অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
যে প্রশ্নের উত্তর নেই – সুপ্তা বড়ুয়া

     লেখালেখি বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছি। ব্যক্তিগত জীবনের সীমাহীন ব্যস্ততা আর কর্মজীবনে কর্মস্থলের পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের কারণে লেখালেখি করার সময়ই করে উঠতে পারি না।  আর মাঝে মাঝে এমন এমন সব ঘটনা ঘটছে, কি লেখা উচিত আদৌ বুঝে উঠতেও পারছি না। আসলে দিনকে দিন নিজের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোও যেন জলাঞ্জলি দিচ্ছি। মাথায় শুধু ঘোরে, লিখে কি হবে? 
     গত ৭ই আগস্ট ছিলো নীলয় নীলের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। আচ্ছা, এটা তো মৃত্যু নয়, এটা হত্যা। রাষ্ট্র একের পর মেধাবীদের হত্যা করেছে, হত্যা করতে মদদ দিয়েছে। দেখলাম, সেই হত্যা নিয়ে কারো মধ্যে তেমন উচ্চবাচ্য নেই, নেই কোন প্রতিবাদ। আগের মতোই গৎবাঁধা একদল মানুষ বাক-স্বাধীনতার পক্ষে নানারকম লেখা লিখে গেলো, কিন্তু তেমন চিৎকার চেঁচামেচি দেখালাম না কারো মাঝে। কিন্তু কেন?
     আচ্ছা, তার আগে আসুন গত বছরের শেষের দিকে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা আপনাদের মনে করিয়ে দেই। আবরার নামে একটা ছেলে খুন হয়েছিলো, শুধুমাত্র ফেসবুক একটা পোস্ট দেওয়ার জন্য। তখন বেশ ভালো করেই চারিদিকে ভীষণ তোলপাড় হলো। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভীষণ লেখালেখি হলো। যেই মানুষগুলো দু'দিন আগেও ফেসবুকে রাজীব, অভিজিৎ ,অনন্ত, নীলয়ের হত্যার জাস্টিফাই করে আসছিলো, তারাও বাক-স্বাধীনতার উপর যেন রাতারাতি পিএইচডি করে ফেললো। সবাই একবাক্যে বলা শুরু করলো, ‘না, কারো ফেসবুকে একটা লেখার জন্য তাকে মেরে ফেলা যায় না'। আমি তো ভাবলাম, আরে বাহ্, আমাদের দেশের মানুষ তো তাহলে এতদিনে বাক-স্বাধীনতার সত্যিকার অর্থটা বুঝে গেলো। মনে মনে ভীষণ একটা পজিটিভ ভাব চলে এলো, যাক শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষ এটা বুঝতে পারলো, যে কারো কথা বলার জন্য তাকে মেরে ফেলা যায় না। আমিও ফেসবুক সেই কথাটা লিখলাম এবং আরেকটু আগ বাড়িয়ে একটা নিবন্ধও লেখে ফেললাম। ভাবলাম, যাক দেশের মানুষ আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে তাহলে। 
     হা হা হা, আমি বোকার স্বর্গে বাস করছি। আমাদের জাতকে চেনার মতো কোন ক্যাপাসিটিই আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে’ই (মস্তিষ্ক আছে কি'না তাই সন্দেহ) নাই৷ আসলে আবরারের ঘটনাটায় মানুষের প্রতিবাদের কারণ ছিলো, ছেলেটা আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছে। ব্যাস, ওটাই কারণ। মনে আছে নুসরাতের কথা, যে মেয়েটাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। সবার এমন প্রতিবাদের কারণ, মেয়েটির বাবা জামায়াতের কোন এক স্থানীয় নেতা ছিলেন। তাহলে কি দাঁড়ালো, আপনি যদি কোন রকমে অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শের হন, কিংবা আপনি যদি আওয়ামী লীগ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তবে এদেশে বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ আবরারের খুনী কিংবা নুসরাত খুনী দুটো মামলাতেই সরকার খুব দ্রুততার সাথে পদক্ষেপ নিয়েছে। জনগণ করবে সিলেক্টিভ প্রতিবাদ আর সরকারও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। যদিও আদৌ আমরা জানি না, এসব ঘটনার বিচার হয়েছে কি'না কিংবা কতদূর হচ্ছে।
     আবার এদিকে দেখেন, আজ পর্যন্ত অভিজিতের খুনের বিচার হয় নি, তার বাবা-মাও সন্তান হত্যার বিচারের জন্য আইনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সন্তান হত্যার বিচার না পেয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো মানুষ দুজন। অনন্ত বিজয় দাশ, যার বৃদ্ধ পিতা সন্তান হত্যার বিচার না পেয়ে, দু'বছর গুরুতর অসুস্থ থেকে অবশেষে ২০১৭ মারা যান। কেউ জানেও না কেমন আছে অনন্তের মা, যিনিও শয্যাশায়ী অসুস্থতায়। যাদের সেবাযত্নের সকল দায়িত্ব অনন্ত নিজে পালন করতো। কিংবা নীলয়, জানি না তাদের পরিবার কোন দিন সুবিচার পাবে কি'না। দীপনের বউ আর ছেলে কেমন আছে, তারা বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে না তো? ২০১৩ সালে রাজীব হায়দারের হত্যার বিচার হয়েছে? শরীয়ত বয়াতির কি খবর? তণু, পূর্ণা ত্রিপুরার পিতা-মাতা, ধর্ষণের বিচার পেয়েছেন? কিংবা মিতু নামের সেই মেয়েটা যার স্বামী সুইসাইড করার কারণে তাকে জেলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, সে কেমন আছে? কেমন আছে মিন্নি? রূপা নামের সেই নার্সটা যে বাসে গ্যাং রেপড হয়ে খুন হয়েছিলো, তার বাবা-মা কন্যা হত্যার বিচার পেয়েছে? না পায় নি। একদিকে ‘যদি, কিন্তু, তবে’ বলে বলে একের পর এক হত্যা, জেল-জুলুম, ধর্ষণকে জায়েজ করার জন্য এক বাহিনী প্রস্তুত  আর অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রকাশ্য মদদে বিহারহীনতার ধারাবাহিকতা, দুই মিলেমিশে একদম একাকার।  ধুর, আমি উন্নয়নের মহাসড়কের জাতিকে এসব কি বলছি? চারিদিকে চেতনার বাম্পার ফলন আর আমি এর মাঝে ফালতু সব বিষয়ে বকবক করছি। 
     আয়মান সাদিক নামে একটা ছেলেকে কিছুদিন আগে মৃত্যু হুমকি দেওয়া হয়েছিলো। তার অপরাধ, তার কোন এক বন্ধু ফেসবুকে সমকামীদের অধিকার বিষয়ে কথা বলেছে। তো তখন দেখলাম, কারোরই কোন উচ্চবাচ্য নেই। বরং আমার কয়েক ফেসবুকীয় বন্ধু উল্টো তাকে নিয়েই ট্রল করছিলো দেখলাম। কারণ, এখন বিষয়টা স্পর্শকাতর হয়ে গেছে। কারণ ধর্ম আর সমকামিতা সাংঘর্ষিক। যেই লোকগুলোই কিছুদিন আগেও আবরার হত্যায় ফ্রীডম অফ স্পিচ নিয়ে গাদা গাদা পোস্ট করেছিলো সেই মানুষগুলোই এবার এলো বোঝাতে, কিভাবে ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না। কিভাবে ধর্মের অসারতা নিয়ে কথা বললেই আপনাকে হত্যা করাটা জায়েজ হয়ে যাবে। আসলে ধর্ম বিষয়ে আমরা সবাই চুপ, সেটা যে কোন ধর্মই। এই যে এত যুগের পর যুগ ধরে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা হচ্ছে সেদিকে কারোরই কোন নজর নেই। কিন্তু যেই একজন বললো, সমকামীও মানুষ। তারও অধিকার আছে সমানভাবে বাঁচার। ধর্মের দোহাই দিয়ে আমরা চাইলেই তাকে মেরে ফেলতে পারি না। প্রকৃতিতে সমকামীতা বিরাজ করছে সৃষ্টির শুরু থেকেই। কেউ একজন এসে বললেই সেটা অনৈতিক অন্যায় হয়ে যায় না। আয়মান সাদিক কিংবা অন্য কেউ সমকামীদের অধিকারের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেও সেটা মিথ্যা হয়ে যায় না। ধর্ম বইয়ে লেখা থাকলেই সব কথা সত্য হয়ে যায় না। এদিকে আবার সেখানে আয়মান সাদিককে নিয়ে ট্রলও হলো যে সে কেন এত এত লেকচার ছেড়ে এখন কান্নাকাটি করছে। দেখুন ভেবে অবস্থাটা ! একজনকে মৃত্যু হুমকি দেওয়া হচ্ছে আর অন্যরা বসে বসে তামাশা দেখে আরো বলছে এখন কাঁদছিস কেন। আমরা নাকি পরোপকারী, বন্ধুবৎসল জাতি। এসবই কি তারই নমুনা?
     এর আগেও আরো বহু উদাহরণ হয়ে রয়েছে হূমায়ন আজাদ, রাজীব, অভিজিৎ, অনন্ত, নীলয়, বাবু, দীপনরা। যাদের মৃত্যুতে শোকের বদলে বাংলার আকাশে আনন্দের বন্যা হয়েছিলো। এখন বাংলাদেশে খুব চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে, মেজর সিনহা নামে এক সৌখিন পরিচালককে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে দেখে। মেজর সিনহার অপরাধ সে সত্য কথা বলতে গেছে। এই হত্যাটিও সেই একই ধারাবাহিকতা, এটাও বাক-স্বাধীনতার উপর আঘাত। কিন্তু মানুষ এটা নিয়ে প্রতিবাদ করছে। কারণ, ওই একটাই। খুনটা হয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে আর সিনহার খুনের সাথে ধর্মের সংযোগ নেই। আমি এই প্রতিবাদের বিরোধিতা করছি না। কিন্তু আমার প্রশ্ন এভাবে আর কতকাল আমরা সিলেক্টিভ প্রতিবাদ করবো? হত্যাকে হত্যা বলতে কতটা শিরদাঁড়ার প্রয়োজন হয়? আর কতকাল বাংলার মানুষ এভাবে ‘যদি, কিন্তু, তবে’ বলে বলে কিছু হত্যাকান্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিবে, জায়েজ করবে? দেখুন এই দেশে, সত্য কথা বললে, কিংবা নিজের মত প্রকাশ করলে আপনাকে হয় চাপাতির কোপ খেতে হবে নয়তো ক্রসফায়ার নামক প্রহসনে প্রাণ খোয়াতে হবে। তার চেয়ে চলুন সবাই চুপ থাকি আর নিজেদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেই।
     শেষ করছি, ছোট্ট আরেকটি ঘটনা দিয়ে। আসাদ নূরেরে পরিবারকে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে, কারণ সে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে গেছে। এদিকে তো বৌদ্ধ নেতারা মেরুদণ্ড বেঁচেই দিয়েছে, সে কথা লিখতে গেলে রামায়ণ আর শেষ হবে না। যে দেশে বা যে ভাষায় আপনি কথা বলার স্বাধীনতা চাইলেই আপনার মৃত্যু অবধারিত কিংবা আপনাকে যখন পাওয়া যায় নি, তখন আপনার পরিবারের উপর চলবে নির্যাতন, হয়রানি সে দেশে বাক-স্বাধীনতার লেকচার দেওয়াই ভুল। আমিও বরং ফুল-পাখি-লতা-পাতা নিয়ে থাকি। আমার এক বন্ধু আমাকে রান্নার একটা গ্রুপে এ্যাড করেছিলো, সে নিয়েও থাকা যায় কিংবা সাজুগুজু’র গ্রুপে এ্যাড হয়ে যেতে পারি। এত সুন্দর, সৌখিন জীবন ছেড়ে, কে যায় এসব ক্যাচালে?

সুপ্তা বড়ুয়া। অটোয়া, কানাডা 
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে তাঁর নিজস্ব ব্লগ supta.ca ভিজিট করুন।