অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
মুক্তিপথিক সুভাষ চন্দ্রের দেশপ্রেমের উৎসভূমি সঙ্গীত ও কাব্য : পেক্ষিত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন –ডঃ সুবীর মণ্ডল

ভারতবর্ষের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর ঘটনা বহুল  বৈচিত্র্যময় জীবনের মূল্যায়ন হয়েছে স্বাধীনতার ৭৩ বছর ধরে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই। স্বাধীনতার ৭৪তম বর্ষে দেশ জুড়ে মহামারীর সীমাহীন দাপট, চারিদিকে মৃত্যুর করালথাবা। তবু স্বাধীনতা দিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি থেমে থাকতে পারে না। দিনটি সারাদেশে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হলো।  বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে  আমাদের অনেকের ই অজানা তথ্য সহ  তাঁকে নতুন ভাবে তুলে ধরাই ও নব মূল্যায়ন করাই মূল উদ্দেশ্য এই নিবন্ধটির।   তিনি ছিলেন এক অখণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লৌহপুরুষ যিনি বর্ণময় জীবনের প্রেরণা লাভ করেছিলেন জীবনের নানা ক্ষেত্র থেকে। কাব্য, সঙ্গীত, নাটক, উপন্যাস, শুধুই তার দেশপ্রেমকেই   উদ্বুদ্ধ করেনি, দেশের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে এবং তাঁর চিন্তা-দর্শন-মননকেও গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনার বিষয়, তাঁর জীবনের এই বিশেষ দিকটি  নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে আলোচনা হলেও  তথ্যনিষ্ঠ পূর্নাঙ্গ বিশ্লেষণ আজ ও সেই ভাবে হয়নি। একথা সত্য তিনি কখনও কবি বা সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না। কিন্তু কবিতা ও সঙ্গীত তাঁর জীবনের প্রেরণায় অন্যতম উৎস ছিল যা বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে অনুপ্রেরণায় সাহায্য করেছিল। তাঁর জীবনের সঙ্গে গান ও কবিতা একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে গভীর ভাবে পরিচয় ছিল এবং তাদের প্রত্যেকের দ্বারাই  অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ভারতের জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে কবি, সাহিত্যিক ও সঙ্গীতকারগণের অবদানকে তিনি অকুন্ঠচিত্তে স্বীকার করেছিলেন। একথা সত্য সুভাষচন্দ্র বসু দেশাত্মবোধক কবিতা, গানের অনুরাগী ছিলেন কিন্তু তাঁর প্রকৃতি প্রেম ও দেশপ্রেম পরস্পরের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এক অন্যভুবন তৈরি হয়েছিল তাঁর মনোভূমিতে।

(১) সুভাষচন্দ্রের জীবনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কাব্যের প্রভাব ছিল অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। কেবলমাত্র তার লেখার  মধ্যেই নয়, তাঁর জীবনের নানা ঘটনার মধ্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়। 'তরুণের স্বপ্ন' -তে তিনি উদ্ধৃত করেছেন রবীন্দ্রনাথের 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা,' নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের কয়েকটি  পংক্তি --  'আমি ঢালিব করুণধারা। আমি ভাঙিব পাষাণ কারা, 'নববর্ষের গান' ( হে ভারত আজি নবীন বরষে  শুন হে কবির গান) 'বন্দী বীর'  কবিতায় বিখ্যাত চরণ -----" ' জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্তভাবনাহীন" ইত্যাদি তিনি তরুণ সমাজকে  আত্মসচেতন করে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে  বাংলার তরুণদের মধ্যে  "ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় অসীম শক্তি আছে। সাধনার দ্বারা যে ভস্মরশ্মি অপনীত  হইবে এবং অন্তরের দেবত্ব কোটি সূর্যের উজ্জ্বলতার সহিত  প্রকাশিত  হইয়া মনুষ্যসমাজকে মুগ্ধ করিবে"। তিনি চেয়েছিলেন যে ভারতের চিরন্তন সত্তা  বিশ্বদরবারে নিবেদন করার জন্য তরুণসমাজ তটিনীর মতো দেশে দেশে হৃদয়ের কথা বহন করে নিয়ে যাবে ।  "এই দেওয়ার শেষ নেই কারণ যত দেবে প্রাণ বহে যাবে প্রাণ  ফুরাবে না আর  প্রাণ।" তিনি জানতেন যে তরুণ সমাজ  " জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য'  করে রেখেছে। দেশমাতৃকার চরণে নিঃশর্ত আত্মবলিদানের আদর্শে তিনি বা়ংলার  ছাত্রসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, " এনেছি মোদের দেহের শকতি,এনেছি মোদের মনে ভকতি, এনেছি মোদের  ধর্মের মতি, এনেছি মোদের প্রাণ। এনেছি মোদের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য তোমিরে করিতে দান।" রবীন্দ্রনাথের 'বলাকা'   কাব্যগ্রন্থের  'সবুজের অভিযান' ও  'নববর্ষের আশীর্ব্বাদ'  কবিতা দুটি ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রিয়। দিলীপকুমার রায়কে তিনি বলেছিলেন যে দেশের আদর্শবাদী ছেলেরাও আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে ইতস্তত করেন। অপরদিকে আইরিশ ও জাপানিদের মধ্যে মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর সামনের আদর্শের জন্য প্রাণদানের  মানসিকতা লক্ষ করা যায়। সুভাষ চন্দ্র বলেছিলেন "রবীন্দ্রনাথ এদের কথা মনে করে লিখেছিলেন না কি, ' ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা?'  এই কবিতাটির মধ্যে সুভাষচন্দ্রের জীবনদর্শন গভীর ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। আসলে সুভাষচন্দ্র জীবনকে একটা আ্যডভেঞ্চার হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। গতানুগতিক, বাঁধাধরা জীবনকে তিনি সব সময় ঘৃণা করতেন। জীবনের রোমাঞ্চ ও উন্মাদনাকে উপভোগ করার জন্য তিনি বিপদ-বাধাকে সব সময়  স্বাগত জানিয়েছিলেন। সবধরনের বাঁধাকে লঙ্ঘন করে অজানার পথে পাড়ি দেওয়ার মধ্যে নিহিত আছে মানুষের মনুষ্যত্ব,এ কথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।তাই ১৯৩৮ সালের এক অটোগ্রাফ খাতায় তিনি লিখেছিলেন, "nothing lures me more than a life of ceaseless adventure. away from the beaten track in Search of the unknown", এ যেন রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিধ্বনি " আনরে টেনে বাঁধা পথের শেষে বিবাগী কর অবাধ পানে,পথে কেটে যায় অজানাদের দেশে।আপদ আছে জানি আঘাত আছে, তাই বলেই  তো বক্ষে পরান নাচে, ঘুচিয়ে দে ভাই পুঁথি পোড়োর কাছে, পুঁথি পড়ার বিধি বিধান যা চা। আয় প্রমুক্ত আয় রে আমার কাঁচা।' 'নববর্ষের আশীর্ব্বাদ' কবিতাতেও  একই কথার  প্রতিধ্বনি শোনা যায় ---'বলাকা' কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতায় --  " ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে  তোর তরে, নহে রে সন্ধ্যায় দীপালোক, নহে প্রেয়সীর অশ্রুচোখ। পথে পথে অপেক্ষিছে কালবৈশাখীর আশীর্ব্বাদ, শ্রাবণরাত্রির বজ্রনাদ।"  মান্দালয় কারাগারে বন্দী    জীবনের দু্ঃসহ যন্ত্রনাকে  সুভাষচন্দ্র  জয় করেছিলেন নিজের দেদীপ্যমান অধ্যাত্মসত্তা দিয়ে চিরচঞ্চল তারুণ্যের রসে  উপচীয়মান সুভাষচন্দ্রের স্থানে এই সময়  দেখা দেয় এক  চিরপ্রশান্ত ধ্যানগম্ভীর  স্থিতপ্রজ্ঞ সুভাষ।  রবীন্দ্রনাথের 'গুরুগোবিন্দ' কবিতায় কয়েকটি চরণ ছিল তাঁর খুবই প্রিয়----"এখনো বিহার কল্পজগতে অরণ্য রাজধানী। এখনো শুধুই নীরব ভাবনা কর্মহীন বিজন, সাধনা, দিবানিশি শুধু বসে  বসে শোন আপন মর্মবাণী।" ১৯২৬  সালে কারাগৃহে থেকে ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে তিনি লেখেন --" কবির এত আদর এই জন্য যে আমাদের অন্তরের কথা কবিরা আমাদের অপেক্ষা স্পষ্টতর ও স্ফুটতরভাবে ব্যক্ত করিতে পারেন।"মান্দালয়ের সুভাষচন্দ্র বারবার স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে।অনাথবন্ধু দত্তকে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছেন এখন আমার প্রার্থনা শুধু এই, " তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবার দাও শকতি"। সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে ১৯২৪ সালে শহীদ গোপীনাথ সাহার ফাঁসির পরে  ফরোয়ার্ডের অফিসে সুভাষচন্দ্র দেওয়ালে টাঙানো ভারতের মানচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে গুন গুন করে গাইছিলেন "তোমার পতাকা যারে দাও।" এর আগে সুভাষচন্দ্রের গান তিনি শোনেননি। সুভাষচন্দ্র হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে তাঁর দিকে চাইতেই সাবিত্রীপ্রসন্ন দেখেন যে তাঁর সারা মুখ যেন কেউ সিঁদুর ঢেলে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে গুমরে গুমরে কাঁদলে যেমন মুখের চেহারা হয়  তেমনই। সুভাষচন্দ্র নিজেই নিস্তব্ধতাভঙ্গ করে আবেগকম্পিত কন্ঠে বলেন "গোপীনাথ সাহার ফাঁসি হয়ে গেল। জেল গেট থেকেই বরাবর এখানে আসছি।" সুভাষচন্দ্রের ভাগিনেয়ী প্রতিমা মিত্রের স্মৃতিচারণ  থেকে জানা যায় মে তিনি নিজগৃহের উপাসনা কক্ষে 'আগুনের পরশমণি ছোঁওয়াও প্রাণে'  গানটি স্বকন্ঠে গাইতেন। অমূল্যচন্দ্র ভদ্র নামে আজাদ হিন্দ ফৌজের এক সৈনিকের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে  প্রচণ্ড সঙ্কটের সময়ে  বোমাবর্ষণের মধ্যেও সুভাষচন্দ্র অকুতোভয়ে গান গেয়ে চলেছিলেন --" প্রলয় নাচন নাচলে তখন আপন ভুলে হে নটরাজ।" এই ঘটনার মধ্যে  তাঁর নির্ভীক, অদম্য ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত তাঁর 'উদ্যত খড়্গ সুভাষ' গ্রন্থে  লিখেছিলেন যে  কৈশোরকালে সুভাষচন্দ্র ও তার বাল্যবন্ধু চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় কটকের কাঠজুড়ি নদীর ধারে গান গেয়ে বেড়াতেন, "আগে চল আগে চল ভাই। পড়ে  থাকা মিছে, মরে থাকা মিছে বেঁচে মরে কিবা ফল ভাই।" একথা অনেকের জানা আছে যে রবীন্দ্রনাথের " যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে  তবে একলা চল রে"  গানটি গান্ধীজির খুব প্রিয় ছিল। এই গানটি সুভাষচন্দ্রকে গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর দেশ প্রেমের উৎসভূমি ছিল এই গান। এ যেন সুভাষচন্দ্রের জীবনের বাণী। দেশ ছেড়ে তখন দুর্গম পথে তিনি পাড়ি দিয়েছেন  তখন কেউ  ছিলনা সঙ্গে। বজ্রের অনলে নিজের বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে ঝড়- বাদলের আঁধার রাতে একলা  জ্বলতে  জ্বলতে তিনি চলেছিলেন অকম্পিত বক্ষে  দৃঢ় পদক্ষেপে দেশের মুক্তিসাধনের অটল সংকল্প নিয়ে।  রবীন্দ্রনাথের আরও দু-একটি গানের উল্লেখ  সুভাষচন্দ্রের ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। দিলীপকুমার রায়ের কাছে তিনি একবার "আমায় বোলো না গাইতে" গানটির উল্লেখ করে বলেন যে "যশের কাঙাল হয়ে কোন লাভ নেই।" একবার দিলীপকুমার রায়কে বলেন, 'আমার দেশের মানুষ একবেলা পেটে ভরে খেতে পায়না, এ চলবে না, রবীন্দ্রনাথ  মিথ্যা বলেন নি'--"হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ অপমান, অপমান হতে  হবে তাহাদের  সমান।' যখন তিনি বাঙালিকে মনুষ্যত্বলাভে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন, তখনই ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা " সাত কোটি বাঙালীরে হে মুগ্ধা জননী, রেখেছ বাঙালী করে  মানুষ করনি।' সুভাষচন্দ্র দেশপ্রেমের উৎসভূমি ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা। মানসিক শক্তি বাড়ানোর জন্য তিনি এগুলোকে জীবন বেদ হিসাবে মনে করতেন। সুতরাং বহু চর্চিত কথা এখানে গভীর ভাবে প্রাসঙ্গিক, 'Pen is mightier than sword'

(২) সুভাষচন্দ্রের রচনার মধ্যে কান্তকবি  রজনীকান্ত সেনের গানের তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না। 'তব চরণ নিম্নে' গানটি সুভাষচন্দ্র নিজস্ব কন্ঠে মাঝে মাঝে গাইতেন। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে  রজনীকান্ত সেনের জনপ্রিয় গান 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়'   গানটি সুভাষচন্দ্র স্নান ঘরে উচ্চৈঃস্বরে গাইতেন, একথা জানিয়েছেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র শিশিরকুমার বসু। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে  কবি ও সাহিত্যিকদের অবদান সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন সবিশেষ কৃতজ্ঞ।

(৩) সুভাষচন্দ্র ছিলেন  দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক গান ও নাটকের অকৃত্রিম অনুরাগী  ভক্ত।  তিনি তখন কটকের  কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন শহীদ ক্ষুদিরাম দিবস উপলক্ষে ছাত্রাবাসে অরন্ধন দিবস পালন করা হয়। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ও তাঁর শিক্ষা গুরু বেণীমাধব দাসের উৎসাহে  দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের " বঙ্গ আমার জননী আমার' গানটি গাওয়া হয়। সেই সময়ে গানটি সভা-সমাবেশে গাওয়া নিষিদ্ধ  ছিল। এছাড়াও তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কয়েকটি গান খুব পছন্দ করতেন। " ভারত আমার ভারত আমার', ' ধাও ধাও সমর ক্ষেত্রে'। সুভাষচন্দ্র সবচেয়ে ভালোলাগা গান ' ধনধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের ই  বসুন্ধরা' । এই গান গুলোর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন তিনি। তিনি দিলীপকুমার রায়কে বলতেন, ' দিলীপ কি অপরূপ চরণ লিখেছিলেন তোমার পিতৃদেব,' 'আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।' গান গুলো শোনার পর অন্য জগতে বিচরণ করতেন সুভাষচন্দ্র। 'প্রতিমা দিয়ে কি পূজিব তোমারে' এই গানটি তিনি নিজে গুন গুন করে গাইতেন। দিলীপকুমার তার সঙ্গে চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে যান, সেখানে একটি গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন, ' ও কে গান গেয়ে গেয়ে চলে যায়'  যা চৈতন্যদেবকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছিল। এই গানটি সুভাষচন্দ্রের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করেছিল, কারণ বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি সুভাষচন্দ্রের  গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ১৯২৩-১৯২৪সালে সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে দিলীপকুমার ইউনিভার্সিটি ইনিস্টিটিউটে রাজবন্দীরদের জন্য কনসার্টের আয়োজন করে। সেখানে 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটকের একটি দৃশ্যে অভিনয় করেন দিলীপকুমার। চরিত্র ছিল এক অন্ধ ভিক্ষুকের। অন্ধ ভিক্ষুকের কন্ঠে একটি গান ছিল। অভিনেতা হিসাবে দিলীপকুমার ছিলেন। সেই সুবিখ্যাত গানটি সুভাষচন্দ্রের প্রিয় ছিল। এই গান প্রেরণা যুগিয়ে ছিল গভীর ভাবে। গানটি জনপ্রিয় দ্বিজেন্দ্র গীতি। " ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে।" আসলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন সুভাষচন্দ্রের জীবনের এক অন্যতম প্রেরণা। তাঁর কথা তিনি বারবার সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন। বহু অনুষ্ঠানে তিনি দিলীপকুমার রায়কে নিজের পিতৃদেবের দেশাত্মবোধক গান গাইতে অনুরোধ করতেন।

(৪) বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান সুভাষচন্দ্র বসুকে শিহরিত, পুলকিত, রোমাঞ্চিত করত। সেই প্রাণমাতানো গানের যুগে  তখন ওভারটুনহল, রামমোহন লাইব্রেরি ও ইউনিভার্সিটি ইনিস্টিটিউটে একাধিক চ্যারিটি কনসার্টে নজরুল ইসলাম স্বকন্ঠে গান গেয়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুর উপস্থিতিতে। দিলীপকুমার রায়ের সাক্ষাৎকার  থেকে জানা যায় যে তাঁর কন্যার 'বিদ্রোহী', কবিতাটি শুনে সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হয়েছিলেন। 'শিকল পরা ছল' গানটি শুনে তাঁর মুখমন্ডল হয়ে উঠেছিল দীপ্ত। দেশবন্ধুর চোখে জল চিকচিক করে উঠেছিল। গানটির মধ্যে কেবল বাংলায় সুপ্তোত্থিত যুবশক্তির অন্তরবহ্নি প্রজ্বলনের শুধু আহ্বান নয়, সুভাষচন্দ্রের নিজের ছায়াও প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ছিলেন এখানে বর্ণীত 'মুক্তিপথের অগ্রদূত' । একথাটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্যবহার করেন তাঁর 'পথের দাবী ' উপন্যাসে  যা সুভাষচন্দ্রের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক সুবোধ সেনগুপ্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, 'পথেরদাবী'র সব্যসাচীর চরিত্র ছিল প্রকৃতপক্ষে সুভাস-চরিত্রের রূপায়ন। নজরুল ইসলামের 'সব্যসাচী' কবিতাটির প্রতি ছত্রে ছত্রে সুভাষ-চরিত্রের প্রতিফলন ঘটেছে। তিনিই ছিলেন নিরস্ত্র বন্দীর দেশের 'যুগশস্ত্রপাণি'  তিনি নবীনমন্ত্রে দীক্ষা দিতে এসেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে দিলীপকুমার রায় বলেছিলেন,' 'ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান' স্তবকটি যখন নজরুল ইসলাম গাইতেন, তখন সুভাষচন্দ্রের মুখ আবেগে রাঙা হয়ে উঠত। ভারতের সর্বাঙ্গীন মুক্তির যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিফলন ঘটেছিল এই গানটির মধ্যে। সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ সাম্যভিত্তিক  সমাজ গড়ে তুলতে। তাঁর মনের কথাকে বাস্তব রূপদান করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, 'আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের' অথবা' দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কাণ্ডারী হুঁশিয়ার'।' জাতের নামে বজ্জাতি সব' গানটি সুভাষচন্দ্রের প্রিয় ছিল। মান্দালয় কারাগৃহে তখন বন্দী সুভাষচন্দ্র বসু, তখন বারবার স্মরণ করেছেন নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গানটি, "কারার ঐ লৌহ কপাট  ভেঙে ফেল কর  রে লোপাট রক্তজমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী।"

বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় সুভাষচন্দ্র সব সময় বলতেন, " আমরা যখন  যুদ্ধে যাব, সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে।"  সুভাষচন্দ্র বসুর দেশপ্রেম ও বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে নজরুল ইসলামের গান গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। নজরুলের 'অগ্রপথিক সৈন্যদল, জোর কদম চল রে চল' গানটি সুভাষচন্দ্রের প্রিয় ছিল। এই গানটি আজাদ হিন্দ ফৌজের ' কদম কদম বাড়ায়ে  যা'  গানটি সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

শেষকথাঃ দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে  ভারতভূখণ্ডের  মুক্তিপুরুষ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জনগণের সাম্রজ্যবাদবিরোধি আন্দোলনের ও সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। তাঁর অসামান্য জীবন জাতীয় আন্দোলনের অধ্যায় থেকে অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। সমকালীন ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্রের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি রহস্যময়়তার অন্তরালে অন্তর্হিত হলেও সমসাময়িক জীবনে তিনি এক যুগ-নায়কের আসনে   সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।--অনেকটা রূপকথার মত তাঁর জীবনের ও ভারতের মুক্তিসাধনার জন্য নিরিবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের কাহিনী দেশের প্রায় ৭৫ বছরের ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গীতের জগৎ  তাঁকে দিয়েছে প্রার্থিত শক্তি ও মনোবল। সঙ্গীতের মধ্যেই তিনি  শুনেছেন মৃত্যুর ভয়াল-ভয়ঙ্ক গর্জন, এবং বজ্রের মধ্যে শুনেছেন বাঁশির সুর অশান্তির অন্তরেই তিনি দেখেছেন শান্তি সুমহান। তিনি ছিলেন আজন্ম আশাবাদী বর্ণময় মানুষ। প্রখ্যাত আইরিশ কবি জর্জ রাসেলের একটি কবিতা ছিল তাঁর জীবনের মহামন্ত্র স্বরূপ-- 'And even when the crushed jewels drop and fade,' -- আপোষহীন সংগ্রামের মহানায়ক সুভাষচন্দ্রের  মুক্তি ও বিপ্লবের মন্ত্র ছিল সঙ্গীত ও কবিতা যা জীবনের প্রেরণার মন্ত্র। এসো তুমি,ঝলসিত সূর্য কিরণ দূর--বহু দূরের পথ অতিক্রম করে কোটি কোটি মানুষের বেদনার্শ্রুবিমথিত জয় পতাকা হাতে নিয়ে। মানুষের মনে যাঁরা চিরস্থায়ী পদাঙ্ক এঁকেছেন, তাদের জীবনের উদয় ও অস্ত  দুটি তারিখ ই  ইতিহাসে থাকে; জন্মোৎসব ও মরণোৎসব   সম্পন্ন করে উত্তরপুরুষ তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। নেতাজি আজ  স্বাধীন ভারতে যে আলোকে প্রকাশিত তাতে রাজনৈতিক সংশয়ের  কোনও আবিলতা নেই, দৃপ্ত মধ্যদিনে  তাঁর পরিচয় সুস্পষ্ট। বহু সংগ্রাম, নিঃস্বার্থপরতা, মানবিকতা বোধ, প্রাণময়তা ও অভিজ্ঞতা আত্মসাৎ করেই  সুভাষচন্দ্র এই অজেয় জীবনীশক্তি লাভ করেছিলেন। মানবিক ও মানসিক শক্তির কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  চিত্তকে  প্রসারিত করতে পেরেছিলেন বলেই নেতাজি তাঁর দৃষ্টিকে নিয়ে যেতে  পেরেছেন স্বদেশের সীমা অতিক্রম করে ইতিহাসের দূর বিস্তৃত ক্ষেত্রে। কোন  পরাভবকেই তিনি অন্তিম সত্য বলে  কোনোদিন মেনে নিতে পারেননি। তাই সুভাষচন্দ্রের চারিত্রিক শক্তিকে আজ স্বাধীন দেশের অন্তরের  মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। আগামী প্রজন্মের তরুণদের আদর্শ হোক তাঁর অমলিন জীবনাদর্শ। 

ডঃ সুবীর মণ্ডল

লোক গবেষক ও প্রাবন্ধিক
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।