অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
উত্তর-পূর্ব ভারতে রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা - পার্থ প্রতিম হালদার

     বীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা সারা বিশ্ব জুড়ে। সারা ভারত বর্ষ জুড়ে। সারা পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলা জুড়ে। তাই পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলাতে রবীন্দ্রনাথের যতটা জনপ্রিয়তা ততটা জনপ্রিয়তা উত্তর-পূর্ব ভারতেও। রবীন্দ্রনাথের জীবনে শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পাতিসর যতটা প্রভাব ফেলেছিল ঠিক ততটাই প্রভাব ফেলেছে উত্তর-পূর্ব ভারত। অর্থাৎ এভাবে বলা যেতে পারে, পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলার প্রতি রবীন্দ্রনাথের যতটা আন্তরিক টান ছিল ততটাই উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিও ছিল। যাইহোক শুধু রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি টান নিয়ে নয়, তাঁর সাহিত্য, সঙ্গীত, জীবনী সারা বিশ্ব জুড়ে আলোচিত, তিনি সবার কাছে সমান ভাবে সমাদৃত। শুধু তাই নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে, এখানকার মানুষদের ভালোবাসার টানে তিনি ত্রিপুরাতে সাত বার এসেছিলেন। আর আসামে এসেছিলেন দু বার। আরও কয়েক বার আসার ইচ্ছাও ছিলো তাঁর কিন্তু তিনি সময় করতে পারেননি। তবে তিনি সবাইকে সমানভাবে ভালোবেসেছেন। সবার কাছ থেকে অনেক অনেক ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মানও পেয়েছেন।
     তাঁর অনেক নাটক  শিলং, গুয়াহাটি, আগরতলা, শিলচর, করিমগঞ্জ, ডিগবয়, ধুবড়ী, ডিব্রুগড়, কোকড়াঝাড়, নগাঁও, লামডিং, খোয়াই, তেজপুরতে মঞ্চায়িতও হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর 'রক্তকরবী' নাটক উত্তর পূর্ব ভারতে অনেক বার অভিনীত হয়েছে। তবে সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতের মধ্যে শিলংতে 'রক্তকরবী' নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল- শিলং ক্লাবে। অনুষ্ঠিত হয় সন্ধ্যা সাড়ে ছ টায়। শিলচরের গান্ধিমেলাতেও এই নাটকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আবার করিমগঞ্জতেও  একাধিকবার এই নাটকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় করিমগঞ্জের রবীন্দ্র সদন গার্লস কলেজে। এইভাবে রবীন্দ্রনাথের অনেক নাটক উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে অভিনীত হয়েছে।
     সেইসঙ্গে তৎকালীন সময়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা 'সপ্তপর্ণ' তে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, সঙ্গীত ও জীবনী নিয়ে অনেক আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য দেশ বিদেশের বিভিন্ন ভাষাতে যেমন অনূদিত হয়েছে তেমনি উত্তর পূর্ব ভারতের মণিপুরী, অসমিয়া, ককবরক, খাসি, ডিমাসা, গারো, হিন্দী, মিজো, বোডো, মিসিং, আও প্রভৃতি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। বরাক উপত্যকার কামিনী কুমার অধিকারী 'গীতাঞ্জলি'র অনুবাদ করেন দেবনাগরী লিপিতে। সাহিত্যিক নাজমা মুখার্জি অসমিয়া ভাষায় 'শেষের কবিতা' উপন্যাস টি অনুবাদ করেছেন। সাহিত্যিক বিনোদ বিহারী রায় রবীন্দ্রনাথের ৭৮ টি গান খাসি ভাষাতে অনুবাদ করেছেন। হাফলং এর সাহিত্যিক যতীন্দ্রনাথ থাওসেন ডিমাসা ভাষাতে রবীন্দ্রনাথের অনেক গুলো গান অনুবাদ করেছেন। অসমের ধনঞ্জয় রাজকুমার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় রবীন্দ্রনাথের অনেক গুলো কবিতা ও নাটক অনুবাদ করেছেন।
     সব থেকে বড় কথা, আসাম ত্রিপুরার অনেক মানুষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সুসম্পর্কও ছিলো। যেমন ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে তাঁর 'মুকুট' ও 'রাজর্ষি' উপন্যাস পড়লে বোঝা যায় এই উপন্যাসের ঘটনা, স্থান, কাল, চরিত্র সবই ত্রিপুরার রাজ পরিবারকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। আবার ত্রিপুরার নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা ককবরক ভাষায় রবীন্দ্রনাথের 'বলাকা' কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ করেছেন।
     ত্রিপুরার মতো আসাম বা মেঘালয়ের বহু মানুষের সঙ্গেও তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ছিল। এসব দিক থেকে দেখতে গেলে তিনি পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলার মতো উত্তর পূর্ব ভারতেও সমান ভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। তাই তো তিনি আগরতলাতে যখন প্রথম এসেছিলেন তখন তাঁকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল তা ভাবলে এখানকার মানুষের হৃদয়ের টানটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মণিপুরের সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের মণিপুরী নৃত্যের মাধ্যমে কবিকে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। আর এই প্রথমবার মণিপুরী মেয়েদের নৃত্য দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। ত্রিপুরাতে এসে, ত্রিপুরা সুন্দরী বা ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি 'এবার ফিরাও মোরে', 'বিদায় অভিশাপ' রচনা করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর 'পোস্টমাস্টার', 'একরাত্রি', 'শাস্তি' গল্পে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণিত হয়েছে তা ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরই ছবি।
     তিনি বুঝেছিলেন উত্তর পূর্ব ভারতের মানুষেরা তাঁকে হৃদয় দিয়ে আদর করছে। তাই যতবার তিনি উত্তর পূর্ব ভারতে এসেছেন ততবারই তিনি এটা বুঝেছেন যে, তাঁকে সবাই পাগলের মতো ভালোবাসছে, সম্মান করছে, শ্রদ্ধা করছে, অভিবাদন জানাচ্ছে। এটা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেছেন। মুগ্ধ হয়ে গেছেন নতুনত্ব মণিপুরী নৃত্য দেখে। সেইসঙ্গে আবার তাঁর 'রক্তকরবী' নাটক, 'শেষের কবিতা' উপন্যাসেও কিন্তু মেঘালয়ের শিলং এর কথা উঠে এসেছে। তাছাড়া এটা আমরা সবাই জানি মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির মেঘ কবির হৃদয়ে এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে- 'চেরাপুঞ্জি থেকে একখানি মেঘ ধার দিতে পারো গোবি সাহারার বুকে।'  সর্বোপরি তাঁর জীবনের অমর গ্রন্থ সেই 'গীতাঞ্জলি'র ভাবনার পেছনে আসামের কিন্তু বড় অবদান রয়েছে। আবার 'রক্তকরবী' নাটকের নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য কবি আসামের রেবা রায়কে নির্বাচন করেছিলেন। সুতরাং উত্তর পূর্ব ভারতে রবীন্দ্র চর্চা পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলার মতো সমানভাবে যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
     ভাবলে অবাক লাগে রবীন্দ্র চর্চা যাতে আরও বেশি বেশি করে বৃদ্ধি পায় সে জন্য এই উত্তর পূর্ব ভারতে 'রবীন্দ্র পরিষদ' নামে একটা সংস্থাও গড়ে উঠেছিল। এই সংস্থাতে শুধুমাত্র রবীন্দ্র চর্চাই হত- রবীন্দ্রনাথের গান, সাহিত্য,  জীবনী, অভিনয় -এ সমস্ত নিয়েই লেখালিখি চলত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা না বললেই নয়, তা হলো- এই রবীন্দ্র পরিষদ সংস্থার অফিসটি কিন্তু গুয়াহাটিতেই তৈরি হয়েছিল। গুয়াহাটির মানুষেরাও কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। অর্থাৎ এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে উত্তর পূর্ব ভারতের মানুষেরা কতটা রবীন্দ্র প্রেমী। এমনকি রবীন্দ্র গানে মুগ্ধ হয়ে খাসি ভাই রাও পথ চলতে চলতে  গেয়ে  ওঠেন - 'He uba Me aiti la lama ia uta ia bor ban Kit ban ran'  অর্থাৎ 'তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।'

পার্থ প্রতিম হালদার। আসাম