অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
খেলা দেখার খেলা, সিআরসেভেন এবং অন্যান্য - পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

১)
ইস্টবেঙ্গল, চিমা এবং ডে স্লিপের উপাখ্যান:
সময়টা গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ ভাগ। কলকাতা ময়দানে তখন চিমা ওকেরি দাপটে রাজত্ব করছেন, প্রবল তার জনপ্রিয়তা। সেই সময় চিমা একবার নাইজেরিয়ান জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়ে দেশে ফিরে গেছেন, তিনি তখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রধান স্ট্রাইকার, আমরা ক্লাব সমর্থকরা স্বভাবতই হতাশ। মাঠে যাচ্ছি যথারীতি, কিন্তু কি যেন একটা নেই। তারপর সময়ের নিয়মেই খবর এল চিমা ফিরছেন এবং ইস্টবেঙ্গল মাঠে কলকাতা লীগে তালতলা একতার বিরুদ্ধে ম্যাচে ময়দানে তার পুনরাভির্বাব ঘটবে। এই ২০২০ সালে বসে বোঝা যাবে না, গত শতাব্দীর আশি নব্বই দশকের কলকাতা লীগের বড় দলগুলির খেলায় সমর্থকদের মধ্যে কি বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হত।
ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের নয়নের মণি চিমা বহুদিন বাদে আবার মাঠে নামতে চলায় সমর্থকদের উত্তেজনা অতীতের সব নজিরকে ছাপিয়ে গেছিল। আমরা থাকতাম দমদম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির কর্মী আবাসন, ‘আঠেরো নম্বর মলরোড এস্টেটে।’ আমরা কয়েকজন বন্ধু প্রতিটি ইস্টবেঙ্গল ম্যাচই দেখতে যেতাম, যাতায়াতের সামান্য বাস ভাড়া এবং একটাকা দশ পয়সার গ্যালারির টিকিটের দাম যোগাড় করতে আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা হত, সদ্য যুবক আমাদের সব বন্ধুরাই ছিল কাঠ বেকার। খেলা দেখার টিকিটের পয়সা অবশ্য রোজ লাগতো না, কারণ আমাদের কোয়ার্টারের ফুটবল দলের অধিনায়ক, ‘কাশি নাথ দাস’ ছিল প্রথম ডিভিসনের একটি ক্লাবের গোলরক্ষক। সেই সময় আইএফএ থেকে, তাদের রেজিস্ট্রার্ড ক্লাবগুলোতে বড় দলের খেলা দেখার জন্য ডে স্লিপ দেওয়ার চল ছিল। কাশিদাও সেই স্লিপ পেত, যেদিন তিন চারটি ডে স্লিপ পেয়ে যেত, সেদিন আমরা ডে স্লিপ দেখিয়ে খেলা দেখার সুযোগ পেয়ে যেতাম। সেইসব দিনে টিকিটের পয়সা দিয়ে মাঠে বিক্রী হওয়া দুটাকা দামের প্যাটিস কিনে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেতাম, সেই প্যাটিসের ভেতরে কিছুই থাকতো না, কিন্তু তখন তাই ছিল অমৃত সমান, এখন হয়তো মুখে দিতে পারব না।
আমি আর আমার বন্ধু বাপী ঘোষ, কোনও খেলা ছাড়তাম না। অন্য বন্ধুরাও সঙ্গী হত, তবে সবাই প্রত্যেকটি ম্যাচ দেখতে যেত না। তালতলা ম্যাচের দিন কাশিদা আমাকে আর বাপীকে বলে দিল, ময়দানের বটতলায় থাকবি, আমি অফিস  থেকে চলে যাব, ডে স্লিপ থাকবে, টিকিট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা দুজনে তো মহা আনন্দে যথাসময়ে বটতলায় গিয়ে হাজির, গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য, একটা টিকিটের জন্য চারিদিকে হাহাকার। আমাদের সেই জ্বালা নেই, তাই ফুরফুরে মেজাজে আছি। এমন সময় দেখি আমাদের পাড়া থেকে আরও দুই বন্ধু আশিষ আর বিকাশও গিয়ে বটতলায় উপস্থিত, ওদের কাছে  টিকিট নেই, ওরা জানে আমাদের বটতলায় পাওয়া যাবেই এবং আমরা নাকি ওদের খেলা দেখার একটা ব্যবস্থা করবোই, আমাদের পরিভাষায় একে বলে বডি ছেড়ে দেওয়া। যাইহোক একটা সময় কাশিদা এলো চারটে ডে স্লিপ নিয়ে, ভেবেছিল আমার আর বাপীর সঙ্গে অতিরিক্ত কেউ এলে কাজে লাগবে, কিন্তু এখন চারটি ডে স্লিপ এবং পাঁচজন দর্শক, নতুন করে টিকিট পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, একজনকে মাঠের বাইরে থাকতেই হবে। আমি আর বাপী বাকিদের বললাম, তোরা তিনটে ডে স্লিপ নিয়ে মাঠে ঢুকে যা, একটা ডে স্লিপ আমাদের কাছে থাকল, হয় আমরা দুজনেই মাঠে ঢুকব, নয়তো দুজনেই ফিরে যাব। ওরা তিনজন তো মাঠে ঢুকে গেল, এবার আমরা কী করব! ইস্টবেঙ্গল মাঠের গেটের কাছে গিয়ে দেখলাম মাউন্টেড পুলিশ কারও একটু বেচাল দেখলে বেধড়ক লাঠি চালাচ্ছে, ঘোড়াগুলো যেভাবে দৌড়ে আসছে তাতে ভয় ধরে গেল, টিকিট ছাড়া মাছি গলবার জায়গা নেই। আমি বললাম, “বাপী চল কেটে পড়ি, আজ বেগড়বাই করতে গেলে মার খেয়ে মরব।” বাপী বললো, “চুপচাপ থাক, আমার হাত ছাড়বি না, যা করার আমি করব।” আমরা দুজনে গুটি গুটি ডে স্লিপ দেখিয়ে মাঠে ঢোকার নির্দিষ্ট গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। টিকিট পরীক্ষক টিকিট দেখতে চাইলে বাপী তার হাতে একটা ডে স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে অম্লান বদনে আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে ঢুকতে গেলে টিকিট পরীক্ষক স্বভাবতই বাধা দিলেন, “একি একটা টিকিটে তোমরা দুজন ঢুকছ কেন?” এবার শুরু হল আমাদের পাড়ার সেরা নাট্যাভিনেতা বাপী ঘোষের জীবনের সেরা অভিনয়। ও একদম আকাশ থেকে পড়লো, আর চেঁচাতে শুরু করলো, “তার মানে দুটো ডে স্লিপ দিয়েছি, একটা বললে তো মানবো না, কোথায় ফেলেছেন দেখুন।” গেটের মুখে তখন একটা জটলা আর দেখি আমার বুক কাঁপিয়ে যমদূতের মতো একটা ঘোড়সওয়ার পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসছে। আমার মনে হল ঐ লাঠি পিঠে পড়লে আর বাঁচবো না। বাপীও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে, ও কিন্তু আমার হাত এতটুকু আলগা করেনি, শুধু বললো, “ঘাবড়াবি না।” বাপীর আসল খেলা তখনও বাকি ছিল। মারমুখী ঘোড়সওয়ার পুলিশটি এসে লাঠি উঁচিয়ে ধমকে উঠলেন, “কী হচ্ছে এখানে?” বাপী আক্ষরিক অর্থেই কাঁদতে শুরু করে দিল, “দেখুন না স্যার, দুটো ডে স্লিপ দিয়েছি আর বলে কিনা একটা দিয়েছি, ঢুকতে দেবে না!” পুলিশ অফিসার আমাদের নিরীহ চেহারা আর বাপীর দুচোখে জলের ধারা দেখে আমাদের নেহাত ভালো মানুষ ঠাওরে নিলেন। প্রচন্ড গর্জন করে টিকিট রক্ষককে ধমকে উঠলেন, “বাচ্চা বাচ্চা ছেলে পেয়ে পয়সা খাওয়ার তাল হচ্ছে? আমি কিছু বুঝি না?” বেচারি টিকিট পরীক্ষক আমতা আমতা করে কিছু বলতে চেয়েছিলেন, তাতে অফিসার আরও ক্ষেপে গিয়ে হাঁক পাড়লেন, “খবর্দার।” আর বিস্ফারিত টিকিট পরীক্ষকের চোখের সামনে দিয়ে আমরা মাঠের ভেতর দে দৌড়, ম্যাচটা ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল, খুব আনন্দ করেছিলাম। হ্যাঁ, অসাধু উপায়ে মাঠে ঢুকেছিলাম, কারণটা কিন্তু একেবারে সাধু ছিল, নির্ভেজাল ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা এবং ইস্টবেঙ্গল প্রেম। এই সুযোগে এতদিন বাদে, এই লেখার মাধ্যমে সেই টিকিট পরীক্ষক ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনাকে সেদিন বেশ অপদস্থ হতে হয়েছিল, কিন্তু তার কিছুই ব্যক্তিগত নয়। ক্ষমা করবেন।

২)
আমি, ‘জি’ টিভি এবং স্পোর্টিং ইউনিয়ন গেট:
এবার জাম্প কাটে এই শতাব্দীর প্রথম দশকের অগ্র ভাগ। আমি তখন দমদমের মলরোড ছেড়ে চলে এসেছি সোদপুরে। আমার খেলা দেখার পার্টনার বাপী ঘোষ রয়ে গেছে মলরোডেই। সেদিন সকালে বাড়ির ল্যান্ড লাইন ফোনে কল করে জানালো, “বট তলায় দাঁড়াস, আমি আর টাবুলদা এদিক থেকে যাচ্ছি।” আমি বললাম, “পৌঁছে যাব, আর ফোন করিস না কারণ গতকাল মোবাইলটা বাজারে খুইয়েছি, রাস্তায় থাকলে ফোন করে লাভ নেই।” ও বললো, “হুঁ, তাই মোবাইলে ফোন করলে সুইচড অফ বলছে।” যাইহোক চান খাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম, সোদপুর থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ পৌঁছে, বাকিটা বাসে চলে যাব। ম্যাচটা ছিল ইস্টবেঙ্গল মাঠে, কলকাতা লীগের ইস্টবেঙ্গল বনাম ঐক্য সন্মিলনী। সেদিন ভারতীয় রেল আমাকে একদম ঝুলিয়ে দিল, ট্রেন ভীষণ লেটে চলছিল, হাতে সময় নিয়ে বেরিয়েও যখন বট তলায় পৌঁছোলাম, তখন সেখানে কেউ নেই, বুঝলাম বাপী আর টাবুলদা অপেক্ষা করে করে মাঠে ঢুকে গেছে, ঘড়ির কাঁটা বলছে অন্তত পনেরো মিনিট খেলা শুরু হয়ে গেছে। কি করি! গোষ্ঠ পাল সরণি দিয়ে এগিয়ে গেলাম ইস্টবেঙ্গল সদস্য গেটের দিকে, দেখি কাস্টমস ক্যান্টিন থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে মোবাইলে কথা বলছেন, ওনার কথা বলা শেষ হলে, কাছে গিয়ে বললাম, “আমার মোবাইলটা হারিয়েছি, আপনার ফোন থেকে বাপীকে একটা ফোন করা যাবে?” আমরা পরস্পরকে কস্মিনকালেও দেখিনি, উনিও অম্লান বদনে বললেন, “বাপীদাকে ফোন করবেন তো করুন না।” আমি ফোনে বাপীকে ধরলাম, ও বললো সবুজ গ্যালারিতে আছে, মানে সাধারণ দর্শক সমর্থকরা যেখানে বসেন। যেন বটতলায় দাঁড়াই, খেলা শেষে দেখা হবে। আমি ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা ফেরত দিতে, হেঁসে বললেন, “আবার ধন্যবাদ কিসের! বাপীদাকে ফোনে পেয়ে গেলেন, এই তো অনেক।” কে জানে, উনি কোন বাপীদার কথা বুঝেছিলেন! ইস্টবেঙ্গল গেটে গিয়ে দেখলাম, কোনও কলা কৌশলেই ঢোকার উপায় নেই। এরিয়ান ক্লাবের গেটেও তথৈবচ অবস্থা, ভাবছি কী করা যায়, সময় বয়ে যাচ্ছে, মাঠে এসে খেলা না দেখে চলে যাব! এমন সময় দেখি ‘জি’ টিভির সংবাদদাতা এবং ক্যামেরাম্যান একটি অল্পবয়সী ছেলে এবং একটি অল্পবয়সী মেয়ে, তারাও দেরি করে ফেলেছে এবং প্রেস কার্ড দেখিয়েও বন্ধ গেট খোলাতে পারেনি, হাফ টাইমের আগে ওদের কোনও চান্স নেই, তাই মরীয়া হয়েই হয়তো আমাকেই জিজ্ঞাসা করে বসলো, “দাদা কোনও উপায় হয় না।” আমি মনে মনে বললাম, “আলবাত হয়, আপনারা যখন আছেন হয়ে যাবে বলেই মনে হয়।” মুখে বললাম, “আসুন।” বহু যুদ্ধের পোড় খাওয়া দর্শক হিসেবেই জানি, ইস্টবেঙ্গল এরিয়ান এজমালি মাঠে একটি দুর্বল জায়গা হল স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাবের গেট। হ্যাঁ, ইস্টবেঙ্গল এরিয়ান মাঠ হিসেবে পরিচিত হলেও স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাবেরও ঐ মাঠে একটা ছোট্ট অংশ আছে, স্পোর্টিং গেটে কড়াকড়ি অনেক কম। ‘জি’ টিভির সাংবাদিকদ্বয়কে নিয়ে পৌঁছে গেলাম স্পোর্টিং ইউনিয়ন গেটে। গিয়ে, নিজের সবথেকে জাঁদরেল গলায় হাঁক পাড়লাম, কে আছো? দু তিনবার ডাকার পর এক মালি দৌড়ে এল। তাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই তার ওপর চড়াও হলাম, “কোথায় থাকো হে? তোমাদের জন্য, ‘জি’ টিভি মাঠে ঢুকতে পারছে না!” সে তখন ক্যামেরা ট্যামেরা দেখে বেশ ঘাবড়েছে, গেটের তালা খুলতে খুলতে বললো, “বড্ড ভুল হয়ে গেছে স্যার, আর হবে না।” আমি ‘জি’ টিভি সহ সোজা মেম্বার গ্যালারিতে আর ঢুকে জমিয়ে বসার পরই ইস্টবেঙ্গল প্রথম গোলটা করলো। এবারও অবৈধ উপায়ে, কৌশলে মাঠে ঢুকেছিলাম, তা কি আর করা যাবে? বৈধ উপায়ে ঢোকা অসংখ্য বার তো গল্প হবে না, আর পাঠক নিশ্চয়ই বুঝবেন, সবটাই ইস্টবেঙ্গল এবং ফুটবল প্রেম বৈ কিছুই নয়।

৩)
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর রাজ্যপাটে:
সময়টা ২০১৭ সালের মার্চ মাস। একটি আন্তর্জাতিক লেদার গুডস ফেয়ারে কলকাতার কোনও এক কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করতে পৌঁছে গেছি, স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ শহরে। উঠেছি হোটেল, নভোটেল মাদ্রিদে। ঐ হোটেলেই অনুষ্ঠিত হবে লেদার গুডস ফেয়ার। পৌঁছোনোর পরের দিন সকালে হোটেলে ব্রেকফাস্ট টেবিলে প্রথম দেখলাম সেই দৃশ্য, একটি বছর পাঁচেকের ছেলে তার মার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে ঢুকেছে পুরোপুরি রিয়াল মাদ্রিদ কিটে সজ্জিত হয়ে এবং তার জার্সির নম্বরটি সেই আইকনিক সাত, পিঠে লেখা রোনাল্ডো।
যে দৃশ্য অহরহ পরের সপ্তাহব্যাপী মাদ্রিদ বাসকালে জানিয়ে দেবে আপনি রাজা রোনাল্ডোর রাজত্বে স্বাগত। নানা বয়সী পুরুষ এবং নারী যত্রতত্র সিআর সেভেনের জার্সিতে সজ্জিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মনে রাখতে হবে রিয়াল মাদ্রিদ দলে মহা তারকার কোনও অভাব নেই, আছেন রিয়ালের ঘরের ছেলে, ক্লাবের বিখ্যাত অধিনায়ক সের্গিও রেমোস এবং এই শহর শুধু রিয়াল মাদ্রিদের একার নয়, তাদের সিটি রাইভাল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ প্রবল ভাবেই মাদ্রিদ এবং স্প্যানিশ ফুটবলে বিরাজমান। কি করেই বা ভোলা যায় রোনাল্ডোর মহা প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার মহা তারকা লিওনেল মেসির কথা! তিনিও তো স্প্যানিশ লীগের খেলেন। কিন্তু সব ছাপিয়ে মাদ্রিদ সিআর সেভেনের। এয়ারপোর্ট থেকে শপিং মল, হোটেল সব জায়গায় রোনাল্ডোর ছবি এবং জার্সির ছড়াছড়ি। ট্যুরিস্টদের মধ্যেও রোনাল্ডোর জার্সির ব্যাপক চাহিদা। লেদার গুডস ফেয়ার ছিল তিন দিনের, চতুর্থ দিন সকালে চলে গেলাম, ‘বের্নাবিউ’ রিয়েল মাদ্রিদের জগদ্বিখ্যাত স্টেডিয়ামে কনডাক্টেড ট্যুরে। সে এক স্বপ্নের জগৎ। কে নেই সেখানে? ডি স্টেফানো, পুসকাস, জিদান, ফিগো, রোনাল্ডো দ্য লিমা, কাকা, সের্গিও রেমোস, মার্সেলো, ক্যাসিয়াস, রাউলরা যেন চাঁদের হাট বসিয়ে দিয়েছেন। ট্রফির মিছিল, তখনও পর্যন্ত জেতা এগারোটি চ্যামপীয়ন্স লীগের রেপ্লিকা, যা পরে ২০১৭ এবং ১৮ তে জিতে তেরোটিতে দাঁড়াবে, কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে আছেন তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। শুধু ফটোশপের মাধ্যমে ক্রিশ্চিয়ানোর সঙ্গে ছবি তুলতে মানুষ পঁচিশ ইওরো খরচ করতে পিছপা নয়। রিয়াল ড্রেসিং রুমে ঢুকে দেখলাম যেখানে বসে রোনাল্ডো তৈরি হন, সেই আসনের পেছনে তাঁর আইকনিক ছবি। তারপর ঘুরলাম রিয়ালের প্রেস কনফারেন্স রুম, ভিআইপি বক্স, এবং অবশ্যই রিয়াল মাদ্রিদ ডাগ আউট। আমি ব্যক্তিগত ভাবে আর্সেনাল সমর্থক, কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম ফুটবল ক্লাবে এই সফর চির জীবন অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।
পরের বছর ২০১৮ এর মার্চে ফিরে গেছি মাদ্রিদে, (তখনও আমরা জানি না, সেই বছর চ্যামপীয়ন্স লীগ ফাইনালের শেষে রোনাল্ডো ঘোষণা করবেন, তিনি মাদ্রিদ ছাড়ছেন।) উপলক্ষ্য সেই লেদার গুডস ফেয়ার। এবার উঠেছি হোটেল চামিরটানে। চামিরটান রেল স্টেশন সংলগ্ন এক বিল্ডিংএ ফেয়ার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হোটেল চামিরটানে অতিথি হয়েছে আমেরিকান কিশোরীদের একটি ফুটবল দল, যারা এসেছে রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল একাদেমিতে প্র্যাক্টিস করতে, তাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল, তারা রিয়ালের একাদেমিতে প্র্যাক্টিস করতে পেরে অভিভূত এবং সকলেই রোনাল্ডো ভক্ত। না ভুল বললাম, রোনাল্ডো যেখানে আছেন তাঁর মহা প্রতিদ্বন্দ্বী মেসি তো কাছাকাছি থাকবেনই। তাঁরা তো একে অপরের পরিপূরক। মাদ্রিদের সেই প্রবল রোনাল্ডো হাওয়াতেও আমেরিকান কিশোরী দলের এক সদস্যা বললো সে রোনাল্ডোকে পছন্দ করলেও মেসি সমর্থক। রিয়াল একাদেমিতে সেটা বলা বুদ্ধিমানের কাজ নয় সে জানে এবং নিজের দলেও সবাই মাদ্রিদে এসে রিয়াল মাদ্রিদ এবং সিআর সেভেনে মেতে আছে, সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু সে নিরুপায়। সত্যিই তো এই বিতর্কের শেষ নেই। আপনারা দুজনেই থাকুন, রোনাল্ডো ও মেসি। আমরা পরম সৌভাগ্যবান, আপনাদের দুজনকে একই সময় খেলতে দেখলাম। আপনাদের ধন্যবাদ।

৪)
টীম ম্যানেজার আমি, মোহনবাগানের গুলকি এবং লাউহাটিতে বিপদ:
ফ্ল্যাশব্যাকে আবার পিছিয়ে যাই গত শতাব্দীর আটের দশকে। দমদম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির কর্মী আবাসন, ‘আঠেরো নম্বর মলরোড এস্টেট’ এর সিনিয়র ফুটবল দলটি ছিল প্রবল শক্তিশালী এবং এই দলটি অনেক জায়গায় অন্য কোনও ক্লাবের হয়ে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে খেপ খেলতে যেত। আমরা জুনিয়ররাও দাদাদের সঙ্গী হয়ে সেসব খেলা দেখতে যেতাম। একবার আমাদের ডাক এল লাউহাটির একটি ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য, সেখানকার একটি নাম করা স্থানীয় টুর্নামেন্টে খেলবার আমন্ত্রণ। সারা দিন ও রাত্রি ব্যাপী খেলা। টুর্নামেন্টের ফাইনাল হবে মাঝরাত পেরিয়ে। সকাল দশটা নাগাদ পৌঁছে দেখি ব্যাপক আয়োজন। মাঠে বিরাট দর্শক সমাগম। টুর্নামেন্টটি নাইন সাইড না ইলেভেন সাইড টুর্নামেন্ট ছিল এখন আর মনে নেই, তবে খেয়াল আছে খেলা হয়েছিল বুট পরে। আমাদের দলের অধিনায়ক কাশিদা লাউহাটিতে আমাদের নিয়োগকারী ক্লাবের সেক্রেটারিকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বলে দেয়, এই হচ্ছে আমাদের টীম ম্যানেজার, টাকা পয়সা, খাওয়া দাওয়া এবং অন্যান্য যেকোন কথা ম্যানেজারের সঙ্গেই বলতে হবে। আমি প্রথমেই চুক্তি অনুযায়ী প্রথম ম্যাচের টাকা আমার টীমের পক্ষ থেকে বুঝে নিলাম। আমাদের থাকার জন্য একটি স্কুল খুলে দেওয়া হল, ব্যবস্থা ভালই বলতে হবে। হালকা ব্রেকফাস্ট করে আমাদের টীম মাঠে নেমে পড়ল, বিপক্ষ দলটিও শক্তিশালী। অনেকেই বলাবলি করছিল, এই দুটো টীম ফাইনালে দেখা হলেই ঠিক হত কিন্তু উদ্যোক্তাদের ভুলে প্রথম ম্যাচেই এরা মুখোমুখি হয়ে গেছে। যাইহোক আমাদের দল শুরু করলো প্রচন্ড আক্রমণাত্মক মেজাজে এবং বিপক্ষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবিশ্বাস্য ভাবে প্রথম দশ মিনিটে তিন গোল চাপিয়ে দিল। বিপক্ষ দলটিও খেপ সার্কিটে সুপরিচিত দল, ওরা প্রবল ভাবেই ম্যাচে ফিরতে চাইল, টানা আক্রমণ করতে থাকলো, একটা পরিবর্তন করে একজন লম্বা শক্তিশালী স্ট্রাইকারকে মাঠে নামিয়ে, সমানে তাকে লক্ষ্য করে উঁচু বল ফেলতে থাকলো। এতে আমাদের সুবিধাই হল, ওদের স্ট্র্যাটেজি একদম জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল, আর গোলে কাশিদা দুর্ভেদ্য হয়ে উঠলো। সব বল যেন চুম্বকের মতো টেনে নিতে থাকলো। খেলা শেষ হল ঐ তিন শূন্য ব্যবধানেই। পুরো লাউহাটিতে রটে গেল কলকাতার টীমের গুলকি (গোলকীপার) মোহনবাগানে খেলে আর এরা হাসতে হাসতে চ্যামপীয়ান হবে। দুপুরে মুর্গীর মাংস ভাত খাওয়া হল, আমাদের নিয়োগকর্তারা পাঁঠা কাটতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি বারণ করলাম, সন্ধ্যার শুরুতেই আমাদের খেলা আছে, ফুটবলাররা পাঁঠা খেয়ে নড়তে পারবে না। খাওয়া দাওয়ার পর একটা সিগারেট খাব বলে স্কুল বাড়ির বাইরে এসে দেখি আমার পিছনেই একদল লোক চলেছে, সবাই মোহনবাগানের গুলকি সম্বন্ধে জানতে চায়। কাশিদা প্রথম ডিভিসনের বিভিন্ন ক্লাবের গোলরক্ষা করলেও এবং সুব্রত কাপ ফুটবলে একসময় মধ্যমগ্রাম হাই স্কুলের হয়ে সেরা গোলকীপারের শিরোপা ছিনিয়ে নিলেও, মোহনবাগানের গোলকীপার ছিল না। যাইহোক আমি উপস্থিত জনতার আশাভঙ্গ করিনি, যখন মোহনবাগানের গুলকি ব্যাপারটা ওরা নিজেরাই ঠিক করেছে, তখন আমার কি দায়! সিগারেট কিনতে গিয়ে দেখলাম দাম তো দিতে পারলামই না, কে একটা পুরো প্যাকেট ফিলটার উইলস আমার হাতে ধরিয়ে দিল। বুঝলাম মোহনবাগানের গুলকির পর ওখানে আমিই সবথেকে বড়ো তারকা, টীম ম্যানেজার হিসেবেই আমার এই খাতির। দ্বিতীয় ম্যাচ কিন্তু খুব সহজ হল না, মাঠে প্রচুর হ্যালোজেন জ্বেলে আলোকিত করা হলেও সেইসব আলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে লাগানো হয়নি, একদিকের গোল পোস্টের কাছে বেশ অন্ধকার। সেই দিকের গোল পোস্টই আমরা হাফ টাইমের আগে রক্ষা করছিলাম, বিপক্ষ কিন্তু কলকাতার টীমের গ্ল্যামারে ভয় না পেয়ে সাহস করে আক্রমণে আসছিল এবং বক্সের বাইরে একটা ফ্রীকিক থেকে ওদের একজন খেলোয়াড় আমাদের রক্ষণের পাঁচিল টপকে জোরালো শট মারলে কাশিদা বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে অনবদ্য ভাবে সে বল আটকে দেয়। আমাদের পক্ষের স্থানীয় জনতা গর্জে ওঠে, ওরে এ মোহনবাগানের গুলকি,  গোল করতে পারবি না। পরে কাশিদার মুখে শুনেছি ও অন্ধকারে বল দেখতেই পায়নি এবং সম্পূর্ণ আন্দাজে বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে বল বার করে দেয়, বস্তুত কাশিদা আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিল বাঁ পাশেই ঝাঁপাবে, ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলেছিল শটটা ওদিকেই আসবে। মোহনবাগানের গুলকি কিন্তু গোল খেল, হাফটাইমের আগে ডানদিক থেকে উড়ে আসা ক্রস থেকে ওদের ওভারল্যাপে আসা স্টপার ব্যাক মাথা ছুঁইয়ে গোল করে গেল। হাফটাইমে ০-১ পিছিয়ে পড়ে আমাদের ছেলেদের ঝিমিয়ে পড়া ভাবটা কেটে গেল। আমরা ম্যাচে ফিরলাম, শুরু হল মাটিতে বল রেখে বহু পাস খেলে বিপক্ষকে দিশেহারা করে দেওয়ার আঠেরো নম্বরীয় ট্যাকটিক্স, যে ফুটবলের জন্য আমাদের ছেলেরা খেপ সার্কিটে বিখ্যাত। আমরা ম্যাচ জিতলাম ২ - ১ গোলে। আমি কিন্তু আমার ম্যানেজারীয় কর্তব্য ভুলিনি, দ্বিতীয় ম্যাচের আগেও টীমের টাকা বুঝে নিয়েছিলাম। টীম সেমিফাইনালে পৌঁছে গেছে, রাত দশটায় খেলা। চুক্তি অনুযায়ী সেমি ফাইনালে আমরা গত দুম্যাচের ডাবল টাকা পাব। ফাইনালে উঠলে সেমি ফাইনালের দ্বিগুণ। আমি স্বভাবতই সেমি ফাইনালের টাকা বুঝে নিতে চাইলাম, আর গোল বাঁধলো সেখানেই। নিয়োগকারী ক্লাবের সেক্রেটারি বললো সব টাকা মিটিয়ে দেব টীম চ্যামপীয়ন হলে, এখন টাকা দিতে পারছি না, আর আপনারা মানে আমরাও এই টুর্নামেন্ট জিতছিই। আর যেসব টীম টিঁকে আছে তারা ধারে ভারে আপনার টীমের সমকক্ষ নয়। আমি বললাম, “তা তো হতে পারে না, খেলায় হার জিত আছে, তার মানে দাঁড়াচ্ছে সেমি ফাইনালে হেরে গেলে আপনারা টাকা দেবেন না, অথচ চুক্তি অনুযায়ী আপনি টাকা দিতে বাধ্য। খেলার আগে টাকা না পেলে খেলোয়াড়রা মাঠে নামতেও রাজি হবে না।” সেক্রেটারি সাহেব বললেন তাহলে, আপনি টীম তুলে নিতে পারেন, আমার আপত্তি নেই।” আমি ক্ষুব্ধ ফুটবলারদের নিয়ে বাস স্টপে এসে আসল বিপদ টের পেলাম, যেটুকু মনে পড়ছে ঘড়িতে আটটা বেজে গেছিল আর লাউহাটি থেকে শেষ নাইন্টিওয়ান রুটের বাসটি তার আগেই ছেড়ে চলে গেছে, সেকালে ঐ বাস ছাড়া লাউহাটি থেকে রাতে ফেরার কোনও উপায় ছিল না। বুঝলাম সেক্রেটারি সাহেবের কেন আমার টীম তুলে নেওয়াতে আপত্তি ছিল না। এখন ওনার আতিথেয়তাই গ্রহণ করতে হবে এবং সেমি ফাইনাল খেলতে হবে। আমার মনে হল, না খেললে এরা আমাদের এখান থেকে ফিরতেই দেবে না। ক্লাব সেক্রেটারি ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে দূরেই বসে ছিলেন, পাহারা দেবার দরকার মনে করেননি, কারণ হেঁটে তো আর আমরা ফিরতে পারব না।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একটি ম্যাটাডোর থেকে একটি দোকানের সামনে কোল্ড ড্রিংক্সের ক্রেট নামানো হচ্ছে, একটা আশার আলো মনের কোণে ঝিলিক দিয়ে উঠল, পায়ে পায়ে ম্যাটাডোরের দিকে এগোলাম, অন্যদের বললাম কেউ আমার সাথে আসবে না, মন বলছিল, দূর থেকে সেক্রেটারির সাঙ্গোপাঙ্গরা আমাদের নজরে রাখছে। কাছে গিয়ে বুঝলাম ম্যাটাডোর ড্রাইভার আমাদের পরিচিত, মলরোডেও কোল্ড ড্রিংক্স সাপ্লাই করতে যায়। সন্তর্পণে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বললাম, “আমরা সাতেরো আঠেরো জন আছি, শেষ বাস চলে গেছে, তোমার সঙ্গে মলরোডে ফিরতে চাই।” ও বললো, “মলরোড তো যাব না তবে কৈখালী ভিআইপি মোড়ে নামিয়ে দেব, ওটুকু তোমরা দিব্যি চলে যেতে পারবে।” আমি মনে মনে ভাবলাম যথেষ্ট, ড্রাইভারকে এখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে কিছু বলিনি, ও ভয় পেতে পারে। সবাইকে ইশারা করলাম, ম্যাটাডোর স্টার্ট দিলে যেন লাফিয়ে ওঠে, আগে ওঠার দরকার নেই। ম্যাটাডোর স্টার্ট দেওয়ার পর সবাই লাফিয়ে উঠে পড়লো, গাড়ি চলতে শুরু করবার পর সেক্রেটারি আর তার দলবল টের পেয়ে তেড়ে এল, কিন্তু তখন ওরা দেরি করে ফেলেছে, গাড়ি স্পীড তুলে ফেলেছে, আমরা ওদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সেদিন যদি ওরা আমাদের ধরতে পারতো, তবে কী হত ভাবতে গেলে, আজ সে ঘটনার কথা লিখতে বসে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
একদল পেশাদার ফুটবলারকে তাদের ন্যায্য চুক্তির বাইরে খেলতে বাধ্য হওয়ার হাত থেকে অক্ষত অবস্থায় অব্যাহতি দিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারার জন্য তৃপ্তিও।

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ