অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
কবি দিলওয়ার : নিজের বিশ্বাস যে হারায় সে কবি নয়

ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদঃ  আজ ১০অক্টোবর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক কবি দিলওয়ারের (১লা জানুয়ারি ১৯৩৭-১০অক্টোবর ২০১৩) প্রয়াণ দিবস। তাঁর প্রয়াণের সাত বছর হতে চলল।
কবি দিলওয়ার, যাঁর সম্পর্কে আমার আজকের উপস্থাপনা তাঁর পরিচয় পাঠককে নতুন করে দেবার কিছু নেই। তবুও কবি সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণের চুম্বকাংশ তুলে ধরার ইচ্ছে পোষণ করি। এরূপ নির্ণীত আকাঙ্খা থেকেই আমার এ প্রয়াস।

১. কবি দিলওয়ারের কাব্যসাধনায় কোন অনুকরণ বা অনুসরণের বন্দনা নেই। অনুসন্ধিৎসু  মনের প্রাজ্ঞবিবেচনায়, আত্মগত ভাবনায়, অন্তর্গত মনের বাস্তবানুভূতির স্বপ্নচিত্র মননশীল চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে নিজের মতো নিজের কবিতা নিরঙ্কুশ মৌলিকতায় উপস্থাপন করেছেন।

২. কবি দিলওয়ার তাঁর কাব্যসাধনায় যাদের কথা খুব বেশি করে ভাবনার নীতল অন্তরে চর্চার প্রয়াস পেয়েছেন, তাঁরা ছিলো সাধারণ খেটে খাওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
     আর অন্যদিকে কাব্যচর্চার মৌলিক সাধনার অন্তর্গত অনুষঙ্গ, যা কাব্যানুভূতির উদ্ভাসিত চেতনায় গুরুত্বের সাথে ওঠে আসে তা হলো স্বদেশ,স্বজাতি, ও মানবকল্যাণের নৈর্ব্যক্তিক অঙ্গীকার। যে কারণে তাঁকে "গণমানুষের কবি বলে অভিহিত করা হয়। এ অভিধায় অভিধিত হওয়ার চলমান সময়টুকুর মধ্যেই তাঁর হাত থেকে ক্রমাগত বেরিয়ে আসে- "জিজ্ঞাসা"(১৯৫৩),"ঐকতান"(১৯৬৪), "পুবাল হাওয়া"(১৯৬৬),"উদ্ভিন্ন উল্লাস"(১৯৬৯), ও "বাংলা তোমার আমার"(১৯৭২), প্রভৃতি কালজয়ী সব আধুনিক কাব্যসম্ভার। তাঁর ব্যাপক কাব্যখ্যাতির যাত্রা তখন থেকেই শুরু।
     বস্তুত ষাটের দশক থেকেই দিলওয়ার আধুনিক কাব্যচর্চায় এদেশের কবি তালিকায় নিজের দীপ্তোজ্জ্বল অবস্থান নিশ্চিত করেন। এধারায় দিলওয়ার হয়ে ওঠেন একজন খ্যাতিমান আধুনিক কবি। আর এরই ধারাবাহিকতায় "গণমানুষের কবি" হিসেবে সিলেটে তিনি সংবর্ধিত হন ১৯৭৭ এর ৭ই মার্চ। সেখান থেকেই তিনি "গণমানুষের কবি" হিসেবে পরিচিতি পান।
     তাঁর কাব্যসাধনার মূলমন্ত্র ছিলো মাটি-মানুষ,তথাএ জাতি, এ দেশ ও বিশ্বমানবের কল্যাণ। এধারায় তাঁর সকল কাব্যে উদ্ধৃত উচ্চারণের প্রেক্ষিত বিবেচনায় তাঁকে মাটি- মানুষের কবিও বলা যেতে পারে। এ মেধাবী লেখকের হাত থেকে স্বতঃস্ফূর্ততায় বেরিয়ে এসেছে গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, ও সংবাদপত্রে উদ্ধৃত যত মেধাবী কলাম।

৩. বস্তুত এ সংবেদনশীল কবি তাঁর কবিতায় অতীতকে গ্রহণ করেছেন বর্তমানের স্পর্ধীত সময়ের দীপ্ত আলোর ধারায়।নিঃসঙ্গতার ভেতর প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে অতীতে বিচরণ তাঁর কাব্যাদর্শের এক ব্যতিক্রমী স্টাইল।কিছু কবিতার বর্ণিল পঙক্তিমালায় তাঁকে অতীত থেকে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে বিচরণ করতে দেখা যায়। কল্পনার বিভায় স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে সময়ের ঘরে বন্দী হতে চাননি কবি। হেঁটেছেন ক্রমাগত- বিরামহীন প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ সময়ের ঘরে। সেখান থেকেই পুনঃযাত্রা তাঁর বর্তমানের দৃশ্যমান প্রকৃতি আর প্রজ্ঞার পুনর্বিবেচিত সমকালীন জীবনবাস্তবতার নীরিক্ষিত চেতনার সত্যলোকে। যেখানে সত্য ও সুন্দরের দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মননে,ধারণ করেছেন প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠতায়। পুনঃযাত্রা মাটি ও মানুষের মাঝে। এজন্যেই গণমানুষের মূল্যায়ন তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেছে। এটাই কবি দিলওয়ারের আধুনিক কাব্যবোধের বিনির্ণীত চেতনা। এখানেই দিলওয়ার হয়ে ওঠেন গনমানুষের কবি।

৪. শিকড় সন্ধানী কবি কাব্যের উৎকর্ষ সন্ধানে নিজের মধ্যে লালন করেছেন সর্বজনীন এক সংস্কৃতি। তাহলো মাটি- মানুষের সংস্কৃতি। এ দেশ, এ জাতির অন্তর্গত হৃদয়ের হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতি। গণমানুষোর অন্তরানুভূতির সংস্কৃতি। এ ধারায় তিনি প্রকৃতিতে বিচরণ করেছেন একজন দক্ষ প্রেমিকের মতো; যে প্রেম একেবারেই শতভাগ মানবিক। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি কোথাও বিবর্ণ, কোথাও বিপন্ন। একই অনুভূতির প্রেক্ষিত বিবেচনায় মানুষ কখনো বিপন্ন, কখনো অসহায়; এ বিষয়গুলো সমানভাবেই কবিতার বিভঙ্গ বিশ্লেষণে ওঠে আসে,যা উচ্চারিত সত্যে সমুজ্জ্বল। 

৫. দিলওয়ারের কবিতা আধুনিক চিন্তা -চেতনা, মানুষের মানবিক জীবনদর্শন, ও গণমানুষের চেতনায় সমৃদ্ধ। তাঁর কবিতা আধুনিক কাব্যচেতনায় পরিপূর্ণ। কবিতায় শিল্পশৈলীর চিত্র যেমন উজ্জ্বল তেমনি আবেগের পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়। 
     দিলওয়ার অনেকটা সময়ের আগেই ৭৬ বছরে গৌরবোজ্জ্বল সাহিতচর্চার দীপ্ত পথপরিক্রমায় ইতি টেনে চলে গেলেন। খ্যাতির নির্মোহ ব্যক্তিত্ব, অন্তর্মুখী কবি যেনো অনেকটা অভিমান করেই কবিতার জগত থেকে চলেগেলেন- না ফেরার দেশে। যাবার আগে তাঁর উচ্চারিত বাণী এক চরম সত্যকে বিজ্ঞাপিত করে গেছে; "নিজের বিশ্বাস যে হারায়  সে কবি নয়”।

৬. উল্লেখ্য কবিতার রহস্যময় উঠোনে কবি দিলওয়ারের অবাধ বিচরণ যেমন ছিলো, সমানভাবে সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তাঁর প্রাজ্ঞ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য সাময়িকী এবং সংকলন যথাক্রমে "সমস্বর" ১৯৬৯-'৭৪, "উল্লাস" ১৯৭২, "মৌমাছি" ১৯৭৫, "গ্রাম সুরমার ছড়া" ১৯৭৬, "মরুদ্যান" ১৯৮১, "সময়ের ডাক" ১৯৮৫, "সিলেট পরিদর্শক" ১৯৮৬, প্রভৃতি।
     বস্তুত সাহিত্যচর্চায় কবিতাই ছিলো তাঁর সাধনার প্রধান বিষয়। তিনি কাব্যচর্চার পাশাপাশি গানের লিরিক রচনায়ও দক্ষতার অনবদ্য স্বাক্ষর রেখেছেন। এখানে তাঁর উল্লেখযোগ্য গানের কয়েকটি তুলে ধরা যায়। যেমন, "তুমি রহমতের নদীয়া..."। যা তদানিন্তন "রেডিও পাকিস্তান সিলেট" এর উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে খ্যাত ও সমাদৃত।
     গানটি পরিবেশনার সাল ১৯৬০। আরো একাধিক গানের মধ্যে রয়েছে "মুরশিদ আমি খুঁজবো নাগো", "মন আমার কেমন করে", "নদীর ঘাটে জল আনিতে গিয়া" প্রভৃতি।
     এই মেধাবী কবি মনন চর্চায় কাব্য জগতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে নানা পুরস্কারে অলংকৃত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য "বাংলা একাডেমি পুরষ্কার" ১৯৮০, "একুশে পদক" ২০০৮, এছাড়া অন্যান্য সম্মাননার মধ্যে "আল মনসুর সাহিত্য পুরষ্কার" ১৯৮৬, দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক সম্মাননা "১৯৯১ প্রভৃতি।


ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ
শ্রীমঙ্গল, বাংলাদেশ