অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
সাহিত্যের কেন্দ্রিকতা: প্রসঙ্গ মানুষ ও প্রকৃতি - আলী রেজা

     সাহিত্যের প্রধান দুটি উপাদান মানুষ ও প্রকৃতি। প্রাকৃতিক বা নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে রচিত হয়েছে সাহিত্যের একটি বড় অংশ। এ অংশটি সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক দিকটিকে সমৃদ্ধ করেছে। শিশুতোষ সাহিত্য ও লোকসাহিত্যের প্রধান উপাদান প্রকৃতি। লোকসাহিত্য যতটা প্রকৃতিকেন্দ্রিক ঠিক ততটাই আবার মানবকেন্দ্রিক। মানুষ ও প্রকৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে লোকসাহিত্যের ইমারত। সমকালীন সাহিত্য প্রকৃতিকেন্দ্রিকতা থেকে ক্রমে ক্রমে মানবসংলগ্ন হয়ে উঠছে। মানবসভ্যতা শিল্পায়ন ও নগরায়নের দিকে তার জয়যাত্রা অব্যাহত রেখে ক্রমশ যান্ত্রিকতার ঘূর্ণাবর্তে প্রবেশ করছে। তার আগে কৃষিসভ্যতার যুগে মানুষ ছিল প্রকৃতি সংলগ্ন। এই প্রকৃতি সংলগ্ন মানুষ মেধায়, মননে, চিন্তায়, অনুভবে ছিল সহজ-সরল। প্রাকৃতিক উপাদানই তাদের সকল প্রয়োজন মেটাতো। তাই শুধু প্রকৃতি সংলগ্ন থেকে মানুষ তার যাপিত জীবনকে বয়ে বেড়াতো। মানুষের হাসি-আনন্দ, সুখ-দুঃখ ও আবেগ-অনুভূতি ছিল একরৈখিক। এই একরৈখিক প্রাকৃতিক জীবনে নানামাত্রিক জটিলতা ও সংকট দেখা দেয় শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে। মানুষের যাপিত জীবন দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। সাহিত্যেরও  বাকবদল ঘটে। সাহিত্যের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তু পাল্টে যেতে থাকে। সাহিত্য ক্রমশ প্রকৃতি কেন্দ্রিকতা থেকে মানবকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। 
     প্রকৃতিকেন্দ্রিক সাহিত্যের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তু ছিল সহজ-সরল। আজও প্রকৃতিকেন্দ্রিক সাহিত্য ভাষার লালিত্যে, বিষয়ের সরলতায়, ভাবের নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ। কিন্তু সাহিত্য যতই জীবনঘনিষ্ঠ বা মানবকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে ততই তার ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তু বদলে যাচ্ছে। মানবকেন্দ্রিক সাহিত্য ব্যক্তি মানুষের নানামাত্রিক সংকটকে যেমন তুলে ধরে তেমনি মানবসমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে। ফলে মানবকেন্দ্রিক সাহিত্য ভাবের তীব্রতা, ভাষার জটিলতা ও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে বহুরৈখিক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের ব্যবহারিক জীবনকে সহজ করলেও মানুষের মনোজগতকে করেছে জটিল। মনোজগতের এই জটিলতা মানুষের চিন্তার জগতকে করেছে দুর্বোধ্য। ব্যক্তি নিজেই নিজেকে আর বুঝে উঠতে পারছে না। সংকটের আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে মানুষ তার আবেগকে নষ্ট করে ফেলছে ক্রমশ। এই মনোজাগতিক সংকটের প্রতিফলন দেখাতে গিয়ে সাহিত্য অমার্জিত ভাব ও ভাষা ধারণ করছে। ব্যক্তির অর্থনৈতিক সংকটকে চিত্রিত করা মানবকেন্দ্রিক সাহিত্যের একটি বিশেষ দিক। নবপর্যায়ে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে শ্রেণির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবর্তী শ্রেণিগুলো এক ধরণের মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। তাই শ্রেণিশোষণেরও বৃত্তায়ন ঘটেছে এবং বহুস্তরে সমাজব্ধ মানুষ শোষিত হচ্ছে। এই শোষণ যেহেতু মানবসৃষ্ট তাই এর স্বরূপ তুলে ধরতে গিয়ে সাহিত্য দিন দিন আরও বেশি মানবকেন্দ্রিক হচ্ছে। ব্যক্তিসংকট, সামাজিক শোষণ, নৈতিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের ভিন্ন সংজ্ঞায়ন, অপসংস্কৃতির চর্চা মানুষের যাপিত জীবনকে দূর্বিষহ করছে। শোষিত-বঞ্চিত শ্রেণির অসহায়ত্ব এবং শোষক শ্রেণির লাগামহীন অস্বাভাবিক আচরণ পুরো মানব সমাজকে বিকৃতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই সাহিত্যের বক্তব্য এখন ক্রমশ প্রত্যক্ষ বা সরাসরি হয়ে যাচ্ছে। নান্দনিকতা সাহিত্যের একটি অন্যতম দিক হলেও সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক দিকটি এখন পাঠককে আর খুব একটা আলোড়িত করে না। কারণ মানুষ নিজেই তার জীবনের নান্দনিক দিকটিকে অগ্রাহ্য করে অর্থবিত্তের পেছনে ছুটছে অবিরাম। অর্থ এখন সামাজিক মর্যাদা ছিনিয়ে আনতে পারে। অর্থ পারে ভোগ-বিলাসী জীবনের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে।  
     প্রকৃতিকেন্দ্রিক সাহিত্য এখন জীবনের কথা বলে না। কারণ জীবন এখন প্রকৃতি সংলগ্ন নেই। জীবন এখন যান্ত্রিক। এই যান্ত্রিক নিয়মে চলমান জীবনে সংঘটিত নানামাত্রিক সংকটকে প্রতিফলিত করে যে সাহিত্য সেই সাহিত্যই এখন ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা দিতে পারে। সাহিত্য যদি ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষার সাথে তার গতিপথ পরিবর্তন করতে না পারে তবে সে সাহিত্য ব্যক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রকৃতি এখন আর সাহিত্যের প্রধান উপাদান নয়। কারণ ব্যক্তি নিজেই এখন প্রকৃতি সংলগ্ন নয়। ব্যক্তির সংলগ্নতাই সাহিত্যের গতিপথ নির্ধারণ করে। ব্যক্তি এখন ব্যক্তিসংকটের আবর্তে ঘূর্ণায়মান থেকেই তার যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ খুঁজে নেয়। তাই তার চিন্তার জগত জুড়ে আছে ব্যক্তিমানুষ ও তার সমাজ।
     বর্তমান সাহিত্যের কেন্দ্রিকতা প্রকৃতি থেকে ব্যক্তির দিকে ধাবমান। সাহিত্যের এই প্রবণতা শুরু হয়েছে ফরাসী বিপ্লবের হাত ধরে। শিল্পবিপ্লব ও রুশবিপ্লব সাহিত্যের এই প্রবণতাকে আরও বেশি শাণিত ও শক্তিশালী করেছে। সাহিত্য এখন পুরোটাই মানবকেন্দ্রিক বা মানবতাবাদী। মানুষ শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত হলে সাহিত্যের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তু  হয়ে ওঠে প্রতিবাদের হাতিয়ার। মানুষ যখন থেকে বুঝতে শিখেছে যে মানবসমাজকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে তখন থেকেই মানুষ হয়ে উঠেছে প্রকৃতিবাদী। তাই মানুষের প্রকৃতিবাদী হয়ে ওঠাটাও মানবকেন্দ্রিক চিন্তার ফসল।
     মানবকেন্দ্রিক বা মানবতাবাদী চিন্তাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান বাহন বা মাধ্যম হলো সাহিত্য। সাহিত্য সৃষ্টি হয় ব্যক্তি ও সমাজের নানা অসঙ্গতি থেকে। স্থিতাবস্থা যে সাহিত্যের জন্ম দেয় তার নান্দনিক মূল্য থাকতে পারে। এই নান্দনিকতার আবেদন ব্যক্তির মধ্যে ততক্ষণই থাকবে যতক্ষণ সে কোন সংকটের মুখোমুখি না হবে। ব্যক্তি সংকটে পতিত হলেই তার ভেতরে দ্রোহের হাওয়া বইতে থাকে। এই সংকট এক সময় ব্যক্তিকে দ্রোহী করে তোলে। প্রথাগত সমাজকে সে তখন অগ্রাহ্য করার চিন্তা করে। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা তার কাছে হয়ে ওঠে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই সামাজিক অসঙ্গতি ও ব্যক্তিসংকট যখন সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় তখন ব্যক্তি তাকে নিজের সাহিত্য মনে করে। সাহিত্যের এই জীবনমুখিতা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় শক্তি। সাহিত্য নন্দনতাত্ত্বিক হবে নাকি মানবকেন্দ্রিক হবে এ বিতর্ক পুরোনো। এ বিতর্কের মীমাংসা না হলেও সাহিত্য তার গতিপথ তৈরি করে নিয়েছে। সাহিত্য তার নান্দনিক বৈশিষ্ট্য গৌণ করে জীবনঘনিষ্ঠ বা মানবকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যই মুখ্য করে তুলছে দিন দিন। সাহিত্য মানেই এখন জীবনসংকটের নির্মোহ রূপায়ণ। জীবনের নির্মোহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাহিত্য যতটা না রসসৃষ্টি করছে তার চেয়ে বেশি সমাজবাস্তবতাকে রূপায়িত করছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা অসঙ্গতিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে তা সেই সমাজসংলগ্ন পাঠকের সামনে তুলে ধরাই সাহিত্য নামক দর্পণের কাজ। ম্যাথিউ আরনল্ড সাহিত্যকে ‘ক্রিটিসিজম অব লাইফ’ বা  জীবনের সমালোচনা বলেছেন। জীবনকে বাদ দিয়ে কোন ফলপ্রসূ সাহিত্য হতে পারে না। জীবনের ইতিবাচক দিক হোক কিংবা নেতিবাচক দিক হোক কিংবা হোক কোন আবেগ-অনুভূতির দিক- যাই হোক না কেন জীবনের নানামাত্রিক ঘাত-প্রতিঘাত, সমস্যা-সংকট, আনন্দ-বেদনা ব্যতিরেকে কোন সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে না। ‘সহিত’ শব্দ থেকে সাহিত্য শব্দের উৎপত্তি। এই সহিত হলো ব্যক্তির সহিত। তাই সাহিত্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রেম, দ্রোহ, বিরহ, বিচ্ছেদ- সবকিছুই মানুষকে ঘিরে। মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তিত করে নেয়। মানুষের এই পরিবর্তন তার পারিপার্শ্বিক সমাজকেও বদলে দেয়। মানুষ বদলে গেলেই সবকিছু বদলে যায়। বদলে যায় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকে সমকাল পর্যন্ত সাহিত্যের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তুর যে বিবর্তন তা মানুষের আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনেরই ফল। তাই মানবজীবনের সামূহিক পরিবর্তনই সাহিত্যের গতিপথ নির্ধারণ করে।
     বাংলা সাহিত্যের আড়াই’শ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে চিত্র পাওয়া যায় তার পুরোটাই মানবকেন্দ্রিক। এই কালপর্বে মানুষের সংগ্রাম ছিল মানুষের বিরুদ্ধে। বস্তুত সকল কালেই মানুষের সংগ্রাম মূলত মানুষের বিরুদ্ধেই হয়ে থাকে। ব্রিটিশবিরোধী কালপর্বটি ছিল বাংলা সাহিত্যের অগ্নিযুগ। এ সময় মানুষ পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। সাহিত্য সেদিন মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়/ দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায় (রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়)। স্বাধীনতার এই বীজমন্ত্রে উজ্জীবিত জাতি সেদিন এক সমৃদ্ধ সাহিত্যের ভাণ্ডার পেয়েছিল। সৃষ্টি করেছিল এক মানবতাবাদী সাহিত্য। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় যেমন এক সমৃদ্ধ সাহিত্যের বলয় তৈরি হয়েছিল তেমনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত হয়েছিল এক বিশাল সাহিত্যের জগত। নব্বইয়ের গণআন্দোলনও জন্ম দিয়েছিল উৎকৃষ্ট সাহিত্যের। অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই যুগে যুগে সাহিত্যের এই নির্মিতি। সাহিত্য যে সংগ্রামের জন্ম দেয় সে সংগ্রামের পেছনে থাকে মানবমুক্তির আকাঙ্ক্ষা। মানবমুক্তি কোন দৈহিক বিষয় নয়; এটা বৌদ্ধিক বা চেতনাগত বিষয়। সাহিত্য কোন শারীরিক বিষয় নয়; সাহিত্য মনোজাগতিক। যে সাহিত্য নান্দনিক সেটাও মানবকেন্দ্রিক। কারণ তা মানুষের মনোজাগতিক যন্ত্রণা প্রশমনে কাজে লাগে।
     সমাজবাস্তবতার রূপায়ণ সাহিত্যের প্রধান কাজ। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার সাথে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের যে নানামাত্রিক সম্পর্ক সেটাও যেমন একজন সাহিত্যকর্মীর অন্বিষ্ট বিষয় তেমনি সামাজিক মানুষ একে অন্যের সাথে যে সম্পর্ক সৃজন করে তাও অনুসন্ধান করে একজন সাহিত্যকর্মী। সাহিত্যের প্রধান বিষয়বস্তু এখন সমাজস্থ মানুষ। মানুষের সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়; নৈতিক ও সামাজিক সংকটও মানুষকে হতাশায় নিমজ্জিত করে, কখনো জীবন ও জীবনযাত্রাকে করে তোলে দূর্বিষহ। তখন ব্যক্তিমানুষের নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অনাচারের মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্য সাহিত্যই এগিয়ে আসে। ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়ায় সকল মানবসৃষ্ট অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন উপমা-উৎপ্রেক্ষায় তুলে ধরে প্রকৃত সত্যকে। সাহিত্যই সবচেয়ে বেশি শক্তি জোগায় বঞ্চিত মানুষের মনে। সাহিত্যের শক্তি কখনো নিঃশেষ হয় না। বঞ্চিত মানুষের চেতনায় বহমান থেকে সে শক্তি ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে অগণিত মানুষের চেতনায়। মানুষই সাহিত্যের শক্তিকে বয়ে নিয়ে যায় কালে কালান্তরে। তাই সাহিত্যকে হয়ে উঠতে হয় মানবকেন্দ্রিক, হয়ে উঠতে হয় জীবনঘনিষ্ঠ। বর্তমান সাহিত্য সেদিকেই তার গতিপথ নির্মাণ করে চলছে।

আলী রেজা 
কবি ও কথাসাহিত্যিক
টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ
e-mail: alirezaphilo@gmail.com