অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’- সুইটি রাণী বণিক

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন অনন্ত প্রেমের কবি! তার ছিল অফুরন্ত ভালবাসা জগৎ!  তিনি প্রেম- বিরহের কাব্য- গান-উপন্যাস বহুধর্মী সৃষ্টিশীল রূপায়নে বাংলা সাহিত্য শিল্পায়নের হৃদয় স্পর্শী গঙ্গার মত প্রবাহমান স্রোতধারা যা পাঠক মনকে প্রেমের আনন্দ উপভোগ করিয়ে বিরহ বেদনার করুন সুরে অবলোকন করিয়েছেন অপূর্ব সৃষ্টির লীলায়।

আমার বেদনা আজি রূপ ধরি’ শত গীত-সুরে
নিখিল বিরহী-কন্ঠে–বিরহিণী–তব তরে ঝুরে!
এ-পারে ও-পারে মোরা, নাই নাই কূল!
তুমি দাও আঁখি-জল, আমি দেই ফুল!
(কবির ‘তোমারে পড়িছে মনে’ কবিতার শেষ চার লাইন।)

নজরুল মানেই প্রেম, প্রেম মানেই পুজার জগৎ, কবি তার মনের আরাধ্য শক্তি প্রেমের পুজায় অর্ঘ হিসেবে অর্পন করেছেন প্রিয়ার অন্তরে!  কখনো প্রিয়া তার প্রেম বুঝে উঠতে পারে না, কখনো আবার প্রিয়ার হৃদয় তৃষিত হয় কবির ভালবাসা পাবার তৃষ্ণায়।
কবির প্রেমের গান, কখনো আমাদের প্রানে গিয়ে বাজেঃ-
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায় আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি আমারি পিয়াসী বাসনায়। আমার মনের তৃষিত আকাশে কাঁদে সে চাতক আকুল ...
কবি তব মনে অনন্ত প্রেমের জোয়ার যুগযুগ ধরে বয়ে চলবে প্রেমিক দের মনে,

কোথা চাঁদ আমার!
নিখিল ভুবন মোর ঘিরিল আঁধার॥
ওগো বন্ধু আমার, হ'তে কুসুম যদি,
রাখিতাম কেশে তুলি' নিরবধি।
রাখিতাম বুকে চাপি' হ'তে যদি হার॥
আমার উদয়-তারার শাড়ি ছিঁড়েছে কবে,
কামরাঙা শাঁখা আর হাতে কি রবে।
ফিরে এস, খোলা আজো দখিন-দুয়ার॥

কবি তার ভালবাসার পুষ্পার্ঘ গানের মাঝে অর্পন করতে চেয়েছেন প্রিয়ার সৌন্দর্য বর্ননায়। আমরা কবির শীল্প মনের ভালবাসা মিশ্রন খুজে পাই তার এই গানের মধ্যে -
অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে
প্রদীপ-শিখা সম কাঁপিছে প্রাণ মম
তোমারে,সুন্দর,বন্দিতে!
সঙ্গীতে সঙ্গীতে।।

বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান পরিচয় হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন প্রেমিক কবি। আমাদের জাতীয় কবির জীবনে প্রেম এসেছে বহুবার। নারীর প্রেম তার কাব্যে ফেলেছে গভীরতর প্রভাব। যার ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন দ্রোহ ও প্রেমের কবি। তার জীবনে এসব প্রেমের ছোঁয়া বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে অনন্যমাত্রা।

যে বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত হন সেই কবিতাতেই তিনি বলেছেন- ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’। মূলত, নজরুল সাহিত্যধারায় দ্রোহের পাশাপাশি প্রেমের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে যে তারুণ্যের জোরে তাঁর শির চির উন্নত-চির দুরন্ত দুর্মদ সেই তারুণ্য বন্ধনহারা ষোড়শী কুমারীর প্রেমেও উদ্দাম, চঞ্চল মেয়ের ভালবাসায় মুখর।

‘বিদ্রোহী’ কবিতাতে কবি আরও বলেন- ‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণি, তন্বী নয়নে বহ্নি,/ আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!/ আমি উন্মন, মন-উদাসীর,/ আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।’ মূলত, তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের জয়গান গেয়েছেন কবি। মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত কবি প্রেমের শাশ্বত আবেদনের কাছে হার মেনে স্বস্তি খুঁজে পেতে চেয়েছেন- ‘হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে/আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।’

নজরুল রচনায় তেজোদৃপ্ত ও উদ্দীপিত জীবনচেতনার বিপরীতে যে প্রেমচেতনা সেখানে নারীও ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপিত। তাঁর প্রেমমূলক কাব্য ভাবনায় প্রেমিক নজরুলের বিরহী, অভিমানী, অতৃপ্ত ও ক্ষুধার্ত রূপ দেখা যায়। প্রেমের কবিতা ও গানে তাঁর মূল সত্তাটি হচ্ছে বিরহী আত্মার!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কবি নজরুল চলে যান করাচিতে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি করাচির মাটি। তিনি চলে এলেন কলকাতায়, কমরেড মুজাফফর আহমদ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলে নজরুল সম্পাদিত অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ বের করেন। তারপর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘লাঙল ‘প্রকাশিত হয়। লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বিদ্রোহী কবির সাম্যবাদী চরিত্র প্রকাশিত হয়। তখনই ঘোষিত হলো মানবতার জয়গান। 
‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়েছে গেছে সব বাধা ব্যবধান 
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খৃষ্টান’ 

চৌদ্দশো বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল ইসলামই হিন্দু মুসলমান মিলনের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করলে ও সাহিত্যে তা আদৌ যথাযথ ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ব্যক্তি জীবনেও নজরুল তাঁর ব্যবধান রাখেননি। বিয়ে করলেন হিন্দু মেয়ে। তাঁর পুত্রদের নাম রাখলেন হিন্দু মুসলিম ঐতিহ্যকে সমান করে। নজরুল হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের আচার থেকে অন্তর আত্মা অবধি ব্যবহার করেছেন। শুধু কবিতায় নয় গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, গানে সব ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত মানুষেরই মহিমা কীর্তন, মানুষেরই বিজয় ঘোষণা। বহুমাত্রিক নজরুল, ইসলাম ধর্মের অসামান্য সাহিত্যিক রূপ দিয়েছেন তাঁর কবিতায়, তাঁর গানে।

আবার নজরুলের ইসলামি কবিতার একটি প্রধান উদ্দেশ্য, মুসলমানের জাগরণ বা পুনর্জাগরণ। ফলে তাঁর কবিতা গানে ভক্তি ও আত্মসমর্পণ যেমন আছে তেমনি আছে আরও কয়েকটি দিক। নজরুল বিশেষ ভাবে জোর দিয়েছেন ইসলামের সাম্য চেতনায়। তাঁর একটি গানের কথা ধরা যাক—
‘ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি।
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।
আমরা সেই সে জাতি।।’
এই গানে কবি উচ্চ নিচের ভেদহীন ইসলামের কথা বলেছেন, অমুসলিমদের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধের কথা বলেছেন। তেমনি একটি নাত এর কথা—
‘পাঠাও বেহেস্ত হতে হযরত পুনঃ সাম্যের বাণী, আর দেখিতে পারি না মানুষে মানুষে হানাহানি।’

নজরুলের ঈদ বিষয়ক কবিতায় প্রায় সব সময়ই মানুষে মানুষে সাম্যের কথা উচ্চারিত হয়েছে। সম্ভবত নজরুলের কবিতা কৃষকের ঈদে প্রশ্ন তুলেছিলেন কবি—
‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’

বাংলার এ মাটি থেকে এ মৃত্তিকাকে ভালোবেসে আমাদের দেশের উনিশ শতকের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর দেশপ্রেম, জন প্রেম পূর্বের শতাব্দীর বৃহৎ ধারার সঙ্গে সত্যিই একাত্ম। এই মানব প্রেমিক কবির উদ্দেশ্যে বিংশ শতাব্দীর এই শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা সালাম জানিয়ে যেতে

নজরুল প্রধানত রোমান্টিক কবি। কাব্যের ভাষায় তাই অলঙ্কার ব্যবহার স্বভাবজাত । কিন্তু ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে গদ্য ভাষা ব্যবহারের বিশিষ্টতা এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। উপমা-উৎপ্রেক্ষা, যমক শ্লেষ প্রভৃতি অলঙ্কারের অনায়াস প্রয়োগ এ উপন্যাসের ভাষাকে এক অসাধারণ ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত করে তুলেছে।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে নজরুলের জীবনবোধের পরিচয় আমরা পেয়ে থাকি, তার দরিদ্র জীবনকে ছাপিয়ে যেন প্রেম প্রবেশ করে মনের আঙ্গিনায়; সে প্রেম বিয়োগান্তক রুপ ধারন করে! প্রিয়া বঞ্চিত কবি সমাজের অসহায় মানুষের পাশে দাড়ায়,জীবনের মোর নেয় বিদ্রোহী সত্তায় -কয়েকটি উদ্ধৃতি স্মরণ করে নেওয়া যেতে পারে,  
১। “সেজবৌ পাশ ফিরে কাশতে থাকে। মনে হয় ওর প্রাণ গলায় এসে ঠেকেছে। কবর দেবার জন্য বাঁশ কাটার শব্দটা যেমন ভীষণ করুণ শোনায় তেমনি তার কাশির শব্দ ।”
২। “ভোর না হতেই সেজ বৌ’র খোকা সেজ বৌ’র কাছে চলে গেল। শবে বরাত রজনীতে গোরস্থানের মৃতপ্রদীপ যেমন ক্ষণেকের তরে ক্ষীণ আলো দিয়ে নিবে যায়। তেমনি ।”

এছাড়া মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে নজরুল স্থানীয় পরিবেশ নির্মাণে আশ্চর্য দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ব্যক্তি অনুযায়ী মুখের ভাষা, অবস্থা অনুযায়ী পরিচ্ছদ ও আচরণ-উচ্চারণ, এমনকি মিশনারীদের মুখে বাংলা ভাষায় ইংরেজি টানটিও যথাযথ রেখেছেন।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের শিল্পসিদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা এই প্রবন্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এই আলোচনা প্রসঙ্গে অন্য একটি বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বের চিন্তাজগতেও বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। এর প্রভাবে সাহিত্যে প্রভাব ফেললো বস্তুতান্ত্রিকতা। শিল্পের জন্যই শিল্প নয়। মানুষের জন্যই শিল্প। সাহিত্যে খেটে খাওয়া কর্মজীবী মানুষের অনাড়ম্বর ও অভাব অনটনে পর্যুদস্ত জীবনচিত্র ফুটে উঠলো। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এ প্রবণতার ব্যতিক্রম হলো না। এ প্রবণতারই অন্যতম প্রথম রূপকার কাজী নজরুল ইসলাম। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি এই মন্তব্যের সপক্ষে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উৎকর্ষের বিচারে না হলেও এদিক থেকে উপন্যাসটির ঐতিহাসিক মূল্য সমধিক এবং অবশ্যই মূল্যায়নের দাবি রাখে।

"কুহেলিকা"-এ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শ ও মতবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। বিপ্লবী যুবক জাহাঙ্গীর চরিত্র দিয়ে সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতির সফল প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসের রূপরেখা সমসাময়িক হলেও লেখক কাহিনী পরিচর্যা করেছেন নিজের মত করে। ব্যঙ্গ, হাস্যরস ও প্রাণের স্পর্শের পাশাপাশি মিথ-কথনের প্রয়াস রয়েছে---

তরুণ কবি হারুনের মেসে তার রচিত 'নারী কুহেলিকা' কবিতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। জাহাঙ্গীর একজন বিপ্লবী স্বদেশী দলের কর্মী। নারী সম্পর্কে তার ধারণা নেতিবাচক। সে মনে করে ইহারা মায়াবিনীর জাত। ইহারা সকল কল্যাণের পথে মায়াজাল পাতিয়া রাখিয়াছে। ইহারা গহণ পথের কণ্টক, রাজপথের দস্যু। জাহাঙ্গীরের সাথে যোগসূত্র রয়েছে হিন্দু বিপ্লবী প্রম!

একপর্যায়ে কবি নারীর প্রেমকে ছাপিয়ে, বিদ্রোহী হয় দেশ - কাল- পাত্রের কল্যান চিন্তায়! কবির প্রেম প্রান পায় সাম্যের জয়গানে। কবি মানবের জয়গান করেন, কোন জাত-পাতের মধ্যে নয়,তার কাছে  মানুষের চে নহে কিছু মহিয়ান।

এক দিকে আমরা তার কোমল মন তথা ভালবাসার এক প্রেমময় বিশাল জগৎ দেখতে পাই, অন্যদিকে -পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বিদ্রোহের অম্লান স্রোতধারা কবিকে নিয়ে যায় বিশ্বায়নীভবনের চিন্তাধারায়! বাঙ্গালী সমাজ তার কাছে আজ নতশিরে তাকে শ্রদ্ধা জানায়, তার জীবনের গতি বোধ, প্রেম -ভালবাসার এবং বিপ্লবী সাম্যবাদী ধারাকে!
যুগে যুগে তাঁর প্রেম অমর!
অমর তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা!
অমর তাঁর বিশ্ব- বিপ্লবী সাম্যধারার মার্কসবাদী চিন্তাভাবনা!

আমরা ভালবেসে তাকে বলতে পারি -
এক হাতে তাঁর বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’। 

সুইটি রাণী বণিক


সুইটি রাণী বণিক। মুন্সিগঞ্জ