অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
সেই ছবিটির গল্প - মীম মিজান

মার বাবা একজন গ্রাম্য সাদামাটা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একান্নবর্তী পরিবারের বড়ছেলে। সংসার সামলানোর পাশাপাশি তিনি ইন্ডিয়ার সীমান্ত থেকে কম দামে লবণ, কাপড় কিনে আনতেন। সেগুলো স্থানীয় কৈমারী বাজারে বিক্রি করতেন। এ ব্যবসা থেকে যা আয় করতেন তা দিয়ে কিছু জমিজমা কিনেছিলেন। তবে বেশিরভাগ জমিই তিনি রেজিস্ট্রি করতে পারেন নি। কারণ তার আপন খালাগণই ছিলেন জমির বিক্রেতা। বিশ্বাস আর খানিক গড্ডালিকা প্রবাহের কারণে জীবনের প্রায় শেষ দিকে এসে তার বড়ছেলে রেজিস্ট্রি করিয়েছেন।

আমি এরকম একজন সাদামাটা মানুষের চার মেয়ে আর দু'ছেলের মধ্যে কনিষ্ঠ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মক্তবে যেতাম। সক্কাল সক্কাল কায়দা-আমপারা বুকে জড়িয়ে দলবেঁধে কাজীপাড়ার মসজিদে বড় ওস্তাদজীর নিকট পড়তে যেতে আসতে কত্ত মজার মজার ঘটনা আর গল্প হতো। সেখানেই শুনতাম কার লগে কার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ে বিষয়টা ত্যামন একটা বুঝতাম না। আমার দ্বিতীয় বোন আনোয়ারা আপার বিয়েও সেসময় হয়। দেখতাম সে বিষয় নিয়ে মক্তবগামী বড় আপাদের মধ্যে কিশোরীসুলভ বহুমাত্রিক আলোচনা। মক্তবের পথে ছিলো তেঁতুলগাছ। সেখান থেকে নাকি আমার দুলাভাই তেঁতুল কুড়োতেন আর বেসামাল লালা ঝরিয়ে ভক্ষণ করতেন।

আমি প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছি তিনটি প্রতিষ্ঠানে। বলতে গেলে চারটি। কেননা একটি প্রতিষ্ঠান মৌয়ামারী রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে(পরবর্তীতে সরকারি) খণ্ডকালীন পাঠ নিয়েছি। স্কুলটি মাত্রই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। দরজাহীন টিনের ঘরে ছিলো চাঁটি। আর বাঁশের তৈরি আঁটালের বেঞ্চ। সেখানে ত্যামনটা ছাত্রছাত্রী ছিলো না৷ আমাদের অনেককেই ভর্তি দেখিয়েছিলো।

আমার প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো কাজীপাড়ায়  অবস্থিত কাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে কৈমারী আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ি। আমি ফাইভ পাশ করে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়ার জন্য সোৎসাহে স্কুল থেকে ছাড়পত্র সংগ্রহ করি। কিন্তু আমার বড়ভাই আমাকে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে কিছুদিন কাজীপাড়া মসজিদের বড় ওস্তাদজীর নিকট উর্দু পড়ান। মনে আছে ওস্তাদজীর 'পাতা কো বাতা দে' এরকম পাঠ।

কিছুদিন পর আমাকে নিয়ে যান গঞ্জিপুর এর একটি হাফেজি মাদ্রাসায়। সেখানে নুরানি পদ্ধতিতে কুরআন পাঠের কায়দা পাঠ করতে করতে রংপুর সিও বাজারের পশ্চিম পার্শ্বে শরিফাবাদে একটি হাফেজি মাদ্রাসায় স্থানান্তরিত করান। সেখানখার স্মৃতির মধ্যে লজিং বাড়িতে বড় ধরনের বড়া দিয়ে রাতের খাওয়া খেয়েছিলাম। যে বড়ার স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। অতঃপর স্থানান্তরিত করেন হারাগাছের চিলমোনের এক বিশাল হাফেজি মাদ্রাসায়। সেখানে আম্মাপারা মুখস্থ করে কুরআনের প্রথমপারা যেই শুরু করেছি অমনি বড়ভাই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন। এবার আবার শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ। কৈমারী দাখিল মাদ্রাসায় এবতেদায়ি পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করান। বুঝেন তাহলে ক'বছর লস গ্যালো? আর কীরকম পাকনামি শিখেছিলাম।

সেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণকালীন সময়ে বাবার সাথে নানাদিন কৈমারী বাজার বা হাটে যেতাম। মনে পড়ে মুলো বেচতে যেতাম। একটাকা বা  আটআনা সের দরে বিক্রি করতাম। অনেকদিন গ্যাছে মুলোর কিছু অংশ বাজারের পাশে ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে হয়েছিলো।

বাবা তার দাড়ি ছোট করতেন প্রায় সপ্তাহে। আর মাসে একবার চুল কাটাতেন। গোঁফ দেখতাম চেঁছে ফেলতেন। আমাকেও মাসে একবার চুল কাটাতে বসাতেন।

বিনোদ কাকা। একজন লম্বা করে গোঁফঅলা কালো চুলের মানুষ। মুখে হাসি লেগেই থাকতো। ছোট্ট টুল, একটি পিঁড়ি আর ইউরিয়ার বস্তার প্যাকেটের উপর পাশাপাশি দু'টো কাঁচি, দু'টো খুর, ফিটকিরি, সেভিং ক্রিম নিয়ে নাপিতপট্টিতে বসতেন। হাটের দিন বিকেল থেকে সন্ধ্যার পর বেশ সময় পর্যন্ত এই পট্টিতে কাজ চলতো। কাঁচির কচকচ শব্দ আর চিরুনির উপর মৃদুমন্দ বারির শব্দ মুখর করে তুলতো। সন্ধ্যা নামলেই কেরোসিনের কুপি জ্বলে উঠতো। তবে বাজারের দিন হাতেগোনা দু'চারজন নাপিত বসতেন। অন্যরা পাশাপাশি এলাকার হাটে চলে যেতেন।

এই বিনোদ কাকার সাথে ছিলো বাবার এক মধুর খদ্দেরীয়-বন্ধুত্ব সম্পর্ক। মাসে একবার করে সেই বিনোদ কাকার টুলের উপর বসিয়ে দিয়ে বলতেন, 'ছাত্র মানুষ, সিলিম ছাইট দ্যাইস।' অতঃপর চলে যেতেন হাটের ভিতর অন্য কাজে। আধাঘন্টা পরে আসতেন। জ্বলন্ত বিড়ি ঠোঁটে। টানতে টানতে বলতেন, 'এই নে তোর দুই টাকা।'

কাকাও দোয়েল পাখি খচিত দু'টাকার নোটটা নিয়ে একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলতেন, 'অনেক সুন্দর করি কাডি দিছুং।' বাবা আমার মাথাটার চারপাশ একনজর দেখে নিতেন।

গতবছর। আমি ত্রিশোর্ধ। বাবা সত্তুরের কোটা পেরিয়েছিলেন। কাকা সম্ভবত পঞ্চাশের ঘর ছেড়েছেন। বাবা বেঁচে ছিলেন। আমার সেই আনোয়ারা আপার স্বামী হাসানুর দুলাভাইসহ কৈমারী গ্যাছি। দুলাভাই চুল কাটাবেন। আমার দাড়ি বড় হয়েছিলো তাই সেভ করাবো। দেখি বিনোদ কাকা। নাপিতপট্টির প্রত্যেকটা দোকান আজ ঘেরা। লোহার এঙ্গেল দিয়ে উপরে টিনের চালা। সরকার এরকম স্থাপনা তৈরি করে স্থানীয় ইজারাদারের মাধ্যমে দোকান বরাদ্দ দিয়েছে। পাশে অনেকেই জায়গা দখল করে পাকা করে ঘর দিয়ে নিজস্ব দোকান খুলেছে। বিনোদ কাকার দোকান সেই বরাদ্দ করা। আমি কাকাকে দেখেই বললাম, 'আমি মৌয়ামারীর মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। আব্বা আমাকে আপনার কাছে নিয়মিত চুল কাটাতে আনতেন। আর দুই টাকা করে দিতেন।'

দেখলাম কাকা খুউব খুশি হলেন। আমার সামগ্রিক বিষয়ে খোঁজ নিলেন। আমি তাকে মনে রেখেছি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। অন্যান্যরা নাকি দামই দ্যায় না। তার ছেলে বয়সী পোলাপাইনরা তার সাথে সমবয়সী আচরণ করতে চায়। আর সেখানে একটু সম্মান পেয়েই আনন্দে চোখ চিকচিক করে উঠেছে তার। বললেন যে আব্বা নাকি আর তার কাছে চুল-দাড়ি কাটাতে যান না। আমি বললাম, 'আব্বা তো হার্ট অ্যাটাক করে প্রচুর অসুস্থ। তাই বাড়িতে মা ও অন্যান্যরা চুল-দাড়ি কেটে দ্যান।'

দুলাভায়ের চুলকাটা শেষে আমার সেভ করালেন। চুলকাটা আর সেভের টাকা নিলেন। দুলাভায়ের বিশটাকা আর আমার দশটাকা। টাকা দিলেন দুলাভাই। কাকা তার পকেট থেকে আটটাকা বেরকরে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আর বললেন, 'তোমাগুলার জন্য দুই টাকাই নেইম বাউ। তোমা ছোয়া আছনেন। আইজো আছেন। তোমার বাপোক মোর কথা কন।' কাকার সেই স্নেহাশিস আচরণে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। শুনলাম কাকা নাকি মাইল্ড স্ট্রোক করেছিলেন বছর দু'য়েক আগে। বেশ খরচাপাতি গেছে সেরে উঠতে। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হন নি।

চলতি বছর। আট অগাস্ট গেলাম সেভ করাতে। করোনার জন্য ত্যামন জনসমাগমে যাওয়া হয় না। তবুও গেলাম। রাত দশটা পেরিয়েছে। ঈদের সপ্তাহ শেষ। লোকজনের সংখ্যাও কম। পট্টির অধিকাংশ দোকানই বন্ধ করেছে। দু'একজন ঝাড়ু দিচ্ছে। দেখি বিনোদ কাকার ঘর খোলা। বড়ছেলেটি পাঁচশো-একশ টাকার নোট গুছানোয় ব্যস্ত। আমি সেভ করার কথা বললে পাশে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তার মধ্যম ভাইটিকে দেখিয়ে দ্যায়।

চলছিলো সেভ। আমি তার বাপের বিষয়ে খুঁটিনাটি সব বললাম। আরো বললাম স্ট্রোকের কথা। সে বক্সে বাজাচ্ছিলো 'খিচ ম্যারি ফটো', 'ম্যারে আখি' ইত্যাদি ঝাকানাকা গান। সে জানালো তার বাপ আর এ দোকানে কাজে আসে না। পশ্চিমদিকের গ্রাম খলানে  একটি দোকান দিয়ে নিরিবিলি কাজ করেন। কৈমারীতে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেপুলে চেয়ারে বসে সেগরেট টানতে টানতে নানাপ্রকার কাটিং করে দিতে বলে। তিনি ওসব কাটিং পারেন না। আর পুচকে ছেলেদের ইঁচড়েপাকামো সেগরেট টেনে টেনে বন্ধুদের পাশে বসিয়ে অশালীন কথাবার্তাও সহ্য করতে পারেন না। ওখানে গ্রামের কিছু বয়স্ক লোক সাধারণভাবে চুল কাটান। দাড়ি কাটান। নানাপ্রকার হাস্যরস গল্প করেন। খুব নাকি স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করেন বিনোদ কাকা।

সেভ করা শেষ। আমি সেই দশটাকা দিয়ে আটটাকা ফেরতের আন্তরিকতার কথাটিও গল্পের ফাঁকে বলে ফেলেছিলাম।

মানিব্যাগ থেকে শ'টাকার একটি নোট বের করে বললাম, 'কিরে কত্ত দেবো?'

:দ্যান আগোত! সে বললো।

আমি নোটটি ওর হাতে দিলাম। নোটটি ড্রয়ারে ঢুকিয়ে তালা মেরে দিলো। কোনো ফেরত দিলো না। আমি জানতে চাইলাম, 'কিরে, ফেরত দিবি না?'

:কী যে কন ভাইজান! ঈদের মার্কেট। আর অনেক রাইত হয়্যা গ্যাইছে না! যাও আইজ। আরেকদিন আইসলে কম নেমো।

মীম মিজান
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কলামিস্ট

এম. ফিল. গবেষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়