সংগীতবিশারদ ও গুণী সংগীতশিল্পীদের দৃষ্টিতে নজরুলের গান - ঝন্টু চন্দ্র ওঝা
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যভাণ্ডার নিয়ে যেমন বহু কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সাংবাদিক ও গবেষক আলোচনা কিংবা সমালোচনা করেছেন, ঠিক তেমনই তাঁর সংগীতভাণ্ডার নিয়েও বেশ আলোচনা হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি দেশে-বিদেশে বহু ভক্ত, সংগীতবিদ ও গুণীজনের সীমাহীন প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এদেশের মুক্তিকামী মানুষের কর্ণে তিনি যেন মুক্তি আন্দোলনের সুমধুর সংগীতের সুর প্রবেশ করালেন। ভীরুতা ও পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার মহামন্ত্র প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে নজরুল তাঁর গানের মাধ্যমে সার্থকভবে পৌঁছে দিয়েছেন। নজরুলের গান এবং ব্যক্তি নজরুলকে নিয়ে বিভিন্ন সংগীতবিদ ও সংগীতশিল্পী কে কি ভেবেছেন, তা একটু মিলিয়ে দেখা যাক।
দিলীপ কুমার রায় লিখেছেন, “বলতাম ওকেঃ কাজী, কোন দিনই তুমি বুড়ো হবে না, তোামর মাথার ঝাঁকড়া চুলে পাক ধরলেও মন তোমার চলবে যৌবনেরি ঘোড়সোয়ার হয়ে।’ সে হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, ‘তাইতো আমি আপনার ছোট ভাই বনতে পেরেছি দিলীপ দা, হা-হা-হা!’
এক কথায় সনাতন গতানুগতিকতার অকাল বার্ধক্যের সে ছিল যেন মূর্তিমান প্রতিবাদ। সে যখন হো-হো করে ছাদফাটা হাসি হাসত তখন তার সে উল্লাসের উলুধ্বনিতে গম্ভীরাননেরাও সাড়া না দিয়ে পারতেন না।” সুকুমার রায়ের ভাষায়, “কাজী কোন দিনই নাম লেখায় নি - ‘রামগরুড়ের ছানা’- দের দলে - ‘হাসতে যাদের মানা’।”
শচীন দেব বর্মণ লিখেছেন, “কাজীদা, শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত কাজী নজরুল ইসলাম যে কতো বড় গুণী, জ্ঞানী, কতোবড় স্রষ্টা, কবি ও শিল্পী, তাঁর ব্যক্তিত্ব যে কতো মহান, তাঁর বৈশিষ্ট্য যে কতোখানি এবং তাঁর স্থান যে কতো উচুঁতে তা দেশে বিদেশে কারো অজানা নেই।
তবে আমার পুরনো দিনে, কাজীদার সঙ্গ লাভ করার যথেষ্ট সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর ঐ সদাহাস্যময় মুখ, দিল-খোলা হাসি, মধুর ব্যবহার, সরলতা ও আপনহারা ভাব কোনদিনই ভুলতে পারবো না। ছোট খাটো হাসির কথা নিয়ে তিনি হাসির রোল তুলতেন - সেই সঙ্গে তাঁর ভিতরের গভীর ভাবও প্রকাশ পেতো।”
আব্বাসউদ্দীন আহমদ নজরুলের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বললেন, “কাজীদার বাড়ীতে একদিন বসে আছি। কারমাইকেল হোস্টেল থেকে চার পাঁচজন ছাত্র এসে কাজীদাকে বললেন, ‘কাজী সাহেব, আমাদের হোস্টেলে আসছেন তুরস্ক থেকে খালিদা এদিব হানুম। তাঁকে আমরা অভ্যর্থনা জানাবো, আপনাকে সভাপতি হতে হবে।’ কাজীদা বললেন, আচ্ছা যাবো, আপনারা যান। ছেলেরা চলে গেলো। কাজীদা আমাকে বললেন, ‘জানো আব্বাস, এই খালিদা এদিব হচ্ছেন তুরস্কের নারী জাগরণের অগ্রদূতী। এঁর অভ্যর্থনা সভায় নিশ্চয়ই যাবে কিন্তু। ওরা তোমাকে বললো না, হয়তো চেনে না, কিন্তু আমি বলছি - নিশ্চয়ই যাবে।’ আমি বললাম, কাজীদা, যাবো নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনি যাবেন আপনার কবিতার সওগাত নিয়ে, আমি কি নিয়ে যাবো? তিনি বললেন, ‘ওঃ! আচ্ছা।’ তারপর কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। কি অপূর্ব গানই না তিনি লিখে দিলেন বললেন, ‘এ গানে তুমি নিজে সুর দেবে।’ গান তো নিয়ে এলাম। কাজীদার গানে আমি সুর দেবো, এতো বড় ধৃষ্টতা আমার নেই। অথচ তাঁর আদেশ। বাসায় হারমোনিয়াম নিয়ে বসলাম। সৌভাগ্যক্রমে আমার বাসায় এলো ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁর ছেলে মরহুম আব্দুল করিম খাঁ ওরফে বালী। বললাম, ‘ভাই, উদ্ধার করো এ যে বিরাট পরীক্ষা, কাজীদার গানে আমাকে সুর দিতে বলেছেন। বালী প্রথম স্তবকে সুর সংযোগ করলো, তারপর বললো, এইভাবে করতে থাকো।’ পরদিন সমস্ত গানটা যখন গেয়ে শোনালাম, কাজীদা মহাখুশী। গানটা হচ্ছেঃ ‘গুণে গরিমায় আমাদের নারী।’ ......”
কানন বালা দেবী নজরুলকে দেখেছেন, জেনেছেন ও উপলব্ধি করেছেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে। সেই কানন বালা দেবীর উক্তি থেকে জানা যায়ঃ “আমাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বলতেন, ‘ডাগর চোখে দেখছ কি? আমি হলাম ঘটক, জানো? এ দেশে থাকে সুর, অন্য দেশে কথা। এই দুই দেশের এই বর কনেকে এক করতে হবে। কিন্তু দুটির জাত আলাদা হলে চলবে না, তাহলেই বেবনতি। বুঝলে কিছু?’ বলে হাসিমুখে আমার দিকে তাকাতেন। আমি মাথা নেড়ে স্পষ্টই বলতাম, ‘না বুঝিনি।’ বলতেন, ‘পরে বুঝবে।’ পরে বুঝেছি কিনা জানিনা তবে এইটুকুই আজ বোঝবার কিনারায় এসেছি যে, কথার মত অতি বাস্তব বস্তুর বুকেও অসীমে ব্যাপ্ত হবার তৃষ্ণা জাগানো এবং সুরের মত অধরাকেও কথার মাধুর্যে বন্দী করার মিলন উৎসবে যিনি আত্মহারা তাঁর কবিকৃতিকে উপভোগ করা যতখানি সহজ ব্যক্তিত্বকে বোঝাটা ঠিক ততখানি নয়।”
ইন্দুবালা দেবী একজন স্বনামধন্য খ্যাতিমান নজরুল সঙ্গীত শিল্পী। নজরুল তাঁকে বেশ স্নেহসুলভ দৃষ্টিতে দেখতেন। নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভা যে বড় মাপের তা ইন্দুবালা দেবীর কলমেও ফুটে উঠেছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে। ইন্দুবালা দেবীর স্মৃতিচারণের কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা হলঃ
“একদিন তাঁর (নজরুলের) ঘরে লোকজনের ভীড় ছিল কম, কাজীদা তাঁর প্রিয় গান আর জর্দার কৌটো সামনে নিয়ে বসেছিলেন; মুখে এক মুখ পান। সামনে খোলা গানের খাতা। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে তিনি মুখ তুলে তাকালেন তারপর তাঁর নিজস্ব কায়দায় হা হা করে হেসে উঠলেন। এমন হাসি যা আমার মনে হয়েছে কাজীদা ছাড়া আর কেউ হাসতে পারবেন না কোনদিন, হাসতে হাসতে বললেন, ‘আয় ইন্দু বোস।’ তারপর আমি তাঁর পাশটিতে বসতেই বললেন, ‘আচ্ছা, তোর ঐ অঞ্জলি লহো মোর সঙ্গীতে’- এর উল্টো পিঠের গানটা কি লিখি বলতো?’
আমি চট করে কোন জবাব দিলাম না। কাজীদা মহান কবি। শ্রেষ্ঠ গীতিকার। তাঁর এ কথার জবাব দিতে যাওয়া আমার মতো মানুষের পক্ষে মূর্খামী ছাড়া আর কি? তাই একটুখানি চুপ করে থেকে শুধু বললাম, ‘কাজীদা, এই গানটার সঙ্গে এই নতুন গানটাও যেন খুব ভালো হয়।’
কাজীদা আবার হা হা করে সারা ঘর হাসিতে ভরিয়ে তুলে বললেন, ‘আচ্ছা দাঁড়া, চুপটি করে বোস।’ বলে এক মুখ পান ঠেসে খস খস করে কাগজে লিখে দিলেন সেই আমার গাওয়া বিখ্যাত গান, দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে।’
কাজীদা এতো বড়ো ছিলেন, এতো মহান ছিলেন, তবু তিনি আামদের সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে বন্ধুর মতো আলোচনা করতেন। এমন কি যে গানের জন্য তাঁর এতো খ্যাতি, এতো দেশজোড়া নাম, সেই গানের বাণী তৈরীর সময়েও তিনি জিজ্ঞেস করতেন আমাদের মতামত।”
কখনও নজরুলকে মনে হয়েছে ধ্রুবতারা কখনও বা ধূমকেতু, আবার যেন কখনও তিনি সপ্তর্ষি মণ্ডলের প্রধান ঋষি। কিংবা হিন্দু পুরাণের মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, ক্রুতু, বশিষ্ট, পুলহ প্রমুখ মুণি ঋষিদের মিলিত সত্তায় সৃষ্ট এক মহাঋষিই যেন আজকের নজরুল। শ্রদ্ধেয় বেচু দত্ত নিজেও যেন নজরুল সম্পর্কে ঠিক একই বাণী উচ্চারণ করলেনঃ
“বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র যখন বাংলার সাহিত্যগগনে দেদীপ্যমান ঠিক সেই সময়েই অকস্মাৎ কাজী নজরুলের আবির্ভাব। রবি শরৎকে লক্ষ্য করে একদিন এই তরুণ কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘রবি চন্দ্রের মাঝে আমি ধূমকেতু।’ সুতরাং সেই ধূমকেতু সম্বন্ধে আমার নতুন করে বলবার কিছুই নেই। কারণ যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন ‘সাগর কত বড় ?’ বলা কি সম্ভব? ঠিক সেই রকম কাজী নজরুল ছিলেন মহাশক্তি, মহাজ্ঞানী, মহাঋষি। যোগী ঋষিরা ঈশ্বরের দূত। তাঁরা এক একটা মহাজ্যোতিষ্ক প্রকাশ করবার জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, কাজ শেষ হলেই তাঁরা আবার চলে যান। বাংলার ভাগ্যাকাশের এক অতি দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে ‘বিনাশায় চ দুস্কৃতম’ বিদ্রোহী কবি নজরুলের আবির্ভাবের প্রয়োজন ছিল; আর সেই জন্যই তিনি এসেছিলেন। বাংলার যুবশক্তিকে উজ্জীবিত করে, মূঢ় ম্লান দেশবাসীর মুখে ভাষা দিয়ে চারণ কবি নজরুল আবার স্তব্ধ হয়ে গেলেন।”
নজরুল গীতির অন্যতম পথিকৃত সুকণ্ঠী গায়িকা প্রভাবতী ওরফে আঙ্গুরবালা দেবী। গ্রামোফোন কোম্পানীতেই আঙ্গুরবালার পরিচয় ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের সনে এবং খুব কম সময়ের ব্যবধানে অন্যান্যদের মতই আঙ্গুরবালার কাছেও নজরুল ‘কাজীদা’ হয়ে গেলেন। এক সময় নজরুলের কাছে আঙ্গুরবালা সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলেন, বিশেষ করে নজরুলের ঠুংরী প্রকৃতির গানেই আঙ্গুরবালা অত্যধিক তালিম গ্রহণ করেছেন। নজরুলের গানের প্রতি তীব্র আকর্ষণের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে আঙ্গুরবালা বললেনঃ
“কাজীদার গানের ভাষা অপরূপ ছন্দ ও সুরের বৈচিত্র্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল। প্রাণবন্ধুর ভাষার সঙ্গে মার্গ সংগীতের ধারায় মেশা নজরুল গীতি হল আমার সাধনার জিনিস। নজরুল গীতির গায়িকা হিসাবে সার্থক হবার আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে গড়ে উঠলো।”
বাংলা সংগীতে ‘পারস্য গীত’ বা ‘গজল’ রচনায় অতুল প্রসাদ হাত দিলেও তা তেমন একটা সার্থকরূপ পায়নি। বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর মিলনে নজরুল সার্থকভাবে গজল গানের রূপ দিলেন, যা হীরেন্দ্র নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের লেখায় স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়ঃ
“১৯৩৩ খ্রীস্টাব্দের ১লা আগস্ট গ্রামোফোন কোম্পানীর সঙ্গে নজরুল ইসলামের এক কন্ট্রাক্ট হলো। শর্ত হল যে, তিনি তাঁদের গান রচনা ও রেকর্ডিং প্রযোজনা করবেন। প্রতি রেকর্ডের দরুন তিনি শতকরা হারে রয়ালটি পাবেন। কবি নতুন করে জীবনের পথ খুঁজে পেলেন। বিদ্রোহী কবির লেখনীতে উৎসারিত হলো ললিত গীতির মন্দাকিনী ধারা। দ্বিগুণ উৎসাহে শুরু করলেন গান লিখতে। বাংলায় গজলের জোয়ার বয়ে গেল। দেখতে দেখতে গ্রামে নগরে মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে পড়লো সেই গজলের ঢেউ। যেমনঃ
১.
“কে বিদেশী বন - উদাসী
বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে,
সুর সোহাগে তন্দ্রা লাগে
কুসুম বাগের গুল বদনে।”
২.
“নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি জল
এ শুধু শীতের মেঘে
কপট কুয়াশা লেগে
ছলনা উঠেছে জেগে
এ নহে বাদল।”
স্তব্ধ দুপুরে রাখাল ছেলে গাছের ডালে বসে গাইতে লাগলোঃ
“বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল
আজো তুার ফুলকলিদের ঘুম টুটেনি তন্দ্রাতে বিলোল।”
গজল লিখতে লিখতেও যেন মাঝে মাঝে সুর কেমন মন্দীভূত হতো, ভিজে উঠত অনুভূতি। হঠাৎ একদিন একটা গান লিখে তরুণ সুরশিল্পী বিমলভূষণকে দিলেনঃ
“ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি
ভোরের হাওয়ায়
কান্না পাওয়ায়
তব ম্লান ছবি।”
নজরুল সবাইকেই শ্রেণীহীনভাবে দেখেছেন, বড়ো ছোটো সবাইকেই তিনি বয়সভেদে শ্রদ্ধা করেছেন, স্নেহ করেছেন, তুলে নিয়েছেন বুকে। তাইতো তাঁর স্নেহ মমতার কথা স্মরণ করে তাঁর প্রিয় ভক্তরা কেঁদেছেন অকাতরে। তেমনই এক বিরহী ভক্ত ও গানের শিষ্যা সরযুবালা দেবী ‘কাজীদার স্মৃতিকথা’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেনঃ
“রক্তকমলে মমতার ভূমিকায় আমি অভিনয় করি। এ ভূমিকার জন্য কাজীদা পাঁচখানি গান লিখে সুর করে আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সে গানগুলি স্টেজে বেশ উতরে গিয়েছিলো শেষ পর্যন্ত। তারপর নাট্যকার মন্মথ রায় রচিত ‘মহুয়া’ নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করার ডাক এলো আমার কাছে। সেটা ১৯৩০ সালের কথা। কাজীদা এই নাটকে আমার জন্য সাত আটটি রাগপ্রধান গান লিখেছিলেন। এর সব কটি গান স্টেজে উঠে আমাকে গাইতে হবে শুনে আমি বেঁকে বসলাম একেবারে, ও আমি কিছুতেই পারব না। আগেরগুলি মোটামুটি সাদামাটা সুরের গান ছিলো। তাই চালিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু এসব রাগ সঙ্গীত গাইতে হলে তো রীতিমতো তালিমের দরকার, গলা সাধতে হয় একি খেলার কথা নাকি?
এই কথা শুনে কাজীদা হা হা করে হেসে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, ‘বাঃ বাঃ, সরযু দেবী দেখছি সত্যিই বেশ বড়ো হয়ে গেছেন, কেমন বড়ো বড়ো কথা দিব্যি গুছিয়ে বলছেন দেখ। আমরা কথার বেসাতি করি, আমাদেরও তো মাথায় কথা এতো আসে না।’
কাজীদার এই কথা আর হাসিতে আমার সমস্ত আপত্তি ভেসে যায় যেন। আমি যতো বলি, হবে না উনি ততোই জেদ ধরে বলেন, ‘হ্যাঁ, হতেই হবে, না হলে আমার নাম পালটে দেবো। তোমায় কিচ্ছুটি করতে হবে না। লাফাতে হবে না, ডিগবাজী খেতে হবে না, একপায়ে দাঁড়াতেও হবে না, শুধু আমার সঙ্গে গাইবে আর হাসবে। ওঃ হো, তুমি তো জর্দা খেতে ভালবাসো আচ্ছা দেখ তোমায় কি সুন্দর জর্দা খাওয়াচ্ছি।’ বলে তিনি নিজের হাতে পানের বাটা থেকে পান সেজে জর্দা দিয়ে আমার মুখে পুরে দিলেন। জীবনে কতো জর্দা, কতো পান খেয়েছি, কিন্তু কাজীদার হাতের সেই স্নেহ মাখানো পানের স্বাদ যেন আজও ভুলতে পারিনি। আর শুধু কি পান খাওয়ানো ? নানাভাবে উৎসাহ দিয়ে মাত্র তিন দিনের মধ্যেই অতোগুলো রাগপ্রধান গান একেবারে পাখী পড়ানোর মতো করে শিখিয়ে দিলেন কাজীদা। সে সব গানের সুরও তৈরী করেছিলেন তিনি অপূর্ব।
কাজীদার সেইসব গান গেয়ে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ বিদগ্ধ দর্শকের প্রশংসা আর আশীর্বাদ অর্জন করেছি আমি। এর জন্য ঐ একটি মানুষ - কাজীদার কাছে যে আমি কতো ঋণী তা বলে বোঝানো যাবে না।
কাজীদা আমাকে বড়ো দাদার মতো উৎসাহ দিয়েছেন, স্নেহ করেছেন। তিনিই আমার মনে এই আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিলেন যে, আমার দ্বারা কিছুই অসম্ভব নয়। আজ সে সব দিনের কথা ভাবলে চোখে জল আসে, এমনভাবে স্নেহ করবার, ভালোবাসবার মতো আপনজন তো জীবনে খুব বেশী আসে না।”
কাজী সাহেবের কথা যুথিকা রায় লিখতে গিয়ে লেখেন, “দমদমে গ্রামোফোন স্টুডিওতে যখন আমি রেকর্ড করতে যেতাম, কাজী সাহেবও প্রায়ই আসতেন রেকর্ডিং - এর সময়। সারা স্টুডিও ঘরে মহা আনন্দে ঘুরে বেড়াতেন আর নানাভাবে আমাদের উৎসাহ দিতেন। যখন টেস্ট রেকর্ড শোনা হতো, কবি কনট্রোল থেকে ছুটে এসে, গ্রামোফোনের কাছে দাঁড়িয়ে এক মনে শুনতেন। যেখানে তাঁর ভালো লাগতো আনন্দে মাথা নেড়ে বাঃ বাঃ করে উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশংসা করতেন। তাঁর এই আনন্দ উৎসাহে আমাদের সকলের উৎসাহ আরও অনেক বেড়ে যেতো। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা কাজে সফল হয়ে উঠতাম।
একবার আমার মা কবিকে বলেছিলেন, ‘যুথিকা ছোট্ট মেয়ে, ওকে আপনি ছোটো মেয়ের গাইবার মতো গান দিলে ভালো হয়।’ কাজী সাহেব একথা শুনে মাকে তাঁর বাড়ীতে যাবার জন্য অনুরোধ করেন।
মা যখন কবির বাড়ী যান, তখন তিনি তাঁর অনেকগুলি গানের খাতা মায়ের সামনে এনে বলেন, এই আমার সমস্ত খাতা আপনাকে দিলাম, এর ভেতর থেকে যে গানগুলো পছন্দ হয় আপনার মেয়ের জন্য নিতে পারেন।
তাঁর এই উদার মনোভাব ভোলবার নয়। অনেক সময় গ্রামোফোন কোম্পানীর ঘরে বসে কবির গান লেখা ও সুর তৈরী করার সুন্দর দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কবি যখন তন্ময় হয়ে বসে সুর করতেন বা গান লিখতেন, তখন মনে হতো কোনো সাধক সৃষ্টির আনন্দে ভাবের ঘোরে কোথায় যেন ডুবে আছেন। সে পরিবেশ ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি নিঃশব্দে সে দৃশ্য দেখে কবির প্রতি আমার প্রণাম জানাতাম।”
নজরুলের গানের গলা ছিল বড়ই সুমধুর, যে কেহ হঠাৎ তাঁর গান শুনলেই থমকে যেতেন, সুরের মোহে জড়িয়ে পড়তেন। মধুসূদন মজুমদারের লেখায় সে রকমই ইঙ্গিত পাওয়া যায়ঃ
“ বৌ-বাজারের একটি রাস্তায়, গলিরই নামান্তর, একটি যুবক চলেছে টিউশনি করতে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, হঠাৎ যুবকটি স্তব্ধ হয়ে গেল একটি গানের শব্দে। একটি মেয়েকে গান শেখাচ্ছে আর একটি যুবক। ঘটনাটা নতুন কিছু নয়। এমন প্রায়ই হয়। রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে এ দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে। কিন্তু পথচারী যুবকটি এতে মুগ্ধ হয়ে গেল। কে ওই গাইয়ে যুবক ? যার কণ্ঠস্বর ভরা মাদকতা। গানের প্রত্যেকটি শব্দ দরদ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে। তাকে দেখবার আকাঙ্ক্ষায় পথচারী থামলো! একবার এদিক ওদিক চাইলো, তারপর ভাবলো - না চলেই যাই।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গাইয়েকে দেখা ভদ্রতাবিরুদ্ধ। কিন্তু গাইয়ের কণ্ঠস্বর তাকে তখন টানছে। সে জায়গা ছেড়ে আর যাওয়া হলো না। ধীরে ধীরে সে গিয়ে দাঁড়ালো সেই একতলার ঘরের জানালার পাশে। উঁকি দিল ভেতরে।
কিছুক্ষণ পরে গাইয়ের দৃষ্টি পড়লো জানালার দিকে। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কে? গাইয়ে বললেন, ‘আপনি কে? ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?’
আগন্তুক একটু লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘আপনার গান শুনতে বড় ভাল লাগলো, তাই দাঁড়িয়ে গান শুনছি।’ গাইয়ে বললেন, ‘ভেতরে এসে গান শুনুন।’
আগন্তুক ভুলে গেল, সে যাচ্ছিল টিউশনি করতে। ভেতরে গিয়ে গান শুনতে বসলো। হল দু’জনকার মধ্যে প্রথম পরিচয়। পরে দু’জনেই বন্ধুত্বের বাঁধনে পরষ্পরকে বেঁধেছিলেন।
আগন্তুক যুবকটি আর কেউ নন, পরবর্তী জীবনে সুসাহিত্যিক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। আর সেই গাইয়ে যুবকটি হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।”
নজরুলের গান সম্পর্কে সলিল চৌধুরী বললেনঃ “গানের ভুবন নজরুল ভরিয়ে তুলেছিলেন স্বরচিত গানে আর সুরে। সঙ্গীতের প্রতিটি বিভাগে ছিলো তাঁর অবাধ পদসঞ্চার। তাঁর ভক্তিমূলক শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামী গান, দেশাত্মবোধক মার্চ সঙ্গীত আর পল্লী বাংলার শ্যামলতা মাখানো বাউল, ভাটিয়ালী, ঝুমুর, কীর্তন প্রভৃতি গীতির কথা ভুলবার নয়। এ সময় নজরুল এই বাংলাদেশে গানের পুষ্পবৃষ্টি করে গেছেন। তিনি নিজেই ছিলেন একজন বিশিষ্ট সুরকার। তাই তাঁর গানে পরিপূর্ণ প্রাণসঞ্চার করতে পেরেছিলেন। নজরুলের নব নব সুরের মাধুর্য আর মূর্ছনায় বাংলাদেশ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলো একদিন। গান লেখা আর সুর তৈরী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্ত ছিল না তাঁর। নানা ধরনের গান তিনি রচনা করেছেন।
এমনকি সংখ্যায় খুব কম হলেও উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হাসির গানও তিনি রচনা করেছেন। তাঁর ‘চন্দ্রবিন্দু’ ও ‘সুরসাকী’ সঙ্গীত গ্রন্থের কিছু অংশে হাসির গানও তিনি রচনা করেছেন। স্বরচিত হাসির গানে নজরুল এঁকেছেন আমাদের সমাজ আর রাজনীতিগত ভুল-ক্রুটির প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, শ্লেষপূর্ণ হাস্যরসের নির্মম কষাঘাত। দেশের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে কবি নজরুলের যোগাযোগ ছিলো গভীরভাবে। মুক্তি সংগ্রামে নিয়েছিলেন তিনি সক্রিয় ভূমিকা।”
নজরুলের গানের ঠিক সংখ্যাটি কত বা তাঁর রেকর্ডে প্রকাশিত গানের সংখ্যাটিই বা কত তার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণভিত্তিক তথ্য আজ উদ্ধার করা বেশ কঠিন। এই একই বিষয়ে নজরুলগবেষক সন্তোষকুমার দে বললেনঃ
“রবীন্দ্র-যুগে জন্মগ্রহণ করেও সঙ্গীত রচয়িতা এবং সুরকার হিসাবে নজরুল যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তার তুলনা নেই, বস্তুতঃ যদিও বিদ্রোহী কবি বলেই নজরুলকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, কিন্তু গীতিকার হিসাবেও তাঁর স্থান আরও বিশিষ্ট একথা প্রমাণ করা কঠিন নয়। রেকর্ডে রবীন্দ্র রচনার আনুপূর্বিক ইতিহাস ও তালিকাসহ গ্রন্থ ‘কবিকণ্ঠ’ প্রকাশিত হলে অনেকেই নজরুলের গানের রেকর্ড সম্পর্কেও অনুরূপ গবেষণা করবার জন্য আমায় অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কাজে নেমে দেখা গেল, ব্যাপারটি রীতিমত দুরূহ; তার কারণ কবি যত অজস্র গান রেকর্ড করেছেন তার সবগুলিতে নিজের পরিচয় রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। মনে রাখতে হবে, নজরুল গীতিকার এবং সুরকার হিসাবে গ্রামোফোন কোম্পানীর সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন, ফলে তাঁর অজস্র গান বহু খ্যাত-অখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠে অবাধে রেকর্ড হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। তাই আজ পর্যন্ত তাঁর যত গান রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছে তার সংখ্যা বিস্ময়কর; একমাত্র রবীন্দ্রনাথের রচনার সঙ্গেই তার পরিমাণের তুলনা করা চলে। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। সে গ্রন্থ প্রকাশিত হলে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জনসাধারণ সহজেই মেনে নেবেন, রেকর্ডে প্রকাশিত নজরুলের রচনার সংখ্যাই এখনও সবচেয়ে বেশী এবং পৃথিবীর মধ্যে এ বিষয়ে তিনিই সর্বাগ্রগণ্য।”
নজরুলের বহুমুখী প্রতিভার মধ্যে তাঁর একটি উঁচুমানের প্রতিভা ছিল সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে। অসীম ধৈয্য ও স্নেহ-মমতা দিয়ে তিনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের গান শেখাতেন। বরদা গুপ্তের ভাষায়ঃ
“কাজীদা তাঁর স্বরচিত গানে শুধু সুর যোজনা করেই থেমে থাকেননি, নিজে সেই গান অক্লান্ত পরিশ্রমে শিখিয়েছেন সঙ্গীত শিল্পীদের।
গান রচনা ও সুর যোজনা ছাড়া এই শেখানোর কাজে যে সময় তাঁর খরচ হয়েছে, সেই সময়গুলি অন্যত্র অন্যভাবে ব্যবহৃত হলে কাজীদা বাংলাদেশের কাব্য সাহিত্যভাণ্ডারে আরো অনেক মূল্যবান রত্ন জমিয়ে রেখে যেতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি।
কাজীদার এই গান-শেখানোর পদ্ধতি আর সঙ্গীত শিক্ষাগুরু হিসাবে তাঁর ব্যবহারটি অনুকরণযোগ্য। অনুকরণযোগ্য এই জন্য বলছি যে, গান শেখাতে বসে কাজীদা যে অসীম ধৈর্য্য, অফুরন্ত অধ্যবসায় আর বুক ভরা ক্ষমা স্নেহ মায়া মমতায় নিজের দরাজ হৃদয়টি ভরিয়ে রাখতেন, তা যদি অন্য সকল শিক্ষকদের পক্ষে রাখা সম্ভব হতো, অনুকরণ করতে পারতেন কাজীদার এই প্রকৃতিটি, তাহলে তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারতো সহজে, অনেক নির্ভয়ে আর দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে উত্তীর্ণ হতে পারতো।”
গানের নেশায় পাগল হয়ে এক একদিন কবি খাওয়া-ঘুমের কথা ভুলে যেতেন। জীবনের সাজানো প্রমোদতরীতে উঠে আনন্দস্রোতে ভাসতে ভাসতে কবি চলে যেতেন সাগর থেকে মহাসাগরে, সেই সাথে অন্যদেরও ভুলিয়ে নিয়ে যেতেন সেই অজানা রহস্যময় রাজ্যে। সারদা গুপ্ত লিখেছেনঃ
“কতোদিন দেখেছি একটি হারমোনিয়াম আর পান জর্দা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গান গেয়ে আর গান শুনে কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। কোথায় ভেসে গেছে তাঁর জরুরী এ্যাপয়েন্টমেন্ট আর প্রয়োজনীয় কাজ। একাই একশো হয়ে কাজীদা সকলকে মাতিয়ে রেখেছেন। নিজের আলোয় অপরকে উদ্ভাসিত করতে পারেন, এমন ক’জন মানুষের সান্নিধ্যে আমি এসেছি, কাজীদা তাঁদের শিরোমণি। এতো মুক্তিপ্রতীক আকাশের মতো নির্মল হাসি আনন্দ কাজীদা কোথা থেকে আহরণ করে আনেন ? কোথা থেকে নিয়ে আসেন এতো হাসির ঝর্ণাধারা টুং টাং ছন্দ?”
নজরুলের গান নিয়ে কলম ধরেছেন অনেকে, তাঁর গানকে সমীহ ও সমাদর করেছেন সকলেই। নারায়ণ চৌধুরী নজরুলের গান নিয়ে মত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেনঃ
“যে অশান্ত আর অদম্য প্রাণশক্তি কাজী সাহেবকে কাব্যসৃষ্টিতে প্রণোদিত করেছিল সেই একই অস্থিরতা আর প্রাণপ্রাচুর্য তাঁকে সুরের ক্ষেত্রেও টেনে নিয়ে গিয়েছিলো। তাঁর ভিতর সুরবোধ ছিল সহজাত। সহজাত সুরবোধ যার আছে, এমন কবির পক্ষে কাব্য জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে সঙ্গীত অনুশীলনে আত্মনিয়োগ অবধারিত। কাজী সাহেবের বেলায়ও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তিনি কাব্য ও সঙ্গীত উভয়ত্র স্বচ্ছন্দতার সঙ্গে বিচরণ করেছেন।”
আত্মভোলা নজরুল নিজের নাওয়া-খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে শুধু চা-পান খেয়েই সারাদিন গান লিখতেন, সুর সংযোজন করতেন এবং সাথে সাথে রিহার্সাল রুমে নানা জাতীয় শিল্পীদের সেই সব সঙ্গীত হাতে ধরে ধরে শিখিয়ে দিতেন। দিনশেষে বাড়ীতে গিয়ে মাত্র এক বেলা অন্ন গ্রহণের অবসরও যেন তাঁর ছিল না। আবার দেখা গেছে কবি কোথাও সভা-সমিতিতে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করে আছেন, সভাশেষে সভাপতির ভাষণ পরিত্যাগ করে মানুষের অনুরোধে তাকে গান ধরতে হয়েছেঃ
“বসিয়া বিজনে কেনো একামনে
পানিয়া ভরণে চললো, গোরি।
চলো জলে চলো, কাঁদে বনতল,
ডাকে ছল ছল জল-লহরী।”
কবি নজরুল সম্পর্কে যতই পড়ছি ততই অবাক হয়ে ভাবছি কী করে জীবনের এত স্বল্প পরিসরে এত বিচিত্র প্রতিভা অর্জন করা সম্ভব ? নজরুলের এত বিশাল সংগীতভাণ্ডার নিয়ে লেখা সত্যি খুব কঠিন। এজন্য নজরুলের গান নিয়ে কোনো উপসংহারে উপনীত হওয়াও কঠিন। বরং তাঁর গানের সৃষ্টিরহস্য কিংবা রচনা কৌশলের মান বিচারের ক্ষেত্রে নীহাররঞ্জন গুপ্তের একটি স্মৃতিচারণমূলক উক্তি দিয়েই শেষ করতে ইচ্ছে হচ্ছেঃ
“ঘনিষ্ঠভাবে কবিকে জানবার পর মনে হয়েছিল কাজী সাহেবকে না চিনলে জীবনের আমার একটা দিক বুঝি শূন্যই থেকে যেত। রিহার্সেলের সময়ই একটা দিনের কথা আজও মনে আছে। কবির সঙ্গে গাড়ীতে তাঁর পাশে বসে যেন কোথায় চলেছি - হঠাৎ কোথায় কোকিল ডেকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গেই কবি সুর করে মুখে মুখেই রচনা করলেন একটি গানের কয়টি লাইন।
“রেশমী চুড়ির তালে
কৃষ্ণচূড়ার ডালে
পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা
ডেকে ওঠে পাপিয়া।”
গান ও সুরের সাধক নজরুল ইসলাম, এমনিই দেখেছি তাঁকে। কি হালকা সুরের গান, কি দেশাত্মবোধক গান, কি শ্যামাসঙ্গীত, অনন্য তাঁর রচনাশৈলী - অপূর্ব তাঁর সুরের ছন্দ।”
কাজী নজরুল ইসলাম বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তাঁর অপূর্ব সৃষ্টিভাণ্ডার। তবে তাঁর বিশাল সঙ্গীতভাণ্ডার অনেক বেশী সমৃদ্ধ। বিভিন্ন সঙ্গীততাপসের উপরোক্ত বক্তব্যে সে কথা সাবলিলভাবে প্রমাণিত। তাই তাঁর সঙ্গীত এখনো যা প্রকাশিত হয়নি কিংবা অনুসন্ধানের আওতায় আসেনি, সেগুলো প্রকাশযোগ্য করা অত্যাবশ্যক।
-ঝন্টু চন্দ্র ওঝা
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
ঢাকা, বাংলাদেশ।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
11-09-2020
-
-