অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
শেখ মুজিব : এক অবিনাশী গান - ড. নূর সালমা খাতুন

     বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই লাল-সবুজের ভূ-খন্ডের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। এই নামটি একজন সম্মোহনী নেতার, একজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের, একজন সরলহৃদয়ের উদারমনা মানুষের যিনি রক্ত-মাংসের মানুষ থেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন, পরিণত হন মহান আদর্শে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি, স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাতা।  মহাবিদ্রোহের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের দিয়েছিলেন আত্মিক মুক্তি, বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে এক মর্যাদাসহ প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিলেন আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের এনে দেন রাজনৈতিক মুক্তি। হাজার বছরের গোলামীর ইতিহাসকে মুছে ফেলে এই জাতির এক অমর বীরত্বগাথা পৃথিবীর ইতিহাসের রচনা করে যান এই মহান নেতা। বিবিসির জরিপে নির্বাচিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুচোখে ভরা ছিল সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা প্রতিকৃতি। এক অক্ষয় অমর ইতিহাসের পুরোধাপুরূষ বঙ্গবন্ধু যার কাছে দেশই ছিল সকল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। এই মহান নেতার সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। 
     বাইগার নদীর তীরে ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। নদীর দু’পাশে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ।  ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কণ্ঠ থেকে, পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে । ১ 
     গোপালগঞ্জের এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামের মনোরম পরিবেশেই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এই সংগ্রামী মানুষটি জন্ম নিয়েছিলেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের প্রথম পুত্র সন্তান তিনি।  গুরুজনরা আদর করে ‘খোকা’ ডাকলেও গ্রামবাসীরা ডাকতো ‘মিয়া ভাই’ বলে। কে জানতো সত্যিকারঅর্থেই তিনি বাঙালি রক্ষাকর্তা তথা অভিভাবক হয়ে উঠবেন একদিন। শেখ মুজিবের শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদামাটিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কিভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর… দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভাল লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন । ২
     প্রকৃতির এই মনোরম ও উদার পরিবেশের নিবিড় সন্নিধ্যে শিশু মুজিব বেড়ে ওঠেন। আবহমান বাংলার আলো-বাতাস তাঁর শরীর ও মনকে পূর্ণতা দেয়।  তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন। 
     গ্রামের মাটি ও মানুষের সাথে শৈশবেই এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় শেখ মুজিবের । সরলপ্রাণা ও উদারমনা দাদা-দাদি ও বাবা-মায়ের সাহচার্য শিশু মুজিবকে হৃদয়বান মানুষে পরিণত করে । করে অধিকার সচেতনও ।  শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজজীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষন ও প্রজাপীড়ন দেখেছেন । চোখে দেখা বাস্তবতা বালক মুজিবকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে । অন্যায়ের প্রতি আপসহীন এই মানুষটি তাই পরবর্তী জীবনে কোন শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি । 
     পরোপকারী এবং বন্ধুপ্রিয় মুজিবের মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে স্কুলে পড়া অবস্থা থেকেই । মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে এই মানুষটি সব মিলিয়ে প্রায় ১২ বছর জেলে কাটিয়েছেন । প্রতিবাদী ও আপসহীন এই নেতা স্কুল জীবনে তাঁর স্কুলের ছাত্রাবাস সংস্কারের দাবি জানান তৎকালীন যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে স্কুল পরিদর্শন করতে এলে । এরপরের সময়টা দীর্ঘ সংগ্রামের । এই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নকে হৃদয়ে ধারণ করে রাজনীতির বন্ধুর পথে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত পদচারণা । ১৯৪২ খ্রি. থেকে ১৯৪৭ খ্রি. পর্যন্ত পাকিস্তান দাবির জন্য মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে যে সব আন্দোলন হয়েছে তার পুরোভাগে ছিলেন তিনি । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৪৩-৪৪ খ্রি. বাংলার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় । শেখ মুজিব তখন গোপালগঞ্জ ও কোলকাতায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন । ১৯৪৬খ্রি. কোলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙার সময় শেখ মুজিব দাঙা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন । ১৯৪৭ খ্রি. এর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কোলকাতা ত্যাগ করে ঢাকায় আসেন এবং ১৯৪৬ খ্রি.এর ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে এসে কতিপয় ছাত্র ও যুবনেতার সাথে পৃথক ছাত্রলীগ গঠন করেন । ১৯৫৩ খ্রি.-এ ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে এ সংগঠনের ‘ছাত্রলীগ’ নামকরণ হয় । শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার সকল জেলায় ঘুরে ঘুরে ছাত্রলীগ গঠন করেন। তাঁর পরিচালিত ছাত্রলীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে । 
     মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব-বাংলার প্রতি অর্থনৈতিক শোষণ ও ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে শুরু করে । সরকারের বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র প্রতিবাদ জানান । ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ শেখ মুজিব দলীয় কর্মীদের ভাষা-আন্দোলন চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন ।  ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৬৫ খ্রি. পর্যন্ত এক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু নতুন রাজনৈতিক চিন্তাধারায় উপনীত হন । দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝতে পারলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কোনদিন স্বায়ত্বশাসন দেবে না । ১৯৬৬ খ্রি.এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছয় দফা দাবি পেশ করেন । এই ঐতিহাসিক ছয় দফার মধ্যে  দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের ভালবাসা কেড়ে নেন তিনি । ইতিহাসের এই মহানায়ক বাঙালিদের বুঝিয়ে দিলেন তারা পাকিস্তানের একটি কলোনি মাত্র । প্রায় ১৯ বছরের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনে শোষিত, নিস্পেসিত, নির্যাতিত জনতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তাদের সমঅধিকার ফিরে পেতে চাইল । আর তখনই ১৯৬৮ খ্রি. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত করা হয় । এখান থেকে মুক্তি লাভের পর শেখ মুজিবকে রেসকোর্সে গণ-সংবর্ধনা দেয়া হয় । তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভুষিত করা হয় ।  জনতার উপস্থিতিতে ১৯৬৯ খ্রি. এর ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব এই সম্মান গ্রহণ করেন । 
  ’৬৯ এর গণ অভুত্থানে হতচকিত পশ্চিমারা ’৭০-এ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় । আর এই নির্বাচনে বাঙালি তাদের প্রাণের নেতাকে রায় দেয় । বিপুল ভোটে জয়ী শেখ মুজিব ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওর্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে আলোচনাসভায় পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’ । 
     ১৯৪৭ এর পূর্ব বাংলা, ১৯৫৬ এর পূর্ব পাকিস্তান হলো ১৯৭০-এ বাংলাদেশ ।  কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাঙালিকে আরও একটি বছর এক রক্তাক্ত পথে হাঁটতে হয় । যে পথের দিশারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । ৭ মার্চ, ১৯৭১-বাঙালির জীবনে এক স্মরণীয় দিন । রেসকোর্সের ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার মাঝে বাধ ভাঙা স্লোগানে মুখরিত অঙ্গনে বীরদর্পে এগিয়ে এলেন মঞ্চের দিকে এক অকুতোভয় বীরপুরুষ । শোনালেন বাঙালি জাতির প্রানণর কথা । বললেন :
     ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস….বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস । ……মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস । আমি প্রধান মন্ত্রিত্ব চাইনা । এদেশের মানুষের অধিকার চাই । আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল । মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো । এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ । এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । ৩ 
     মূলত এটিই ছিল আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা । এই সম্মোহনী নেতার ভাষণে মন্ত্রমুগ্ধ জনতা ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর তাঁর অনুপস্থিতিতেও তাঁর নেতৃত্বকে স্বীকার করে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে । বঙ্গবন্ধু তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসায় একত্রিত করেছিলেন সাত কোটি বাঙালিকে, উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সংগ্রামের পথে হাঁটতে, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার । এই মুক্তিপাগল জনতা মাত্র নয় মাসে বিশ্বের অন্যতম সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে তেমন কোন সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুধু দেশ প্রেম আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পরাস্ত করে । বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম হয় লাল সবুজের পতাকাশোভিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের । বিনিময়ে অবশ্য দিতে হয় এক সাগর রক্ত আর ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণ এবং দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম । পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে স্বাধীনতার জন্য এত প্রাণের বলিদান আর কখনোই ঘটে নি । প্রশ্ন হচ্ছে কোন্‌প্রেরণায় স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেয়াটা এত সহজ হয়ে গিয়েছিল? আসলে সেই প্রেরণার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । 
     সেই জ্যোর্তিময়ী বছর একাত্তরে তখন আমার সত্যিই মানুষ ছিলাম, তখন এক বিশাল মিছিল হয়েছিল, মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মতো সেই জ্যোর্তিময় পুরুষটি । ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখর ছিল এ বাংলার প্রতিটি জনপদ । ….বাঙালির সুদীর্ঘ সময়ের মুক্তি আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সবচেয়ে সফল স্বপ্নদ্রষ্টা পুরুষ । ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে দেখা যাবে এসময়ে বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব ছিল সেই প্রথম দিনের সূর্যের মতো । যিনি সত্তার নতুন আবির্ভাবে জেগে ওঠে প্রশ্ন করেছিলেন, কে তুমি? জবাব ছিল, বাঙালি । ঠিকানা-পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।  ৪ 
     শেখ মুজিবের ধ্যান জ্ঞান সবই ছিল এদেশের আপামর জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণ । তাঁর চোখেই বাঙালি নিজেদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলো । অথচ স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পরেই বাঙালি জাতির এই স্বাপ্নিক মহানায়ককে এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় । যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের আপামর মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি যখন চেষ্টা করছিলেন তখনই দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয় । 
     বঙ্গবন্ধুর আজন্মলালিত স্বপ্ন এদেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়নের জন্য প্রণীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, একাত্তরের পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র আর কতিপয় উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসারের বিশ্বাসঘাতকতা বঙ্গবন্ধুকে পৃথিবী থেকে নিয়ে যায় । ঘাতকের বুলেট ঝাঁজরা করে দেয় তাঁর বুক যেখানে সঞ্চিত ছিল বাঙালির জন্য সীমাহীন ভালবাসা, আর অকৃত্রিম আন্তরিকতা । বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর বলেছেন :
     আমি তো ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি নাই । জীবনভর প্রকাশ্যভাবে রাজনীতি করেছি । যে পথে দেশের মঙ্গল হবে, যে পথে মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তাহাই করেছি ও বলেছি । আজ দুঃখের সাথে ভাবছি আমাকে গোপন ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে শাসকদের একটু বাঁধলো না । এরা তো আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ভাল করে জানে ।  ৫ 
     সহজ-সরল মনের এই মানুষটির পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল অথচ তাঁর আত্মার আত্মীয়, এক কালের সহযাত্রী, সহমর্মী সর্বোপরি যাদের তিনি নিজের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন তাদের তৈরি করা গভীর ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন । তবে এই শ্যামল জনপদ তার শ্রেস্ঠ সন্তানটিকে কখনোই ভুলবে না ।  ক্ষুদ্রমনারা বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যু ঘটালেও বাঙালির অন্তরে, এই জনপদের আলো-বাতাসে তাঁর অক্ষয় অমর অবস্থান । বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরদিন বেঁচে থাকবেন বাঙালি আর বাংলাদেশ নামটির মধ্যে । তাই তো অন্নদাশঙ্কর লিখেছিলেন :
যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী
মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান ।
     বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল আদর্শ ছিল গণমানুষের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা । তাঁর অস্তিত্ব জুড়ে ছিল বাঙালি জাতি আর তাদের স্বপ্ন । হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী দ্বারা শোষিত এই বাঙালি জাতি কখনোই নিজের স্বকীয়তা বিসর্জন দেয় নি । কিন্তু বারবার আঘাত সয়েছে । আর্য থেকে শুরু করে মোঘল, পাঠান, পর্তুগীজ, ফরাসী, ওলন্দাজ, ইংরেজদের আধিপত্যবাদী মনোভাব প্রতিহত করে তিতুমীর, মাস্টার দা, প্রীতিলতারা যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিল সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন এই বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিব ।  মনে-প্রাণে খাঁটি বাঙালিত্বকে ধারণ করেছিলেন বলেই এই জাতির একান্ত সুহৃদ, পরম আত্নীয় হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু । উদার, অসাম্প্রদায়িক, আর অসম সাহসী দুর্জয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী প্রিয় নেতা অবিসংবাদিত মানুষ শেখ মুজিব বাঙালির বিক্ষুব্ধ চেতনা ও সংগ্রামী মানসিকতার প্রতীক । শেখ মুজিবুর রহমান তাই শুধু একটি নাম নয়, একটি আদর্শ, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সংগঠন, একটি জাতিসত্তা এবং অফুরান প্রেরণার উৎস । ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ-শ্যামল জনপদের পরতে পরতে আর তার ষোলোকোটি গণ মানুষের হৃদয়ে গভীরতম প্রদেশে চিরসঞ্চারমান ভালবাসা, শ্রদ্ধা, আর মমতার মিশেলে লেখা শেখ মুজিব এক অবিনাশী চেতনা, এক অবিনাশী গান।

তথ্যনির্দেশ:
১.শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব আমার পিতা (৮ম মু:, ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১৮) পৃ. ২৫
২.তদেব পৃ. ২৬
৩.আবু মাহমুদ, সম্পা., বঙ্গবন্ধুর ভাষণ  (ঢাকা: ন্যাশনাল পাবলিকেশন, ২০১৩) পৃ. ১৩৪-১৩৬
৪.কুমার প্রীতীশ বল, ‘‘প্রজন্মের দর্শনে পিতার মুখ’’, মোনায়েম সরকার ও অন্যান্য সম্পা., শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ  (২য় সংস্করন, ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১০) পৃ. ১৮৪
৫.শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা  (ষষ্ঠ মু., ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০১৭) পৃ. ২৫৮

-ড. নূর সালমা খাতুন

ড. নূর সালমা খাতুন। রাজশাহী