অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
কবি মোহাম্মদ সাদিক ও রোদ্দুরের গল্প - ড. ফজলুল হক সৈকত

ক।
সেদিন ছিল সোমবার। ২১ জানুয়ারি ২০১৯। আগেরদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা ছিল- মোহাম্মদ সাদিকের অফিসে যাবার। সাথে যাবেন তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল কবি দৈনিক যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক জুননু রাইন। ঠিক ১১টায় সময়মতো গিয়ে হাজির হলাম আগারগাঁও সরকারি কর্মকমিশন কার্যালয়ে। রিসেপশনে হাজির হয়েই বুঝলাম, আমার ব্যাপারে সেখানে তথ্য রয়েছে। সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হলো। গলায় ভিজিটর কার্ড ঝুলিয়ে দিয়ে একজন সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারীর কক্ষে আমাকে বসতে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি-বিস্কুট পরিবেশন করা হলো। মোহাম্মদ সাদিকের পিএস বললেন- একটু বসতে হবে, স্যারের রুমে ভিজিটর আছেন। আমার সামনে ও পাশে তখন সরকারি সঙ্গীত কলেজের অধ্যক্ষসহ কয়েকজন শিক্ষক। অপেক্ষারত। কলেজের কী একটা প্রোগ্রামে স্যারকে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানাতে এসেছেন। তখনও জুননু এসে পৌঁছেননি। তাঁর সেদিন ডে-অফ। কাজেই বাসা থেকে ম্যানেজ করে বেরুতে হবে। জুননু আমার সুবিধার কথা বিবেচনা করে সোমবারে সাক্ষাতের দিন ধার্য করেছিলেন- সেদিন দুপুরে আমি বাংলাদেশ বেতারে খবর পড়তে যাই, সেটা জানতেন বলে। আর সাদিক স্যারও একটু ফ্রি হতে চাচ্ছিলেন, পরে বুঝেছিলাম। যাইহোক, কলেজের প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে যাবার পর, এর মধ্যে কবি জুননুও এসে পড়েছেন, আমাদের ডাক পড়লো। ভেতরে ঢুকতেই পরিপাটি এক ভদ্রলোক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ‘আসুন প্রফেসর সৈকত’। -হ্যাঁ, এই ভদ্রলোকটি সরকারের বড় কর্মকর্তা। কিন্তু সেই মুহূর্তে তিনি কর্মকর্তার আসন থেকে সরে কবির ভূমিকায় অবতীর্ণ।

ব্যাপরটা খুব সামান্য। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সারা দেশের কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা ও সম্পাদনার কাজ চলছে। বাংলা বিষয়ে সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্কব প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য আমি। এছাড়া গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে রয়েছি। কবিতা সংকলনের জন্য ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সদস্য এবং সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছি। আমি বিভিন্ন কবি-সম্পাদকের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিচ্ছিলাম, সেই সময়ে। কবি জুননু রাইনের মাধ্যমে কবি মোহাম্মদ সাদিক জানতে পেরেছিলেন বিষয়টি। তখন তিনি বলেছেন- ‘সৈকতকে একদিন সাথে করে নিয়ে এসো। কোন কবিতা দেবে সংকলনে সে বিষয়ে আলাপ করবো।’ আমার ছিল আগ্রহ। আর কবির ভেতরে ছিল উচ্ছ্বাস। তিনি প্রথমেই তাঁর ২টি বই আমাকে উপহার দিলেন। কবিতা সংগ্রহ গ্রন্থে লিখলেন- ‘অধ্যাপক ফজলুল হক সৈকত প্রিয়ভাজনেষু’। আরেকটি বই দিলেন- শফাত শাহের লাঠি। বললেন, কয়েকটি কবিতার প্রতি তাঁর দুর্বলতা আছে। যদি আমাদের সম্পাদনা পরিষদের কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে যেন সেগুলো বিবেচনায় রাখি। তারপর কবিতা-শিল্প নিয়ে আলাপ শুরু হলো। আমাদের আলাপের মধ্যে অফিসে ঢুকলেন দৈনিক জনকণ্ঠের রাহুল রাহা এবং জাতীয় সংসদের মাননীয় সদস্য অসীম কুমার উকিল। তাঁদের সাথে প্রয়োজনীয় কথা সেরে তিনি আমাদের সাথে পুনরায় যোগ দিলেন- কবিতাগুলো সম্পর্কে তাঁর অনুভূতির কথা জানালেন। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। আমাদের সাক্ষাতের উদ্দেশ্য মোটামুটিভাবে সফল হলো। কিন্তু পরের ঘটনাগুলো আমার মনে আজও দাগ কেটে আছে।

এর মধ্যেই তিনি দুপুরেরর খাবারের আয়োজন করে ফেলেছেন। বললেন- ‘আজকে আমার সাথে লাঞ্চ করবেন।’ আমি ক্ষমা চেয়ে বললাম, ‘স্যার আমাকে যেতে হবে- রেডিওতে নিউজ আছে ২টায় লাইভ।’ তিনি বললেন- ‘চিন্তা করবেন না, আমি পৌঁছে দেবো।’ দুটো বিষয় আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে। ১. কবি সাদিকের কাছে জানতে পারলাম- তিনি কখনো শাদা ছাড়া অন্য কোনো রঙের শার্ট পড়ে অফিস করেননি। এবং কোনোদিন হাফশার্ট বা টিশার্ট পরে অফিসে আসেননি। ২. তিনি নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করলেন। পরিবেশনের ফাঁকে পাশের রুমে গিয়ে ড্রেস পরিবর্তন করে আসলেন- অফিসের পোশাক পরে খাবেন না বলে। তাঁর কথা ও কাজগুলো এতোটাই স্বাভাবিক ছিল যে, মনেই হচ্ছিল না আমি তখন অফিস টাইমে সরকারি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়ে অবস্থান করছি। এবং ঠিক সময়মতো তাঁর পিএসের গাড়িতে আমাকে রেডিওতে পৌঁছে দিলেন। সেদিন তাঁর আতিথ্যে, বিনয়ে, সরলতায়, আদর্শে, চিন্তায় ও সহজে সব কাজ সামলে-নেওয়ার দক্ষতা ও কুশলতায় অনেকক্ষণ বিহ্বলতার ভেতর ছিলাম। বিকেলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে গিয়ে কবি মোহাম্মদ সাদিকের আদর্শ ও জীবনধারা বিষয়ে প্রায় ১০ মিনিট কথা বলেছিলাম। সে-লেকচারটা ছিল এক ধরনের মুগ্ধতার বহির্প্রকাশ মাত্র। তখনও ভাবিনি তাঁর কবিতা বিষয়ে বই লিখবো। কয়েকদিন পর কবিতা বাছাই করতে গিয়ে পড়তে থাকি তাঁর কবিতা। এর আগে পত্র-পত্রিকায় সাদিকের কবিতা পড়লেও কোনো বই পড়ার সুযোগ হয়নি। তখন ভাবলাম, তাঁর কবিতার বিষয়-আশয় নিয়ে লিখবো। এরপর ভাবলাম কবির একটা সাক্ষাৎকার নেবো। তারপর অনেকদিন চলে গেছে। মাঝে তাঁর কয়েকটি কবিতা পড়ে, কবিতাভাবনা ও রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ে নোট নিয়েছিলাম। মাঝে সংকলন বিষয়ে দু-একবার কথা হয়েছে। এর মধ্যে এলো করোনাকাল। আমার হাতে তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহারিক বাংলা আর কবিতা সংকলন-এর কাজ। ব্যবহারিক বাংলা প্রায় ২৩ ফর্মার গ্রন্থ একা লিখছি। প্রায় শেষ পর্যায়ে। কবিতা সংকলন-এর জন্য কবিতা বাছাই প্রায় চূড়ান্ত- কবি-পরিচিতি লিখছি। ফাঁকে ফাঁকে এমফিল গবেষকদের ২টি অভিসন্দর্ভ সম্পাদনা করছি। মনে হলো, কোথায় যেন একটু অবসর। ভাবছি- মোহাম্মদ সাদিকের কবিতার মূল্যায়ন নিয়ে যে-ভাবনাটা মাথায় ছিল, সেটাকে চূড়ান্ত রূপ দিলে কেমন হয়, একটা বই লিখে ফেলি না তাঁর ওপর। ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলাম: ‘কারোনাকালে নতুন বই লিখছি: মোহাম্মদ সাদিকের কবিতা: সমাজ ও রাষ্ট্রভাবনা’।

দুই।
কবি ও অনুবাদক মোহাম্মদ সাদিকের জন্ম ১৯৫৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৭৬ সালে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৭৭ সালে এমএ ডিগ্রিধারী মোহাম্মদ সাদিক যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪-৯৫ সালে পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট-এর উপর পড়াাশুনা করেন এবং পরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সিলেটি নাগরী লিপি বিষয়ে গবেষণার জন্যে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিব, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য- আগুনে রেখেছি হাত (১৯৮৫), ত্রিকালের স্বরলিপি (১৯৮৭), বিনিদ্র বল্লম হাতে সমুদ্রের শব্দ শুনি (১৯৯১), কে লইব খবর (২০১০), শফাত শাহের লাঠি (২০১৭)। এছাড়াও তিনি কবি রাধারমণ দত্ত: সহজিয়ার জটিল জ্যামিতি (২০১৭) শিরোনামে জীবনী রচনা করেন; অনুবাদ করেন আফ্রিকার নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবের উপন্যাস। কবিতায় অবদানের জন্য তিনি ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

পেশায় সরকারি কর্তকর্তা মোহাম্মদ সাদিক। তবে নেশায় তিনি কবি। আর স্বভাবে গবেষক বা পর্যবেক্ষক। সমাজের বিচিত্র বিষয় তিনি অনুভব করেন, ধারণ করেন। আর সেইসব অনুভূতি ও চিন্তা প্রকাশ করেন কবিতায়, বক্তৃতায়, নিবন্ধে ও অনুবাদের ভাষায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও মনে-মনে, ভেতরে-ভেতরে তিনি আপাদমস্তক কবি। কবি সাদিকের বাবা আলহাজ্ব মোহাম্মদ মবশ্বির আলী, মা মাসতুরা বেগম। সহধর্মিণী জেসমিন আরা বেগম। পুত্র মোহাম্মদ কাজিম ইবনে সাদিক, কন্যা মাসতুরা তাসনিম সুরমা। -পারিবারিক এই গণ্ডির ভেতর সাদিকের বসবাস ও সাহিত্যচর্চা।

মোহাম্মদ সাদিক বেড়েওঠার কালে শৈশবে-কৈশোরে-যৌবনে পাড়ি দিয়েছেন সমাজ-রাজনীতির উত্তাল সময়, যাপন করেছেন জটিল সব প্রসঙ্গ। ষাটের দশকের শুরুতে পূর্ব-পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক সংকট, ’৬২-র শিক্ষা-আন্দোলন, ’৬৬-র ছয়দফা- বাঙালির বাঁচার দাবি, ’৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ- এই সময় ও যাবতীয় ঘটনার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছেন কবি মোহাম্মদ সাদিক। কাজেই তৈরি হওয়ার প্রহরেই পেয়েছেন সৃজন-ভাবনার মাল-মসলা। আর ’৭১-পরবর্তী যে বাংলাদেশ, নতুন রাষ্ট্রের কাঠামো, তার গঠনের কৌশল এবং সাফল্য-ব্যর্থতা তিনি অবলোকন করেছেন সচেতন নাগরিক হিসেবে। তখন তাঁর যৌবনকাল। কাজেই স্বাধীন দেশের সুখ ও অসুবিধা অনুভব করেছেন, দেখেছেন বিচিত্র কলা ও কৌশল। সে সবের মধ্য থেকে তাঁর কবি হওয়ার জায়গাটি নির্মিত হয়েছে। তাই তাঁর প্রকাশ-ভাবনা বা বিবরণভাষ্য প্রখরতা ও নিষ্ঠায় ভরা। তিনি লিখেছেন: ‘অষ্পষ্ট শব্দের যেসব বিমূর্ত বাক্যবন্ধ রচিত হল আমার ঘামের মূল্যে, রক্তের নোনা স্বাদে, মহত্তম কাব্যরচনার জন্যে তাকে কোনোদিন ফরমায়েশ দেওয়া হয়নি। সে শুধু রচনা করেছে তার দেখা পৃথিবী, তার দুঃখের এক মরমী ভুবন।’ (‘ভূমিকা’, কবিতা সংগ্রহ, ঢাকা : ধ্রুবপদ, ২০১৬, পৃ. ১৫) -এই চেতনা ধারণ করে কবিতার বিচিত্র পথ পারি দিয়ে চলেছেন কবি মোহাম্মদ সাদিক। তিনি কবিতাকে ধারণ করেছেন সাধনার মাধ্যম হিসেবে। চিন্তা ও পরিকল্পনা প্রকাশের অনন্য আশ্রয়রূপে কবিতাকে কল্পনা করে তিনি অবিরাম নির্মাণ করছেন শিল্পের সুতো ও সৌন্দর্য। শাদা পোশাকের মতো খুব স্বচ্ছ তাঁর শিল্প-অভিজ্ঞান।  

হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ডানায় ভর করে যে-বাঙালি জাতির অভিযাত্রা, তারা কখন কীভাবে কবিতার কাছে স্বস্তি প্রার্থনা করলো, তার একটা সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা মোহাম্মদ সাদিকের কাছে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। তিনি জানেন, বনের মানুষ, অসভ্য মানুষ, বর্বর মানুষের ঘাম আর শ্রমের স্তরে স্তরে প্রতীক্ষায় ছিল কবিতার জন্য। তাদের অভিমান, সভ্যতা গড়ার অহংকার আর নিয়তির সাথে প্রকৃতির সাথে সংগ্রামের যে বিপুল পথ, তার অন্তরালে তারা কবিতার প্রহর-ই কেবল যাপন করেছেন অতি সন্তর্পনে। এই যে অন্তরালের অনুভব- এটাই বাঙালির কবিতার উৎস ও প্রেরণা। সম্ভবত আদিম মানুষের অশেষ ঘাম, সংগ্রামে-পাওয়া রক্ত, বনের হিংস্র বাঘের নখের তীব্র থাবার যন্ত্রণার দাগের ঋণশোধের দারুণ দায় থেকে সাদিকের কবিতা-ভ্রমণ। তাঁর ভাবনা-প্লাবনে মানুষের শ্রমের স্রোত লেগে আছে অকৃত্রিম আভা ও শোভায়। সভ্যতার দাগে কবিতার চিহ্ন কীভাবে লেগে আছে, তার একটা চেহারা কবি তাঁর পাঠকের জন্য হাজির করতে চেষ্টা করেছেন। এই যে পাঠককে নিয়ে, তাদের অনুভবকে নিয়ে ঐতিহ্যের বাড়ি ও বারান্দায় শিল্পের যাত্রা, তার যে অভিলক্ষ্য সেই আলোয় প্রক্ষেপিত কবি সাদিকের শব্দমালা। তিনি যেন শান্ত স্বরে বাঙালির তৈরি হওয়ার, জেগে উঠবার সময়ের কথাগুলো মনে করিয়ে দিতে চান এই সময়ের অগ্রসর মানুষদের কাছে। বর্তমানের সাথে অতীতের, সভ্যতার সাথে ঐতিহ্যের, নতুনের সাথে পুরনোর, চিন্তার সাথে কল্পনার যে মেলবন্ধন তিনি তৈরি করছেন কবিতার মেঘে-মেঘে, তার ব্যপ্তি সুদূরে প্রসারিত। মেঘে-মেঘে অনেক বেলা পার করলেও বাংলা কবিতা যে তার পথ থেকে আজও বিচ্যুত হয়ে পড়েনি, তা টের পাওয়া যায় মোহাম্মদ সাদিকের কবিতার সতর্ক পাঠে।  তাঁর লেখা ‘শিকড়ের শিলালিপি’ কবিতা থেকে খানিকটা পাঠ নেওয়া যেতে পারে- ‘আবার আসব আমি।/কপালে দুঃখের চিহ্ন, করোটিতে দুর্ভিক্ষের ছবি/সমস্ত শরীরে সময়ের ধুলো নিয়ে/ফিরব ফেরার/ঘাড়ারগাঁয়ের লোক আমাকে তখন চিনবে না জানি/অচেনা সে এক আগন্তুক হেঁটে যাব মৌনমুখ/গোপনে গোপনে ক্ষয়ে যাবে বুকের পাঁজর/হাসিমুখে কোনো ঘরে চৌকাঠ আগলে এসে/দাঁড়াবে না কেউ/বারান্দায় লুপ্ত হবে আনন্দের শেষ আলপনা!/তবু তুমি জেনে রাখো আবার আসব আমি/ দু-চোখে ক্লান্তির দাগ/হারানো সে আলপথ ধরে চুপচাপ হেঁটে যাব/প্রত্যাশার কারুকাজ বুকে নিয়ে ফিরব নিশীথ।... অপেক্ষায় থেকো আমি ফের ফিরব আকাশ/গভীর মৃত্তিকা থেকে/পুরোনো মুদ্রার মতো জেগে উঠে ফিরব রোদ্দুর।’ 

মোহাম্মদ সাদিক জানেন রাষ্ট্রে, সমাজে শান্তি নেমে আসে যুগে যুগে মানুষেরই প্রচেষ্টায়। অসুবিধা, অশান্তি যেমন আছে, হতাশা এবং না-পাওয়ার বেদনা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে সকল অপ্রাপ্তির দুঃখবোধ থেকে মুক্তি লাভের উপায়। গুরু-পন্থায় ও গুরু-পথে মনে মনে পরিভ্রমণ করেছেন তিনি। জাতিকে, রাষ্ট্রকে দিতে চেয়েছেন অপার শান্তির বারতা। তিনি লিখেছেন- ‘নেমেছে গভীর অন্ধকার/ভবতরী নিয়ে আমি শেরে বাংলা নগরে/ আটকে আছি গুরু তুমি উপায় বলো না!/ মানুষেরা সত্য শব্দ ভুলে গেছে এবং এখন মিথ্যাই প্রধান/এমন সময় আজ, কেউ কারও কথাই শুনছে না!.../গুরু উপায় বলো না/আমি কী করে নদীকে বলব, নদী তুমি মরুভূমি পুনরায় জলবতী হবে/সেখানে একটি বোয়াল মাছের লেজে রুপালি ঝিলিক হবে/তোমার বুকেও পূর্ণিমার আলো হবে/আমি কী করে একটি নদীকে বলব তুমি আয়ুস্মতী হও/ধবল দুধের বাটি নিয়ে তুমি পুনরায়/সুজাতার মতো/পায়সান্ন হও/আমাদের সন্তানরা জেনে নিক/মিলনের মধ্যে সুখ থাকলেও ভালোবাসায় বিরহই প্রধান/তার অশ্রু হীরার অধিক মূল্যবান!.../গুরু উপায় বলো না/পার করো পার করো বলে দিন তো গোয়াইলাম/রাত কাটাইলাম, দিন খাইলাম।.../আমার মাথায় বারি গুরু আমি দম হারাইলাম!’

তিন।
সরকারি চাকুরিজীবি হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন এই কবি। কবিতাচর্চার ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করেছেন এক সুখী রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়। কবিতাকে করেছেন জীবন-অনুশীলনের বিশেষ পথ ও মত। কবিতাশিল্পের স্নিগ্ধতায় সাজিয়ে তুলতে চেয়েছেন তাঁর প্রিয় রাষ্ট্রভূমি এই বাংলাদেশকে। হাওর-বিলের অসীম সৌন্দর্য আর ঐতিহ্যের রোদ্দুরে গাঁথা যে বাঙালির জীবন, যে অপরূপ কাব্যময়তার ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতির শত শত বছরের অভিযাত্রা, সেই ঐতিহ্যে ও অভিনিবেশে মোহাম্মদ সাদিক এক সাধক কবি। তাঁর কল্পনায় ও পরিকল্পনায় সবসময় রয়েছে মানুষের সুখ আর রাষ্ট্রের প্রশান্তিময় প্রতিবেশ।

ড. ফজলুল হক সৈকত। বাংলাদেশ


লেখক: শিক্ষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ; সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার; ফ্রেঞ্চ ভাষার প্রশিক্ষক।