অটোয়া, রবিবার ৫ মে, ২০২৪
বিপুল তরঙ্গ - লাবণ্য কান্তা

হু প্রতীক্ষিত বইটি হাতে নিলাম। সেখানে নিশ্চয় সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারুর কথা থাকবে;  কেন না,  সেটি ভ্রমণ বিষয়ক উপন্যাস। প্রবোধ কুমার সান্যালের ‘মহা প্রস্থানের পথে’। ২১১ পৃষ্ঠার বই,  মূল্য চার টাকা। এই ঔপন্যাসিকের পূর্বেই যে উপন্যাসটি পড়া হয়েছে  তার নাম ‘ দেবতাত্না  হিমালয়’ দারুণ রোমাঞ্চকর। সেটি পড়েই এই উপন্যাসের জন্য এমন পিপাসা। সেটি ৫০ এ যদি লিখিত হয়ে থাকে তাহলে যেটি এখন হাতে নিয়েছি,  তার বয়স কতো?  বইটির বয়স অজানা।  বইটিকে বহু কষ্ট করে পুনঃ পুনঃ বাইন্ডিং করতে গিয়ে হয়তো এমন পর্যায় এসেছে যে তার সঠিক ঠিক ঠিকানা বুঝা দায়। একটি জায়গায় উল্লেখ রয়েছে পঞ্চম সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৫১। বইটির জন্ম সাল অজানা। 

উৎসর্গের পরের পাতায় লেখা রয়েছে একটি কবিতা। তা নিম্নরূপ ___

‘ উদয়াচলের সে তীর্থপথে আমি 
চলেছি একেলা সন্ধ্যার অনুগামী, 
দিনান্ত মোর দিগন্তে লুটে পড়ে।

জীবনের পথ দিনের প্রান্তে এসে
নিশীথের পানে গহনে হয়েছে হারা, 
অঙ্গুলি তুলি তারাগুলি অনিমেষে
মাভৈঃ বলিয়া নীরবে দিতেছে সাড়া।

ম্লান দিবসের শেষের কুসুম তুলে
একুল হইতে নব জীবনের কুলে
চলেছি আমার যাত্রা করিতে সারা।

হে মোর সন্ধ্যা যাহাকিছু ছিল সাথে
রাখিনু তোমার অঞ্চল-তলে ঢাকি।
আঁধারের সাথী,  তোমার করুণ হাতে
বাঁধিয়া দিলাম আমার হাতের রাখী। ’

উপক্রমণিকায় প্রথম তিন লাইন পড়েই চোখের পাতা বুজে এলো।  এমন ভারী কথাগুলো পড়ে ভাবতে ভাবতে আরো কিছু পড়ে নেয়া... এখনও রয়েছি উপক্রমণিকায় ... তারপর পড়া হবে হিমালয়ের আশ্চর্য  দেবদারুর কথা  ….
কিন্তু না, পড়তে পড়তে একাত্তর পৃষ্ঠায় চলে গেলাম  লেখক  রুদ্রপ্রয়াগ, উখীমঠ, নীলগঙ্গা, অলকানন্দা, মন্দাকিনী, চন্দ্রা এমন সব নদীর কথা বলতে বলতে আর তীর্থযাত্রীদের করুণদশার কথা বলতে বলতে যে বীভৎস ছবি এঁকে  চড়াই উতরাই পথের যে দুঃখকথা শোনাতে লাগলেন, তাতে করে  দেবদারুকে কোথায়  হারায়ে ফেললাম।  

সেখান থেকে কিছু  অংশ __

“চারিদিকে ঘনান্ধকার কালিবর্ণ পর্বতরাজি, তারই গভীর গহ্বর থেকে উন্মাদিনী চন্দ্রার প্রবাহ অন্ধবেগে ছুটে আসচে, সেই নদীর উপর দিয়ে রহস্যময়ী মেয়েটি কিছুদূর গিয়ে নিশীথিনীর অঞ্চলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় তার বাসা, কত দূরে, কোন গহন- গভীরে, কে জানে। নির্বাক স্তম্ভিত দৃষ্টিতে শুধু সেইদিকে তাকিয়ে রইলাম। সেই বিচিত্র ঘটনাটি আজ নিজের কাছেও স্বপ্ন মনে হয়।

এ কি, এ কোথায়? নদীর ভাঙ্গনে পথ যে হারিয়ে গেল। মন্দাকিনী ও চন্দ্রা নদীর সঙ্গম ___ কিন্তু যাবো কোনদিকে? ভয়ার্ত গর্জনে হু হু করে অতল পাথার নদী বয়ে যাচ্চে, দেখতে দেখতে পথের চিহ্ন অদৃশ্য হলো। মনে আছে মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে গেল, মুখখানা যেন অন্যের। গা কাঁপচে, হাটু দুটো আর নিজের বলে মনে হচ্চে না ___ নিতান্ত দশ বছরের বালকের মতো নিরুপায় হয়ে এই পথের তীরে দাঁড়িয়ে চোখের জলে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো।”

এই উপন্যাসের বিষয়কে অনুধাবন করতে হলে হিমালয় সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা না থাকলে পড়ে কিছু খুব সহজে বুঝে নেবার কোনও উপায় নেই। ভাগ্যিস কিছু না কিছু তো ধারণা তাই থেকে থেকে কয়েক পাতা পড়ে নিয়ে হিমালয়কে নিয়ে ভাবাভাবি আরেকটু বেশি। ভাবতেই অবাক  লাগছে, লেখক শুধুমাত্র ভ্রমন পিপাসা থেকে সেই কঠিন দুস্তর পথে যাত্রা করেছিলেন। পথে যেতে যেতে ক্ষুধা –তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আর পা দুটো যখন পাহাড় পর্বতের কঠিন শিলায় থেতলে যাওয়ায়  ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তখন বার বার ভেবেছেন, আর সামনে যাবেন না; এখান থেকেই পেছনের দিকে হাঁটবেন, কিন্তু যতোবার এমন কথা ভেবেছেন, ততোবারই নতুন উদ্দামে সামনের দিকেই অগ্রসর হয়েছেন। 

তাঁর তেমন করে মন্দাকিনী আর চন্দ্রা নদীর সঙ্গমস্থলের বর্ণনা পড়ে কতো সময় যে ভাবতে হয়েছে সেসব দৃশ্যের কথা। কতো সময় আনমনা থেকেছি চন্দ্রার উচ্ছ্বাসের কথা পড়ে, তার হু হু করে  বয়ে চলা; যেন সে কিছুই দেখবে না আছে শুধু তার বয়ে চলা। 

অলকানন্দা আর মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থলে যে প্রয়াগ, লেখকের বর্ণনায় তা ‘রুদ্র প্রয়াগ’। রুদ্র প্রয়াগে যখন ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সন্ধ্যা নামে তখন কেমন রূপ হয় তার! মনটা বড় ব্যাকুল  হয়, ইচ্ছে করে যদি এখনি পাখির মতো উড়ে যাওয়া যেতো, আর কিছু না হোক, একটি গোধূলি, একটি সন্ধ্যা আর অলকানন্দা এবং মন্দাকিনীর মিলনস্থলের সৌন্দর্য দেখে আসা যেতো! খুব বেশি  ভাবুক হয় মন। লেখকের চোখের দেখা দৃশ্যকে কল্পনায় দেখা  ভীষণরকম  রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার  সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। আনমনা হয় মন, উদাস হয়। দুই পৃষ্ঠা পড়ে ত্রিশ মিনিট ভাবতে হয়, কী রহস্যময় হিমালয়! কখন তার জন্ম, কোন শুভক্ষণে! হাজার প্রশ্ন মাথায় আসে, শূন্য আকাশে  মিলায়ে যায়। এমন রহস্যময় হিমালয় ভ্রমণ কী যে কষ্টসাধ্য যদি একটি বই পাঠ করে এমন অনুভুত হয়, তবে যিনি এই হিমালয় সশরীরে ভ্রমণ করেছেন তাঁর রক্ত-মাংসের দেহ কি না সয়েছে সেই বন্ধুর পার্বত্য- নদী- শিখরচুড়া ডিঙিয়ে  অনাহারে, অর্ধাহারে তুষারাচ্ছন্ন দুস্তর গিরি পেরিয়ে কি হতে পারে তার মনের এবং দেহের অবস্থা! সে তো যিনি সেসব বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনিই ভুক্তভোগি; কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি তার শক্ত হাতে সাদা কাগজে যে কলমের ঝরণাধারা ঝরিয়েছেন তা পাঠ মাত্রই অনুভব করা যায়।  

এতো কষ্ট সয়ে গিয়েও লেখক বদরীতে পৌঁছানোর পর মনস্থ করলেন কিনা তিনি ‘কৈলাশ’  যাবেন! শেষ পর্যন্ত কি গিয়েছেন কৈ্লাশ? 

না।

কৈলাশ তাঁর আর যাওয়া হয়নি। 

বদরীতেই দেখা হলো সেই অল্প বয়স্ক সুশিক্ষিত বিষম সুন্দরী রাণী নাম্নী সদ্য বিধবার সঙ্গে। সেই  তাঁর পথ রোধ করেছিলো। তাই লেখকের যাত্রা তথা ভ্রমণ সেইখানেই সমাপ্ত হলো এবং সেই সময়টুকু তাঁর লেখায় পূর্ণযাত্রা রুপে স্থান করে নিয়েছে।

পরের পর্ব  পুনরাগমন।

পুনরাগমনে সেই রাণী রইলেন সঙ্গী। সে এক বিচিত্র এবং নব রোমাঞ্চ। পাঠোদ্ধারেই কেবল তা বোধগম্য তার বেশি কিছু লিখবার ধৃষ্টতা নেই। তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ বইটি পড়বার সময়ে ভীষণ কৌ্তুহল জেগেছে মনে, জেগেছে নানা প্রশ্ন। উদ্ধার করতে চেয়েছে মন সেইসব বর্ণিত লেখকের কলমের পথ, বিভিন্ন প্রয়াগ, নদী-ঝরণা-অরণ্য-মন্দির-তুষারঝড়-বিপদ-বিঘ্ন- দুঃখ-সুখ, আনন্দ-বেদনা; সেসব রহস্যময় সৌন্দর্য এবং একটি সময়ে দু’চোখ ভরে উপচে পড়া সৌন্দর্যে দু’চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। শেষে আরো কিছু বইয়ের নাম সংযোজন রয়েছে, আরো চৌদ্দটি গ্রন্থের নাম উল্ল্যেখ রয়েছে। এইখানেই লিখে রাখা হলো সেসব নাম ___

‘জীবন মৃত্যু’, ‘শ্যামলীর স্বপ্ন’, ‘কাজল-লতা’, ‘স্বাগতম’, ‘সরলরেখা’, ‘জয়ন্ত’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘নদ ও নদী’, ‘সায়াহ্ন’, ‘দেবীর দেশের মেয়ে’, ‘নববোধন’, ‘অগ্রগামী’, ‘ঝড়ের সংকেত’, ‘আলো আর আগুন’।  

এই গল্পের এখানেই শেষ নয়, তারও আগের গল্প রয়ে গেছে বাকি। তখন নভেম্বর মাস ২০১৫  সাল হঠাৎ এই লেখকের আরেকটি  উপন্যাস ‘দেবতাত্না হিমালয়’ পড়ছি। কি অপরূপ কি আশ্চর্য সব শব্দেরা, পাহাড়- ঝরণা, নদী, অজানা পথ কতো কি যে জানা হলো সেই উপন্যাসের প্রতিটি লাইনে তা আজ আর বলা অসম্ভব। সেই বইটির শুরু থেকে শেষ বলতে কিছু নেই। মনে হয় এইখানেই শুরু হলো শেষ হয়তো অন্য কোথাও হবে... কিন্তু না শুরু এবং শেষ বলতে কিছু খুঁজে পাওয়া দুরূহ; শুধু রহস্যে আর  অপরুপ শোভায় ভরা দুই খন্ডের বইটিতে যখনই পড়তে নিয়েছি তখনই কেবল অজানা আশ্চর্য এসে দাঁড়িয়েছে চোখের সামনে। বইটির দৃশ্যপট রয়ে গেছে চোখের তারায়  জ্বলজ্বল নিঝুম তারার মতো।  মাঝে মাঝে সেই নিঝুম তারার দিকে তাকাই আর বিপুল তরঙ্গে ভেসে যাই।

লাবণ্য কান্তা
ঢাকা, বাংলাদেশ