অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
বাঙালির নিষ্ঠুরতম মাস আগস্ট - এস ডি সুব্রত

জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে- মুজিবর্ষে বছর ঘুরে ফিরে আসল আগস্ট মাস। বাঙালির হৃদয় হু হু করে উঠে বেদনায়। বাঙালির ইতিহাসে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমা লিপ্ত এই আগস্ট মাস।  এক ভয়ংকর শোকের মাস আগস্ট। আগস্টের আগমনে দূঃসহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায়। প্রতি বছর এক বুক বেদনা আর শোকের স্মৃতি নিয়ে আমাদের কাছে হাজির হয় আগস্ট মাস। কিছু সুখ কিছু দূঃখ  কিছু আনন্দ কিছু বেদনা প্রতি মাসেই থাকে। কিন্তু আগস্ট বড় বেদনার এক অশ্রুগাঁথা মাস। আগস্ট এলে  বাঙালি শোকে ম্যুহমান হয়, পাথর হয়। আগস্ট মাসে যেন বাঙালির ভাগ্যাকাশে নেমে আসে দূর্যোগের ঘনঘটা। বাংলাদেশের মানচিত্রে পড়ে শোকের গাঢ় ছায়া। বাঙালির সমস্ত হদয় জুড়ে আছরে পড়ে উত্তাল তীর ভাঙা ঢেউ। এ মাসে আমরা হারিয়েছি জাতির পিতাকে পরিবার ও স্বজনসহ। এ মাসে হারিয়েছি নোবেলজয়ী বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুরকে, হারিয়েছি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। এ মাসে হারিয়েছি বাংলা কবিতার কিংবদন্তী কবি শামসুর রাহমানকে, হারিয়েছি কবি শহীদ কাদরীকে, হারিয়েছি শক্তিশালী লেখক ডঃ হুমায়ুন আজাদকে। এ মাসে প্রাণ হারিয়েছেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক মিশুক মুনীর। কবি টি এস এলিয়টের কাছে নিষ্ঠুরতম মাস ছিল এপ্রিল। আর বাঙালিদের কাছে নিষ্ঠুরতম মাস হচ্ছে আগস্ট মাস।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুটা আর সবার চেয়ে আলাদা, অন্যরকম, বড় বেদনার, বড় কষ্টের। বঙ্গবন্ধু মৃত্যু বরন করেননি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। যার কারনে আমরা পেয়েছি একটি নতুন দেশ, পেয়েছি লাল সবুজের কাঙ্ক্ষিত পতাকা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছে এদেশের ষড়যন্ত্র কারীদের রোষানলে পড়ে। 

শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অকুতোভয় এক বীর সেনানী। ছিলেন নৈতিকভাবে প্রচন্ড বিশ্বাসী, নীতিতে ছিলেন অটল। কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন- "আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।" নিজের লক্ষে অবিচল আস্থা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। মৃত্যুকে তিনি কোনদিন ভয় পাননি। ভয় পাননি জেল জুলুমকে। নিজের কথা, পরিবার পরিজনের কথা ভাবেননি। ভেবেছিলেন শুধু দেশের কথা।

ষাটের দশকে সাড়া দেশ জুড়ে বেড়িয়েছেন। দেশের মানুষকে বুঝিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের কথা। বুঝিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষন বঞ্চনার কথা। একেকটা জনসভা শেষে হলে তাকে গ্রেফতার করা হতো। জেল থেকে বেরিয়ে আবার জনসভায় যোগ দিতেন। আবার গ্রেপ্তার হতেন। কখনো দেখা যেতো জেল থেকে বের হয়ে জেলগেটেই জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তার ফাঁসি হতে পারতো। ১৯৭১ সালে তার ফাঁসি হতে পারতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো মৃত্যু ভয়ে  পিছপা হননি। তিনি বলেছিলেন- মরতে যখন শিখেছি, কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে  পারবে না। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর আঘাতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল তখন হত্যা, ধর্ষণ লুটতরাজের  প্রতিবাদে ঝলসে উঠল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসের প্রতিরোধ যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে এদেশ স্বাধীন করেছিল বীর বাঙ্গালি, বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের  এদেশীয় দোসররা পরাজয় মেনে নিলেও এই পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি। ধ্বংস স্তূপ থেকে যখন বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে, বাংলার মানুষ যখন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে, তখনই ৭১ এর পরাজিতরা বর্বর আঘাত হানে। নীল নকশার অংশ  হিসেবে পঁচাত্তরের পনের আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে পরিবার ও স্বজনসহ। সেদিন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে হত্যা করা হয় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে। হত্যা করা হয় ছেলে শেখ জামাল, শেখ কামাল, শেখ রাসেলক,  হত্যা করা হয় পুত্র বধু সুলতানা কামাল,  রোজী জামালকে। হত্যা করা হয় সুকান্ত বাবু,  আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনি, আরজু মনিকে। সেদিন নিষ্পাপ শিশু রাসেলের কাকুতি হার মেনেছিল ঘতকের বুলেটের কাছে। ১৫ আগস্টের আক্রমন শুধু কিছূ বিপথগামী উচ্চাভিলাসী সেনা কর্মকর্তাদের আক্রমন ছিল না ,এর পেছনে ছিল দেশী বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্র কারীদের বিষয়ে ছিলেন উদাসীন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী এক সময় কথা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন-
"প্রথম বিপ্লবের সময় আপনাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় বিপ্লবের সময় আপনাকে বন্দি করে রাখা সম্ভব হবে না। ফলে প্রাণনাশের চক্রান্ত হতে পারে। আপনি কিন্তু সেই চক্রান্ত সম্পর্কে উদাসীন।” 

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে পাকিস্তানের অনুগত সরকার গঠন করাও ঘাতকদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ দাফনের পূর্বেই তার স্নেহধন্য খন্দকার মোস্তাকসহ খুনীরা যোগ দিয়েছিল নতুন মন্ত্রিসভায়। এ যেন বিশ্বাস ঘাতকতার এক নির্মম ইতিহাস প্রত্যক্ষ করল বাংলার জনগণ। যিনি দেশকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশী ভালবাসতেন তাকে হত্যা করা হল স্বাধীনদেশে নিজের দেশে। বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটি কখনো ভাবেননি এভাবে নিজ দেশে তাকে হত্যা করা হবে। এ রক্তক্ষরণ কখনো বন্ধ হবার নয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেলজয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইন ব্রানডিট বলেছিলেন- "মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি মুজিবকে খুন করতে পারে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।”

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক নিরোধ সি চৌধুরী তখন বলেছিলেন- "বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরা হয়েছে।”

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দ্যা টাইমস অফ লন্ডন এ বলা হয়- "সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে, কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের কোন অস্তিত্ব নেই।”

 ডেইলি টেলিগ্রাফ ১৯৭৫ এর ১৬ আগস্ট  লিখেছিল- " বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।”

তখন এ হত্যাকাণ্ডের নায়কদের বিচার না করে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করে,রায় ঘোষিত হয়,রায় কার্যকর করা হয়। এতে জাতি অনেকটা কলংকমুক্ত হয়। কিন্তু কয়েক জন খুনী দেশের বাইরে থাকায় তাদের রায় কার্যকর করা যায়নি এখনো। এদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হলে জাতি নির্ভার হবে,  কলংকমুক্ত হবে পুরোপুরি।

এখানেই থেমে থাকেনি ঘাতকেরা। পরবর্তীতে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে দেশব্যাপী  কুচক্রীমহল সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছে দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে । ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তান -এ আওয়ামীলীগ এর জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালায়। পরে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালানো হয়। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও মারা যায় তার দেহরক্ষী। এ হামলায় আইভীসহ  ২৪ জন প্রাণ হারান, আহত হয় অনেক নেতাকর্মী। তৎকালীন সরকার এ বিচার নিয়ে টালবাহানা করলেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এর বিচার শুরু করে।

জাতির ইতিহাসে এ মাসে রচিত হয়েছিল এক কলংকিত অধ্যায়। বাঙালীর নিরন্তর প্রেরণার চিরন্তন উৎস বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এ মাসের ১৫ ই আগস্ট নির্মমভাবে খুন হয়েছিলেন এদেশের কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তাদের হাতে দেশী বিদেশী চক্রান্ত  নীল নকশার চুড়ান্ত পর্যায়ে। সবশেষে বলতে হয়-
"যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌড়ি যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান"।

তথ্যসূত্র:
১) ধন্য সেই পুরুষ- আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী
২) মুজিব ভাই- এ বি এম মুসা।
৩) বঙ্গবন্ধুর নীতি ও নৈতিকতা- হাসান মোরশেদ।
৪) সরস কথা নিরস কথা- আনিসুল হক।
৫) শেখ মুজিব তাকে যেমন দেখেছি- আবুল ফজল।
৬) ইতিহাসের আলোকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ- হারুন হাবীব।


এস ডি সুব্রত
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক,
সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ।