কোভিড-১৯ যুদ্ধ---কতোটা দীর্ঘ? – ফরিদ তালুকদার
তথ্যমতে গতবছরের নভেম্বরে প্রথম মানব দেহে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ সনাক্ত হয়েছিলো। সে হিসেবে আর একমাস পরই পৃথিবী ব্যাপী এই ভাইরাসটি সংক্রমণের এক বছর পূর্তি হয়ে যাবে। জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির হিসাব মতে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সর্বোমোট সংখ্যা ৩৫,৩৪৬,৫২৬ জন, এবং এ কারণে মৃতের সংখ্যা ১,০৩৯,১৯৯ জন। নিঃসন্দেহে বলা যায় প্রকৃত হিসাবে এই দুই ক্ষেত্রেই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশী। পৃথিবীর যে সব দেশ প্রথম আক্রমণের পরে কঠিন লকডাউন এর মাধ্যমে এটাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলো, জীবন ব্যবস্হা খানিকটা শিথিল করার পর সে সব দেশ আবার দ্বিতীয় পর্যায়ের আক্রমণের (Second wave of attack) স্বীকার হচ্ছে। আজকের খবর অনুযায়ী গত চব্বিশ ঘণ্টায় অন্টারিও তে ৭৩৩ জন টেস্ট এ পজিটিভ হয়েছেন। যা কিনা প্যানডেমিক শুরু হওয়ার পর থেকে একদিনের রেকর্ডে সর্বোচ্চ! অথচ গত একমাস পূর্বেও এই সংখ্যা একশো এর নীচে ছিলো। প্রসংগত অন্টারিও তে প্রতিদিন গড়পড়তা প্রায় চল্লিশ হাজার লোককে টেস্ট করা হয়। আক্রাম্তের সংখ্যা হিসেবে শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো আমেরিকা, ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া ও কলম্বিয়া। গতকালকের বিশ্বব্যাপী প্রধান খবরগুলোর একটি হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মিলেনিয়া ট্রাম্পের কোভিড -১৯ পজিটিভ হওয়া। যদিও ব্যাক্তিগত ভাবে আমার কাছে এ খবরটা একদিক থেকে কোন বাড়তি গুরুত্ব বহন করে না আবার অন্যভাবে দেখলে কিছুটা তো অবশ্যই। পৃথিবীতে প্রতিটা জীবনই মূল্যবান। সে হিসেবে দেখলে ডোনাল্ড ট্রাম্প তেমনই একজন। এর বেশী কিছু নয়। তদুপরি মানব সভ্যতা এবং মানবতার কল্যানে তার ভূমিকা ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক ই বেশী। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন আমেরিকাকে গ্রেট করার শ্লোগান নিয়ে। পৃথিবীকে নয়। আরও পরিস্কার করে বলতে গেলে আমেরিকার শুধু একটা শ্রেণীকে গ্রেট করাই তার লক্ষ্য, সবাইকে নয়। অন্যদিক থেকে দেখলে কোভিড-১৯ এর পূর্বে পৃথিবীতে আসা এমন আর কোন মহামারী ই এ ধরনের এলিট ক্লাসকে আক্রান্ত করতে পারেনি। সেদিক থেকে কোভিড-১৯ এদের কাছে কিছুটা বাড়তি গুরুত্ব তো রাখেই। শুধু খাদ্যাভাব এবং পুষ্টিহীনতার কারনে পৃথিবীতে প্রতিদিন যতো মানুষ মারা যায় কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে এখনো সে সংখ্যার চেয়ে অনেক কম মারা যাচ্ছে। কিন্তু দারিদ্র এবং অহেতুক যুদ্ধের কারনে এই মৃত্যু যে শুধু আমাদের গা সহা হয়ে গেছে তাই নয়, স্বচ্ছ দৃষ্টিতে বোঝা যায় পৃথিবীর মোড়লরা এটাকে বরং জিইয়ে রাখতেই তৎপর! সেক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিস্কারের জন্যে পৃথিবী এখন নিরলস এবং বলা যায় আন্তরিক ভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। অবশ্যই ভালো খবর এবং আশার কথা। মোটামুটি ভাবে যে খবরগুলো চোখে পড়ে তাতে তারা আশা করছেন যে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে এর ভ্যাকসিন মানব দেহে প্রয়োগের জন্যে অনুমোদন পেয়ে যাবে। আজকের এই নিবন্ধটি মূলতঃ এই ভ্যাকসিনের কিছু বাস্তবতাকে তুলে ধরারই এক চেষ্টা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) এর তথ্য মতে গত তিরিশে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ৪১টি গবেষণা ল্যাবরেটরী কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক ভাবে মানব দেহে প্রয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। এই সংখ্যার মধ্যে রয়েছে কানাডারও একাধিক ল্যাব। যার মধ্যে মেডিকাগো ইনকরপোরেটেড (Medicago Incorporated) এবং এনটোস ফার্মাসিউটিক্যালের (Entos Pharmaceutical) এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এক সপ্তাহ আগের খবর অনুযায়ী আমেরিকার জনসন এবং জনসন (Johnson and Johnson) কোম্পানি বিশ্বব্যাপী তাদের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে চলে গেছে। সুতরাং বোঝা যায় এ দৌড়ে তারাও এখন অনেকটাই এগিয়ে। প্রসংগত উল্লেখ করতে হয় যে, ইতিহাস মতে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিন ই চার বছরের কম সময়ে আবিস্কার করতে পারেননি। সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে আবিস্কৃত ভ্যাকসিন টি ছিলো মাম্পস (Mumps) এর ভ্যাকসিন, ১৯৬৭ সালে আবিস্কৃত হয়। সময় লেগেছিল চার বছর। এখন দেখা যাক বিজ্ঞানীরা এই কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিস্কারের ক্ষেত্রে কতোটা দক্ষতা এবং সফলতার পরিচয় দেন। কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন গবেষণায় একটা সুবিধাজনক দিক হলো যেহেতু এটি সারস ভাইরাসের ই (SARS Virus) আর একটি রূপ সারস-কোভ-২ (SARS-Cove-2)। সারস ভাইরাসের ভ্যাকসিন বিজ্ঞানীরা আবিস্কার না করলেও এ নিয়ে গবেষণা করে তারা অনেকটা পথই এগিয়ে ছিলেন। গবেষণা লব্ধ সেই ফল এখানে অনেকটাই কাজে লাগবে বলে মনে করা যায়।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের গবেষণায় বিশ্বব্যাপী অনেকগুলো গবেষণা সংস্হার এমন উঠেপড়ে লাগার পেছনে মূলতঃ দুটা কারণ কাজ করছে। যার প্রথমটি অবশ্যই পৃথিবীর মানুষকে এই ভাইরাসের কবল থেকে মুক্ত করা। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো আর্থিক মুনাফা লাভ করা। স্বভাবতই ধরে নেয়া যায় প্রথম যে এক বা একাধিক কোম্পানি সফলতার সাথে এই ভ্যাকসিন বাজারে নিয়ে আসতে পারবে, বাজারের চাহিদার কারণে খুব অল্প সময়েই তাদের আর্থিক সফলতা তুঙ্গে উঠে যাবে। আমার মতে ভালো দিকের সাথে এখানে একটি বড়ো রকম শঙ্কাও কাজ করছে। এবং সেই শঙ্কাটি হলো এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এমন একটি ভ্যাকসিনের স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদি কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা অস্বাভাবিক নয়। থাকলে সেগুলো পরবর্তীতে আমাদের শরীরে কতোটা ক্ষতিকর হিসেবে দেখা দিবে তা কি পৃথিবীর সবাই জানতে পারবে? কারণ এসব ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানি গুলো এবং অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতার পরিচয় তো আমরা এর পূর্বে অনেকবারই পেয়েছি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় এসিডিটির ওষুধ জানট্যাক (Zantac, Ranitidine Group) এর কথা। ৩৮ বছরের বেশী সময় পড়ে আমরা জানতে পারলাম এর ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা। যা কিনা আমাদের দেহে ক্যান্সার এর মতো মরন ব্যাধি সৃষ্টিতে সহায়ক হিসাবে কাজ করে। আর ইউরোপ, এশিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার বাজারে এই দীর্ঘ সময় এটি দাপটে ব্যবসা করার পরে এখন তুলে নেয়া হলো! তাই বলছিলাম কোভিড-১৯ এর মতো ভ্যাকসিন এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানতে যদি ৪/৫ বছরও লেগে যায় ততোদিনে কোম্পানি গুলো তাদের বিলিয়ন ডলার মুনাফা তুলে নিবে। এবং তারপরে তারা আবার ঐ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ওষুধ বেড় করে নির্বিঘ্নে দ্বিতীয় দফা মুনাফার ফায়দা নেবে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা এ শঙ্কা থেকে তো মুক্তি দিতে পারছে না!
এবারে আমরা দ্বিতীয় আর একটি বিষয়ের দিকে একটুখানি তাকানোর চেষ্টা করি। ধরে নেয়া যাক আগামী এক বছরের মধ্যে এই ভাইরাসের এক বা একাধিক ভ্যাকসিন বাজারে এসে গেলো। এখন প্রশ্ন হলো এর প্রতি ডোজের মূল্য কতো হবে? পৃথিবীর কতো % মানুষ এই আবিস্কারের সুবিধার আওতায় আসবে? তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সাধারণ জনগন কি এই ভ্যাকসিনের সেবা পাবে? তথ্যমতে কানাডা ইতোমধ্যে ফাইজার এবং বায়ো টেকনোলজিক্যাল ফার্ম মডার্না (Pfizer and Biotechnological firm Moderna) এর সাথে চুক্তি করেছে মিলিয়নস ডোজ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পাবার জন্যে। এর মধ্যে ফাইজার সরবরাহ করবে BMT162 mRNA162 based vaccine candidate এবং মডার্না সরবরাহ করবে mRNA1273 vaccine candidate. হেলথ কানাডা এর মতে এ দুটা ভ্যাকসিনের সম্ভাবনা খুবই আশা ব্যঞ্জক (তথ্য সূত্র সিবিসি নিউজ)। অনুমান করছি পৃথিবীর অন্য সম্পন্ন দেশ গুলোও এ ধরনের ওষুধ কোম্পানি গুলোর সাথে একই রকম চুক্তি করে রেখেছে। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর দরিদ্র দেশ গুলোর ভ্যাকসিন সেবা পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক্ষেত্রে কতোটা ভূমিকা রাখতে পারবে তা এখনো পরিস্কার নয়। এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করি এবং তা হলো, কোভিড-১৯ সম্পর্কে প্রথম দিককার তথ্যগুলো বিভ্রান্তিকর (আমেরিকার মতে) ছিলো বলে আমেরিকা এই সংস্থাটি থেকে নিজেকে বেড় করে নিয়েছে এবং তাদের সবরকম অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে।
সঠিক তারিখটা মনে নেই কিন্তু সেদিন বিকেলের দৃশ্যটা বেশ মনে পড়ছে। অন্টারিও তাদের লকডাউনের বিধি নিষেধ এলাকা ভিত্তিতে ধীরে ধীরে তুলে নিচ্ছিল। টরোন্টো সেই তালিকায় অনেকটা পরেই আসে। কারণ কানাডার সবচেয়ে বড় শহর হওয়ায় এখানে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যাটাও নিয়ন্ত্রণে আনা একটু কঠিন ছিলো। কিন্তু যেদিন এই নিষেধাজ্ঞা তুলে শহরটি দ্বিতীয় পর্যায়ের উন্মুক্ততার ঘোষণা দেয় সেদিন এখানকার একটি জনপ্রিয় পার্কের পাশ দিয়ে ড্রাইভ করে যাওয়ার সময় পার্কটিতে মানুষের যে জমায়েত দেখতে পাই তাতে তখনই মনে হয়েছিলো ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা অতি শীঘ্রই আবার বেড়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা বাস্তবে রূপ নিতে মোটেই সময় নেয়নি। অন্টারিও আবারও লকডাউন এ যাবার কথা ভাবছে। দ্বিতীয় দফায় অর্থনীতি অচল হয়ে পড়বে এই ভয় না থাকলে হয়তো যেতোই। কিন্তু পূর্ণ লকডাউন না হলেও আবারও প্রায় তার কাছাকাছি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। কেন? দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় দফায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত জনগনের ৬০% এর ওপরে লোকের বয়স ৪০ বছরের নীচে। বিষয়টি আমাকে যে ধারণা দেয় তা হলো ঐ ভোগবাদী ধ্যান ধারণায় ধোলাই কৃত মানসিকতার ই প্রতিফলন। ভ্যাকসিন বাজারে আসার পূর্ব পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই এর প্রসার ঠেকানোর একমাত্র উপায় এবং এটা যে এখন সব বিবেকবান মানুষের ই দায়িত্ব এরা তা মানতে নারাজ। ডিজনিল্যান্ড, মেক্সিকো, কিউবা গিয়ে জীবনকে ভোগ করতে না পারি কিন্তু তাই বলে ভোগ ছাড়া তো জীবন মেনে নেয়া যায় না! বিশ্বাস টা যেন এমনই। এটা যে শতবছর ধরে আমাদের মস্তিষ্কে ভোগবাদী ধোলাইয়ের মাধ্যমে প্রথিত হয়ে গেছে! তাই অন্যকিছু না হোক, এখানেই অন্তত পার্টি করে, বারে গিয়ে যতটা পারা যায় এই ভোগ চর্চা চালিয়ে যেতে হবে! বলাবাহুল্য এই ভোগ চর্চার সাথে পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবকাঠামোও এখন অনেকটা নির্ভরশীল। সুতরাং এ এক শাখের করাতের মতো অবস্থা। পৃথিবীর কোন কোন শহরে এই শ্রেণীর লোকজন তাই লকডাউন এর বিরুদ্ধে ছোটখাটো প্রতিবাদ সমাবেশ ও করেছে, সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম! মোদ্দা কথা ভোগ না থাকলে বেঁচে থাকার মানে কি? ভাবখানা যেন এমনই! এ হলো উন্নত বিশ্বের চিত্র। সুস্থ জীবন নয়, ভোগই প্রধান কথা। সুতরাং বিবেকের প্রয়োগে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সেখানে এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশগুলোতে লকডাউনের আইন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না সংগত কারনেই। হ্যাঁ আমি বলবো সংগত কারনই। কারণ ঐ দেশগুলোর মানুষের একটি বিশাল শ্রেণীই একদিন কাজ না করলে পরের দিনই পেটে খাবার পড়ার কোন নিশ্চয়তা নেই! সরকারের সঞ্চয়েও এমন কিছু নেই যে এদেরকে মাসের পরে মাস ঘরে বসিয়ে রেখে ভাতা দিবে। যতসামান্য যা কিছু অনুদান তাও অসৎ নেতাকর্মী, কর্মকর্তাদের চুরির কারনে তাদের কাছে কিছুই পৌঁছায় না। মৃত্যু তো মৃত্যই। এটাই তো চূড়ান্ত কথা। সে মৃত্যু কোভিড-১৯ এর কারণে হোক আর না খেয়ে হোক। তফাৎ তো কিছু নেই। তাই তো বেঁচে থাকার শেষ সংগ্রামে তারা মরিয়া। বেড়িয়ে পড়ে সব নিয়ম নীতি ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কারণ ভিন্ন হলেও উন্নত বিশ্ব কিংবা অনুন্নত বিশ্ব উভয় ক্ষেত্রেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ভাইরাসটি কে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
জগতময় কোভিড-১৯ এর এই প্রাদুর্ভাব পৃথিবীর মানচিত্র তথা তার অধিবাসীদের জীবন যাপনে কি ধরনের পরিবর্তন আনবে তার সঠিক সমীকরণ নির্ণয় করা এখনো সম্ভব নয়। অর্থনীতির কথা ভাবলে অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আর একটি অর্থনৈতিক মেরুকরণ হতে যাচ্ছে এবং পৃথিবী ব্যাপী সাধারণ মানুষের জীবনে বড়ো রকমের আর একটি অর্থনৈতিক দূর্ভোগ নেমে আসছে। যেখানে বরাবরের মতো দূর্বলেরাই এর ভুক্তভোগী হবে এবং হচ্ছে! মানুষের জীবন ও জীবিকার ধরণেও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। কানাডার মতো উন্নত দেশে যেখানে সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে স্বাভাবিক অবস্থা ধরে রাখতে সেখানেও প্রায় ২৫% ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা চিরতরে ব্যাবসার পাট গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকেই চাকুরী হারাবে দীর্ঘ সময়ের জন্যে বা বলা যায় চিরতরে! বড় কোম্পানিগুলো যারা আগে থেকেই আমাজন, আলিবাবার মতো অনলাইন বিক্রয়ের পথে ধীরে হাঁটছিলো তারা এখন ঐ পথে দৌড়াতে শুরু করেছে। প্রযুক্তির প্রসার এবং আগ্রাসনের কারনে আমাদের জীবনে যে ভারচুয়ালিটির প্রভাব (প্রাদুর্ভাব বললেই মনে হয় ভালো হয়!) আধিপত্য বিস্তার করছিলো এই ভাইরাসের কারণে তা এখন অনেকটা সুনামির রূপ নিয়েছে এবং নিবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্মের জীবনে এর প্রভাব কতটা সুদূর প্রসারী এবং স্থায়ী রূপ নিবে সে অংক এ মুহূর্তে করা বেশ কঠিনই। উন্নত বিশ্বের বেশীর ভাগ দেশগুলোতেই প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারী স্কুল গুলোতে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীরাই এখন অনলাইনে শিক্ষা নিচ্ছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় গুলো তো সবটাই অনলাইন। এই ব্যবস্হাটা স্থায়ী রূপ নেয়ার শঙ্কাটাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ পুঁজির গ্রাসে পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বেশীরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই মূলতঃ এখন অন্যসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো একই দর্শনে চলে। ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টো থেকে শুরু করে কানাডার সব বড়ো বিশ্ববিদ্যালয় গুলোই এখন অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস নিচ্ছে। যেখানে রেগুলার ক্লাসের তুলনায় তাদের খরচের পরিমান অনেকাংশেই কম হওয়ার কথা। কিন্তু ছাত্র/ছাত্রীদের কাছ থেকে টিউশন ফি তারা আগের হিসেবেই নিচ্ছে। সুতরাং কোভিড-১৯ যুদ্ধে মানুষ জয়ী হলেও তারা এ ব্যবস্থা থেকে ফিরে পূর্বের অবস্থায় আসতে কতটা আগ্রহী হবে তা সময়ই বলবে। প্রসঙ্গত ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টো খাতা কলমে পাবলিক হলেও প্রকৃত অর্থে সে গোত্রে আর পড়ে না। ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ঐ বছরের বাজেটের ৫৪% আসে ছাত্রদের টিউশন ফি এবং আনুষঙ্গিক খরচ (৪৪% এবং ৯%) থেকে। যেখানে সরকারের অনুদান থেকে আসে মাত্র ৩৪%। সুতরাং একে পাবলিক কি করে বলা যায়? খরচের সিংহভাগটা কাদের পকেটে যায় তা খুঁজতে গেলে যে দৃশ্য বেড়িয়ে আসবে তা যে কোন মানবিক বিবেকের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিনই হবে!
সবশেষে, কোভিড-১৯ কি এই পৃথিবীর কর্ণধারদের কোন নূতন শিক্ষা দিতে সফল হবে? কিছুটা মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা? আরও মানবিক অর্থনৈতিক বিন্যাসের শিক্ষা? একটি যুদ্ধহীন বা কম যুদ্ধংদেহী পৃথিবীর শিক্ষা? বিপর্যয়ের সাথে সংগ্রাম রত পৃথিবীর আপামর মানুষের সেই স্বপ্ন, একটি আরও মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন কি কখনো বাস্তবে রূপ নিবে? আজকের এই কষ্ট কি একটি সুন্দর আগামীর পথ তৈরীতে সহায়ক হবে? না আমরা যে আস্তাকুঁড়ে ছিলাম সেখানেই থাকবো কিংবা আরও অধপাতে নেমে যাবো? জানি আমরা মানুষেরা সুন্দরের স্বপ্ন দেখতেই ভালোবাসি। কিন্তু কঠিন সত্য হলো তা বাস্তবায়ন করতে আমরা চাইনা। এখানে আমাদের স্ববিরোধী সত্ত্বা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিশেষ করে সেই সুন্দরের স্বপ্ন যদি সবাইকে নিয়ে হয়! এর প্রমাণ ও আমরা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছি। মিডলইস্ট পারস্য এবং আফ্রিকার নিরলস (!) যুদ্ধ অশান্তি সেতো এখন নিত্য কথা! তার সাথে কয়েকমাস পূর্বে দেখলাম চায়না - ভারত সীমান্তেও হয়ে গেলো এক পশলা বারুদ বৃষ্টি। এ নিবন্ধ যখন লিখছি তখন আজারবাইজান আর আর্মেনিয়া নূতন করে আবারও যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে! সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের পৃথিবী কি একদিন ও যুদ্ধ ছাড়া ছিলো? থাকলে সেই দিনটির কথা জানতে আমার খুব ইচ্ছে হয়! আজকের বাইরের মুখোশ আমরা নিকট ভবিষ্যতে খুলে ফেলবো তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। কিন্তু কোনদিন কি পারবো আমাদের অন্তর্গত মুখোশটিকে চিরতরে খুলে ফেলে দিতে?
এমন যেখানে বাস্তবতা, সেখানে আশায় বুক বাঁধতে গিয়ে আবারও তো ততোধিক হতাশায় ডুবে যাই! দিগন্ত থেকে আরও দূর দিগন্তে সরে যায় একটি মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন। একটি সত্যিকার মানুষের পৃথিবীর স্বপ্ন…! দেখি… ক্রমশঃ সে হারিয়ে যায় এই জীবন সীমানারও ওপারে…!?
ফরিদ তালুকদার
টরেন্টো, কানাডা
অক্টোবর ৫, ২০২০
-
নিবন্ধ // মতামত
-
06-10-2020
-
-