অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
একুশ শতকের সংকট এবং সম্ভাবনার পথ (তিন) – দীপিকা ঘোষ

     খাদ্যসংকট এবং খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাঃ বিশ্বব্যাপি মানুষের খাদ্য মূলত পাঁচ ধরনের।  ১: কৃষিশস্য - ধান, গম, যব, ভুট্টা, বার্লি, ডাল, রাই।  ২: আমিষজাতীয় - মাছ, মাংস, ডিম।  ৩: দুগ্ধজাত - দুধ, দই, ছানা, চিজ।  ৪: শাকসব্জি এবং বিভিন্ন ধরনের ফলমূল।  ৫: শর্করাজাতীয় – চিনি, গুড়, মধুসহ বিভিন্ন ধরনের সিরাপ।  সুষম খাদ্য তালিকায় এদের প্রত্যেকটি থাকলেও, ধনীদরিদ্র নির্বিশেষের জীবন ধারণের জন্য সিংহভাগ পূর্ণ হয় কৃষিশস্য থেকেই।  সেই অর্থে ধান, গম, যব, ভুট্টা, বার্লি উৎপাদন যখন প্রয়োজন অনুসারে  জন্মায় না কিংবা সর্বত্র সুষম বন্টণ হয় না,  তখনই খাদ্যসংকট ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়।  অবশ্য সুষম খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিজনিত অসুস্থতাও খাদ্যসংকট ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার  মধ্যে পড়ে।  কারণ সুষম খাদ্যের অভাবেই মানুষ অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। 
     খাদ্যসংকট এবং নিরাপত্তাহীনতা সাময়িক অথবা স্থায়ী দু’রকমই হতে পারে।  সাধারণত আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে খাদ্যসংকট আর নিরাপত্তাহীনতা একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও ব্যাপক অর্থে দুয়ের ভেতরে পার্থক্য রয়েছে।  বাজারে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহে ঘাটতি হলে,  উচ্চ মূল্যের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের কেনার সামর্থ্য হারালে,  প্রাকৃতিক কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে,  জনসংখ্যার তুলনায় কৃষিজমির পরিমাণ কম থাকলে কিংবা চাহিদা অনুযায়ী ফসল উৎপাদন না হলে খাদ্যসংকট তৈরি হয়।   আবার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতায় পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলেও সংকট সৃষ্টি হতে পারে।  খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা  হিসেবে এই অবস্থাকেও চিহ্নিত করা হয়।  অর্থাৎ খাদ্যসংকট ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এক অর্থে একই পরিস্থিতির অবস্থা।  
     তবে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার একটি বিশেষ দিক হলো, অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া।  স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্য দায়ী, নিম্নমানের খাদ্য অথবা খাদ্যে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস কিংবা প্যারাসাইটের উপস্থিতি।  এর থেকে ডায়রিয়া, টাইফয়েড যেমন হয়, তেমনি বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কারণে মারাত্মক অসুস্থতাও দেখা দিতে পারে।  যেমন, কৃষিকাজে এগ্রোকেমিক্যাল ও অজৈব সার ব্যবহারে জন্ম নেয় জটিল চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার।  ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে কৃষিপণ্য থেকে মাংস ও মৎস্যসম্পদ কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলার কাজে বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি ফার্টিলাইজার, এগ্রোকেমিক্যাল, হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিক বহাকাল ধরেই ব্যবহার করা হচ্ছে।  একই সঙ্গে ব্যাপকভাবে জেনিটিক ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে (জিন পরিবর্তন করে নতুন প্রজাতির কৃষিপ্ল্যান্ট সৃষ্টি)  উচ্চ ফলনশীল বীজ তৈরির কাজও কয়েক যুগ ধরে চলছে।    
     প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে খাদ্যসম্পদের পরিমাণ যত বেড়েছে, ততোই বড় হয়েছে জনসংখ্যার আকার।   আরেকভাবে বলা চলে, জনসংখ্যার আকার যত বড় হয়েছে, কৃষিপণ্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তাও তত বেশি দরকার হয়েছে।  অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্যনিরাপত্তা যত বেশি নিশ্চিত হয়েছে,  মানবজাতি ততোই সংখ্যা বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছে।  গত দুই যুগ ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা এবং খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বিশ্বব্যাপি দ্রুতগতিতে বেড়েছে।  তারপরও ২০১২ এর জুন মাসে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন ‘জনসংখ্যা উন্নয়ন’-এর আলোচনা সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের জানিয়েছিলেন, ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব তৈরি করাই বর্তমান শতাব্দীতে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ।  ২০৩০ সাল নাগাদ যাতে একজন মানুষও অভুক্ত না থাকে এবং অপুষ্টিতে না ভোগে, তার জন্য পাঁচটি পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও তখন ঘোষণা করা হয়েছিল।  সে উদ্যোগের সফলতা নিশ্চিত করতে ২০১৪ -এর নভেম্বরে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এবং ফুড এণ্ড এগ্রিকালচার অর্গানইজেশনের যৌথ উদ্যোগে আরও একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।   কিন্তু অভুক্ত মানুষের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা কোনোদিনই সম্ভবপর কিনা সে সম্পর্কে তখনও যেমন, এখনও তেমনি সংশয়টা রয়েই গিয়েছে।  
     ২০৫০ সাল নাগাদ হিউম্যান পপুলেশনের আকার আরও বড় হবে।   খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে ৬০ পার্সেন্ট।  যে কারণে আগে থেকেই কৃষি গবেষণায় অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে দ্বিগুণ কৃষিপণ্য উৎপাদন করে কঠিন চ্যালেঞ্জ শতভাগ মোকাবিলা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।   মাটি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বৈচিত্র্য আনা হয়েছে খাদ্য তালিকায়।   কিন্তু তারপরও ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বেড়েছে।   কেন ব্যাপক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সমস্যার সমাধান সম্ভব হচ্ছে না?  এ জিজ্ঞাসার উত্তরে গবেষকদের রয়েছে বিচিত্র মতামত।  খ্যাতিমান মার্কিন পরিবেশবিদ ডক্টর জনাথনের মতে, ১‘Feeding more people would be easier if all the food people grew went into human hands. But only 60% of the world’s crops are meant for people. Another 35% is used for animal feed, and the final 5% goes to biofuels and other Industrial products.  Meat is the biggest issue. Even with the most efficient meat and dairy systems, feeding crops to animals reduces the world’s potential food supply. To produce one kilogram of edible, boneless beef, people need to use 30 kilograms of grain,’ (‘Can We Feed the World and Sustain the Planet’ by professor Jonathan Foley, University of  Minnesota).  
     এমন পরিস্থিতিতে তাহলে করণীয় কী? মানবহিতাকাঙ্ক্ষিদের জবাব, গরুর মাংসের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে।  বস্তুত মাংস খাওয়া কমিয়ে  ভেগান এবং নিরামিষভোজীর সংখ্যা বাড়াতে হবে।  নিদেনপক্ষে, সপ্তাহে কয়েকটা দিন খাদ্যতালিকা থেকে বিফসহ অন্যান্য মাংসের ডিশ সরিয়ে ফেলতে হবে সম্পূর্ণ।  কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতেই খাদ্য সমস্যার সমাধান হবে তো?  ২০৫০ সালে যখন বর্তমান পরিমাণের সঙ্গে আরও ৬০ কিংবা ৭০ পার্সেন্ট বেশি পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে, তখনও কি গরু-ছাগলের সংখ্যা কমিয়ে তাদের খাদ্য দিয়ে আরও আড়াইশো থেকে তিনশো কোটি বেশি মানুষকে নিয়মিত পোষা সম্ভব হবে?  আসলে একুশ শতকে খাদ্যসংকট এবং খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী কোনটি, এই প্রশ্ন নিয়ে এখনও উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বিতর্কের অবসান ঘটেনি।  এই দুই বিপরীত মেরুর প্রশ্ন তাই ঝুলেই থাকছে -  খাদ্যসংকটের জন্য দায়ী কি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অনিয়ন্ত্রিত জনবিস্ফোরণ ? নাকি উন্নত বিশ্বের প্রয়োজন অতিরিক্ত ভোগবাদ?   
     এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতেই পারে।  ১৯৯৪ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোতে আন্তর্জাতিক আলোচনা সভায় নানা দেশের প্রতিনিধিরা এসেছেন মানব উন্নয়নের বিষয় নিয়ে কথা বলতে।  সেখানে আলোচনা প্রসঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিরা বলে বসলেন , আফ্রিকা কিংবা ভারতের একটি শিশু তার জীবদ্দশায় পৃথিবীর যতটা সম্পদ ভোগ করে, তার কুড়ি গুণ বেশি ভোগ করে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো একটি শিশু।  অতএব, ২ ‘The problem for the World’s environment, they argued, is overconsumption in the North, not overpopulation in the South,’ (‘Do We Consume too much’ by Mark Sagoff, June 1997 Issue, The Atlantic).  এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা রাখতে কেনিয়ার প্রতিনিধি মন্তব্য করলেন, শিল্পোন্নত দেশগুলোই উন্নয়নশীল দেশের সিংহভাগ সম্পদ ব্যবহার করে।  তাঁর কথার প্রতিধ্বনি সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো অন্য দেশের আরেক প্রতিনিধির কণ্ঠেও।  তিনিও বললেন, ঠিক কথা! উন্নত রাষ্ট্রসমূহের জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের মোট সম্পদের ৮০ পার্সেন্ট তারাই ভোগ করে চলেছে! 
     জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে অধিক জনসংখ্যার দায় নেই, এমন মন্তব্য কোনো পরিবেশ বিশেষজ্ঞই করেন না।  তবে সীমিত পৃথিবীতে অধিক জনসংখ্যা একুশ শতকে জনবিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে কিনা এ বিষয়ে যেমন নানা মতের গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তেমনি খাদ্য ঘাটতির কারণে বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, নাকি জনবিস্ফোরণের কারণেই উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়ানো সত্ত্বেও খাদ্যসংকট দেখা দিচ্ছে, তা নিয়েও বিতর্কের খামতি নেই।  একদলের বক্তব্য, ৩ ‘The World’s population continues to grow, but the Earth’s surface doesn’t. And already one in nine people around the world suffers from hunger. Although fertility levels worldwide are declining, life expectancy is increasing, and therefore the global population keeps growing. So how can we feed all these billions without destroying the Earth?’ (www.dw.com. >environment-world-population-day-agriculture …  ‘Sustainable Food for Everyone’? 11th July, 2017).  
     অপর পক্ষের অভিমত, পৃথিবীতে খাদ্যের অভাব নেই।  তা সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশে কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধার বিরুদ্ধে নিয়মিত যুদ্ধ করছে।  গত ত্রিশ বছর ধরে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ (কৃষিপণ্যসহ সব ধরনের খাবার)  জনসংখ্যার তুলনায় বেশি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।   কিন্তু অতি অপচয়, সুষম বণ্টনের অভাব, উন্নত বিশ্বের মধ্যে খাদ্যপণ্য আটকে থাকার দরুন ক্ষুধাহীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।  এছাড়া অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দারিদ্র, খাদ্যপণ্যের অতি মূল্য, এমনকি খাদ্য এবং কৃষি সম্পর্কিত পলিসি গ্রহণকেও অনেকে দায়ী করতে চান।  ৪ ‘World hunger is shameful! There is no shortage of food on the planet, U.N Secretary General Kofi Annan said. But while some countries produce more than they need to feed their people, others do not, and many of these cannot afford to import enough to make up the gap,’ (www.theguardian.com>jun>famine, June 10, 2002).


     খাদ্যপণ্যের অপচয় এবং সুষম বণ্টনের অভাব অবশ্যই খাদ্যসংকট ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী।  পৃথিবীতে প্রতি বছর ১৩০ কোটি টন খাদ্যের অপচয় ঘটে।  এই বাস্তবতা উন্নত এবং উন্নয়নশীল, দুই বিশ্বের ক্ষেত্রেই সত্য।   প্রতি বছর উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়।  যার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ এবং রাষ্টের ওপরে।  এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তারা ক্রয় ক্ষমতা হারায়।  যদিও ধনী ও শিল্পোন্নত দেশ  এবং  স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে একই কারণে অপচয় ঘটে না।  ধনী ও উন্নত দেশে সাধারণত ভোক্তারা খাদ্যের অপচয় করে।   স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বিনষ্ট হয় দুর্বল প্রযুক্তি আর উপযুক্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচারের অভাবে।  সেখানে মজুদিকরণের সুব্যবস্থা না থাকায়, প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং ঠিকমতো না হওয়ায় কাঁচা মাল অনেক সময়েই পচে যায়।  উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে অপচয়ের অনুপাতেও পার্থক্য প্রচুর।  ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ভোক্তারা (গড় প্রতি) বছরে যেখানে ৯৫ থেকে ১১৫ কেজি খাবার নষ্ট করে (উপরন্তু ফলমূল, শাকসব্জি, মাছমাংস তো রয়েইছে) সেখানে দক্ষিণ, দক্ষিণপূর্ব,  পশ্চিম এশিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকায় জনপ্রতি অপচয়ের পরিমাণ ৬ থেকে ১১ কেজির মধ্যে।  শুধুমাত্র  ইউরোপ, আমেরিকা মিলে বছরে যত খাবার নষ্ট করে (২২২ ম্যাট্রিক টন), তার প্রায় সমপরিমাণ কৃষিশস্য উৎপন্ন হয় সাব-সাহারান আফ্রিকার পুরো অঞ্চল জুড়ে (২৩০ ম্যাট্রিক টন)।
     কিন্তু এই বাস্তবতাসত্ত্বেও বলতে হয়, শুধুমাত্র সুষম বন্টন না হওয়ায় এবং অপচয়ের কারণেই যে পৃথিবীতে বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কিংবা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে তা নয়।  জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁদের মতে, জনবিস্ফোরণের ফলে একদিকে উর্বর কৃষিজমির পরিমাণ কমছে, অন্যদিকে বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু।  যার প্রভাবে উৎপাদন প্রতি বছর সর্বত্র প্রত্যাশিত পর্যায়ে হচ্ছে না।  যেমন, দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে রাশিয়ায় যখন ২০১০ সালে পরপর কয়েকটি ভয়াবহ দাবাণলে গম উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়, তখন ছ’মাসের মধ্যেই আরববিশ্ব জুড়ে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ে গণবিদ্রোহ। পশ্চিমের কোনো কোনো ভাববাদীরা যাকে ‘আরব স্প্রিং’ বলে সম্বোধন করে উৎফুল্ল হতে চেয়েছিলেন।     


     বিশ্বায়নের যুগে খাদ্যসংকট আজ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিষয় হয়ে নেই।   আন্তর্জাতিকভাবে সেখানে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে।  উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে খাদ্যসম্ভার।  ২০১৬-তে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক সংগঠন, জরুরিভিত্তিতে ১২ কোটি ৪০ লাখ অভুক্ত মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করেছে।   ২০১৫-এর তুলনায় এই অনুপাত ছিল ২৫ পার্সেন্ট বেশি।   ২০১৭-য় দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় ২০১৬-র তুলনায় আরও ১৬ শতাংশ বেশি পরিমাণ খাদ্যের  দরকার হয়েছিল।  সাব-সাহারান আফ্রিকায়, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোয় ফসল উৎপাদনের পরিমাণ আগে থেকেই সীমিত। এর ওপর ক্রমাগত জনসংখ্যার আকার বড় হচ্ছে।  উত্তর আমেরিকা এবং কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর (বিশেষত রাশিয়া) গম, ভুট্টা আর সয়াবিন রফতানির ওপরে  এখানকার মানুষ নির্ভরশীল।  তাই রফতানিকারক দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলে এখানকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তার প্রভাব পড়ে।  ওদিকে ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও চরম আবহাওয়ার কারণে কৃষিজমি ক্রমাগত উষর, রুগ্ন আর বন্ধ্যা হয়ে উঠছে।  নিচে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকায় জনসংখ্যার কত পার্সেন্ট খাদ্যসংকটে ভুগছে তার তালিকা দেওয়া হলো। 
     এশিয়াঃ  দক্ষিণ এশিয়া  ১৪.৪%, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া  ১১.৫%,  পশ্চিম এশিয়া  ১০.৬%।  মোট জনসংখ্যার  ৩৬.৫%। 
     আফ্রিকাঃ  সাব-সাহারান আফ্রিকা  ২৩%। 
     ল্যাটিন আমেরিকাঃ ক্যারিবিয়ান অঞ্চল  ১৭.৭ %।
     এ কথা ঠিক গত চল্লিশ বছরের তুলনায় জনসংখ্যা বাড়ার তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।   কিন্তু  এশিয়া, আফ্রিকার সবখানে একইভাবে সেটা হচ্ছে না।   তরুণ জনসংখ্যা যেসব রাষ্ট্রে বেশি, সেখানে ২১০০ সাল নাগাদ জনসংকোচনের সম্ভাবনা নেই।  ২০১৭ থেকে ২০৫০-এর মধ্যে আফ্রিকার ২৬টি দেশে পপুলেশন বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হবে।  এশিয়া মহাদেশে আরও বড় হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ ।  এশিয়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে  ৭০ শতাংশ অবদান থাকবে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার।  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার  থাকবে ১৮ শতাংশ।   ১২ শতাংশ থাকবে পূর্ব এশিয়ার।   জনসংখ্যার ৮১ শতাংশই বৃদ্ধি পাবে ক্রমানুসারে ভারত, পাকিস্তান, চীন, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন থেকে ।  ভারত ৩৭ % ,  পাকিস্তান  ১৩% , চীন ১২% , বাংলাদেশ ৮% , ইন্দোনেশিয়া ৭% , ফিলিপাইন ৪% ।   জনসংখ্যার আকার বড় হওয়া মানেই বড় আকারের অর্থনীতি।   আরও বেশি পরিমাণ কৃষিজমির প্রয়োজনীয়তা।  আরও বেশি খাদ্য উৎপাদন।   সেই সঙ্গে আরও বড় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া।  আরও বেশি বুভুক্ষতা।  সামাজিক অস্থিরতায় আরও বেশি অস্থিতিশীলতা। 
     এ কথা ঠিক উন্নয়নশীল বিশ্বে পরিবার প্রতি আয় বেড়েছে।  ব্যবসাবানিজ্যের প্রসারতা বেড়েছে।  জনমানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে কয়েক গুণ।  যাকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে অর্থনৈতিক দারিদ্র সংকোচন বলে।  বাজারে নতুন নতুন খাদ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।   কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি অন্যান্য খাদ্যসম্পদের পরিমাণও বাজারে আমদানি হচ্ছে ক্রমাগত।  একই সঙ্গে সঙ্গত কারণে বেড়ে চলেছে উৎপাদনের খরচ, জ্বালানি মূল্য।  অতি ব্যবহারে নিঃশেষিত হচ্ছে ভূগর্ভের জলরাশি।  বাসস্থানের প্রয়োজনে কৃষিজমি কমছে। কৃষিজমির কারণে ধ্বংস হচ্ছে অরণ্য।  অরণ্য ধ্বংসের ফলে জীববৈচিত্র বিলুপ্ত হচ্ছে।  নগরায়ন, শিল্পায়ন দূষিত করছে পরিবেশকে।   পরিণতিতে বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু।   অবশ্য জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণগুলো হঠাৎ করে একুশ শতকে তৈরি হয়নি।   বর্তমানে যা কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে তার বাতাবরণ রচিত হয়েছে শতাব্দীকাল আগেই।   কিন্তু একুশ শতকে বিরাট জনসংখ্যার চরম কর্মধারা এই বিপর্যয়কে আরও দ্রুতগতি দিচ্ছে।  প্রবলতা দিচ্ছে তার রূপকে।   
     ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যাই শুধু বাড়বে না।  কৃষি উৎপাদনের পরিমাণও কমতে থাকবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে।  জনসংখ্যার প্রয়োজনে নতুন পরিকল্পনা, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়ে কৃষি উন্নয়নের কাজ শতাব্দীকাল ধরেই চলছে।  এ যাবৎ সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই বারবার পূরণ করা হয়েছে খাদ্যঘাটতি।  ভবিষ্যতেও নতুন মেধায় নতুন পরিকল্পনা তৈরি হবে।  উদ্ভাবন করা হবে নতুন প্রযুক্তি।  কিন্তু তাতে আদৌ সফলতা আসবে, এমন নিশ্চয়তা  দিতে পারছেন না কৃষিগবেষকেরা।  এ সম্পর্কে তাই উদ্বেগ বাড়ছে  ইউনাইটেড নেশনের খাদ্য ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।  তাঁদের মতে, একটা সময় পরে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলেও কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ স্থবির হয়ে যাবে।  নগরায়ন বৃদ্ধির কারণে একদিকে জমির পরিমাণ সংকুচিত হবে, অন্যদিকে দীর্ঘকাল অজৈব সার এবং বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের অতি ব্যবহারে মাটি হারিয়ে ফেলবে উর্বরতা শক্তি।  পরিণতিতে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বৃদ্ধি পাবে মরুকরণ।   


     বিশ্বব্যাপি একুশ শতকের বিজ্ঞানীদের ভাবনার মাপকাঠি যাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে প্রভাবিত করছেন, তাঁরা কুড়ি শতকের দুজন মার্কিন বিজ্ঞানী।  পরিবেশবিদ উইলিয়াম ভট  ( ১৯০২ - ১৯৬৮)  এবং কৃষিবিদ নরম্যান বরলগ ( ১৯১৪ – ২০০৯)।  দুজনের দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ,  ‘Road to Survival’ by William Vogt এবং ‘Feeding a world of 10 Billion people’ by Norman Borlaug, এখন অবধি  গবেষকদের ধারণা ও বিশ্বাসকে দুই ধারায় প্রবাহিত করে রেখেছে।  ভট বলেছিলেন, বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চয়ই কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।  কিন্তু তার দীর্ঘ স্থায়িত্বের ফলাফল হবে মারাত্মক।  ভট তাই ‘Ecological Limits,’ এবং ‘Planetary Boundaries’ শব্দগুলো বারবার  উল্লেখ করেছেন তাঁর গ্রন্থে।  তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন,  ৫ ‘ The enormous jump in productivity will lead to enormous Environmental damage. As human numbers will increase, our demands for food will exceed the Earth’s carrying capacity. The results will be catastrophic. Erosion, desertification, soil exhaustion, Species extinction, water contamination, that will sooner or later, lead to massive famines,’ (`Road to Survival’ by William Vogt).  
     শান্তিতে নোবেলজয়ী কৃষিবিদ নরম্যান বরলগ বিশ্বকে বিজ্ঞানপ্র‍যুক্তির পরশ দিয়ে বদলে দিয়েছিলেন নাটকীয়ভাবে।  ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল।  বরলগের মতে,  নতুন নতুন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়ে যত খুশি ফসল উৎপাদন করা সব সময়েই সম্ভব হবে।  ‘সবুজ বিপ্লবের’ জন্মদাতা হিসেবে তাঁর অবদান সবচাইতে বেশি আশীর্বাদপুষ্ট করেছিল দারিদ্র-পীড়িত এশিয়াকে। বিভিন্ন ধরনের ইরি ধানের উদ্ভাবন ডক্টর নরম্যানের নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছিল।  এর আগে এই মহাদেশের অর্ধেক রাজ্যই দারিদ্র আর ক্ষুধার পীড়ন সহ্য করেছে নিয়মিত।  সবুজ বিপ্লব ( Green Revolution)  এখানকার কৃষিঅর্থনীতিতে বিপুল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়।  সত্তর এবং আশির দশকে ধান উৎপাদনের পরিমাণ তিন চার গুণ বেড়ে যায়।  আপাতত পৃথিবীর ৮০ শতাংশ ধানই উৎপন্ন হয় এশিয়া মহাদেশে।  যে কারণে ১৯৬০ সালের পর থেকে এখানে জনসংখ্যার আকার আকাশচুম্বী হয়েছে।  আজও তাঁর আশ্বাসবাণীতে  আস্থাশীল অনেক বিশ্বহিতৈষী বিশ্লেষকেরা।   
     ভট এবং বরলগ দুজনেই পৃথিবী এবং জীবজগতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পথ দেখিয়েছেন মানবজাতিকে।  ভট পরিবেশ রক্ষার জন্য, মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কঠোরভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন।  বলেছেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেমন নূন্যতম চাহিদা দিয়ে জীবনযাপন করেছেন, প্রবল ভোগবাদিতা পরিহার করে মানুষকেও সেভাবে জীবন পরিচালনা করতে হবে।  কারণ বিজ্ঞানপ্রযুক্তির শক্তি সীমাহীন নয়।  তার হাতে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ ধরা নেই।  বরলগ বলেছেন, পৃথিবীর মানুষ যাতে বুভুক্ষুর যন্ত্রনা থেকে চিরতরে মুক্তি পায়, তার উপায় অনুসন্ধানের পথ বিজ্ঞানপ্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনেই আমাদের খুঁজে নিতে হবে।  কারণ সেটাই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়।  সন্দেহ নেই, বরলগকে অনুসরণ করে অনেকগুলো দুর্ভিক্ষের ছোবল থেকে কোটি কোটি প্রাণ সংরক্ষিত হয়েছে।  ইরিগেশন এবং রাসায়নিক সার, উদ্ভিদ ও কীটনাশক ক্যামিক্যাল ব্যবহারে ৪০% থেকে ৬০%  বেশি খাদ্যশস্য অনেক দেশেই এখনও পর্যন্ত উৎপন্ন হচ্ছে।  


     তবে বাস্তবতা হলো,  সবুজ বিপ্লব অনুসরণ করে অধিক জনসংখ্যার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অল্প পরিমাণ কৃষিজমিতে অতীতের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি কৃষিশস্য উৎপাদন করা সম্ভব হলেও খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে শতভাগ নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা যায়নি।  সবুজ বিপ্লব কৃষিবানিজ্যের লক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় একদিকে অতিরিক্ত এগ্রোকেমিক্যাল এবং সারের ব্যবহার পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে,  জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করেছে, অন্যদিকে মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রেও হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।  সিনথেটিক ফার্টিলাইজারে মারকিউরি, লিড, নিকেল, ইউরেনিয়ামসহ আরও অনেকগুলো ধাতব পদার্থের মিশ্রণ থাকায় এগুলো লিভার, ফুসফুস, কিডনি, ব্রেন, প্রোস্টেট ক্যান্সারসহ আরও কয়েক ধরনের ক্যান্সারের সম্ভাবনাকে ছয়গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।  এছাড়াও এতে রয়েছে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, পটাসিয়াম ক্লোরাইড, ক্যাডমিয়ামের মতো রাসায়নিক পদার্থ।  যার অনিয়ন্ত্রিত এবং দীর্ঘ ব্যবহারে  চোখ ও চামড়ার অসুখ, গ্যাস্ট্রিক, রক্ত আমাশয়, নার্ভের অসুখ, পেট রোগ সৃষ্টি হয়।  অনিয়ন্ত্রিত মাসল মুভমেন্ট, ব্রঙ্ককাইটিস, হার্ট এবং কিডনির  ওপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলে।  এছাড়াও অজৈব সারের পাশাপাশি কীট এবং আগাছানাশক কেমিক্যাল ব্যবহারে মাটির পুষ্টি ধীরে ধীরে নষ্ট হয় এবং কৃষিজমি অনুর্বর হয়ে পড়ে। 
     নিঃসন্দেহে বিশ্বব্যাপি ‘সবুজ বিপ্লবের’ অবদান অনেক।   কেবল যে কোটি কোটি টন খাদ্য ফলিয়ে লক্ষ লক্ষ বুভুক্ষু মানুষের জীবন রক্ষা করেছে, তাই নয়।  অল্প কৃষিজমিতে অধিক খাদ্য উৎপন্ন করায় হাজার হাজার হেক্টর ভূমিখণ্ড এর ফলে অব্যবহৃত রাখা গেছে।   কিন্তু তারপরেও ডক্টর নরম্যানের সবুজ বিপ্লব অতিরিক্ত জনসংখ্যার ক্ষেত্রে পরম আশ্বাস হতে পারেনি।  ৬ ‘The Green Revolution brought new irrigation techniques, hybrid seeds, fertilizers, pesticides, herbicides and mechanization. It averted hunger for millions of people.  But it was not always the panacea for solving the myriad of poverty, food security and nutrition problems facing poor societies. In India, farmers find that benefits of pesticides and herbicides may come at a tragically high cost,’(www.usnews.com>news>world news, The Toxic Consequences of the Green Revolution / World News, July 7, 2008). 
     খাদ্যসংকটের কারণে, খাদ্যনিরাপত্তার অভাবে ভবিষ্যতে আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ কি সংঘটিত হবে? উর্বর কৃষিভূমির দখলদারিত্ব নিয়ে এরই মধ্যে বিশ্ব জুড়ে প্রবল প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।  খাদ্যসংকট নিরসনের নামে বিদেশী কোম্পানিগুলো এখন দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে শস্য উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে তাই।  তাতে দরিদ্র কৃষকের হাত থেকে কৃষিজমি এদের হাতে চলে যাচ্ছে।  পৃথিবীর বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ চীনও সামিল হয়েছে এই প্রতিযোগিতায়।  কারণ নিজের দেশে আগের তুলনায় ছয়-সাত গুণ বেশি পরিমাণ ফসল ফলিয়েও সংকট মোচন করা সম্ভব হচ্ছে না।  ওদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারত উদিত শক্তির প্রতীক হয়েও জনসংখ্যার ভারে টালমাটাল।  ২০৩০ সালের মধ্যেই তার জনসংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে যাবে।  অতএব এখানে কৃষি, অর্থনীতি, শিল্পোন্নয়নে অসাধারণ সাফল্য এলেও খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি এখনও আদর্শিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।  গত তিন যুগ ধরে পপুলেশন দ্রুত বাড়ায় সঙ্গত কারণেই কৃষিজমির পরিমাণ  হ্রাস পাচ্ছে।  ওদিকে ল্যাটিন আমেরিকায়, দক্ষিণ আমেরিকায় কয়েক বছর ধরে চরম আবহাওয়া বিরাজ করায় উৎপাদনশীলতায় ঘাটতি শুরু হয়েছে।  প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য সংগৃহীত না হওয়ায় রাষ্ট্রসংঘের খাদ্যগুদামগুলোও দ্রুত নিঃশেষিত।  
     দারিদ্রের কারণে মানুষের জীবনে খাদ্যসংকট বিশ্বের চিরন্তন বাস্তবতা।  যার কারণকে চিরকাল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈষম্যের পরিস্থিতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু একুশ শতকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জনসংখ্যা বিস্ফোরণেরর কারণে খাদ্যসংকটের যে প্রবলতা নজর কাড়ছে, তাতে বহু কৃষিগবেষক এবং কৃষকেরা বিশ্বাস করেন, খাদ্যসংকট দূরীকরণে দ্বিতীয়বারের মতো আবারও নতুন রকমে ‘ সবুজ বিপ্লবের’ প্রয়োজন।   খাদ্যঘাটতি দূরীকরণ এবং নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য যেসব পদক্ষেপ অনুসরণ করার পরামর্শ এখন দেওয়া হচ্ছে সেগুলো হলো, (১) কৃষিউন্নয়নে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার।  (২) নতুন জেনিটিক্যালি মডিফাইড প্ল্যান্ট সৃষ্টি করা (যা পরিবর্তিত জলবায়ুতে উচ্চ ফলন দিতে সক্ষম।  যাতে কম কীটনাশক, উদ্ভিদনাশক এবং জল ব্যবহারের প্রয়োজন হবে)।  (৩) জৈব সার আবিষ্কার (যা মাটির স্বাভাবিক পুষ্টি সংরক্ষণ করবে।  পরিবেশ দূষণ ঘটাবে না)।  (৪) বায়োফুয়েলের জন্য কৃষিজমির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা।  (৫)  গ্রীনহাউস গ্যাস উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা।  (৬) কৃষিবিষয়ে  কৃষকদের আধুনিক শিক্ষা দান।  (৭)  দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে বৈশ্বিক সহযোগিতা সৃষ্টি।  (৮) বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় খাদ্যসংগ্রহশালা নির্মাণ। (৯) দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতিমালা তৈরি না করা।  (১০) খাদ্যসম্পদের অপচয়রোধ।  (১১) খাদ্যসম্পদের সুষম বণ্টন।  
    একুশ শতকের বিজ্ঞান প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতায় এসব পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সফল করা কতটা চ্যালেঞ্জের, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা  গবেষকেরা এরই মধ্যে নানাভাবে দেখিয়েছেন।  ওদিকে জেনিটিক্যালি মডিফাইড প্ল্যান্টের ব্যাপারেও মতপার্থক্য রয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে।  কেউ একে খাদ্যঘাটতি পূরণের একমাত্র সম্ভাবনা হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন।  কেউ অর্থনৈতিক সফলতার সোপান হিসেবে দারিদ্র দূরীকরণের উপায় হিসেবে ভাবছেন।  কেউ আবার জনস্বাস্থ্য সংকটের কারণ হিসেবেও দেখছেন।  কারণ গবেষণায় ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু’ রকম ফলাফলই পাওয়া যাচ্ছে।  যদিও নব্বইয়ের দশক থেকে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এই খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করছে, তা সত্ত্বেও সব ধরনের ভোক্তারাই এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।  বিশেষত ধনী এবং সুউন্নত দেশগুলোতে।  এসব খাদ্যের মধ্যে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, আলু, সয়াবিন, মাছ, মাংস, বিভিন্ন ফল ও শাকসব্জি।  যাহোক, গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জিন পরিবর্তনের সুবিধা, অসুবিধার কয়েকটি দিক এখানে তুলে ধরা হলো। 
    সুবিধা: (১) এতে শক্তিশালী কৃষিবীজ তৈরি করা যায়।  (২)  শক্তিশালী হওয়ায় ক্ষতিকর পোকা আক্রমণ করতে পারে না।  (৩) রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি থাকে। (৪) জমিতে আগাছা ও কীটনাশক কেমিক্যাল কম পরিমাণে ব্যবহারের দরকার হয়। (৪) অল্প কৃষিজমিতেই অধিক ফসল উৎপন্ন করা সম্ভব।  (৫) উৎপাদন খরচ কম।  (৬) কম উৎপাদন খরচ এবং ফসল বেশি হওয়ায় কৃষকের ইনকাম বেশি হওয়ার সম্ভাবনা।  (৭) ফুড সাপ্লাই বেশি হলে খাদ্যমূল্য কম হবে এবং সাধারণের ক্রয় ক্ষমতাও বাড়বে।  (৮) পরবির্তিত জলবায়ুতেও (চরম  শুষ্কতায় কিংবা বরফঢাকা শীতে) ফসল চাষ সম্ভব হবে।  (৯) নতুন নতুন কৃষিবীজ সৃষ্টি করা যাবে।  (১০) এতে খাদ্যপুষ্টির অনুপাতও থাকবে বেশি।
    অসুবিধা: (১) অ্যালার্জি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।  (২) শতভাগ পরিবেশবান্ধব নয়।  (৩)  জীবদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে।  (৪) খাওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়।  (৫)  নতুন, নতুন রোগের সূচনা করে।  (৬) জেনিটিক পলিউশন জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে, (জেনিটিক পলিউশনের কারণে বন্য জীবজন্তুর নানা অসুস্থতা দেখা দেয়)।  (৭) কৃষিশস্য উৎপাদন হুমকির মধ্যে পড়তে পারে ( আইডেনটিক্যাল হওয়ার কারণে, অর্থাৎ প্রযুক্তিগতভাবে একই রকম হওয়ার জন্য একটি বীজের যদি সমস্যা হয়, তাহলে অবশিষ্ট বীজেরও একই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।  ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়)।  সুতরাং বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা হলো, জিন পরিবর্তিত খাদ্য পৃথিবীর খাদ্যসংকট দূরীকরণ এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যার সমাধান দিতে পারলেও এর ব্যবহারে বিশেষ হুঁশিয়ার থাকা দরকার। যাতে পারিপার্শ্বিকতার ওপর এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে  নেতিবচাক দিকগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানো যায়।     
     এই পরিস্থিতিতে তাই পুরনো প্রশ্নটাই এসে যায়, খাদ্যসংকট এবং খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সমাধান তাহলে  কিভাবে সম্ভব?  আরও বড় জনসংখ্যার জন্য আরও বেশি খাদ্য উৎপাদন করে সমস্যার সমাধান কি সম্ভব ভবিষ্যতে? ৭ ‘Humanity has defeated the negative feedback loop relating food supply to population. We continue to grow more food and then instead of stabilizing our population, we allow it to grow at even faster rates, requiring even more food.  As part of this process, we are turning the biomass of the planet into human mass, and by using fossil fuels to do so are expanding 10 calories of energy to obtain each single calorie of food. We are preempting land, resources, and habitat for human consumption at the expense of other species, our neighbors in the community of life, and are whittling away at the very capital of our planet. By increasing consumption and the number of people, we are removing bricks from the foundation of our building – from the biosphere which sustains us. The current human-induced extinction rate is approximately 100 times the normal background extinction rate,’ (‘Food Production and Population Growth’ by Daniel Quinn and Alan D Thornhill).    
     বর্তমান সভ্যতা এমন এক কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, বিজ্ঞানপ্রযুক্তির আবিষ্কার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছে।  তারপরও পৃথিবীর সীমাবদ্ধতা মেনে না নিয়ে, বর্তমান বাস্তবতাকে অস্বীকার করে যদি বসুন্ধরাকে আরও বেশি ব্যবহার করে মানুষ ভবিষ্যত স্বপ্ন দেখতে চায়, তাহলে সফলতার চাইতে ব্যর্থতার বেদনাই গভীরভাবে ফিরে আসবে।  অতএব আজকের প্রচলিত পথ ধরে নয়, মানুষকে হাঁটতে হবে পরিবর্তিত পথ ধরেই।  যে পথে  চললে বসুন্ধরা পৃথিবী ভবিষ্যতে উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, পশুপাখী, মানুষ সবার জন্যই পরম আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে। 
দীপিকা ঘোষ । ওহাইয়ো, যুক্তরাষ্ট্র