২২ শে শ্রাবণ এলে বাঙ্গালীদের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে – বটু কৃষ্ণ হালদার
একদিকে পূব আকাশের রবি আলো দিয়ে পরিবেশকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে তোলে। অপরদিকে প্রাণের রবি সমগ্র বিশ্বে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। তিনি ছিলেন শৈশবের হাতেখড়ি, শিক্ষাজীবনের পথচলা শুরু। সহজপাঠ বুঝিয়ে ছিলে তুমি শিক্ষাগুরু।
বিশ্বকবি রবি ঠাকুর, আমাদের সবার প্রাণের ঠাকুর। হৃদয় মননের ছবি। তিনি পূব আকাশের সোনালী রঙের ছটা। যুগ যুগ ধরে সাহিত্যের আলোচনায়, নবীন কবিদের কলমে ঝড় ওঠে। সমাজের বুকে কবির মহিমা অন্তহীন দিগ চক্রবাল। সাহিত্যের শুভ চেতনায় রবি ঠাকুরের কবিতা ছন্দ গান, বাঙালির রক্ত শিরায় নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। তিনি সর্বক্ষেত্রে বিশারদ, তিনি আমাদের পথ প্রদর্শক অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। আজও মায়েদের ঘুম পাড়ানি গানে তোমার সুরের ছোঁয়া পাই। হৃদয়ে শক্তিমাখা সে রং তুলি দিয়ে যে স্বপ্ন আঁকা, তিনিই তো সেই প্রাণের ঠাকুর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। ওই দুর আকাশে যখন মিটমিট তারাদের দিকে চেয়ে দেখি, মনটা বড়ই ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, আজ বাইশে শ্রাবণ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জীবনশৈলীতে বিশ্বাসী অসীম সাহিত্যের দার্শনিক। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন জীবন রসের কবি। অসীম সসীমের মিলনকে কবি অনুভব করেছেন। প্রেম ভালোবাসার রূপে, রসে, গন্ধ, স্পর্শে, বিষাদে, সুখ দুঃখে পৃথিবীর তুচ্ছতম ধুলিকনা ও কবির কাছে পরম উপভোগ্য হয়েছে।সবই অভিষিক্ত হয়েছে সৌন্দর্যায়নের উৎসরসে। বিশ্বের অন্তর্নিহিত যার থেকে এই অনন্তময় পৃথিবীর সৃষ্টি, সেই অন্তর্নিহিত সৃষ্টির মূল সত্য কবির মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছিল। বিশ্বে কোনো কিছুর স্থির নেই। সমস্ত বিপুল পরিবর্তনময়। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে অবিরাম। এই অনির্দিষ্ট ছুটে চলা, অনন্ত জীবন প্রবাহের এটাই বিশ্ব সৃষ্টির মূল তত্ত্ব। কবি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ও গভীর ভাবে অনুভব করেছিলেন। বিশ্ববাসির কাছে এক জীবন্ত প্রতিমূর্তির নাম হল রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর। ২২ শে শ্রাবণ দিনটি আজও সমগ্র ভারত তথা বিশ্ববাসির হৃদয়ের মাঝে অক্ষত। এই দিনটির জন্যে প্রতি বছর অপেক্ষা করে থাকি আমরা সবাই কারণ সাহিত্যের পিতাকে স্মরণ করার জন্যে। সেই গৃহবন্দি ছোট্ট রবি, বিশ্ব বরণীয় কবি। সমগ্র বিশ্বের দরবারে এক বিস্ময়কর বাস্তব ধর্মী জীবন্ত প্রতিমূর্তি। তাই তাঁকে স্মরণ করে পঁচিশে বৈশাখ সমগ্র ভারত বর্ষে জন্ম দিনের উৎসব মহা আড়ম্বরের সহিত পালন করা হয়। সমগ্র বিশ্বের দরবারে তিনি এক জীবন্ত আইডল। স্থান, কাল-পাত্র, অলিগলি, রাজপথ, গ্রাম সমগ্র জায়গায় তাঁর অবস্থান। তাই তাঁকে ছাড়া সাহিত্যের ভান্ডার অপূর্ণ। বর্তমানে যারা সাহিত্য নিয়ে চর্চা করেন তার উৎস হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ যুগ যুগ ধরে তাকে নিয়ে গবেষণা হয়ে আসছে এবং আগামী ভবিষ্যতেও হবে। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে গঙ্গা জলে দাঁড়িয়ে গঙ্গা পূজা করা, নিজের সাহিত্যের আত্মlকে শুদ্ধ করে নেওয়া। এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে যেমন মাপা যায় না সমুদ্রের গভীরতা তেমনি কার সাধ্য আছে তাঁকে বিশ্লেষণ করার। যদি পাহাড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াও নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয় ঠিক তেমনই সাহিত্য তথা সমাজ দর্শনে তিনি এক জাগতিক মাহীরুহ, তার মহিমাত্ব কখনও মাপা যায় না। ব্যস্ত সময় একে একে ফিরে যায় গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, আসে বসন্ত, ঝরাপাতা ডাক দিয়ে যায় আগামীর নব কল্লোলের, রবীন্দ্র সম্ভারের বিশ্বচর্চিত বন্দনায় তাঁর স্মরণে স্বরচিত কবিতা, গান, নাটক, ছড়া, গীতিআলেক্ষ্য, গল্প ভরিয়ে দেবে লাল পলাশের সামাজিক বন্দনায়। তিনি ছিলেন বঙ্গতনয়ার গর্ব। মা সরস্বতীর কৃপায় ভরে উঠেছিল তার সাহিত্যের অঙ্গন। তিনি ছিলেন দেশগৌরব শ্রেষ্ঠ কলম সৈনিক। জাগতিক সমগ্র ধারা তার কলমের রেখায় ফুটে উঠেছিল। তিনি বঙ্গবিশ্বের বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরোবরের তাজা পদ্ম হয়ে উনিশ শতকের দোর গোড়ায় এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যের রেনেসাঁস। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যর মিলন ঘটিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন সাহিত্যের দরবার। দেশ তখন পরাধীন। ব্রিটিশদের পায়ে পদদলিত ভারতবাসি স্বাধীনতা পাওয়ার লক্ষে অবিচল। পরাধীনতার বন্ধন থেকে দেশমায়ের মুক্তি ঘটাতে মিটিং, মিছিলে ব্যস্ত সন্তানরা। যে কোনো মূল্যে এমন কি দেশের জন্যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে বদ্ধ পরিকর সবাই। একে একে বীর সন্তানেরা ফাঁসির মঞ্চে গাইছে জীবনের শেষ জয়গান। সেই সময়ে তিনিও বসে থাকেননি হাত গুটিয়ে। জনগণকে উৎসাহ দিতে গর্জে ওঠে তার কলম। দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে কলমের খোঁচায় তুষের আগুনকে খুঁচিয়ে দিয়ে লিখেছেন অগণিত দেশত্ব বোধকগান, কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি। শহীদ ভাইদের স্মরণে তাঁর কলম অবিরত চলেছিল। সর্বদা অবিচল ছিলেন আন্দোলনের লক্ষতে। অনেক আন্দোলনে তিনি সামিল হয়েছেন। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বাংলা বিভাজনের প্রয়াস ব্যর্থ করতে তিনি সামিল হয়েছিলেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে। তিনি হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মিলন ঘটাতে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করেন। দিয়ে গেছেন সম্প্রতির মেলবন্ধন এর বার্তা ।১৯১৯ সালে বিশেষ করে জালীয়ানওয়ালাবাগে বর্বর হত্যাকান্ডের নায়ক জেনারেল ডায়ারের তীব্র নিন্দা করেন এবং সেই সঙ্গে ব্রিটিশদের থেকে প্রাপ্ত নাইট উপাধি ত্যাগ করেন লর্ড চেমসফোর্ডকে তিনি বলেন যে, "আমার এই প্রতিবাদ, আমার আতঙ্কিত দেশবাসির মৌন যন্ত্রণার অভিব্যক্তি"। এর থেকে বোঝা যায় তিনি কত না দেশকে ভালোবাসতেন। তিনি শুধু কলম দিয়ে নয় মন প্রাণ দিয়ে দেশকে সেবা করেছেন। তিনি একদিকে দেশপ্রেম আর অন্যদিকে সাহিত্য চর্চায় নিজেকে মোহিত করা দুটোকেই সমান তালে চালিয়ে নিয়ে গেছেন। সাহিত্য দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন সমগ্র বিশ্বে। তিনি বিশ্ব জোতিরময়ের অগ্নি বলয়। জীবন্ত প্রতিমূর্তি, যুগ যুগ ধরে জাজল্যমান। বিশ্বকবি তাঁর অমূল্য সৃষ্টি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ লিখে পেয়েছিলেন বিশ্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল ১৯১৩ সালে। বিদগ্ধ এশিয়ায় সর্বপ্রথম এই বিশ্ব সম্মানে ভূষিত হয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি তথা ভারতকে বিশ্বের দরবারে এক আলাদা স্বাক্ষর রেখে যান। আজও কখনো কখনো গুণগুণ করে হৃদয়ের আলক্ষতে গেয়ে ওঠে আমার ও পরান যাহা চায়, তুমি তাই, তাই গো। কোনো অনুষ্ঠান বাড়ি, পূজা পাণ্ডেল, এ দূর হতে দূর অন্তরে আমরা তার সুরের ছোঁয়া পাই। তার সৃষ্টিধারা মধুরিত হয় আকাশ বাতাস। কোনো সাহিত্য চর্চা অনুষ্ঠান এ আমরা তাঁর আলোচনা দিয়ে শুরু ও শেষ করি। যারা এই সময় সাহিত্য চর্চা করেন তার অমৃত ধারা পান করে শুদ্ধ হই মাত্র। তিনি জাগতিক সাহিত্য ধারার সৃষ্টিকর্তা তাই তাঁকে স্মরণ না করলে, সাহিত্যের আসর কখনো ও পূর্ণ হবার নয়। ছোট্ট শিশুর ঘুম পাড়ানিয়া গানে মায়ের সুরে তাঁর ছোঁয়া। বিশেষ করে একটি বিনি সুতোর মালায় গাঁ, শহর, অলি, গলি, রাজপথকে বাঁধার যে প্রয়াস তিনি করেছিলেন, সে দিক থেকে তাঁর প্রয়াস সার্থক। তাই তিনি যুগ যুগ ধরে বেঁচে আছেন, এবং থাকবেন সমগ্র বিশ্ববাসির হৃদয়ে। রবি ঠাকুর শুধুমাত্র সাহিত্যের ধারক ছিলেন না, ছিলেন দেশের প্রতি কর্তব্য বিমূড় সুচিন্তিত রাজনীতিবিদ। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ধারা ছিল অত্যন্ত জটিল। তিনি সর্বদা সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত "মানসী" কাব্যগ্রন্থতে কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু _জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় তথ্য প্রমাণ ও পরবর্তী কালের বিভিন্ন বিবরণ থেকে জানা যায় তিনি গদর ষড়যন্ত্রর কথা শুধু জানতেন না বরং এই ষড়যন্ত্র তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর এর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। অন্যদিকে ১৯২৫ সালে একটি গ্রন্থে স্বদেশী আন্দোলনকে "চরকা" সংস্কৃতি বলে বিদ্রুপ করে রবি ঠাকুর এর কঠোর বিরোধিতা করেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদকে ঘৃণা করতেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার চোখে ছিল "আমাদের সামাজিক সমস্যা গুলির উপসর্গ"। এই কারণে বৈকল্পিক ব্যখ্যা হিসাবে তিনি বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির উপর গভীরভাবে আলোকপাত করেন। তিনি অন্ধ বিপ্লবকে বিশ্বাস করতেন না। বাস্তবসম্মত উপযোগী মূলক শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহবান জানান। তাঁর এই ধরণের রাজনৈতিক মতবাদে অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোর একটি হোটেলে অবস্থান কালে একদল ভারতীয় চরমপন্থী রবি ঠাকুরকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে উজ্জীবিত করার জন্য লিখেছেন অগনিত গান ও কবিতা, নাটক ইত্যাদি। তাঁর কবিতা "চিত্ত যেথা ভয় শূন্য" ও গান "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে" রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে টনিক হিসাবে কাজ করেছিল। একলা চলো রে গানটি বাপুজির খুব প্রিয় ছিল। গানটির আক্ষরিক অর্থের সঙ্গে মানব জীবনের অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সত্যই একা এই পৃথিবীতে আগমন ও একা একা ফিরে যাওয়া তবু ও এই বিশ্বের দরবারে আমার আমিত্ব সংজ্ঞায় ভাই ঝরায় ভাইয়ের রক্ত বা সন্তান ঝরায় পিতা-মাতার রক্ত। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কবির ছিল মধুর সম্পর্ক। দলিত সম্প্রদায় দের জন্যে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে মহাত্মা গাঁধী ও ড: বি. আর. আমবেদকরের মধ্যে যে বিরোধের সূত্রপাত হয় তার সমাধানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। গান্ধী তাঁর আ _মরণ অনশন প্রত্যাহার করে নেন। স্বদেশ প্রেমে তিনি মোহিত ছিলেন কারণ দেশের উন্নতি কল্পনায় সর্বদাই উন্নত শীল চিন্তা করতেন। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় আনতে চেয়েছিলেন আমূল পরিবর্তন। তিনি বুঝেছি লেন যে একমাত্র শিক্ষার আলোয় অন্ধ কুসংস্কারছন্ন ভারতের মুক্তির পথ লুকিয়ে আছে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিলিয়ে দিয়ে নতুন শিক্ষার অঙ্গন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। আধুনিক চিন্তাধারায় সমাজকে সাজাতে চেয়েছিলেন। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠবে আধুনিক ভারতের সমাজ ব্যবস্থা, এই রাস্তায় আসবে প্রকৃত বিপ্লব, পাল্টাবে বস্তা পচা ধ্যান ধারণা, আসবে উন্নতির জোয়ার তাই জ্ঞানের আলোয় সমাজকে আলোকিত না করলে থমকে যাবে উন্নত সমাজ ব্যবস্থার ধারা। আর উন্নত সমাজ না গঠন হলে গড়ে উঠবে না উন্নত দেশ। উন্নত দেশগড়ার মানচিত্র থেকে যাবে খাঁচায় বন্ধী পাখির মত, শুধুই ডানা ঝাপটাবে কিন্তু অসীম আনন্দের দিশা খুঁজে পাবে না। ১৯১৭ সালের ১১ই অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সানটা বারবারা ভ্রমণের কালে এই চিন্তা ধারার ফলশ্রুতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক নতুন ধরণের বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করেন। তাঁর হাতে গড়া শান্তিনিকেতনের আশ্রমটিকে দেশ ও ভূগোল এর গণ্ডির বাইরে ভারত ও বিশ্বকে এক সূত্রধারায় বিশ্ব পাঠকেন্দ্রতে পরিনত করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। এক কথায় তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে এক ধারায় আনতে চেয়েছিলেন। অবশেষে ১৯১৮ সালের ২২শে অক্টোবর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাস করেন। ১৯২২ সালের ২২শে ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়েরর। তিনি নিজে কঠিন পরিশ্রম করে অর্থ জোগাড় করেছেন শুধু মাত্র দেশের মানুষকে সু চিন্তায়, সু শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে বলে। তিনি পেয়েছিলেন বিশ্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল গীতাঞ্জলি কাব্য গ্রন্থের জন্য সেই পুরস্কার এর অর্থ মূল্য ও ব্যয় করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত একাধিক বার ইউরোপ ও আমেরিকায় গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে অর্থ জোগাড় করতে। তিনি একধারে মহান ব্যক্তিত্ব অন্যদিকে সাহিত্যের দরবার। ভারতের সক্রিয় রাজনীতিতে তিনি নিজেকে যুক্ত না করলেও অনেক খানি ভূমিকা পালন করেছিলেন কারণ সমসাময়িক কিছু কিছু ঘটনা গুলি (বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলন, জালীয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ইত্যাদি) থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেনি বরং তিনি ছিলেন স্বদেশীকতার বরেন্য পুরুষ। ১৮৯৬ সালে কলকাতায় যে কংগ্রেস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে "বন্দে _মাতরম" গানটি রবি ঠাকুর উদ্বোধন করেন। মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর শিবাজি উৎসব পালন করেন তার অনুপ্রেরণায় তিনি লিখেছেন বিখ্যাত কবিতা "শিবাজী উৎসব"। তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জন দেশের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন আনতে চেয়ে বাংলাকে দুই ভাগ করতে চেয়েছিলেন তার প্রতিবাদে তিনি রাস্তায় নেমে পড়েন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন গড়ে তুলতে তিনি "রাখিবন্ধন" উৎসব চালু করেন। আজও সেই উৎসব যুগের পর যুগ পালন করা হয় সম্প্রীতির মেলবন্ধন হিসাবে। এই উৎসবকে স্মরণীয় করার জন্য রচনা করেন গান "বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পূন্য হউক, পূন্য হউ ক, পূন্য হউক হে ভগবান"। তিনি শিলাইদহে বসবাস কালীন দরিদ্র প্রজাদের জন্যে চালু করেন শিক্ষা, চিকিৎসা, পানীয় জল সরবরাহ, সড়ক নির্মাণ ব্যবস্থা, ঋণের দায় থেকে কৃষক দের মুক্তি দান, সহ বিভিন্ন সমাজ সেবা মূলক কাজ। তাই তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন সবার হৃদয়ের মাঝে যুগ যুগ ধরে। তিনি স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন কালে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে কখনো সমর্থন করেননি। একদিকে ভারতের জাতীয় প্রকৃতি ও তার ইতিহাসের ধারা কবির কাছে হয়ে ওঠে গভীর অর্থবহ আর অন্য দিকে আধ্যাত্মিক ভাবনায় তাঁর চিত্ত ধাবিত হয় রূপ। জীবনের পর্বে পর্বে তাঁর জীবন জিজ্ঞাসা ও সাহিত্য দর্শনের পরিক্রম ঘটেছে. যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ঘটেছে কবি সব কিছু কেই আত্মত্ব করেছেন গভীর অবলীলায় ক্রমাগত নিরীক্ষায় এবং বিশ্ব পরিক্রমার মধ্য দিয়ে। এই পরীক্ষা, নিরীক্ষার ফসল তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, ছড়া, ছোট গল্প, গল্প, উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, ভ্রমণ কাহিনী, চিঠি পত্র, এবং দেশ বিদেশে বক্তৃতা মালা। তাঁর অন্তনিহিত জীবনবোধ ছিল স্থির এবং বস্তু পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিয়ে আপন আদর্শতে প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে তাঁর সৃজনশীল রূপটি ছিল চলিষ্ণু ও পরিবর্তনশীল। তিনি কালের নয় ছিলেন কালজয়ী বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আবির্ভাব ছিল যুগান্তর।
"যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাই বো না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে গো" কবিগুরুর পায়ের চিহ্ন না রইলেও তার রচনায় ভর করে খেয়াতরী আজ ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে বিশ্বের প্রতিটি কোনায়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ঘড়িতে তখন বাইশে শ্রাবণ এর বেলা ১২ টা বেজে ১০ মিনিট প্রাণের কবি রবি ঠাকুর আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন। জাগতিক নিয়মের কাছে হার মেনে ছিল নশ্বর দেহ। কিন্তু তিনি আজও আমাদের কাছে চির জীবিত। অসামান্য রচনাশৈলীর মধ্যে দিয়ে সমগ্র বিশ্বে বেঁচে আছেন। তিনি আজও আমাদের কাছে পথপ্রদর্শক, প্রেরণাদাতা। রবি ঠাকুর আমাদের মন মানসিকতা গঠনের চেতনার উন্মেষ এর প্রধান অবলম্বন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যের জগতে এক যুগান্তকারী রেনেসাঁস নেমে আসেন তার হাত ধরে। মহাকালের চেনাপথ ধরে প্রতিবছর বাইশে শ্রাবণ আসে। এই বাইশে শ্রাবণ দিনটি বিশ্বব্যাপী রবি ঠাকুরের ভক্তদের কাছে এক চরম শূন্যতার দিন। বাঙালি জাতিসত্তা, এবং বাংলা সাহিত্যের বিশাল একটি অংশ যে পথের সন্ধান করেছিল সেই পথ লীন হয়েছিল এই দিন। রবীন্দ্র কাব্যে বার বার মৃত্যু ফিরে এসেছে বিভিন্নভাবে। তিনিও সেই সত্যের পথ ধরে অভিযাত্রী হয়েছেন। তাইতো কাব্য কবিতায় তিনি মৃত্যুকে বর্ণনা করেছেন এই ভাবে_ "মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান। মেঘ বরন তুঝ, মেঘ জটা জুট। রক্ত কমল কর, রক্ত_অধ র পুট, তাপ বিমোচন, করুন কোর তব মৃত্যু অমৃত করে দান"। জীবনের শেষ নববর্ষের সময় কবিগুরু ছিলেন সাধের শান্তিনিকেতনে। সে সময় তাঁর কলমে রচিত হয়েছিল "সভ্যতার সংকট" নামের অমূল্য লেখা টি। ১৯৪১ সালের ১৩মে রোগশয্যায় শুয়েই লিখলেন "আমারই জন্মদিন মাঝে আমি হারা"।
বটু কৃষ্ণ হালদার। কবর ডাঙ্গা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
07-08-2020
-
-