অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
শামসুর রাহমান : কবিতায় প্রেম ও বাস্তবতা - ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ

শামসুর রাহমান(১৯২৯-২০০৬) উত্তর তিরিশের বাংলা কবিতার এক বিস্ময়কর রূপকার। পঞ্চাশ এর দশকে নগরের বিস্তীর্ণ পথে অনায়াস বিচরণ; কবিতাচর্চা ও তার উৎকর্ষকে শামসুর রাহমান নিষ্ঠতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে কাব্যচর্চায় শামসুর রাহমানই ছিলেন এগিয়ে। তাঁর মাধ্যমেই সকল সীমাবদ্ধতারর দেয়াল ভেঙ্গে কবিতার শিল্পচর্চার সৃজনশীল ধারা বুদ্ধিদীপ্ত বিভায় উপ্ত হয়েছিল। এ ধারায় বাংলা কবিতার অঙ্গনে শামসুর রাহমানকে বলা হয় 'CREATIVE  GENIUS' যাকে বলা যায় The special inborn faculty of any individual.
     আমার এ আলোচনায় তাঁর কবিসত্তার সামান্যই তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে। উল্লেখ্য এটি শামসুর রাহমান সম্পর্কে উদ্ধৃত বিষয়ের চুম্বকাংশ বা 'ন্যানো' আলোচনা মাত্র।

*১.--- 'কবিতা চৈতন্যেরই এক প্রকার সৌন্দর্যমণ্ডিত অভিলাষী  সুরেলা বহিঃপ্রকাশ' (হা হা র) রুশোই(১৭১২-১৭৭৮) প্রথম মানুষের অন্তর্লোকের এ গূঢ়সত্যকে ইঙ্গিত করেছিলেন।
     পঞ্চাশ এর দশকে পেশাগত দিক থেকে একজন সাংবাদিক চরম নিষ্ঠা ও অসাধারণ প্রতিভায় নিজেকে মেলে ধরে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করেছেন বাংলার আধুনিক কবিতার মৌলিক বিকাশের পথে। আর এখানেই সফল সাংবাদিক থেকে শামসুর রাহমান পুরোদমে হয়ে ওঠলেন একজন ক্ষণজন্মা আধুনিক কবি। তাঁর এ অভিযাত্রায় কোন প্রতিদ্বন্দ্বী সেদিনও ছিলনা আজও নেই। নগর ভাবনায় আমাদের নগর ও মানুষের এক অভিন্ন সত্তার কবি  শামসুর রাহমান।

*২...'১৯৪৯', শীর্ষক কবিতাটি 'সোনার বাংলা'য় প্রকাশিত শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা। কবিতাটি অন্তরিত হলেও এ কবিতায় কবির নির্বিঘ্ন যাত্রাকে 'সমকাল ও জীবন মথিত করে তুলে। তাঁর অপর কবিতা ' কোন নিমগ্ন শহরকে  'অগত্যায়' (১৯৫১) প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এ নিসঙ্গ কবির কবিতাগুলো সমকালে কোন কাব্যগ্রন্থে ওঠে না এলেও রচিত সে সকল কবিতার ধারাবাহিকতায় তাঁর মেধাবী কবিসত্তার উন্মেষ ঘটেছে। কবির আপ্লুত হৃদয়ে আবেগের উচ্ছ্বাস প্রেমের বিস্তীর্ণ  ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় শৈল্পিক চেতনার স্পর্শ রেখেছে। কবির মুখে যে সুরটি প্রথম ধ্বনিত হয়, তা ছিল 'ভালবাসার ইতিহাস ভুলিতে না পারি' এটি ছিল '১৯৪৯' শীর্ষক কবিতার প্রথম চরণ। মনে করা হয় এ লাইনটি ছিল তাঁর জীবনানন্দীয় প্রভাব বলয় থেকে বেড়িয়ে না আসার অতি স্বাভাবিক ব্যবহৃত ও উচ্চারিত শব্দের প্রতিধ্বনি। অবশেষে আমাদের কবি শামসুর রাহমান  জীবনানন্দীয় প্রভাববৃত্তে বৃত্তাবদ্ধ থাকেননি। তার পরিচয় পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত ধারাবাহিক পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলো যা শামসুর রাহমানের স্বকীয়  কবি প্রতিভার চূড়ান্ত সাক্ষ্য বহন করে।

*৩---বস্তুত 'ভালবাসা' ও 'ইতিহাস' শব্দ দু'টির প্রায়োগিক ব্যবহার সমকালীন প্রচলিত নস্টালজিক চিত্রকল্পের এক ভিন্নরূপ। তারই ব্যবহৃত গতিশীল প্রতিক্রিয়ায় জীবনানন্দ (১৮৯৯-১৯৫৪) প্রভাবিত সমকালের ভাব-কল্পনার ধারাবাহিকতায় জীবনানন্দ ঘেষা প্রথম পর্বে শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎ খুঁজে পাওয়া যায়। শামসুর রাহমানের যাত্রা যতই ক্রমপরিণতির দিকে এগুতে থাকলো; তাঁর মধ্যে জীবনানন্দের ইতিহাসচেতনা বিলুপ্ত হয়ে অনাবিল প্রেমের শৈল্পিক উজ্জীবন স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠলো। শামসুর রাহমানের হাত দিয়ে ১৯৪৯ থেকেই ক্রমাগত নান্দনিক কবিতার জীবনবাদী উৎসারণ, সমকালের প্রেক্ষিত, সমকালীন জীবন ও প্রতিবেশকে মুখ্য কেন্দ্রবিন্দু ধরে কবিতার বিষয় নির্বাচনে স্বতঃপ্রণোদিত কবি প্রেরণার আধার খুঁজে পেয়েছিলেন।
     বস্তুত এ ধারায় প্রেরণার মৌলিক উৎস হিসেবেই তিনি 'তিরিশের' কবিতার সীমাবদ্ধতা এবং 'তিরিশি' বলয় থেকে আধুনিক বাংলা কবিতার মুক্তির লক্ষ্যে তিরিশি ধারায় কবিতার অন্তর্জগত থেকে বাংলা কবিতাকে বাইরের নির্মল মুক্ত জগতে নিয়ে আসেন এবং অব্যবহিত প্রতিবেশে তিনি মুক্ত কবিতার দীপ্ত দ্যুতি ছড়িয়ে দিলেন  'কোলাহল কলরোল ক্লান্তিশ্রান্তি উজ্জ্বলতায়'। 

*৪---শামসুর রাহমান তাঁর কবিকর্মে আধুনিক বাংলা কাব্যধারার যে সুর রচনা করার প্রত্যয়কে নিজস্বতায় লালন করেছিলেন তার-ই বহিঃপ্রকাশ  বাংলা কবিতার উৎকর্ষকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বাংলা কবিতার বর্তমান প্রশংসিত ও উজ্জীবিত রূপটি প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। তাঁর কবিতায় প্রেমের স্বরূপটি কাব্যকলার অনিবার্য বাস্তবতার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। কবির অন্তরে লালিত প্রেমের নান্দনিক স্পর্শ কল্পনার বিহঙ্গকে মুক্ত করে দেয় কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে। তাঁর উদ্বেলিত হৃদয়ে প্রেমের সহজাত প্রবৃত্তি; অতুল গৌরবে সংমিশ্রিত হয়ে জীবনানন্দে পরিপূর্ণ করে তুলে পাঠকের মন। বলা চলে বাংলা কবিতার সম্ভাবনাময় নন্দিত ক্ষেত্র প্রস্তুতে যে স্বল্পসংখ্যক কবিগোষ্ঠীর রচনায় নিয়ন্ত্রিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, শামসুর রাহমানের অবদান সর্বাগ্রে। যা প্রতিষ্ঠিত সত্য। 
     বলা যায় সমকালীন নগর সভ্যতার নাগরিক জীবনের বিমূর্ত চেতনার যে ভাস্কর্য তিনি তৈরি করেছেন তার-ই উৎক্ষেপ আমাদের কবির কবিতাকে দিয়েছে আলোকোজ্জ্বল মহিমা, দিয়েছে স্বাতন্ত্র্য, করে তুলেছে হৃদয়সংবেদী। তাঁর কবিতায় প্রেম এসেছে নতুন আঙ্গিকে কাব্যোৎকর্ষের এক নতুন উদ্দীপনারর সিঁড়ি বেয়ে। তাই প্রেম-ই শামসুর রাহমানের কবিতার প্রধান বিষয়।শামসুর রাহমান মনে করেন তাঁর কবিতায় উৎসর্গিত প্রেম শূন্যতাকেও ভরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এ চির প্রেম এভাবেই ব্যক্ত হয়েছে তাঁর কণ্ঠে...
" ... হাজার হাজার বছরের ঢের
পুরোনো প্রেমের কবিতার রোদে পিঠ দিয়ে বসি",...
           ( 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে')
      নন্দিত প্রেমের এমন অজস্র পঙক্তি আছে শামসুর রাহমানের কবিতায়। 'রূপালি স্নান',  ' জর্ণাল শ্রাবণ',  'সে', 'কোন একজনের জন্যে', 'একান্ত গোলাপ', 'কবর খোঁড়ার গান', 'কোন পরিচিতাকে', 'নির্জন দুর্গের গাথা', 'পিতা', 'সুন্দরের গাথা', 'তার শয্যার পাশে',  প্রভৃতি কবিতায়।

*৬--- প্রেমের অতুল সৌরভকে কবি তাঁর 'কাব্যতত্ত্ব' শীর্ষক কবিতায় বিস্ময়কর মাত্রায় বিজ্ঞাপিত করেছেন। প্রেম ও প্রণয়ের গভীর- কোমল সমন্বিত রূপের উপাদান ওঠে এসেছে 'রজনীগন্ধার ঘ্রাণ' ও 'পূর্বরাগ' কবিতায়। কুরূপা নারীর প্রেমের কষ্ট আর নিদারুণ যন্ত্রণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে কবি তত্ত্বের উপচারে রূপ-অরূপের আবহ তৈরি করেছেন যে কবিতায় তার নামম 'সে'। প্রেম তাকে করেনা 'আকুল'; কবি কণ্ঠে উচ্চারিত এ বাক্য সেই মেয়েটির প্রেমে ব্যাকুল হওয়ার অস্থিরতাকে বর্ণনায় শিল্পসফল করে ব্যাখ্যার অবকাশ রেখেছেন। কবির বিজ্ঞাপিত পঙক্তিমালা;
"অভিভূত হঠাৎ কখনো
ফুলের পাপড়ির মতো আকাশকে বলে 'ঐ শোনো
কার যেন বাঁশি বাজে, স্পন্দিত পৃথিবী!..
তবু এক তৃষ্ণা তাকে করেছে পথিক।...
একটি অরূপ নদী প্রাণে বয় যার,...
তারও চোখ রূপ খোঁজে'   ( সে )

*৭---বস্তুত তাঁর কবিতায় প্রেমের ব্যতিক্রমী মূল্যায়ন জীবনঘনিষ্ঠতায় সামাজিক বাস্তবতার-ই প্রতিফলন। কবিতার উৎকর্ষকে মৌলিক চেতনার ভাবধারায় বেগবান করার শর্তে যে ভিন্নতর মূল্যায়নপ্রসঙ্গ ওঠে আসে তা অনেকেই মনে করেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়াজাত। কবি এরূপ চেতনার অনভ্যস্ত পরিবর্তনকে শৈল্পিক চেতনায় সুন্দর মোহনিয় করে তুলার ক্ষেত্রে সম্যক পরিবর্তন শিল্প কুশলতায় ব্যক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন প্রেমনির্ভর সমধারার 'কোন পরিচিতা' শীর্ষক কবিতায়। কবির পরিচিত নারী স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ কোন এক সংসারে সে ছিল কারো স্ত্রী, কারো মা। কিন্তু সে নারী-ই অন্ধগলিতে সকরুণ বিচরণ করেছে সমাজের অনিবার্য বাস্তবতায়। নগরের নাগরিক সভ্যতায় ভাসতে ভাসতে যে এখন উচ্ছিষ্ট বহুবল্লভা হয়ে বিচরণ করছে অন্ধগলিতে। পতিতা এ নারী যেন বা নগরজীবনের নিষ্ঠুর ক্লান্তিকে শুষে নিয়ে নিজেই ক্লান্ত। কবি ব্যক্ত করেন;
'মদির আগুনে জ্বেলে পুরুষের কবন্ধ বিনোদ কখনো জানিনি আগে এতো ক্লান্ত,
এত ক্লান্ত তুমি,।'
       (কোন পরিচিতাকে) 

*৮---উল্লেখ্য শামসুর রাহমানের 'কোন পরিচিতাকে' শীর্ষক কবিতাটিতে বিদগ্ধ সমালোচকরা বোদললেয়ারের (১৮২১-১৮৬৭) 'To a Malabar Woman' শীর্ষক কবিতার সাযুজ্য খোঁজার প্রয়াস পেয়েছেন। আলোচ্য কবিতায় বোদলেয়ারের স্বগত উচ্চারণ;
"Your feet are as slender as your hands,
And your hips are broad enough to fill the loveliest white woman with envy. 
...
Why happy child, do you want to
see our France?
That over peopled land ridden with suffering, and, entrusting
your life to the care of sailors arms,
bid final farewells to your beloved tamarinds?"
(To a Malabar Woman)
[Francis Scarfe, (edt.) "Baudelaire ( selected verse)," Reprinted,  Britain, 1970, page, XVii-XIVi.]

বুদ্ধদেব বসুর অনূদিত উক্ত কবিতাটির বাংলা শিরোনাম 'কোন মালাবারের মেয়েকে' কবিতাটির বাংলায় অনূদিত লাইন;
"তোমারই হাতের মতো সুকুমার তোমার পা দুটি,
জঘনে জাগাও ঈর্ষা ব্যক্ত ক'রে শ্বতাঙ্গীর ত্রুটি;
হায় রে, দুলালী, কেন বেছে নিলি আমাদের এই
জনতাকাতর ফ্রান্স, যেখানে দুঃখের শেষ নেই?
পিষ্ট স্তনে, ভিন-দেশী অঙ্গের আঘ্রাণ ফেরি ক'রে,
অন্ন খুঁটে খেতে হবে প্যারিসের পঙ্কিল খর্পরে-
এদিকে, কুয়াশা -ক্লেদ ছিঁড়ে তোর খিন্ন পথ চাওয়া
খোঁজে সেই সুদূর শুপুরিদের ক্ষীণ প্রেতচ্ছায়া।"

*৯---উল্লিখিত দুটি কবিতায় উভয় নায়িকাই নিজ নিজ নির্জন জীবনের একান্ত সময়টুকু যে নির্মলতায় কাটিয়েছিল তারই এক নিষ্ঠুর জীবনচিত্র কাব্যময়রূপে প্রকাশিত। আলোচিত কবিতা দুটিতে সমকালীন বাস্তবতায় কঠিন সময়ের অনিবার্য সত্য প্রকাশের পাশাপাশি তাদের নির্যাতিত জীবনে অর্থনৈতিক নিপীড়ন ও নগরজীবনের বিকৃতির কাছে আত্মসমর্পণের চিত্রটি অসাধারণ শিল্পকুশলতায় প্রকাশ পেয়েছে।

*১০---শামসুর রাহমান 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' (১৩৬৬) কাব্যগ্রন্থে নাগরিক সমাজের সকল অনৃত তত্ত্বকে বর্জন করে সমাজের অনিবার্য বাস্তবতার পূর্বশর্ত মানুষ আর মানবতার মূল্যবোধকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। তাই কবি কবিতার পঙক্তিতে প্রগাঢ় জীবনবোধের জ্যোতির্ময় স্বরূপকে উপস্থাপন করতে গিয়ে অধ্যয়নলব্ধ অভিজ্ঞতার নিত্য সত্যকে তুলে এনেছেন প্রজ্ঞার আলোকে।
     তাঁর কবিতায় প্রেম বাস্তবতারই একটি মৌলিক অনুষঙ্গ। সামাজিক বাস্তবতায় দীপিত করেছেন নাগরিক জীবনের প্রেম। তিনি এখানেই থেমে থাকেননি; প্রেমের সার্বজনীনতা ও প্রেমের  অতুল সৌন্দর্যকে ধারণ করে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে তার নন্দিত সৌন্দর্যবোধ ও রুচিবোধের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন নিজস্বতায়।
     আমাকে স্বীকার করতেই হবে আমার এ আলোচনায় শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রেমেরর স্বরূপ অনেকটা বিশ্লেষণ পর্যায়ে-ই রয়েছে। তাঁর কবিতায় (কাব্য সমগ্র) প্রেমের স্বরূপ বিশ্লেষণ খুবই দুরূহ কাজ। আমি তার সামান্যই আলোচনায় তুলে আনার প্রয়াস পেয়েছি মাত্র। 

ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ। শ্রীমঙ্গল