অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা - মীম মিজান

কালের কালিমা আর কলুষতা যখন বিষবাষ্প হয়ে সমাজকে মৃতপ্রায় করে তুলে তখনই শান্তি ও সংস্কারের পতাকা নিয়ে আগমন করেন মহামানব, মানবহিতৈষী। চরম বিরোধিতার মধ্যে নিজেকে সংযুক্ত রাখেন শান্তি ও সংস্কারের সাথে। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিজয়ীর মালা গলে শোভা পায় তারই। আর গাড়ল যারা, নানা কৌলিন্যে সুখ সাগরে ভাসমান প্রমোদ তরীর আমুদে তারা পরাজিত হয়ে হারিয়ে যায় সমাজ থেকে। বিশেষ দিবস নয় প্রায় প্রত্যেকদিন হয় শপ্ত।

এমনই এক কুসংস্কারের কালিমা ও কলুষতা ছিলো উনিশ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু সমাজে। সেই কালিমা ও কুসংস্কারকে শান্তি ও মানবতাময় করতে নিবেদিত প্রাণ হয়ে আগমন করেছিলেন মানবহিতৈষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। এ রচনায় তার জীবনী বা সাহিত্যকর্ম আলোচ্য নয় বিধায় তার মননে কীভাবে সংস্কার চিন্তা আসলো, ভাবালো, কীভাবে তিনি তার সংস্কার চিন্তার বাস্তবায়ন করলেন। এ বাস্তবায়নের পথে যে বাধাবিপত্তি তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা উপস্থাপন করে বর্তমান সময়ে তার সংস্কারের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরবো।

তিনি শিক্ষা জীবনে একজন কৃতি ছিলেন। পেয়েছিলেন শিক্ষাবৃত্তি ও পারিতোষিক। যেহেতু কৃতি শিক্ষার্থী সেহেতু তার মনে সামসময়িক বিষয়ের নানা অসঙ্গতি দারুণ পীড়া দিতো। তাই তিনি ব্যথিত চিত্তে এসব নিয়ে ভাবতেন আর পরিত্রাণ খুঁজতেন। শিক্ষা জীবনে তার অন্যতম আগ্রহের বিষয় ছিলো হিন্দু আইন। এই হিন্দু আইন সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ অধ্যয়ন করে তিনি ল কমিটির তত্ত্বাবধানে একটি পরীক্ষা দিলে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হলে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে কমিটি তার জন্য যে সনদ প্রদান করে সেখানেই প্রথম 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি যুক্ত ও ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ যে তিনি হিন্দু আইনের উপর যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। বিদ্যাসাগর হিশেবে দ্বিতীয় যে স্বীকৃতি তিনি পান তা ছিলো ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কলকাতা সরকারী সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য।

হিন্দু আইনসহ উপর্যুক্ত বিষয়াবলীতে যার পাণ্ডিত্য তার নিশ্চয়ই জানা যে, কোন কোন আইনের অপব্যবহারের ফলে এরকম কালিমা ও কলুষতা বিরাজ করছে সমাজে। আদৌ কি সে আইনের কোনও পরিবর্তন বা সংস্কার সাধন সম্ভব কিনা? সেটা তিনি পরিপূর্ণ রূপে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এতদসঙ্গে এও বুঝতে পেরেছিলেন যে, পশ্চাদপদতা কেনো পিছু ছাড়ছে না এ উপমহাদেশের মানুষের। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা গভীর কুসংস্কার এবং আধুনিকতা থেকে পিছিয়ে তা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। এসবের মধ্যে তৎকালীন হিন্দু সমাজের ভিতরে যে প্রথম ও প্রধান সমস্যা ছিলো বিধবাদের পুনর্বাসনের জন্য, সমাজের মূল স্রোতের সাথে একীভূত করণের জন্য বিধবাবিবাহ প্রথা চালু করণ। নারী শিক্ষার ব্যবস্থা ছিলোই না। বাল্য বিবাহের কুফলে সমাজ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কৌলিন্য প্রথার ফলে মানুষকে মানুষ মনে হতো না। তথাকথিত উঁচু শ্রেণির বহুবিবাহ ইত্যাদি ছিলো সমাজের প্রগতির অন্তরায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে অনুপযোগী পাঠ্যক্রম ছিলো অনগ্রসরতার অন্যতম কারণ।

যুগের একজন নকীব হিসেবে তিনি আলোকবর্তিকা নিয়ে শিক্ষার সংস্কারে হাত দিলেন। ইউরোপীয় ভাবধারার নানা বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিষয় তিনি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করলেন। সংস্কৃতকে তিনি বাংলায় পড়িয়ে সহজবোধ্য করলেন। এ জন্য নিজেই কিছু গ্রন্থ লিখেছিলেন। কেননা সময়োপযোগী শিক্ষা ছাড়া জাতি কখনোই উন্নতি করতে পারে না। বিশেষ জোর দিলেন নারীশিক্ষার প্রতি। কেননা তখন নারীশিক্ষার তেমন কোনও প্রচলন ছিলো না। নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কতিপয় মানুষের সাহায্যে তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। লর্ড হার্ডিঞ্জের সহায়তায় গ্রামে অনেকগুলো স্কুল স্থাপন করেছিলেন তার মধ্যে ৩৩টি স্কুল স্থায়ী হয়। বেশ কয়েকটি মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই যে শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি যে সংস্কার এনেছিলেন তা উপমহাদেশের হিন্দুদের বিশেষ এগিয়ে নিয়েছে। আর নারী সমাজকে দিয়েছিলো শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করে নেয়া বিশেষ মর্যাদা।

শিক্ষার ক্ষেত্রে তার আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিলো সংস্কৃত কলেজে সব ধরনের শিক্ষার্থীর পাঠগ্রহণের সুযোগ। যে কলেজের পাঠ গ্রহণের উপর তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের ছিলো দেবত্ব আরোপ। সেখানেই পাঠের সুযোগ লাভে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী নিজেরা একেকজন পরিণত হয়েছিলেন মানবহিতৈষী বা মানব দেবতায়।

এই যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে তার এত অবদান, এত ত্যাগ, পরিশ্রম তা কি শুধু সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য? এর থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই? এখনো পথে প্রান্তরে কত্ত পথশিশু। ঝরে পড়ে কত্ত মেধাবী ভবিষ্যৎ। তাদেরকে যদি মূল শিক্ষার স্রোতের সাথে একীভূত করা না যায় তাহলে কাঙ্ক্ষিত সমাজ পাবো না উপহার।

শিক্ষা সংস্কারের পাশাপাশি যে সংস্কারক হিসেবে তিনি সমধিক খ্যাত তা হচ্ছে বিধবাবিবাহ প্রচলন। উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে এটির কোনও প্রাসঙ্গিকতা ছিলো না। কেননা ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজেই একজন চল্লিশ বছর বয়স্কা বিধবাকে বিয়ে করে বিধবা নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থার প্রচলন করেছেন। আর হিন্দু সমাজে তা ছিলো কল্পনাতীত। কেননা এক ভয়ানক অমানবিক রীতি সতীদাহপ্রথা ছিলো এই হিন্দু সমাজে। খিলজী, সুলতান, মোঘল মুসলিম শাসকগোষ্ঠী এটির বিরোধিতা ও বিরুদ্ধে আইন করলেও হিন্দু সমাজে এর প্রচলন ছিলো। মানব দরদী রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) এই প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক এক আন্দোলন করে লর্ড বেন্টিংক এর সহায়তায় ১৮২৯ সালে রহিত করেন এই চরম অমানবিক জীবন্ত নারীকে পুড়িয়ে মারার প্রথার। এই প্রথা রহিত করণেই বিধবাদের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চললো সমাজে। তাদের প্রয়োজন সামাজিক স্বীকৃতি। সমাজের মূল স্রোতের সাথে সম্মিলন। অনেকে বাল্য বৈধব্যে পতিত। অন্যদের দ্বারা নিপীড়িত হচ্ছিলো। এই উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হয়ে গেলো সমাজের কাছে অন্যতম বিষয়। যেহেতু বিদ্যাসাগর একজন হিতৈষী তাই ভাবছিলেন তাদের অধিকার নিয়ে। কেননা, পুরুষদের স্ত্রী মারা গেলে যদি তারা দ্বিতীয়বার স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে তবে কেনো নারীরা পারবে না গ্রহণ করতে? বিষয়টি পুরুষতান্ত্রিক। একপেশে ও চরম অবমাননাকর। বিদ্যাসাগরের সামসময়িক একজন পুঁথি পাঠক ও রচয়িতা মুন্সী আব্দুর রহীম (১৮২৮-১৯১৩) কিশোরগঞ্জের গলাচিপায় অনেকগুলো পুঁথি লিখেছেন ও পাঠ করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য পুঁথি হচ্ছে 'বিধবার বিরহ-বৃত্তান্ত'। এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮৫৩ সালে। যা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। মোট পঞ্চাশ জন বিধবার বঞ্চিত, উপেক্ষিত, অতৃপ্ত বাসনার করুণ কথা এখানে তুলে ধরেছেন জনাব মুন্সী। তিনি পুঁথি পাঠের মাধ্যমে একটি আন্দোলন গড়ে তুলেন যা ছিলো 'হিন্দু বিধবাবিবাহ' আন্দোলন। এই পুঁথি ও পুঁথি লেখককে আন্দোলনের জন্য খেসারত দিতে হয়েছিলো। চরমপন্থী ও উগ্রবাদী হিন্দুরা একটি মামলা করেছিলো ময়মনসিংহ আদালতে। মামলার ফলাফলে পুঁথিটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। আর মুন্সী সাহেব যে তার নিজস্ব রহমানীয়া প্রেস থেকে প্রকাশ করেছিলো পুঁথিটি তাও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো। এই পুঁথিপাঠ ও আন্দোলন প্রভাবিত করেছিলো বিদ্যাসাগরকে। তিনিও প্রায় একহাজার জনের স্বাক্ষর সম্বলিত বিধবাবিবাহ আইনের স্বপক্ষে আবেদন জানান। অবশেষে সেটি আইন হিশেবে পাশ হয় লর্ড ডালহৌসির শাসনকাল ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। পক্ষান্তরে গোড়া ও উগ্রবাদী হিন্দুরাও বসে থাকে নি।  ৩৬৭৬৩ জনের স্বাক্ষর নিয়ে সে আইনের বিরুদ্ধে আবেদন করে। কিন্তু তা গ্রহণ করেনি লর্ড। ইতোমধ্যে  শাসন ক্ষমতা চলে যায় কোম্পানির কাছ থেকে রানির হাতে।

আইনটি হওয়ার পর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিধবাবিবাহ হয় সংস্কার মানসিকতার অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের। তিনি ছিলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক আর তার নববিবাহিতা পত্নীটি ছিলেন বর্ধমান জেলার পলাশডাঙা গ্রামের ব্রহ্মানন্দ মুখার্জির দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতি দেবি। এরপর বিদ্যাসাগর তার নিজ ছেলে নারায়ণচন্দ্রের সাথে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে আঠারো বছরের বিধবা ভবসুন্দরীর বিয়ে দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে 'হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড' গঠন করেন। এছাড়াও নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে অনেকগুলো বিধবাবিবাহ দিয়েছেন। মেয়েদের বিপদে আপদে সর্বাত্মক সাহায্য করার চেষ্টায় মগ্ন ছিলেন।

তার এ মহৎকর্ম আমাদের এ কালে এসে যে প্রেরণা দেয় তাহলো নারীলিপ্সু ও কলুষ চরিত্রের মানুষদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, আন্দোলন গড়ে তোলা। আর মেয়েদের সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এখন অফিসে অফিসে, নাটক থিয়েটারে, চলচ্চিত্র পাড়ায় যেভাবে নারী হয়রানি বেড়েছে সেখানে বিদ্যাসাগর ও তার সংস্কার খুবই প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণা দায়ক।

তার অন্যতম সংস্কার ছিলো বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করা। এই বাল্যবিবাহের ফলে কত যে সকরুণ মৃত্যু হয়েছে তা বর্ণনাতীত। ছোট্ট বালিকা। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার উপর স্বামীরূপি হায়েনা ঝাপিয়ে পড়ে। ক্ষত বিক্ষত করে দেয় কচি শরীরটিকে। আবার যখন খানিক বুঝার মতো, স্বামীসঙ্গ উপভোগের মতো বয়সে উপনীত হয় তখনই বৈধব্যের শাদা শাড়িতে মুড়িয়ে যায় সব শখ আহ্লাদ। প্রথমে আট বছরে বিয়ে ছিলো। অতঃপর দশ বছর হলো। শেষে আন্দোলন ও সামাজিক চাপে তা বারোতে উপনীত হয়েছিলো। কী সাংঘাতিক এক ব্যাপার! বারো বছরের এক কিশোরী স্বামী সংগম করতে বাধ্য। এক কিশোরী বিধবা সখীর যাতনাময় জীবন দেখেছেন তিনি। এখনও গ্রামীণ সমাজে মেয়েরা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই পিতামাতার চাপে বিয়েতে বসতে হয়। কিন্তু ফুল সুবাস ছড়ানোর উপযোগী হওয়ার আগেই বিষাক্ত হুলে বিক্ষত হয়। তার কলম সরব ছিলো এ ক্ষেত্রেও।

হিন্দু সমাজের এক চরম অমানবিক রীতি কৌলিন্য প্রথা। ব্রাহ্মণ, শুদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় নানা জাত। এ সব জাতের ফলে শত নয় হাজার বিভক্ত মানুষ। নিচু শ্রেণির বলে তাদের শখ থাকবে না। ঘোড়া কিনেছে বলে পিটিয়ে মারো। তথাকথিত উঁচু শ্রেণির গোলামী করে জীবন অতিবাহিত করতে হবে। এই কৌলিন্য প্রথার শেকড় উপড়ে ফেলার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করেছিলেন। হুগলী জেলার ১৩৩জন ব্রাহ্মণের বৈবাহিক সম্পর্কের তালিকা তৈরি করে দেখিয়েছিলেন যে কীভাবে তারা এই হায়েনা হাতিয়ারের সুযোগে নারীদের সর্বনাশ করছে।

বহু বিবাহ প্রথা বিলুপ্তির জন্যও তিনি আন্দোলন করেছিলেন। উপরোক্ত ব্রাহ্মণদের মতো কত্ত যে বহু নারী বিয়ে করতো সে সমাজ তা সামসময়িক লোকজনই জানতেন। পক্ষান্তরে মুসলিম সমাজে ছিলো সর্বোচ্চ চার স্ত্রী গ্রহণ। এর বেশি স্ত্রী গ্রহণ কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। তাই এ সমাজে নারীদের সমস্যা ছিলো না। কেননা নারীরা স্বামী ও পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পেতেন। আরও পেতেন মোহরানা। কিন্তু হিন্দু মেয়েদের বিয়েতে যে পরিমাণে যৌতুক দিতে হতো তাতে পিতা প্রায় নিঃস্ব হয়ে যেতেন। স্বামী  ও পিতার জমিতে নাই কোনও উত্তরাধিকার। আবার উঁচু শ্রেণির বহু স্ত্রী গ্রহণে ছিলো না কোনও বাদ বিছার যা সামাজিক এক ব্যধি ছিলো। এই ব্যধির বিপক্ষে তিনি আন্দোলন করেছিলেন। আমাদের এখন উচিত হবে হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে অধিকার দানের আন্দোলন করা। তাহলে বিদ্যাসাগরের একজন যোগ্য উত্তরসুরী হতে পারি। তিনি যে রেনেসাঁস শুরু করেছিলেন তার একজন কর্মী হতে পারবো।

উপরোক্ত বিষয়াবলী সে সময়ে তিনি যৌক্তিক ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দিয়েছিলেন। কেননা প্রমাণ ও যুক্তি ছাড়া তার আন্দোলন থুবড়ে পড়বে। তিনি যেমন ছিলেন মুক্তমনা তেমনি ছিলেন সময়ের সাথে পরিবর্তনকে মেনে নেয়ার মতো আধুনিক মানস। তার কাজটা একটুও সহজ ছিলো না। কেননা তথাকথিত শিক্ষিত ও উগ্রবাদী হিন্দুরা তাকে পদে পদে লাঞ্চিত করেছেন। হিন্দুদের কাছে ঋষি নামে খ্যাত সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) কটাক্ষ করে একটি গ্রন্থে কথোপকথন স্টাইলে লিখেছিলেন, "সূর্যমুখী' প্রশ্ন করল- যে বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা দেয় সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?" যুগ সন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরগুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) বিদ্যাসাগরের সমালোচনায় কবিতায় লিখেছেন,
"সাগর যদ্যপি করে সীমার লঙ্ঘন।
তবে বুঝি হতে পারে বিবাহ-ঘটন।"

আর সবথেকে সাংঘাতিক আক্রমণ করেছিলো একটি পত্রিকা। বিদ্যাসাগরের পত্নী বিয়োগে সে পত্রিকা শোক প্রকাশের স্থলে লিখেছিলো, "শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই বৃদ্ধকালে তাঁর স্ত্রীর মরণ ঘটিয়াছে। বৃদ্ধকালে স্ত্রীর মরণ বড় কষ্টের কথা, আমরা তাহার কষ্টে নিতান্ত দুঃখিত হইতেছি। কিন্তু শুনিয়াছি, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একটি বিধবা শ্বাশুরি আছেন, তাহার সঙ্গে একবার সাত পাকটা দিয়া লইলে হয় না?" কত্ত বড় অসম্মানজনক কৌতুক। তিনি এসব দেখে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে খুবই আফসোস করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আগে তিনজন বিদ্যাসাগর আছেন ও পরে একজন। অথচ আমরা উন্নাসিক বলে তাদের খোঁজ খবর রাখি না। তাদের কর্ম নিয়ে আলোচনা করি না। বিষয়টি এমনই হবে যে, "যে দেশে গুণীর কদর নাই, সে দেশে গুণী জন্মায় না।" বাকি চারজন বিদ্যাসাগরসহ পাঁচজন বিদ্যাসাগর নিয়ে এক শেকড় সন্ধানী গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন বহুমাত্রিক লেখক, বাগ্মী ও উপস্থাপক জনাব মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম। 'পাঁচ বিদ্যাসাগর' নামক বইটিতে বাংলার প্রথম বিদ্যাসাগর হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.), দ্বিতীয় সৈয়দ শাহ নিয়ামত উল্লাহ, তৃতীয় মৌলভী আব্দুল আলী, চতুর্থ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও পঞ্চম মাওলানা উবায়দুল্লাহ উবায়দী সোহরাওয়ার্দী (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাতামহ) সম্পর্কে বিশদ আলোচনা স্থান পেয়েছে। বাকি চারজন ইসলামি মনা বিদ্যাসাগর বলে তাদের উপেক্ষা করার মতো জ্ঞানপাপ করা ঠিক হবে না। সমাজের সংস্কার ও বিদ্যা প্রসার এবং পাণ্ডিত্যের জন্য তাদেরকেও এ উপাধি দেয়া হয়েছিলো।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একজন কোমলপ্রাণ মানুষ ছিলেন। যার ধ্যানজ্ঞান সবই ছিলো মানব হিতৈষী কাজে। ধর্মীয় গোঁড়ামি তাকে আটকাতে পারে নি। তিনি নতুনকে স্বাগত জানাতেন। মানুষের কল্যাণের জন্যই নিবেদিত ছিলেন। আমাদের উচিত হবে তার মানব দরদী কাজ থেকে প্রেরণা নিয়ে মানব কল্যাণে নিয়োজিত হওয়া।

মীম মিজান
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কলামিস্ট

এম.ফিল. গবেষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
meemmizanru@gmail.com