অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
বিশ্বসাহিত্যে 'ডাডাবাদ'(DADAISM) : একটি অপরিণদ্ধ-পরিচ্যুত আদোলনের নাম - ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ

১. কবিরা নতুন আঙ্গিকে নতুন অনুধ্যানে নতুন ভাষা ও অলঙ্করণে তাঁদের নিরীক্ষিত চিন্তার মেধাবী ফসল পাঠকের কাছে তুলে দেন। এই তুলে দেয়ার  মননশীল সৃজনের প্রেরণা থেকেই সমকালে কবিতায় আধুনিকতা ও মূল্যায়নের যে পালাবদল তার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ঘটাতেই বিবিধ আন্দোলনের সমুদ্ভব লক্ষ্য করা যায়। কবিতার প্রচল রীতির বৃত্ত ভেঙ্গে নতুন রীতির প্রক্ষেপ ঘটানো-ই ছিলো এ সকল আন্দোলনের মৌলিক উদ্দেশ্য। অতঃপর জন্ম হয় নতুন রীতির এবং তা ছড়িয়ে পড়ে এক থেকে বহুতে - সঞ্চারিত হয় শত শত দলে আর এটাকেই সাহিত্যীয় ধারায় কাব্য আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করা হয়।

২. একসময়  কবিতায় ক্লাসিক্যাল রীতির প্রচলন ছিলো। তখন একঝাঁক মেধাবী তরুণ কবি অতি আস্থার সাথে নতুন এক পদ্ধতির উন্মেষ ঘটিয়ে তা পাঠকের হাতে মেলে ধরেন। আর সেটাই হলো নতুন রীতির নতুন নাম "রোমান্টিক" পদ্ধতি। এরই ধারাবাহিকতায় অনেকগুলো আন্দোলনের সূচনা হতে লাগলো। রোমান্টিক রীতির কাব্যরসে পাঠক যখন ক্লান্ত সে সময় কবি বা লেখকের মননে ও মগজে সংশয়ের দীপাবলি জ্বলছে আর নিভছে। আর এর রুচিপ্রিয়তা কবির মনে সংশয়ের রেখাচিত্র দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তখন কবি পুনঃ নতুন কিছু- নতুন পথ ও নতু কথা ভাবছেন। এ ধারায় তাঁর অনুসন্ধিৎসু কাব্যিক মন নতুন পথে নতুন পর্যবেক্ষণ  তুলে আনার প্রায়াস অব্যাহত রাখছে।

৩. আজকের এই আলোচনায় আমাদের তেমনই এক আন্দোলনের কথা তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে। কবিতায় সমকালে 'ডাডাবাদী' আন্দোলন যখন পাঠকের কাছে কাব্যিক বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্যতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে তখনই 'ডাডাবাদী' আন্দোলনের খ্যাতিমান লেখকরা নতুন উদ্যমে আরেকটি নতুন আন্দোলনের সূচনা করেন। নাম দেন "সুররিয়ালিজম"(অধিবাস্তবতা)। বলা চলে আমাদের সাহিত্যও এ সকল বিবিধ আন্দোলনের প্রভাববলয় থেকে মুক্ত ছিলো না। আর এ প্রভাব ঝেঁকে বসেছিলো বস্তুত ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে। তাই ইংরেজি সাহিত্যের যতটুকু পর্যায় ততটুকুই বাংলাসাহিত্যে প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়েছিলো। তবে এ কথা বলতেই হয় সমকালে কিছু কিছু বাঙালি সাহিত্যিক সরাসরি ফরাসি সাহিত্যে অভিনিবেশ করেই এ ধারার বিবিধ আন্দোলনে নিজস্বতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। 

৪. অপরদিকে সুকুমার শিল্পবিভবের-দ্যুতিত পথের অনুসরণ ও অনুকরণে সাহিত্যান্দোলনের সমধারায় চিত্রশিল্পেও এর প্রভাব দুর্লক্ষ্য ছিলো না। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় চিত্রশিল্পেও রঙ ও রেখার অপূর্ব জ্যামিতি প্রতিস্থাপিত হতে দেখা যায়। আর এ আন্দোলন "ইম্প্রেশনিজম" ও "এক্সপ্রেসনিজম" আন্দোলন নামেই সমধিক পরিচিতি পায়। এসকল আন্দোলন কখনো কখনো যতটা ছবি বা চিত্রে প্রযোজ্য ছিলো ততেটা সাহিত্য নয়। যেমন "ফবিজম" ও "কিউবিজম"র কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। বস্তুত কাব্যসাহিত্যকে বুঝার লক্ষ্যেই আমাদের আলোচনার এ প্রয়াস।

৫. গবেষকদের পর্যবেক্ষণ থেকে 'ডাডাবাদ'র নিরীক্ষিত সত্যটাই ওঠে এসেছে। তাঁদের মতে 'ডাডাইজম'র একঘেয়েমি থেকে যে অবস্থান্তর প্রাপ্তি-তার পরিণাম থেকেই 'সুসরিয়ালিজম' বা অধিবাস্তবতার উদ্ভব ও বিকাশ। ডাডাবাদী এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ কবি- সমকালে বিবিধ ধারার রকমারী ধরন-নীতির প্রচল কবিতার বিপক্ষে তাঁদের উদ্দীপ্ত অবস্থান ঘোষণা করেন। এ তরুণ কবিরা অধুনা কাব্য চর্চার সমকালীন প্রথার বাইরে এসে এক স্থিতিশীল ও প্রচল কাব্যরীতির নিয়ম ভাঙ্গার নেশায় মেতেছিলেন। নতুন কিছু একটার অবভাস ঘটানোর লক্ষ্যেই এ তরুণ কবিরা এ ধারায় যাত্রা শুরু করেন। অতঃপর তাঁদের সম্মিলিত আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কিছুদিনের মধ্যেই 'ডাডাইজম' তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে এ তরুণ কবিদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য  যুগপৎ সঠিক ধারায় পরিচালিত হতে না পেরে একটি অতি সম্ভাব্য দুর্বল আন্দোলনে পরিণত হয়। এরই প্রেক্ষিত 'ডাডাবাদী' মেধাবী কিছু লেখকগোষ্ঠী ও তাঁদের সাথে সহযাত্রী কিছু মেধাবী শিল্পী ঐকবদ্ধ হয়ে 'ডাডাবাদী'র স্বপক্ষে প্রচল প্রথার বিরুদ্ধে সেই স্লোগান মুখরিত-বিভ্রান্ত তরুণ কবিদের লক্ষ্যহীন আন্দোলন ত্যাগ করে 'সুররিয়ালিস্ট' আন্দোলনের সাথে সমর্থন ব্যক্ত করে  নিজেদের প্রচল কাব্য রীতির পক্ষে থাকার অবস্থান নিশ্চিত করেন। প্রাজ্ঞ গবেষকদের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় 'সুররিয়ালিস্ট' ( অধিবাস্তবতা) আন্দোলন 'ডাডাবাদ'র-ই যুক্তিহীন দুর্বল আন্দোলনের অনিবার্য ফসল।

৬. প্রথমেই জেনে নেয়া যাক দ্যুতিত ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে কবিতার দ্যোতিত অঙনে এ আন্দোলন কেন? এবং 'ডাডাইজম' কী? বস্তুত ঊনিশের দশকে কবিতা চর্চায় এক মনস্তাত্ত্বিক 'ভার্সেটাইল' বিপ্লব সাধিত হয়। যা কাব্যমোদীদের সমন্বয়ে বোদ্ধা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার একটি সমন্বিত আন্দোলন। এরই ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতায় আলোচ্য 'ডাডাইজম' হচ্ছে সাহিত্যের একটি অস্থায়ী আন্দোলন। এর শুরুটা উদ্দীপিত বিশ শতকের মধ্য দ্বিতীয় দশক। এই সময়টি বিজ্ঞাপিত হয়েছিলো ১৯১৫ থেকে '১৬'র দিকে। এ আন্দোলনটি আদর্শিক পরিপক্বতায় রূপান্তরিত হওয়ার আগেই বহুল আলোড়িত উৎকর্ষের দীপ্তি হারিয়ে ফেলে ১৯২২ এর শেষের দিকে। অতঃপর বলতেই পারি এ সময় ও একটি নাতিদীর্ঘ পরিসরে সাহিত্যের একটি দৃশ্যমান অপরিণদ্ধ আন্দোলনের অনিবার্যতায় 'ডাডাবাদী' আন্দোলনের মৃত্যু ঘটে। 
     জুরিখে একঝাঁক মেধাবী লেখক ও অসম্ভব উৎসাহী ও অস্থির প্রকৃতির কিছু প্রত্যয়ী শিল্পীকে বলা হয় 'ডাডাবাদী' আন্দোলনের ব্রহ্মা। ইউরোপীয় প্রথম বৈশ্বিক যুদ্ধ (২৮ জুলাই ১৯১৪)- যা সমকালে 'গ্রেট ওয়ার' হিসেবে পরিচিত ছিলো। এই প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে রুমানীয় কবি Tristan Tzara ( April 16, 1896 - December 25, 1963), জার্মান কবি Hugo Ball Richard (1886-1927), Hulsenbeck (1892-1974) ও কবি এবং স্থপতি Hans Arp (1886-1966) তাঁদের সারস্বত উপলব্ধিজাত অধুনা এক নবীভূত কাব্যধারার উন্মেষ ঘটানোর নীরিক্ষাধর্মী প্রয়াসে নিজেদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টি পরিষ্কার করেন। এঁদের মধ্যে ব্রেতো(Andre Breton1896-1966) ও আঁরাগের(Louis Aragon, 1897-1982) সক্রিয় ভূমিকার প্রসঙ্গটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এ আন্দোলনের প্রারম্ভিক যাত্রায় তাঁদের জোরালো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দৃশ্যমান সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।

৭. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের(১৯১৪)দৃশ্যমান ভয়াবহ-বিভীষিকা নিরীক্ষণে উল্লিখিত তরুণ মেধাবী কবিরা সমকালীন অধুনাতন সাহিত্যের প্রচল-প্রবর্তিত বিদ্যমান প্রথা বা 'স্টাইল' তথা সবকিছুকে পরিহাস্যতায় অগ্রহণযোগ্য মনে করে এই লেখকগোষ্ঠী আধুনিক কাব্যধারায় একটি হটকারি সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে একটি অপ্রয়োজনীয় পরিবর্তনের শ্লেষাত্মক দ্রোহের- আন্দোলনের অপপ্রয়াসের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। লক্ষণীয় যে,  এ ধারায় প্রাচীন জীবনযাত্রা, আদর্শ ও নীতি এবং  ধর্মবোধ(Theology), নীতিবাক্য ও নীতিশাস্ত্র- এ সবের বিরুদ্ধে তাঁদের সম্মিলিত ও সমন্বিত যে আক্রমণ- আন্দোলন তার শুরুতেই অনিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রচার ও প্রকাশের যে উন্মাদনার  মাত্রা, তা ছিলো সমান সমান। অবশেষে কবিতার এ আন্দোলন হয়ে ওঠে একটি ইতিহাস। আর এ আন্দোলনের নাম-ই হচ্ছে 'ডাডাইজম'।

৮. 'ডাডাইজম'র নামকরণের প্রেক্ষিত পর্যালোচনায় Hulsenbeck তাঁর এক অভিযোজিত ও নিরীক্ষ্যমাণ  বহুল আলোচিত নিবন্ধে(প্রকাশ কাল ১৯২০) তাঁর স্বগত উচ্চারণ "The word 'Dada' accidentally discovered by Hugo Ball Richard and myself in a German-Franch dictionary, isFrench for a  wooden horse. It is impressive in its brevity and suggestiveness."
     বস্তুত শিশুদের মুখে এ শব্দটি (ডাডা) স্বতঃস্ফূর্ততায় অতি স্বাচ্ছন্দ্যে উচ্চারিত হতো বলেই- সেখান থেকে 'ডাডা'(DADA)নামটি বেছে নেয়া হয় বলে প্রাজ্ঞ গবেষকদের ধারণা। এ ধারায় পরীক্ষিত পর্যবেক্ষণে নির্ভরযোগ্য সংশ্লেষিত মতামত ওঠে আসে রুমানীয় কবি Tristan Tzara'র নিজস্ব বক্তব্যে। তিনি বলেন "টেরাস ক্যাফেতে বসে সন্ধ্যে ছ'টা নাগাদ হঠাৎ তিনি 'ডাডা' শব্দটি আবিষ্কার করেন। জার্মান-ফরাসি অভিধানের প্রথম পাতা থেকেই তীক্ষ্ণফলা এক ছুরি বসিয়ে যেখানে ছুরির ডগা গিয়ে শেষ হয়েছে, দেখা গেলো সেখানে রয়েছে ঐ 'DADA' শব্দ। 'DADA' শব্দেই ছুরির ফলা এসে ঠেকেছে কিন্তু বিদ্ধ করেনি, সেই জন্যে এই শব্দকে গ্রহণ করা হলো। এভাবেই 'DADA' শব্দটির আবিষ্কার।"

৯. 'ডাডাবাদী' আন্দোলনের প্রেক্ষিত সমকালে  -উল্লিখিত কবি ও শিল্পী সমন্বয়ে একটি ক্লাব গঠন করা হয়। নাম দেয়া হয় 'ভল্টেয়ার ক্যাবারে'। উদ্দেশ্য হলো সাহিত্য ও শিল্পের প্রচল আদর্শকে আক্রমণ করে বক্তব্য  দেয়া। তাঁদের উচ্চারিত বক্তব্যের বাণী ছিলো এরূপ "যা কিছু স্থির -অনুদ্বেগ, সুস্থিত, তাকে উন্মূল করো- গুঁড়িয়ে দাও-প্রাচীনকে থামিয়ে দাও -পুড়িয়ে মারো।'এটাই ছিলো সমকালীন 'ডাডাবাদী' কবি-শিল্পীদের স্লোগান।  এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের প্রচল কাব্য প্রথার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্টীকৃত করে তুলার জোরালো প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। পাশাপাশি শতাব্দীর প্রচল ধারার কাব্যিক ঐতিহ্যকে রুখে দেবার জন্য 'ডাডাবাদী' লেখকগোষ্ঠী ছিলেন  বেপরোয়াভাবে অঙ্গীকৃত। 
     লক্ষণীয় যে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে Tristan Tzara 'DADA' নামে একটি সাময়িক পত্র প্রকাশ করেন।'DADA'র-সংখ্যা তিন এ 'ডাডাইজম'র মৌলিক প্রস্তাবনা এবং তার লক্ষ্য ও ভূমিকা সম্পর্কে তিনি একটি সারস্বত বক্তব্য প্রকাশ করেন।সেই সুবিন্যস্ত নাতিদীর্ঘ রচনায় বিজ্ঞাপিত হলো সেই সুর "যা কিছু প্রচল প্রথার সমর্থক তাকে বিনাশ করো। যা সুস্থিত বিশ্বাসের দ্বারা লালিত - তাকে উপড়ে ফেলো,যা সনাতন-তা ছুড়ে ফেলো আস্তাকুঁড়ে।"
     ডাডাবাদীরা মনে করতেন 'সমস্ত রচনাই কবিতা'। তাঁদের কবিতা সম্পর্কে উচ্চকণ্ঠ ফতোয়া ছিলো-'ছন্দে গাঁথা, মিলিয়ে বলা কোনো বাক্যবিন্যাস মানুষের স্বভাব চিন্তার ফসল নয়; তার পেছনে বুদ্ধির ও মানুষের মনন কৌশলের কারসাজি আছে। অতএব তাতে আছে জোচ্চুরি, সুতরাং তাকে হঠাও, তাকে ধ্বংস করো।' এটাই হচ্ছে ডাডাবাদের ফতোয়া। যা 'ফতোয়া' নামেই বহুল পরিচিতি পেয়েছিলো। এ ধারায় অনেকটা কঠিন সুরেই ডাডাবাদীরা আওয়াজ তুলেন যে, ছবি আঁকার এবং কবিতা রচনার সেকেলে পথ ও পদ্ধতি  বদলে আধুনিক অনুধ্যানের প্রবর্তন করতে হবে। সমকালে কবিতা ও ছবি বা চিত্রশীল্প সম্পর্কে ডাডাবাদীদের অনেকটা রক্ষণশীল পর্যবেক্ষণ তাঁদের কণ্ঠেই অনায়াস উচ্চারিত হতে দেখা যায়। তাঁদের ধারণা সে সময়ের যা কিছু মহৎ ও চিরকালীন কালজয়ী যত শিল্প - সাহিত্য সমকালীন সমাজে প্রচল ঐতিহ্যে পরিবৃত ছিলো তা 'মহৎ তো নয়-ই স্রেফ একটা ধাপ্পা যা কতিপয় বুদ্ধিমান মানুষের চতুরতা মেশানো মানসিক শ্রমের সৌকর্য, এককথায় যাকে প্রতারণা বলা চলে। ডাডাবাদীদের  কবিতা সম্পর্কে মৌলিক পর্যবেক্ষণ ছিলো "মনের সচেতন অংশ ছাড়া অচেতন এবং অবচেতন অংশ আছে; শেষোক্ত অংশ দু'টি থেকে জাত অনুভব-ই 'যথার্থ কবিতা' "। অতঃপর কাব্য রচনায় অবচেতন মনের স্বতঃস্ফূর্ততায় উন্মেষিত বন্ধনমোচনকেই-ডাডাবাদীরা উপভোগ্য শিল্পের আকর এবং প্রাসঙ্গিকতায় নন্দিত সুন্দর 'রসোত্তীর্ণ কাব্য' বলে গ্রহণ করেন। তাঁদের ধারণা মানুষের মনোজগতে যে মননক্রম তা কখনোই কোনো সূত্রানুযায়ী যেমন গ্রথিত হয় না তেমনি বিন্যস্তও হয় না, বিক্ষিপ্ততার ভেতর তার উদযুক্ত উন্মেষ ঘটে। সুতরাং এলোমেলো-অগোছালো বিন্যাসেই তার রূপ দিতে হয়, অন্যথায় তাতে কৃত্রিমতা আসে- কাব্য অকৃত্রিম হয় না।

১০.  বস্তুত কবিতাকে কৃত্রিমতার বৃত্ত থেকে মুক্ত করার বিদগ্ধ সাধনাই ডাডাবাদী কবিদের কাছে উপাস্যমান তপস্যা হয়ে ওঠলো। তাঁদের পর্যবেক্ষণ ছিলো বিগত শতকে যে সকল কবিতা লেখা হয়েছে তা ছিলো অতি মাত্রায় কৃত্রিম। অতএব তা বর্জন করে অকপট অথচ নন্দিত সহজাত উপলব্ধির অনুধ্যেয় সূত্রের ধারাতেই কবিতা রচিত হোক। এটাই ছিলো সমকালে ডাডাবাদীদের প্রস্তাবিত নীতি। একেই বলা হয় 'ডাডাবাদী ঘোষণা'। উল্লেখ্য ডাডাবাদীরা কবিতা লেখার বিষয়টিকে 'Automatic writing' হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি কাব্য রচনায় স্বতঃস্ফূর্ততার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিলেন।
অতঃপর ডাডাবাদীরা পূর্ববর্তী (Pioneer) কালের কোনোকিছু আমলে না নিয়ে; গ্রহণে অনীহ হয়ে কবিতা বিনির্মাণে নতুন ধারার নতুন আন্দোলন গড়ে তুলেন। 

১১. নতুন ধারায় নতুন আলোকে তরুণ ডাডাবাদীরা মানবমনের নিগূঢ় রহস্যময় এক অজ্ঞেয় অন্তর্লোকের বিমূঢ় উপলব্ধিকে তাঁদের অঙ্গীকারে বৃত্তাবদ্ধ করার প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় কবিতায় দুর্বোধ্যতার যাত্রা। ডাডাবাদীদের অধুনা পরিচিন্তন ও  মননীয় পর্যবেক্ষণে ওঠে আসা কবিতার সংজ্ঞা 'অবচেতন মনের যথাযথ উন্মোচনই কবিতা'।
     বস্তুত প্রচল বা সনাতন যা কিছু  আছে তা ছুড়ে ফেলা এবং সমকালে প্রচল কাব্যরীতির ধারা বর্জনে মানুষকে বিশ্বাসী করে তুলে তাঁদের নব্য অঙ্গীকারের পরিবন্ধনে আবদ্ধ করে রাখাই ছিলো ডাডাবাদীদের মৌলিক দর্শনের পরিপত্র। তাঁদের মুখ্য স্বাধীন বক্তব্য হচ্ছে  'শিল্পী বা সাহিত্যিকের মানসলোকের স্বৈরাচারিতার অবারিত প্রকাশ, কবিতায় বল্গাহীন স্বাভাবিক উচ্ছ্বাসের উদ্দামতা, যথেচ্ছ শব্দ- যা অন্তর্লোকের তাগিদে এসে পড়ে... তারই অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।'
     এ ধারায় আলোচ্য পর্যালোচনার প্রেক্ষিত- বিশ্লেষণ ও প্রতর্ক্য বিবেচনায় যে চিত্রটি পর্যবেক্ষণে নিবন্ধিত হয়ে দৃশ্যমান হয় তা হলো সমকালে কতিপয় তরুণ  মেধাবী যুবকের মনন ও মগজে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক যে ভয়াতুর অধ্যায় সেটাই প্রচল কাব্যরীতির চর্চা ও দীপ্তিময় বিকাশে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছিলো। বস্তুত এ যুদ্ধের ভয়ার্ত প্রভাব তাঁদেরকে অতি নৈরাশ্যের সংকটে নিক্ষেপ করে বিশুদ্ধ কাব্য চিন্তার অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে এই ডাডাবাদী তরুণ লেখকগোষ্ঠী হয়ে ওঠে প্রচণ্ড নৈরাশ্যবাদী। তাঁদের  সেই উপলব্ধি থেকে যে বিষয়টি দৃশ্যমান হয় তা হলো- তাঁরা কোনো 'যুদ্ধকে স্বীকার করতে চায় না, সনাতনী প্রথাসিদ্ধ ব্যবস্থাকে মান্য করতে চায় না, তাঁরা সবকিছু ভেঙ্গে তচনচ করে দিতে চায়। এই বোধ থেকেই ডাডাবাদের সূত্রপাত।'

১২. ডাডাবাদীদের এ আন্দোলন সমকালে দ্রুততার সাথে ব্যাপক বিস্তৃতি পেয়েছিলো লন্ডন হয়ে প্যারিস এবং প্যারিস থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত। নিউইয়র্কে Marcel Duchamp (১৮৮৭-১৯৬৮) প্রমুখ চিত্রশিল্পীরা বিভিন্ন ধারার চিত্রকর্মকে যুদ্ধবিরোধী মাধ্যম হিসেবে প্রাসঙ্গিকতায় ব্যবহারের প্রয়াস রেখেছিলেন। নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিল্পীরা ভাবনার সাথে উৎকর্ষজাত শিল্পবৈভবে পরিবৃত রকমারি নানাবিধ  চিত্রের অনুষঙ্গকে সমান্তরাল ভাবে উপস্থাপন করতে যেয়ে তাঁরা মূল থেকে সরে এসে বিকৃত চিত্র এঁকে অশিল্পীসুলভ একটি বিনিন্দিত পত্রিকার জন্ম দেন। যার নাম '291' ('দুই শত একানব্বই')। এ পত্রিকাটি সমকালে ভাববাদীদের পক্ষে যুদ্ধবিরোধী জোরালো জনমত তৈরির মুখপত্র হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো। পাশাপাশি তাঁরা বিদ্যমান বৈশ্বিক সমাজের চিরকালীন প্রচল সব অনিন্দ্য নান্দনিকতার শিল্পোৎকর্ষকে অস্বীকার করে 'এবসলিউট' সৌন্দর্যকেই ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। একসময় তাঁদের এই তথাকথিত অবিশুদ্ধ আন্দোলন সারস্বত প্রচল চিন্তন ও শিল্পীত চারুকলার বিভব এবং নন্দিত যত বিভাব ও বিশ্বাসবোধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠলো। এখান থেকেই ডাডাবাদীরা পুনঃ- মনের সুপ্ত অন্তঃপুরে সংগুপ্ত অভিজ্ঞার অন্বেষণ শুরু করে। অতঃপর দীর্ঘ এক প্রলম্বিত যাত্রা শেষে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এসে এই ডাডাবাদী আন্দোলনের এক সকরুণ পরিসমাপ্তি ঘটে।
     ডাডাবাদী আন্দোলন তার স্বকীয়তা হারিয়ে 'SURREALISM' -পরাবাস্তবতা বা অধিবাস্তবতার ('বাস্তবতার বাইরে আরেকটা চেতনালাক আছে- তা-ই  অধিবাস্তব চেতনালোক-'SUPER REALISM' ) আন্দোলনের ভেতর একবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

১৩. বাংলা কাব্যোতিহাসের প্রলম্বিত ধারাবাহিকতায় 'ডাডাবাদ'র কোনো সক্রিয় উপস্থিতি বা প্রভাব ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়নি। সমকালে কল্লোলের একদল মেধাবী তরুণ কবি রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করে রবীন্দ্রাদর্শ বর্জনেরও ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছেন। পাশাপাশি দ্যোতিত বিশ শতকের প্রথমদিকে অধুনা কাব্য চর্চার সারস্বত চেতনায় তাঁদেরকে উদ্বেলিত হতেও দেখা যায়। প্রাচীন  বিশ্বাসবোধ ও কাব্য চর্চার প্রচল ঐতিহ্যকে নির্দ্বিধ চিত্তে পরিত্যাগ করে মেধাবী তরুণ কবি গোষ্ঠী আধুনিক কবিতার দীপ্তাঙ্গনে-নিজস্বতায় কবিতার দ্যুতিত অন্তঃপুরে বিচরণের প্রয়াস রাখেন। সাথেসাথে এ লেখকগোষ্ঠী কবিতায় নতুন ধারার উন্মেষ ঘটানোর একটি গ্রহণযোগ্য স্বকীয় এলাকা- পরিব্যাপ্ত অভিজ্ঞানের আওতায় নিয়ে এসে দীক্ষিত ধারায় নীরিক্ষাধর্মী কাব্যরীতির সাধনায় নিজেদের অধিক মাত্রায় অভিনিবিষ্ট করে তুলেন। এ কাব্যরীতির নবীভূত - সংবেদ্য ধারায় যাঁদের নাম পর্যবেক্ষণে  উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চারিত হয়েছে তাঁরা হলেন- মোহিতলাল মজুমদার(১৮৮৮-১৯৫২), যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত(১৮৮৭-১৯৫৪), কাজী নজরুল ইসলাম(১৮৯৯-১৯৭৬) প্রমুখ  এবং তাঁদের পাশাপাশি যাঁদের নাম সমধিক উচ্চারত তাঁরা হলেন 'তিরিশ'র কল্লোলগোষ্ঠী বা 'তিরিশ'র প্রধান পাঁচ কবি - জীবনানন্দ দাশ(১৮৯৯-১৯৫৪), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত(১৯০১-১৯৬০), বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২), বুদ্ধদেব বসু(১৯০৮-১৯৭৪) প্রমুখ।

১৪. ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি এরই পারম্পর্যে  'ডাডাবাদ'র প্রভাবে বাংলা কাব্যাঙ্গনেও একটি কবি গোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো। তাঁদের কাব্যচর্চায়ও দুঃশীল অনুষঙ্গের শব্দ ও চিত্র অনুবৃত্তির সম্যক প্রয়াস ছিলো। বাংলা কাব্য সাহিত্যে বোদ্ধা পাঠক বরাবরই শালীন কাব্য স্বাদে অভ্যস্ত ছিলো। সেখানে এক ঝাঁক তুখোড় নবীন কবি গোষ্ঠী কাব্যে শালীনতার চির সুন্দরের ব্যবহারকে অনাধুনিক আখ্যায়িত করে পরিত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। অতঃপর কবিতার শুচি-শোভন শরীরে মানুষের জৈবিক বৃত্তির নগ্নতাকে স্ফুট করে তুলে ধরার অভিপ্লুত অভিপ্রায়কে প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। কিন্তু সমকালে বাঙালি বোদ্ধা পাঠক তাঁদের এ প্রয়াস গ্রহণ না করে- ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। সে সময় ডাডাবাদী চেতনায় কিছুটা আলোড়িত ও উদ্বুদ্ধ পঞ্চাশের কবিদের সাথে যুক্ত হলেন বাংলা সাহিত্যের আরো মেধাবী দুই তরুণ কবি। তাঁরা হলেন বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। কিন্তু এঁদের লেখায় ও কাব্যচিত্রে জৈববৃত্তির চেয়ে শিল্পজাত উৎকর্ষের সুষমাবৃত বিভব ছিলো বেশি। বলা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কাব্য চর্চায় কবিদের মননেও একটা অবিশুদ্ধ ও অস্থির প্রভাব প্রকীর্ণতায় প্রক্ষিপ্ত হয়েছিলো। এরই নেতিবাচক প্রভাব-প্রতর্ক্যে উজ্জীবিত ১৯৫০'র এ সকল তরুণ কবি গোষ্ঠীর কবিতায় যৌনতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠলো। এ ধারায় সাহিত্যের রুচিশীল পাঠক অধিকতর স্পষ্টতায় অশ্লীলতাকে দৃঢ়তার সাথে বর্জন করে শিল্পকে বেছে নিলো। সমকালে রুচিশীল পাঠকের কাছে তাঁদের 'কবিতা' - কবিতা হয়ে ওঠেনি। 'ডাডাবাদ'র প্রভাব চেতনায় এসকল কবিরা যা লিখলেন বা রচনা করলেন তা কবিতা-ই হয়নি। সমকালের বিদগ্ধ সমালোচকদের প্রাজ্ঞ পর্যবেক্ষণে ওঠে আসা এই তরুণ কবির দল  'হাংরি জেনারেশনের কবি' বলেই সমধিক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সমালোচকরা যথার্থই বলেন 'এঁদেরকে তাই ডাডাবাদী কবি বলা ঠিক হবে না। বিন্যাস, প্রকরণ, শব্দ নির্বাচন, বিষয়বস্তুর ভাবনা-বৈচিত্র্য- কোনো দিক থেকেই এঁরা ডাডাবাদী চিন্তার পরিচয় রাখেন নি, এমন কী অবচেতন মনের উন্মুক্ত প্রকাশের প্রয়াসও এঁদের কাব্যে দেখা যায় না।' বস্তুত ডাডাবাদের মৌলিক শর্ত ছিলো 'অবচেতন মনের আচরণাশ্রয়ী উদ্ভাস।' অর্থাৎ ডাডাবাদে কবিতায় ব্যবহৃত নির্দেশনা হচ্ছে অর্থহীন-বিশৃঙ্খল কিংবা অগোছালো শব্দ বা কথার বিন্যস্ততায় কাব্যদেহ বিনির্মাণ করা। যা সমকালে সারস্বত চেতনা সমৃদ্ধ বোদ্ধা পাঠক কোনোভাবেই গ্রহণ করেনি। তাই আমাদের বাংলা কাব্যাঙ্গনে ডাডাবাদী আন্দোলনের যেমন সক্রিয় প্রভাব পড়েনি তেমনি ডাডাবাদী কবিতারও সফল উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেনি। 
     বস্তুত সমকালে বিশ্বসাহিত্যের কাব্যাঙ্গনে 'ডাডাবাদ' ছিলো একটি আন্দোলনের নাম। যার অনিবার্য পরিণতি পরিলক্ষিত হয় অধিবাস্তবতার হাতে। অতঃপর এখান থেকেই শুরু কবিতায়  'সুররিয়ালিজম'র আন্দোলন বা পরাবাস্তববাদের আলোকিত যাত্রা। ( ক্রমশ...)

ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ 
শ্রীমঙ্গল, বাংলাদেশ