অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
বইয়ের ভ্রমণ এবং বই পাঠের গুরুত্ব - ডঃ মানিক মন্ডল

 ই হলো মানবজীবনে জ্ঞান অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম এবং অনন্য জ্ঞানের সমাহার। বই তার পাঠককে এমন এক স্তরে উন্নীত করে যা দিয়ে সে অপার জ্ঞান লাভ করে, সমৃদ্ধ হয় ও জীবন আলোকিত হয়। অন্যের চিন্তা ও অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এমন ধারনা দেয় যা নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে সহায়ক হয়।
     রবীন্দ্রনাথ বলেছেন - “বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি.....”। বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন - "আমি যা জানি তা হচ্ছে একটি ফোঁটা মাত্র, যা জানি না তা হচ্ছে একটি মহাসমুদ্র।" সুতরাং জ্ঞান অর্জনের জন্য বই অবশ্যই পড়তে হবে। বই আমাদের শ্রেষ্ঠ সাথী, যুগ যুগ ধরে বই মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সৃজনশীলতায় এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে আসছে। মানবজীবনে বইয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিখ্যাত লেখক বোর্হেস্ (১৮৯৯ – ১৯৮৬) বলেছেন আমি সর্বদাই স্বর্গকে একপ্রকার পাঠাগার রূপেই কল্পনা করেছি (“আই হ্যাভ অলওয়েজ ইমাজিনড্ দ্যাট প্যারাডাইস উইল বি এ কাইন্ড অফ্ লাইব্রেরী”)। কী অপরিসীম গভীরতা এই বক্তব্যে! রবার্ট সাউদি (১৭৭৪ – ১৮৪৩) এক কবিতায় লিখেছেন – "বই-ই হল আমার সদা বিশ্বস্ত সুহৃদ, যাদের সাথে আমি রোজ কথা বলি" (“মাই নেভার ফেইলিং ফ্রেন্ডস্ আর দে উইথ্ হুম আই কনভার্স ডে বাই ডে”) অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বই হলো তার অন্তরঙ্গ বন্ধু, তিনি বইকে সঙ্গী করে অনন্দ পান, বিশ্রাম লাভ করেন এবং তার দ্বারা তাঁর দুঃখ লাঘব হয়। আবার হার্বট স্পেনসার (১৮৭৪) বলেছেন – "বই পড়া হলো অন্যের চোখ দিয়ে দেখা" (রিডিং ইজ সীইং বাই প্রক্সি)। তাঁর এই উপলব্ধি বই পাঠের প্রয়োজনীয়তাকেই গুরুত্ব দেয়। বই পাঠে আমরা লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতাকেই জানতে পারি। অনেক অদেখাকে দেখতে পাই, অজানাকে জানতে পারি। এ ব্যাপারে চার্লস ল্যাম্ব যা বলেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ – "আমি নিজেকে অন্যের মনে হারিয়ে ফেলতে ভালবাসি" (“আই লাভ টু লুজ মাইসেলফ্ ইন আদার মেনস্ মাইন্ডস্”)। আসলে তিনি বইয়ের সঙ্গ বিশেষভাবে উপভোগ করেন। তিনিই আবার বলেছেন – "বই পড়া আসলে নিঃশব্দ কথোপকথন" (“হোয়াট ইজ রিডিং, বাট সাইলেন্ট কনভারসেশন”)। জন মিল্টন (১৬০৮ – ১৬৭৪) বলেছেন – "ভাল বই পাঠকের জীবনশক্তির উৎস, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষন করা উচিত।" বই পাঠকের উপর এমন প্রভাব ফেলে যেটা ভবিষ্যৎ বা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খুবই জরুরী। প্রত্যেকের জীবনে বই পড়া হলো গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য।
     আবার একথা সঠিক যে প্রত্যেক বই-ই সহজাতভাবে একটি ভ্রমণ। মানুষের ভ্রমণে বই যেমন সঙ্গী হয়, পাশাপাশি বইয়েরও একটা নিজস্ব ভ্রমণ আছে। বইয়ের ভ্রমণ জানতে হলে আমাদের জানতে হবে বই আসলে কী। বই হলো একটি নথি যা জ্ঞানের মাধ্যম। বইকে আমরা গ্রন্থ (যা গ্রথিত আছে) বা পুস্তক বলে থাকি, ইংরাজীতে যাকে বলে “বুক”। বুক কথাটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ “লিবার” থেকে। লেখা শুরু হওয়া থেকেই বইয়ের ইতিহাস শুরু হয়। পরবর্তীকালে কাগজ ও ছাপাখানা আবিস্কারের পর তা বিস্তৃতি লাভ করে। গুটেনবার্গের ছাপাখানা (১৪৫০) ছাপার ইতিহাসের এক বৈপ্লবিক আবিস্কার, যা থেকে প্রচুর সংখ্যায় বই ছাপা সম্ভব হয় এবং তা দ্রুত জ্ঞান প্রচারের সহায়ক হয়ে ওঠে। সম্ভবত এই ছাপাখানা আবিস্কার না হলে রেনেসাঁস, শিল্পবিপ্লব, প্রযুক্তির উন্নতি ও আধুনিক জগৎ ত্বরান্বিত হত না। সময়ের সাথে সাথে বইয়ের আকারগত পরিবর্তন হলেও বইয়ের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু চিরস্থায়ী। ছাপাবই আবিস্কার হওয়ার বহু পূর্বেই বই বিদ্যমান ছিল বিভিন্ন মাধ্যমে যেমন ক্রমান্বয়ে মাটির ফলকে, স্ক্রোলস্ এবং প্যাপিরাসের আধারে। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ছাপা বইয়ের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে, বর্তমানে যা ই-বুক বা ইলেক্ট্রনিক বই নামে পরিচিত। ই-বুক এর কোন আকার বা অবয়ব নেই যা কম্পিউটার-এ বা অন্য কোনো বৈদ্যুতিন যন্ত্রের (যা হাতে ধরা যায়) মাধ্যমে পড়া যায়। যেমন – ই-বুক রিডার, ট্যাবলেট পি.সি, স্মার্টফোন ইত্যাদি। এছাড়া প্রতিবন্ধীদের পড়ার উপযোগী ব্রেইল বুক-ও উল্লেখযোগ্য।
     আমরা ভ্রমণের সাথে বইয়ের একটা সরাসরি সম্পর্ক দেখতে পাই। ভ্রমণ শুধুমাত্র গন্তব্য স্থানে পৌছানো বা তার দুরত্বই বোঝায় না, ভ্রমণ মানুষের আবেগ ও জ্ঞানের ওপর প্রভাব ফেলে। ভ্রমণকারীর সঙ্গে যদি বই থাকে তবে তার চলার পথে আরও একটি ভ্রমণ সংগঠিত হয়। আকারগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বই যেমন দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছে, তেমনই সময়ের সাথে সাথে প্রত্যেকটি ছাপা বইয়ের একটা নিজস্ব ভ্রমণ বা জার্নি আছে, তার নিজের আত্মকথা আছে। এই যাত্রাপথের চিহ্ন সময়ের সাথে এবং ব্যবহারের সাথে বইটির অবয়বের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। সময়ের সাথে বইয়ের স্থানান্তর ঘটে। বংশ পরম্পরায় বই অনেক পরিবারে থেকে যায় এক মধুর স্মৃতি হয়ে। একইভাবে পাঠকের সাথে গড়ে ওঠে এক নিবিড় সম্পর্ক, বোরহেস্ যথার্থই বলেছেন – বই কোন পৃথক বা স্বতন্ত্র বস্তু নয়, বই মানুষের সাথে এক সম্পর্ক যুক্ত, অসংখ্য সম্পর্কের এক অক্ষরেখা (“এ বুক ইজ নট্ অ্যান আইসোলেটেড বিইং, ইট ইজ এ রিলেশনশিপ, এ্যান অ্যাক্সিস্ অফ্ ইননিউমারেবেল্ রিলেশনশিপস”)।
     বইয়ের ভ্রমণ বা চলনের ব্যাপারে প্রখ্যাত গ্রন্থাগার বিজ্ঞানী ডঃ রঙ্গনাথনের বিশ্বজনীন ও দার্শনিক ভিত্তিতে গঠিত পাঁচটি সূত্রের তৃতীয় সূত্রটি এখানে খুবই উল্লেখযোগ্য। তৃতীয় সূত্রটি হলো, “প্রত্যেক বইয়ের জন্য পাঠক”। বস্তুতঃ পক্ষে বইয়ের ভবিতব্যই হচ্ছে ভ্রমণ। গ্রন্থাগারে বই লেনেদেনের জন্য বইয়ের স্থানান্তর ঘটে। পড়ার জন্য বই একস্থান হতে অন্যস্থানে পাঠানো হয়, আবার এক পাঠক থেকে অপর পাঠকের নিকট পৌঁছায়। এইভাবে এক দীর্ঘপথ অতিক্রম করে। বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞান প্রসার ঘটানোয় মেলভিল ডিইই’র (১৮৯৩) প্রচেষ্টা খুবই উল্লেখযোগ্য। তিনি মনে করতেন, মানবজীবনে প্রগতি বা উন্নতির জন্য বই পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উল্লেখ করেন, এমন অনেক স্থান আছে যেখানে বই পড়ার কোন সুযোগ নেই, কোন আর্থিক সংস্থান নেই গ্রন্থাগার তৈরীর জন্য। যার ফলস্বরূপ ১৯০৫ সালে আমেরিকায় ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগার পরিষেবা চালু হয়। ইতিপূর্বে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগার চালু ছিল। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে “চলন্তিকা” নামক ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগার পরিষেবা চালু করেছিলেন। জ্ঞানের আধার স্বরূপ বই আমাদেরকে এক অদ্ভূত শক্তি দেয় যার দ্বারা নতুন ধারনার সৃষ্টি হয় এবং নতুন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। রে ব্রাডবুরী তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “ফারেনহাইট ৪৫১” বইটিতে (১৯৫৪) উপস্থাপিত করেছেন যে, জ্ঞানই শক্তি, যেখানে শাসকশ্রেণী নিজ স্বার্থে বার বার চেষ্টা করে সমাজকে বইপড়া ও জ্ঞানলাভ থেকে বঞ্চিত করতেন। তিনি দেখিয়েছেন জ্ঞান ও অজ্ঞানের সংঘাত এবং বই-ই জ্ঞানের প্রতীক। তিনি পাঠককে বোঝাতে চেয়েছেন বই পড়া ও মননের প্রয়োজনীয়তা। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক সোপেনহাউয়র (১৭৮৮-১৮৬০) কয়েকটি উপদেশ খুবই মূল্যবান। তাঁর বিখ্যাত “অন রিডিং এ্যান্ড বুক” প্রবন্ধটিতে কিছু উপদেশ আছে যেগুলি চিরন্তন এবং যা পাঠককে পরিপূর্ণতা লাভে সাহায্য করে। যেমন – ১) বই পড়ার সঙ্গে তার প্রতিফলন হওয়া দরকার এবং গভীর চিন্তা ও মননের প্রয়োজন। ২) বই কেনাই যথেষ্ট নয়, বই পড়তে হবে। এখানেও ডঃ রঙ্গনাথনের প্রথম সূত্রের কথাই বলা হয়েছে অর্থাৎ “বই ব্যবহারের জন্য”। ৩) শুধুমাত্র নতুন বই পড়লেই চলবে না। ৪) গুরুত্বপূর্ণ বই পুনরায় পড়া উচিত। ৫) গুরুত্বহীন বই পড়ে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। ৬) শুধুমাত্র মাধ্যমিক উৎস থেকেই বই পড়া উচিত নয়। ৭) চিরায়ত গ্রন্থ অবশ্যই পড়তে হবে।
     আমরা প্রায়শঃই শুনে থাকি জ্ঞানই শক্তি। তাই বই পড়া আমাদের খুবই প্রয়োজন – সে ছাপা বই হোক অথবা ই-বুক হোক। আজকের যুগে তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য এবং বৈদ্যুতিন বইয়ের সহজলভ্যতা সত্ত্বেও আমাদের কাছে ছাপাবই এখনও সমান আকর্ষনীয়।

ডঃ মানিক মন্ডল
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
[লেখক কর্মসূত্রে ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক,
ডঃ বি. সি. রায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, দুর্পাপুর – ৭১৩২০৬, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত]