অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ওমর খৈয়াম – কালোত্তীর্ন বিশ্বকবি? - ফেরদৌস আহমেদ

মার মতে ওমর খৈয়ামকে এখন একজন কালোত্তীর্ন বিশ্বকবি বলা যায়। আশা করি কেউ কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত হবেন। তা না হলে মত প্রকাশ করে সুখ কোথায়? সবাই একমত হলে সেটা হবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হওয়ার তৃপ্তিহীন সুখের মতো। বিরোধী পক্ষ এটা জেনে উৎসাহিত হবেন যে আমি ওমর খৈয়ামের একজন নিরীহ ভক্ত মাত্র, পণ্ডিত নই। আমাকে ঘায়েল করা বিশেষ কঠিন হবে না।
  “রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়াম” প্রথম পড়ি বিশ-একুশ বছর বয়সে। কাজী নজরুল ইসলামের অনূদিত ও সৈয়দ মুজতবা আলীর ভূমিকা সহ এ বই ১৯৫০ সালের দিকে প্রকাশিত হয়েছিল। এ তিন জনই আমার প্রিয় সাহিত্যিক। খুব প্রিয় ছিল এ বইটা; প্রতিদিন না হলেও প্রতি সপ্তাহে পড়তাম বা উলটিয়ে পালটিয়ে দেখতাম। পুরানো বইয়ের দোকান থেকে কেনা এ বইটি সাত আট বছর পর জায়গা বদলের সময় হারিয়ে যায় (আচ্ছা, বইয়ের জন্যে কি কারো মন খারাপ হয়? আমার হয়েছিল)। তারও প্রায় দেড় যুগ পরে আরেকটা কপি কিনেছিলাম – নতুন এডিশনের, কিন্তু তাতে ছিল না শতাব্দীর পুরোনো গন্ধ। পুরানো মদের মতো পুরানো বইয়েরও একটা আলাদা স্বাদ, একটা আলাদা মাত্রা থাকে। এই ডিজিটাল যুগে আর কয়েক বছর পরে আমরা সবাই হয়তো সেটা ভুলে যাব। 
     সৈয়দ মুজতবা আলী যে সরস ভূমিকা দিয়েছেন তার উপর টেক্কা দেয়া সাহজ নয়, প্রয়োজনও নেই। রুবাইয়াৎ রচনার সময়কার ঐতিহাসিক পটভুমি থেকে শুরু করে ভারতের সূফী বৈষ্ণবদের সাথে ওমর খৈয়ামের তুলনা পর্যন্ত সবই মুজতবা আলী গভীর ভাবে পর্যালোচনা করেছেন। বিজ্ঞানে খৈয়ামর নিষ্ঠা ও অবদান সরল ভাষায় বর্নণা করেছেন। খৈয়াম জীবনের প্রায় সবটুকু সময়ই দিয়েছেন বিজ্ঞানের সাধনায়; অতি অল্প সময় ‘নষ্ট’ করেছেন কাব্য চর্চায়। কিন্তু এই অল্প সময়ের এমেচারি দিয়েই তিনি ম্লান করেছেন বহু ফুল টাইম প্রফেশনাল সাহিত্যিকের গৌরব। এ অসাধ্য সাধন তিনি কিভাবে করলেন? এ বিষয়ে অধীনের কিছু এমেচারি বক্তব্য আছে।
     প্রথমত অন্যান্য সুসাহিত্যেকদের মতো ওমর খৈয়ামও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে জীবনকে দেখেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। যা দেখেছেন তা সরল সংক্ষিপ্ত ভাষায় বলেছেন। তার ভাষা এতই সরল যে সেটা বুঝতে সাধারণ পাঠকের আসুবিধা হয় না। বক্তব্য পাণ্ডিত্যে ভরা কিন্তু পণ্ডিত-সুলভ কোন মার প্যাঁচ নেই। নেই কোন কথার ফুলঝুরি। কথার ধরন যাকে বলে ‘টু দি পয়েন্ট’। অনেকটা ছোট একটা অঙ্কের ফরমুলা দিয়ে বিজ্ঞানের সুগভীর থিওরী প্রকাশ করার মতো। এই অল্প কথায় গভীর ভাব প্রকাশ করা ওমর খৈয়ামের বৈজ্ঞানিক মননশীলতার পরিচায়ক। এটাই তাকে অন্য সাহিত্যিকদের থেকে পৃথক করেছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম – নবীন সাহিত্যিকদের উদ্দেশ্যে বলা – যদি বহু দূর যেতে চাও তবে বোচকা বাচকি ছেড়ে হাল্কা ভাবে ভ্রমণ করো (ট্রাভেল লাইট)। এই নিয়মের জাদুকর (মাইস্ট্রো) হচ্ছেন খৈয়াম। বিবেচনা করুন, তিনি যদি তার ভাবগুলো ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক বড় করে লিখতেন, তা হলে কি তার লেখা এত শতাব্দী অতিক্রম করে এত দেশের পঠকের কাছে পৌঁছুত?
     বন্ধু বান্ধবেরা বলেন ওমর খৈয়ামের প্রশংসা করার সময় আমার সীমা-জ্ঞান বুদ্ধি-শুদ্ধি কিঞ্চিৎ লোপ পায়; আমি একটু বেএখতেয়ার হয়ে যাই। কথাটি একেবারে মিথ্যে নয়। গ্রন্থ কীট হিসাবে আমার সুনাম বা দুর্নাম যাই বলুন আছে। অক্ষর পরিচয়ের পর থেকেই আমি ভাল মন্দ সব বইই গোগ্রোসে গিলে যাচ্ছি – কোন মহৎ উদ্দেশে নয়, পড়তে ভাল লাগে তাই পড়ি। যত জায়গায় বাস করেছি, লাইব্রেরী চষে বেরিয়েছি। কাজেই, কোন পূর্ব পরিকল্পনা না থাকলেও, অনেক লেখক পণ্ডিতের সাথে পরিচিত হয়েছি। কালক্রমে ভুল হোক বা শুদ্ধ হোক আমার একটা ‘পার্সপেকটিভ’ বা দৃষ্টিভংগী তৈরি হয়েছে। এবং সে পার্সপেকটিভের উপর ভিত্তি করে যে কোন ব্যাপারে আমিও একটা মতামত দার করাতে পারি (বস্তুত মতামত ছাড়া বাঙালি হয় না)। ওমর খৈয়ামের উপরেও আমার একটি মতামত আছে। আমি লক্ষ করেছি খৈয়ামের  সব কথাই সত্য; তিনি কোন মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেন নি এবং কোন অযৌত্তিক দর্শন প্রচার করেন নি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ওমর খৈয়ামের সব কথাই আমার কাছে যুক্তি সংগত মনে হয় (‘আমারও ছিল মনে, ব্যাটা সেটা জানিল কেমনে’)। অনেক বড় বড় লোকের কথা পড়েছি শুনেছি, কিন্তু করো সংগে তো একশো ভাগ একমত হতে পারি নি। কিন্তু খৈয়ামের বেলায় সেটার ব্যাতিক্রম; শুধু খৈয়ামের মতের সাথেই আমি শতকরা একশো ভাগ একমত। সেজন্যেই হয়তো ওমর খৈয়ামের প্রসঙ্গে আমি একটু আবেগপ্রবণ, একটু পক্ষপাতদুষ্ট। নিজের এ দুর্বলতা সম্পর্কে আমি সচেতন; তাই চেষ্টা করবো নিরপেক্ষ থাকার।
     আমার প্রথম বক্তব্য – খৈয়াম একজন কালোত্তীর্ণ কবি। এর প্রমান, বিগত এক হাযার বছর ধরে তার কবিতা লোকে পড়ে আসছে। তার কবিতা আনুবাদ হয়েছে অনেক ভাষায়। অনেকে তার কবিতা বিশ্লেষনণ করেছেন। আর কার কবিতা মানুষ হাযার বছর ধরে পরেছে? হোমারের অডিসি প্রাচীন কাব্য – কিন্তু কে সেটা উপভোগ করে? সেক্সপিয়ার-এর লেখা কজন ক্লাস রুমের বাইরে পড়ে?
     দ্বিতীয় বক্তব্য – খৈয়ামকে বিশ্বকবি বলা যায়। কারণ তার কবিতা অনেক দেশের অনেক লোক অনেক ভাষায় পরেছে এবং এখনও পড়ছে। এটাই তো বিশ্বকবির সংজ্ঞা, নয় কি? রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি বলা হয়; কিন্তু তার মাত্র তিন চারটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
     এ লেখাটি শুরু করেছিলাম পাঁচ বছর আগে – এখনও শেষ হয় নি। পাঠকগন বুঝতেই পারছেন আমার কাজের দক্ষতা কতটুকু (তবুও দীর্ঘসূত্রতায় কর্তাদের টেক্কা দিতে পারলাম কই)। যাই হোক, আর দুটি কথা বলেই এ লেখা শেষ করব।
     সম্প্রতি একটি নতুন বই পেয়েছি ইন্টারনেটের কল্যাণে। রীতিমত সিরিয়াস বই – ইরান এবং ইউরোপের বিভিন্ন অধ্যাপক এবং গবেষকদের লেখা – সবার নামের পিছেই অনেক ডিগ্রি দেয়া। খৈয়াম সম্পর্কে তারা অনেক বছর ধরে চিন্তা ভাবনা করে মতামত দিয়েছেন। আমি তাদের গুরু গম্ভীর আলোচনায় যাব না। শুধু কয়েকটি শাদা মাটা খবর আপনাদের দেব।
     ফিটজারেলডের  প্রথম অনুবাদ ১৮৫৯ সালে – তারপর এটার তিন শয়ের বেশি সংস্করণ বের হয়েছে। এটা একটি রেকর্ড। গত এক শত বছরে খৈয়ামের প্রায় এক হাযার অনুবাদ বিভিন্ন ভাষায় হয়েছে। এটাও একটি রেকর্ড। এক আরবীতেই পঞ্চাশটি অনুবাদ রয়েছে। এসব পণ্ডিতের মতে উত্তর ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, সঙ্গীত ও চিত্রকলার উপরে খৈয়ামের প্রভাব ব্যাপক ও সুগভীর। মজার ব্যাপার, জীবিত কালে খৈয়াম বৈজ্ঞানিক হিসাবেই বেশি পরিচিত ছিলেন, কবি বা দার্শনিক হিসাবে নন। বিজ্ঞান ও গণিতে তাঁর মৌলিক অবদান এখনো পণ্ডিতেরা নত মস্তকে স্বীকার করেন।
     প্রশ্ন – খৈয়ামের এই ব্যাপক জনপ্রিয়াতার কারণ কি? খৈয়ামের দর্শনের সারমর্ম হল, বিধাতার বিশ্ব খুব রহস্যময় – মানুষের বুদ্ধির বাইরে। মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি যতই বারুক না কেন সে রহস্য চিরকাল রহস্যই রয়ে যাবে। এটা মেনে নিয়েই মানুষকে চলতে হবে। জীবনকে বোঝার চেষ্টা করা ভাল, এমন কি জরুরী। তবে জীবনকে উপভোগ করাও (অন্যায় না করে) প্রয়োজন। তাই তো খৈয়ামের বিচরণ যেমন বিজ্ঞানে তেমনি কবিতায়। মানুষের জীবন সার্থক হয় এ দুটির সঠিক মিলনে। সরল চিন্তা কিন্তু গভীর।
     শেষ কথা, নজরুল অনুবাদকৃত বইয়ের চিত্রায়ন বা ইলাসট্রেশণ নিয়ে। চিত্রায়ন যে ভাব প্রকাশে কতটা সহায়তা করতে পারে এ বই তার শ্রেষ্ঠ উদাহরন। চিত্রকর হিসাবে নাম আছে জনৈক খালেদ চৌধুরীর – এর বেশি কোন কিছু আমরা জানি না। এ অজানা চিত্রকর বইটিকে এক অদ্ভুত নতুন মাত্রা দিয়েছেন।
     সবার প্রতি অনুরোধ, ওমর খৈয়ামের লেখা পড়ুন। মাত্র ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আপনার জীবন দর্শন পালটে যাবে। আর পাঠিকাদের জন্য সাবধান বানী, যে ওমর খৈয়ামের লেখা পড়েনি তার সাথে কোন রকম রোমান্টিক সম্পর্কে জড়াবেন না।

ফেরদৌস আহমেদ
অটোয়া, কানাডা