অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ধর্ষণ ব্যাধি – সুপ্তা বড়ুয়া

ম্প্রতি ২০১৮ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী নাদিয়া মুরাদের বই ‘The Last Girl’ পড়া শেষ করেছি। বই হাতে পেলে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে আগে সে বই পড়ে শেষ করার অভ্যাস আমার। একটা বই পড়া শুরু করলে তা শেষ না করা অবধি অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ না করারও নজির আছে। কিন্তু আমি বার বার থমকে গেছি নাদিয়া মুরাদের ৩০০ পৃষ্ঠার এই স্মৃতিচারণমূলক বই পড়তে গিয়ে। যু্দ্ধের ভয়াবহতা যে নারীদের জীবনকে কি দুর্বিষহ করে তোলে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তার এই বই। কি ছিলো সেই আত্মজীবনীতে যা আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে, সমাজের একটি ব্যাধিকে এত জঘণ্যরূপে আবার সামনে নিয়ে এসেছে?

নাদিয়া মুরাদের জন্ম ইরাকের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত কচো গ্রামে। ছবির মতো মায়াময় না হলেও দারিদ্রতা ক্লিষ্ট এই গ্রামেও একটা জীবন ছিলো ইরাকের প্রাচীনতম সংখ্যালঘু ইয়াজিদীদের। ছোট্ট বাচ্চাদের কলকাকলি, গভীর সামাজিক-ধর্মীয় বন্ধন সবার মাঝে, প্রতিটি পরিবারে একটা করে বলার মতো গল্পও ছিলো। ইয়াজিদীরা সংখ্যালঘু এবং শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতিতে অনেকখানি পিছিয়ে থাকা একটা জাতি ইরাকে। তারা মূলত কৃষক এবং খুবই অল্প সংখ্যক ইয়াজিদী রয়েছে ইরাকের উত্তরাঞ্চল জুড়ে (আনুমানিক ৭-১০ লাখ ইয়াজিদী রয়েছে পৃথিবীতে)। ইয়াজিদীরা সাদ্দাম হোসেনের আমলেই নানা অভাব-অনটন, সমস্যার মাঝেও একটা মানানসই জীবন-যাপন করছিলো, যেখানে আশা ছিলো, স্বপ্ন ছিলো, ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু ২০১৪ সালে ইরাকে আইসিলের (আইসিস) উত্থানের কারণে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবনে নেমে আসে বড় ধরনের বিপর্যয়। ইয়াজিদীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য আইসিস (স্হানীয়ভাবে তাদের ‘দায়েশ’ বলা হয়) সদস্যরা চাপ দিতে থাকে। কিন্তু ইয়াজিদীরা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাদের জীবনে নেমে আসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় যুদ্ধের ভয়াবহতা। যারা আগে সিনজার পর্বতে পালিয়ে যায়, তারা রক্ষা পেয়েছিলো। কিন্তু যারা নানা কারণে গ্রামে আটকা পড়েছিলো, তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। 

ইয়াজিদী পুরুষদের হত্যা করা হয় এবং বয়োবৃদ্ধ নারীদের আলাদা করে পরবর্তীতে তাদেরও হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়। অবিবাহিত নারীদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে এক একজন আইসিস সদস্য এবং যৌনদাসী হিসেবে ধর্ষণ করা হয় নিয়মিত। যুদ্ধে ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে বিক্রি করা হয় ইয়াজিদী নারীদের। যেসব বিবাহিত নারীর সন্তান আছে তাদের সন্তানসহ বন্দী করা হয়। এই সন্তানরা যদি ছেলে হয় তবে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আর ব্রেইনওয়াশ করে আইসিসের যোদ্ধায় পরিণত করা হয় এবং ছোট্ট মেয়েদেরও একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বার বার শিউরে উঠেছি আইসিসের বর্বরতার কাহিনী পড়ে। নাদিয়া মুরাদ কোন রকমে পালিয়ে ইরাকের এক সুন্নী পরিবারের সাহায্যে ইসলামিক এস্টেটের সীমানা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। কিন্তু তার পুরো পরিবার তছনছ হয়ে যায়। তার কয়েকজন ভাই নিহত হয় এ যুদ্ধে, তার মা'কে হত্যা করা হয়, তার প্রিয় ভাইঝিও আইসিসের হাত থেকে পালাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে, ভাইয়ের ছেলেকে  প্ররোচনায় ধর্মান্তরিত করে আইসিসের যোদ্ধা বানিয়ে ফেলা হয়।

এই কাহিনী পড়তে পড়তে আরো একটি বিষয় ক্রমশ আমাকে ভাবিয়ে তোলে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা নারীরাও এরূপ কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে এর চাইতে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সেসব ইতিহাস পড়ার সাহস আমার হয় না। কারণ, পাশবিকতায় পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতা যে কোন গণহত্যাকে হার মানাবে। কিন্তু সেইসব বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধারা শুধু যে পাকিস্তানি সৈনিকদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে তা নয়, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমাদের সমাজে তাদের পুনর্বাসন হয়নি। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এসব নারীকে বাঙালীরা যে অসম্মানের চোখে দেখেছে তার বর্ণনা বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদেরই বয়ানে ফুটে উঠেছে। যুদ্ধ শিশুদের জায়গা হয়নি আমাদের সমাজে, কিংবা তারা মুক্তিযুদ্ধের অর্জন হয়নি, হয়েছে লজ্জার অংশ।

এই বইটা এমন একটা সময়ে (আদতে নারীর জন্য সবসময়ই আতঙ্কের) পড়েছি যখন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে ঘটে গেছে আরো দুটি গণধর্ষনের ঘটনা। সিলেটের এমসি কলেজে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের ৬ সদস্য দ্বারা এক নারী এবং পার্বত্য অঞ্চল খাগড়াছড়িতে এক আদিবাসী নারী ৯ জন বাঙালী বসতি স্থাপনকারী দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয়। শুধু কি গণধর্ষণের মতো এরূপ দু'একটি ঘটনা আকস্মিকভাবে ঘটছে আমাদের দেশে? না, নারী-শিশু নিয়মিত ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছে আমাদের দেশে। ধর্ষণের মূল উদ্দেশ্য কি শুধু যৌন তৃপ্তি লাভ করা? না, ধর্ষণ মূলত দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচারের হাতিয়ার। পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ১০০৫ টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যেটা তার পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৭৩% বেশি। ২০২০ সালের গত ৯ মাসে ৮৯২ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ এ পর্যন্ত পুলিশের কাছে রিপোর্ট হয়েছে। এই সমীক্ষাগুলোর মাধ্যমে আদতে ধর্ষণের ভয়াবহতা এবং সঠিক সংখ্যাটা কখনোই জানা যায় না। কেননা সামাজিক কারণ, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতা কিংবা নানা ধরণের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সব ধর্ষণের খবর পত্রিকার পাতায় আসে না কিংবা পুলিশের কাছে রিপোর্টও হয় না।

ধর্ষণ শুধুমাত্র একটি জঘন্য উপায়ে যৌন লিপ্সার পরিতৃপ্ত করা নয়। ধর্ষণ বলপূর্বক কাউকে দমন করা, আধিপত্য বিস্তারের  উৎকৃষ্ট হাতিয়ার, ভয় প্রদর্শন, প্রতিশোধস্পৃহা থেকে কারো ক্ষতি করা কিংবা ধর্মীয়-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার উপায় হিসেবে নারী-শিশুর উপর ব্যবহৃত হয়ে আসছে শতাব্দীকাল ধরে। এর বাইরেও তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণেও নারী-শিশুর উপর ধর্ষণকে একটা হাতিয়ার প্রয়োগ করে চলেছে পুরুষ আর পুরুষতন্ত্র।  

সিলেটের এমসি কলেজের ধর্ষণে দলীয় সংযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই সরকারী দলের সদস্যরা ধর্ষকরা নিজের দলের সদস্য নয় বলে দাবী করেছে। এটাকে বলা হয় ‘বাতিল সংস্কৃতি'। অর্থাৎ এসব কাজ আমাদের সংগঠনের সদস্য দ্বারা সম্ভব নয়, তার মানে এসব ধর্ষণের দায়ভার গ্রহণ করা থেকে তারা বিরত থাকতে চায়। অথচ সরকারী দল তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য আর ক্ষমতার জোরেই এসব ঘটনা ঘটাতে সাহস পেয়েছে। তাই এ ঘটনার সম্পূর্ণ দায়ভার রাজনৈতিক দলের উপরই বর্তায়। ওদিকে আদিবাসী নারীটিকে ধর্ষণের পর আমাদের সমতলের বাঙালী বন্ধুরা বলছে, ‘ধর্ষণ যেখানেই হোক সেটা অপরাধ’। অর্থাৎ আদিবাসীদের উপর যে নির্যাতন নিয়মিত হয়ে চলেছে সেটাকে পাশ কাটিয়ে কোনরূপে দায়সারাভাবে একটা প্রতিবাদ করা। এবং এর মাধ্যমে আদতে যে পাহাড়ে বর্বর অত্যাচারগুলো হচ্ছে সেটাকে হালকা করে দিয়ে সবাইকে এটা মনে করিয়ে দেওয়া যে, ‘না সবখানেই এসব অপরাধ হচ্ছে’। অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু আদিবাসী নারীদের ধর্ষণের পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মদদ আর সামাজিক-ধর্মীয় উসকানি সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে ‘বাতিল করে' দেওয়াই এই ধরণের দাবীদারদের মূল মনোবৃত্তি।

নারীকে দূর্বল তাই তাকে অত্যাচার করা যাবে, যুগ যুগ ধরে ঘরে বন্দী অবস্থায় থাকবে তারা, হবে একমাত্র সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র। একজন নারী কোথাও কোনভাবেই নিরাপদ নয় এ জনপদে। সিলেটে নারীটি স্বামীর সাথে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকারে পরিণত হয়। কিন্তু খাগড়াছড়িতে ঘরে ঢুকে পরিবারের সদস্যদের বেঁধে রেখে আদিবাসী নারীটিকে ধর্ষণ করা হয়। এই দেশে কে কোথায় নিরাপদ, কিংবা আদৌও নারীর জন্য কোন দেশ আছে কি? বাংলাদেশে যখন মিডিয়ায় এ দুটি ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ভারতে তখন দলিত সম্প্রদায়ের ১৯ বছরের এক মেয়ে, মনীষা বাল্মিকী, ৬ জন উচ্চবর্ণের হিন্দু ছেলে দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। মেয়েটিকে শুধু ধর্ষণই করা হয় নি, বেধড়ক মারধোরও করা হয়। মেয়েটিকে সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, কিন্তু ১৫ দিন লড়ে মেয়েটা মৃত্যুবরণ করে। অথচ মিডিয়া তোলপাড় রিয়া চক্রবর্তী আর কঙ্গনা রানাউতকে নিয়ে। তারপরও মরে গিয়ে হলেও মেয়েটি যেন বেঁচে গেলো। নাদিয়া মুরাদ তার বইটিতে বার বার উল্লেখ করেছে, ‘পুরুষদেরকে আইসিস মেরেছে একবার, কিন্তু নারীদের মরতে হয়েছে বার বার। ধর্ষণ আমাদের আত্মার মৃত্যু ঘটিয়েছে’। এই যে নারী দুজন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে বাকিটা জীবন তারা নানারকম মানসিক-সামাজিক অত্যাচারের ভেতর দিয়ে যাবে। সমাজ তাদের অসম্মানের চোখে দেখবে। সমাজ ধর্ষককে প্রশ্ন না করে ধর্ষিতাকে প্রশ্ন করবে। ধর্ষণ করে, অপরাধ করে পুরুষের সম্মানহানী হয় না, অসম্মানিত হয় নারী এমনই আমাদের মন-মানসিকতা। অথচ ধর্ষণকে বিবেচনা করা উচিত হত্যার মতো একটা অপরাধ হিসেবে। কেননা, ধর্ষণ নারী-শিশুকে ট্রমাটাইজড করে, তার গৌরবকে অসম্মানিত করে, তার আত্মবিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কমলা ভাসিন একবার বলেছিলেন, ‘আমার সম্মান আমার যৌনাঙ্গে নয়। ধর্ষণ আমাকে ভয়াবহভাবে আক্রমণ আর আহত করে, সেজন্য সেটা অপরাধ, কিন্তু কোনভাবেই আমার সম্মানহানী করে না’। কিন্তু ধর্ষিত হলেই এখনো মনে করা হয় নারীর সম্মান নষ্ট হয়েছে, সেজন্যই ধর্ষণের শাস্তি ধর্ষক না পেয়ে পায় ধর্ষিতা। আর সেজন্যই ধর্ষণকে ব্যবহার করা হচ্ছে আধিপত্যের হাতিয়ার হিসেবে, একটি সম্প্রদায়কে অসম্মানিত করার উপায় হিসেবে। নারীকে আহত করার মাধ্যমে পুরো একটি সম্প্রদায়কে ভয়াবহভাবে আক্রমণ, ভীতসন্ত্রস্ত করার নজির হলো পাহাড়ী বা আধিবাসী নারীদের ধর্ষণ। ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারের উদাহরণ ভারতের দলিত শ্রেণীর মেয়েটির উচ্চবর্ণের হিন্দু ছেলেদের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা। নারীর অগ্রযাত্রায় ভয়ার্ত, নারীর স্বাধীনতা ঈর্ষান্বিত পুরুষতন্ত্র নারীদের ঘরে বন্দী করতেও ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। গতবছর নভেম্বরে ভারতের হায়দারাবাদে পশু চিকিৎসক দিশা’র (পরিবর্তিত নাম) ধর্ষণ আর হত্যা তার একটি উদাহরণ। এমনকি একটি নারী তার পরিবারের সদস্যদের সাথেও নিরাপদ নয়, সিলেটের ঘটনা তা আবার মনে করিয়ে দিলো।

নাদিয়া মুরাদের বইটি পড়তে পড়তে বার বার নারীদের এই অসহায়তায় আমি থমকে থমকে বইটি শেষ করেছি। দেশে গণধর্ষণের ঘটনাগুলো হওয়ার পর নিজেকে আরো বেশি অসহায় মনে হচ্ছিল। নাদিয়া মুরাদ আইসিসের কাছ থেকে পালিয়ে বেঁচে ফেরার পর ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে চলেছে। তার এই কাজের জন্য ২০১৮ সালে নাদিয়া শান্তিতে নোবেল জয় করে যৌথভাবে ডেনিস মুকবেগে'র সাথে। ডেনিস মুকবেগে কঙ্গোতে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধের কারণে অথবা নানা সামাজিক কারণে ধর্ষিত নারীদের সার্জিক্যাল সহায়তা দিয়ে আসছেন। বিশ্বব্যাপী নারী-শিশুর প্রতি বিদ্বেষের মহামারীর নামঃ ধর্ষণ। দেশে দেশে নারী-শিশুরা পুরুষের আধিপত্যবাদের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আহত-নিহত হচ্ছে এই ধর্ষণের কারণে। যদিও মনে করা হয়, সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সঙ্কুল কিংবা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেই নারী-শিশুরা মূলত এমন অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছে বেশি। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে রিপোর্টেড ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যুক্তরাজ্যে, যেটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবে উন্নত দেশই। তার মানে তসলিমা নাসরিনের বক্তব্যই ঠিক, ‘নারীর কোন দেশ নেই’। ক্ষমতা আর শক্তির প্রয়োগে এ পৃথিবীতে পুরুষতন্ত্র প্রচণ্ডভাবেই প্রতিনিয়ত আহত-নিহত করে চলেছে নারী-শিশু আর দুর্বলকে। আমি এই লেখাটি লিখতে যে সময়টুকু নিয়েছি, হয়তো সে সময়টুকুতে পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে আরো একটি নারী, আরো একটি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়েছে।

পরিশেষে ‘The Last Girl' বইটি থেকেই একটি তথ্য দিয়ে এই লেখাটিও শেষ করার চেষ্টা করছি। ইয়াজিদী সম্প্রদায়ের পুরুষরা, যারা বেঁচে সেসময় ক্যাম্পে বসবাস করছিলো, তারা এইসব ধর্ষিত নারীদের নানা উপায়ে ইসলামিক স্টেটের সদস্যদের কাছ থেকে বাঁচানোর জন্য নানা পন্থায় কাজ করে যাচ্ছে (যদিও এখনো আরো অন্তত ২৪০০ নারী আইসিসের কব্জায় আছে)। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, বিশাল অংকের টাকা খরচ করে পর্যন্ত এসব নারীদের উদ্ধারে কাজ করে চলেছে ইয়াজিদী পুরুষেরা। ইয়াজিদীদের ধর্মীয় নেতা তাদের সম্প্রদায়কে এসব নির্যাতিত নারীদের সাদরে নিজেদের পরিবার আর সমাজে গ্রহণের আদেশ দেন। ধর্মীয় নেতার এমন সময়োপযোগী এবং মানবিক আদেশের কারণেই এসব নারীরা আইসিসের কব্জা থেকে পালিয়ে নিজেদের পরিবার আর সম্প্রদায়ের কাছে ফেরার সাহস পায় এবং তাতে তাদের মনোবলও বৃদ্ধি পায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে যদি আমাদের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের আমাদের সমাজে এরূপ সম্মান আর সাহসের সাথে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে বোধয় আজ আমাদের ইতিহাস অন্যরকম হতো আর আমাদের ধর্ষিত নারীরাও নিজেদের অসম্মানিত মনে করতো না। যেই দেশ আমরা পেয়েছি এই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগে তাদেরই আমরা ঘৃণা করেছি, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের পুনর্বাসনের কোন সুযোগই আমাদের দেশে সৃষ্টি করা হয়নি। নাদিয়া মুরাদের চেয়ে হয়তো সামাজিকভাবে ভালো অবস্থানে আমরা আছি, কিন্তু যে উদারনৈতিক সমাজ সে পেয়েছে তার তুলনায় আমাদের সমাজের কথা ভেবেই লজ্জিত বোধ করছি।

সুপ্তা বড়ুয়া। অটোয়া, কানাডা
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে তাঁর নিজস্ব ব্লগ supta.ca ভিজিট করুন।