অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
বাণীতে নজরুল অসীম-অফুরান - লাবণ্য কান্তা

     বি কাজী নজরুল ইসলাম সঙ্গীতে যে বাণী রেখে গেছেন তা শুধু শুনেই মন থেমে যাবে এমন নয়, এই বাণীগুলো বাজতে থাকে মনের কোণে বারে বারে, ভাবতে অবসর করে দেয় গানের বাণীগুলোকে ভেঙে তার ভেতরের সুধা পান করতে। গানগুলো কবিতাই, আর কবিতা  বহুমাত্রিক। তাই গানের বাণীগুলো প্রতিটি শ্রোতার শ্রুতিতে যে একই মাত্রা নিয়ে আসবে এমন নয়। ভিন্নজনের কাছে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসবে, তেমনি একটি গানের বাণী -
"কাবেরী নদী - জলে কে গো বালিকা
আনমনে ভাসাও চম্পা -শেফালিকা।।" 
     উপরোক্ত লাইন দুটি গানটির স্থায়ী। এখানে কবি প্রশ্ন করছেন সেই মেয়েটিকে, যাকে তিনি দেখেছিলেন কাবেরী নদীর জলে কোনো এক ভোরবেলাতে আনমনে চম্পা আর শেফালিসহ আরো অনেক ধরণের ফুল ভাসাতে। সেই মেয়েটি তাহলে কে? সেই মেয়েটির নাম গানের বাণীতে উল্লেখ নেই, তাহলে কি করে শ্রোতা চিনবে সেই মেয়েটিকে, যার কাছে কবির প্রশ্ন! সেই মেয়েটিকে জানতে হলে বুঝতে হলে জানতে হবে প্রথমেই সেই নদীর কথা, যে নদীটিতে সেই মেয়েটি ফুল ভাসিয়েছিলো। সেই নদীর নাম " কাবেরী "। 
     কবির গানের বাণীতে অন্য কোনো নদী না এসে কাবেরী-ই বা এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র সেই কবি-ই জানতেন, শ্রোতার কাছে চিরকাল অজানাই হয়তো থেকে যাবে। তাই সেই মেয়েটিকে জানতে হলে, জানতে হবে সেই নদীর কথা। সেই নদীটি কোথায়? আমরা জানি কাবেরী দক্ষিণ ভারতের একটি নদী, যার নাম পুরাণে সপ্তগঙ্গার নামের একটি নদী নামে  অন্তর্ভূক্ত। সেই সপ্তগঙ্গার একটি হলো কাবেরী এবং তা কর্ণাটকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। সেই  সূত্রে কাবেরী নদীর জলে যে মেয়েটি ফুল ভাসিয়েছিলো সে কর্ণাটকার একটি শ্যামা মেয়ে। হিন্দু শাস্ত্রমতে সপ্তগঙ্গার জলে ফুল ভাসিয়ে পুজা-অর্চণার কথা উল্লেখ রয়েছে। কবি কখনো হয়তো দক্ষিণ ভারতের সেই শ্যামা মেয়েটিকে দেখেছিলেন কাবেরী নদীর জলে ফুল ভাসাতে, সেই দৃশ্যটিকে গানের বাণীতে রেখেছেন অমর করে। সেই অচেনা, অজানা শ্যামা মেয়েটির কাছেই কবির বড় মধুর প্রশ্ন, কে গো তুমি বালিকা, তোমার নাম কি? এত আনমনা হয়ে তুমি ফুল ভাসাচ্ছো যে! 
"প্রভাত সিনানে আসি অলসে
কঙ্কন- তাল হানো কলসে
খেলে সমীরণ লয়ে কবরীর মালিকা।।"
      অলস চোখে মেয়েটি নিশ্চয় এসেছিলো ভোরবেলাতে কাবেরী নদীতীরে, তখনো তার চোখে ঘুমের রেশ  লেগে রয়েছে কিন্তু তবুও সে কাবেরীতীরে এসেছে __ কাবেরীজলে স্নান শেষে ফুল ভাসাবে বলে। কিন্তু কবি দেখলেন, মেয়েটি স্নান করতে এসে অলস হয়ে বসে আছে আনমনে। সাথে করে নিয়ে এসেছে মাটির কলস, যাবার বেলায় কাবেরী নদী থেকে জল ভরে নিয়ে যাবে বলে। আনমনে সবকিছু ভুলে সে কলসে সুরের তাল তুলেছে। তার হাতে যে কঙ্কন সে পরে রয়েছে সেই কঙ্কনেই কলসে সুর তুলেছে ভোরের বাতাসে। তার কঙ্কনের ঝঙ্কারে কলসের গায়ে যে রিনিঝিনি বেজে উঠেছে নদীতীরের হাওয়ায়, সেই হাওয়াও যেন আনন্দে বিভোর হয়ে মেয়েটির চুলে খুসে রাখা ফুলের মালিকার সাথে খেলা করছে।
     তাই কবির মনে সেই প্রশ্ন জেগেছে, কে তুমি বালিকা? আনমনে বসে আছো সব ভুলে? কিন্তু কঙ্কনে তাল বেজে যাচ্ছে কলসে, কী মনোমুগ্ধকর বাণী! যেন কাবেরী নদী ও সেই অপরিচিতা মেয়েটি মিলেমিশে এক অপূর্ব মূরতি সৃষ্টি করেছে ভোরের হাওয়ায়; আর কবির মনে গান এলো __ “কে গো বালিকা, আনমনে ভাসাও চম্পা-শেফালিকা?”  
“দিগন্তে অনুরাগে নবারুণ জাগে
তব জল ঢল ঢল করুণা মাগে।” 
ঝিলাম, রেবা নদী-তীরে,
মেঘদূত বুঝি খুঁজে ফিরে
তোমারেই তন্বী শ্যামা কর্ণাটিকা।”
     তার মাঝেই দিগন্ত এসে ধরা দিলো কবির চোখে। দিগন্তে নবারুণ জেগে উঠেছে অনুরাগে, সেই অনুরাগি নতুন অরুণ কবির মনে কি অনুভূতি জাগিয়েছে? গানের বাণী বলছে, দিগন্ত রক্তিম আলোয়ে আলোকিত হয়ে উঠেছে, সেই রক্তিম দিগন্তে নতুন অরুণ ভীষণ কৌতুহলী হয়ে সেই অপরিচিতা মেয়েটির কাছে কাবেরী নদীর টলমল জল অর্ঘ্য-অঞ্জলি চাইছে। সাধারণত সনাতন পরম্পরায় সকালের রাঙা অরুণকে অর্ঘ্য-অঞ্জলি প্রদান করা হয়ে থাকে শুদ্ধ জলের দ্বারা মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে __
“জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম। 
ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।।”
     কাবেরী-তীরে ভোরের বেলায় নদীজলে স্নান করতে আসা সেই মেয়েটিকে দেখে কবির সেই কথাই মনে পড়ছে ভোরের নতুন অরুণ অনুরাগি হয়ে রয়েছে যেন সেই মেয়েটি এখনি নদীজলে অঞ্জলি- অর্ঘ্য প্রদান করবে তাঁকে।
     কবি মনে সেইসাথেই মেঘদূতের কথাও মনে পড়েছে। যক্ষের বার্তাবাহক মেঘ বুঝি ঝিলাম আর রেবা নদীর তীরে থেমে রয়েছে কিছুক্ষণ সেই মেয়েকে দেখার জন্য। কিন্তু সেই তন্বী শ্যামা মেয়ে যে কাবেরী তীরে বসে আছে! মেঘদূতকে যক্ষের বার্তা নিয়ে যেতে হবে অলকাতে। যাত্রাপথে অনেক নদী-পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে যেতে হবে। সেই পথে ঝিলাম ও রেবা নদীর সাথেও দেখা হবে মেঘদূতের। কবি মনে সেই ঝিলাম ও রেবার কথাও মনে পড়েছে কাবেরীতীরে। কিন্তু ঝিলাম আর রেবা কাবেরী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। পুরাণ মতে কিংবা লোকমুখ মতে নর্মদা নদীই রেবা নদী নামেও পরিচিত। নর্মদাও সপ্তগঙ্গার আরেকটি নদী। কবি সঞ্চারীতে বলতে চেয়েছেন, শ্যামা মেয়েটি যে কাবেরী নদীতীরে বসে আছে আনমনে কাবেরীর জলে ফুল ভাসাবে বলে, সে দিগন্তের নতুন অরুণকে জল প্রদান হয়তো করবে নয়তো নয় কিন্তু ঝিলাম আর রেবা নদীতীরে মেঘদূত তাকে খুঁজে ফিরছে। মেঘদূত থেমে আছে ঝিলাম আর রেবাতীরের শূন্য আকাশে কিংবা দিগন্তে সেও নতুন অরুণের মতো শ্যামা মেয়ের কাছে পুষ্পাঞ্জলি পাওয়ার জন্য আগ্রহী। 
     কবির বাণীতে যে প্রশ্নটি তিনি রেখেছেন সেই বালিকাটি কে? তুমি কে গো বালিকা, কেন তুমি আনমনে ভাসাও চম্পা-শেফালিকা কাবেরী নদীজলে? এতক্ষণে বুঝা যায় যে সেই শ্যামা মেয়েটি কর্নাটকারই মেয়ে। স্থায়ীতে কবি প্রশ্ন করেছেন সেই মেয়েকে, তুমি কে? অন্তরাতে তার সমস্ত  অস্তিত্ত্বকে তুলে ধরেছেন তাঁর মধুর বাণীতে আর সঞ্চারীতে এসে সেই অপরিচিতা মেয়েটির সম্পূর্ণ পরিচয় বলে দিয়েছেন মাত্র দুটি শব্দে যে সে কর্নাটকার শ্যামা তন্বী মেয়ে। কারণ, কর্নাটকার মেয়েরা শ্যামলা বরণের হয়ে থাকে; আর কাবেরী নদী যখন কর্নাটকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিতা তখন এতো ভোরে কোথা থেকে এই মেয়ে এসেছে? সে তো এই অববাহিকারই কেউ হবে। কবির কল্পনায় সেই মেয়ে তাই কর্নাটকারই শ্যামা মেয়ে হয়ে ধরা দিয়েছে এবং তার নাম তিনি দিয়েছেন কর্নাটিকা। কী সুন্দর নাম দিয়েছেন কবি তাঁর গানের বাণীতে সেই মেয়ের! তার হাতে অঞ্জলির ফুল শেফালিকার সাথেই যেন নামটি মিলে মিশে হয়েছে কর্ণাটিকা।
কবি বড় দৃঢ় চিত্তে বলেছেন,__ 
“মেঘদূত বুঝি খুঁজে ফিরে তোমারেই তন্বী শ্যামা কর্ণাটিকা।”
     কবি কাজী নজরুল ইসলামের এসব গানের বাণীতে মন চলে যায় বহু দূর-দূরান্তে, ভেসে বেড়ায় কখনো কোনো নদীতীরে, কখনো কোনো ফুলের কাছে, কখনো কোনো বৃক্ষের কাছে, কখনো কোনো আশ্রমে, কখনো হিমালয়ের মন্দাকিনীর তীরে, কখনো মানস সরোবরে, বিল-ঝিল-ঝর্ণার কাছে, কখনো শরতের শিশিরে, কখনো বর্ষার রিমঝিমে মন ভেসে যায়। তাঁর বাণীগুলো তাই শুধু শ্রোতাকে শ্রুতিতেই আবদ্ধ রাখে না, শ্রোতার মনকে মুহূর্তেই ভাবুক করে তোলে। শ্রোতার ভাবনার সাথে মন ভেসে যায় দূরে বহুদূরে, যতদূর মনকে নিয়ে যাওয়া যায় ততোদূর এসব বাণী নিয়ে যেতে পারে। কবি নজরুলের এসব বাণীর বিস্তৃতি তাই অসীম-অফুরান।       

লাবণ্য কান্তা 

লাবণ্য কান্তা। ঢাকা