নেতানো। একজন রেইনকোট পড়া লোক পিছনে মোটরসাইকেলে। লোকটি বলল-এই ভ্যান জরুরী বিভাগের দিকে নিয়ে চলো। এক্সিডেন্ট কেস। নীলা ভাবছে-এই বৃষ্টিতে কার যে এক্সিডেন্ট হলো! কে জানে। ওর গায়ের লোম শিউরে ওঠে। ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না-কেন এতো খারাপ লাগছে!

নীলা ফিরে এলো বোনের কাছে। বোনের চোখ বন্ধ।
-আপু তুই ঘুমোচ্ছিস?
-নাহ্। এমনি চোখটা বুজে আছি। তন্দ্রার মাঝেও একটা বিভৎস স্বপ্ন দেখলাম। মনটা ছটফট করছে। কালকে রিলিজ পেলেই বাঁচি। অসুখ-বিসুখ আর ভাল্ লাগে না।
-স্বপ্নের কথাটা বলতো আপু। আমারও ভালো লাগছে না। বুকটা খাঁ খাঁ করছে। খুব কান্না পাচ্ছে।
-বাদ দে ওসব। নিচে গিয়ে টিউবওয়েল থেকে খাওয়ার পানি নিয়ে আসিস একবার।
-আপু, আজ কে যেন একজন এক্সিডেন্ট করেছে; ভ্যানে করে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেল।
দু'বোনের এভাবেই কেটে যায় সারাদিন। হাসপাতাল থেকে রোগীকে খাবার দেয়া হয়। যারা খাবার দিতে আসে; তাদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলে নীলার সহ খাওয়া কমপ্লিট। দুলাভাই ঢাকায় চাকুরি করে। ছুটি পায়নি। এখনকার দিনের মতো মোবাইল ফোন ছিল না।
সন্ধ্যার দিকে বোতল নিয়ে নীলা নিচে নেমেছে পানি নিতে। আবার দ্যাখে-ভ্যানের ঐ লোককে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। নীলা ভাবছে-লোকটি নিশ্চই মারা গেছেন।

পরের দিন সকালে নীলার চাচাতো ভাই ওদেরকে নিতে এসেছে। রিলিজ নিতে যত ঝামেলা। নিচে গিয়ে অফিসে টাকা জমা দিয়ে; সেই কাগজ উপরে এক রুমে রেখে দিতে হবে। ইন্টার্ণ ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করে দিবে-তারপর বের হয়ে আসা। অনেকটা সময় লাগল।

বাড়ির দিকে আসতে আসতে নীলা দেখতে পাচ্ছে-ওদের আত্মীয় স্বজনেরা ওদের বাড়ির দিকেই আসছে। কাছাকাছি আসতেই দ্যাখে-পাঞ্জাবী, টুপি পরে সবাই বাড়ির দিকে আসছে। নীলা বলল- গুলজার ভাই, কার কি হয়েছে? কেউ কি মারা গেছে? মসজিদ তো ঐদিকে। এদিকে আসছে কেন?
-বাড়িতে চল। আমি কিছু বলতে পারব না বোন।
বাইরে চৌকি, মশারি খাটানো, মৃতদেহ গোসলের সব সরঞ্জাম। লোকে লোকারণ্য। মামী; খালারা এসে গলা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। নীলার মা পাগল ও বেহুঁশ কাঁদতে কাঁদতে। নীলার ভাবী বলল- নীলা তোর ভাই নাইরে বোন! আমার পৃথিবী অন্ধকার! আমার ৯ মাসের কাওছার কাকে বাবা বলে ডাকবে? আমার নাকের ফুল খুলে নিলো! নীলা বাকরুদ্ধ।
এক এক করে সবাই বলছে- গতকাল মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করে ভাইয়া। অপরিচিত একজন  মেডিকেলে নিলে-মেডিকেল ফেরত পাঠায়। নীলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ওরে বাপরে। আমার ভাইকে আমি চিনতে পারি নি। এ কেমন কথা! আল্লাহ কেন এমন হলো?

জীবনে যখন বসন্ত আসে ঠিক তখনই বুঝি মানুষ মরে। জীবনে যখন শীত; তখন লোক মরে না। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে ভাই এই সংসারের হাল ধরেছিল। এইমাত্র চাকুরি পেয়েছে। সুখের মুখ দেখা শুরু; আর তখনি পরপারে চলে গেল।
সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে- আজ হোক আর কাল হোক-একদিন যেতেই হবে সবাইকে। আবেগ অনুভূতির ওপর যুক্তি চলে না। মানুষ চিরকাল কেন বেঁচে থাকে না? অমর হলে কী এমন ক্ষতি হতো?
সমস্ত শূন্যতা আজ জমা হয়েছে ৯ মাসের শিশুর চোখে। ও আদো আদো স্বরে ডাকছে-পাপ পা, পাপ পা, ওঠো।
"টাকা, টাকা, টাকা। খালি টাকাই চিনলি জীবনে" -সবাই বলতাম ভাইয়াকে। ভাইয়া বলতো- পাগলি এসব তোরা বুঝবি না রে। 

মানুষজন বৃষ্টির কারণে দুর্ঘটনাস্থলে ভিড় করতে পারেনি। ফাঁকা রাস্তা। গাড়ি চুরমার। মৃত্যু জিনিসটা এমনই-আচমকা এসে হাজির হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হারিয়ে যায় প্রিয়জন। শত চেষ্টাতেও আটকাতে পারি না। আজ নীলার মনে হচ্ছে- এই পৃথিবী কেউ না বুঝি ওর। তীব্র শোক ছুরির মতো খোঁচা মারছে বুকে।

শান্ত এক বিকেল। নীলা ভাবল-ওর ভাইকে বিদায় জানানোর জন্য অপরূপ সাজে সেজেছে প্রকৃতি। মৃত্যুর আক্রমণটা বড্ড  দ্রুত। একাকী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। প্রাণহীন মুখটা স্নিগ্ধ রুপ ধারণ করেছিল। এর চেয়ে সুন্দর; পবিত্র মুখ আগে কখনও দ্যাখেনি নীলা।

শোকের ছায়া কেটে ওঠা সম্ভব নয় নীলার মায়ের। নীলা গর্ভে থাকতেই স্বামী হারিয়েছে। এক ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে কষ্টের সংসার। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্যের বদলে পেয়েছেন অসম্মান আর তিরস্কার। অপবাদ দিয়েছে অনেকে -স্বামী খাওয়া মহিলা। এখন তো মনে হয় বলবে- ছেলে খাওয়া। অনেক কষ্টে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শিখিয়েছে। ইটের বাড়ি তৈরি করলো। ছেলের চাকুরি নিয়ে কী যে আনন্দ! সুখ সহ্য হলো না কপালে। অভাগা যেদিকে চায়;  সাগর শুকিয়ে যায়। অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে দেখা দিল। এখনো নীলার বিয়ে বাকি। কমবয়সী বউটার কী দশা হবে! চিন্তায় চিন্তায় দিনাতিপাত করছে।

নীলা ভাবছে-ওর অনার্স কমপ্লিট। এখন সংসারের হাল ধরতে হবে। ঢাকায় গেলে হয়তো একটা জব খুঁজে পাবে। পাশাপাশি মাস্টার্স সম্পন্ন করতে পারবে। বাড়ির জমি দিয়ে কোন রকমে চলে যাবে। বিয়ে নিয়ে ভাববার সময় নেই।
বৃষ্টির দিনে নীলার  গান শুনতে ভালো লাগত। এখন বৃষ্টির শব্দে অঝোর ধারায় কাঁদে। বিষন্ন চাঁদের আলো উঁকি মারে খোলা জানালায়। আশারও মৃত্যু হয়েছে । আয়নায় চোখ পড়তেই নীলা নিজেকে চিনতে পারে না। কয় মাসের ব্যবধানে রোগা হয়ে গেছে। এখন আদর করে পাগলি ডাকার কেউ নেই। অভিমান ভাঙার লোক নেই।
বড্ড ছোট এই জীবন। বেঁচে থাকলে সবই লাগে। মরে গেলে এক নিমেষে শেষ।আচমকা একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো নীলার।

মেহেনাজ পারভীন মেঘলা
দিনাজপুর, বাংলাদেশ।