অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
অগ্রগতির পথে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় - ড. ফজলুল হক সৈকত

বিশ্ববিদ্যালয় নামক উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি গবেষণার দায়িত্ব পালন করে থাকে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশও অগ্রসর হচ্ছে এ ধরনের গবেষণা ও উন্নয়নমূলক চিন্তাধারায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দরকারি বিষয়সমূহ সম্বন্ধে পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং উন্নয়নের সুপারিশমালা প্রণয়ন করছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। সভ্যতার অগ্রগমনে প্রয়োজনীয় ধাপগুলো অতিক্রম করতে হলে যে নিরীক্ষা ও পদক্ষেপ গ্রহণের দরকার পড়ে, তা নির্ধারণ করতে সহায়তা করে থাকে একাডেমিক গবেষণার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ। বাংলাদেশে, যে প্রতিষ্ঠানটির কাছে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি জাতীয় পরিস্থিতি ও অগ্রগতি বিষয়ে পরামর্শমালা, তার নাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯২ সালে এক বিশেষ শিক্ষা-পরিস্থিতিতে কলেজ-শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এই বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২১ অক্টোবর এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেই, ১৯২০ সালে, কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ব-বাংলায় একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা উত্থাপন করেছিলেন। 
     দেশের সবচেয়ে বৃহৎ এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২২৬০টি; শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৯ লক্ষ। এটি বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে সেশনজটমুক্ত। সারাদেশের সকল উপজেলায় রয়েছে এর কলেজ ক্যাম্পাস। এছাড়া গাজীপুরে নিজস্ব ক্যাম্পাসে চলছে শিক্ষক-প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য উচ্চতর গবেষণা। একাডেমিক মনিটরিং-এর মাধ্যমে শিক্ষার গুনগতমান পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে কলেজ অধ্যক্ষদের নিয়ে মত-বিনিময়ও করা হয়ে থাকে। বিভাগীয় পর্যায়ে স্থাপিত হয়েছে আঞ্চলিক কার্যালয়। সমাবর্তন করে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর হতে তুলে দেওয়া হয়েছে মূল সনদপত্র। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য চালু হয়েছে অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম। ইতোমধ্যে ৩১টি বিষয়ে প্রায় ১৭০০ লেকচার ধারণ করা হয়েছে; যেগুলো নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা হচ্ছে। প্রতিবছর কলেজ র‌্যাংকিং-এর মাধ্যমে সেরা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়ে থাকে। ১৩টি শতবর্ষী কলেজকে চিহ্নিত করে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৬টি কলেজকে প্রদান করা হয়েছে মডেল কলেজের মর্যাদা। বর্তমান উপাচার্যের গতিশীল নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
     জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক গ্রুপবিন্যাস করা হয়েছে এভাবে: গ্রুপ ক- ভাষা, মানবিকবিদ্যা, সামাজিক বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও ব্যবসা প্রশাসন এবং শিক্ষা; গ্রুপ খ- প্রকৃতি বিজ্ঞান, গাণিতিক বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, কম্পিউটার ও প্রযুক্তি বিজ্ঞান এবং আইন। আমরা জানি, বাংলা ভাষার আভিজাত্য, বাঙালির ভাষাবোধ সারাদুনিয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে- সবার চোখের সামনে। আমাদের ভাষার ইতিহাস, ভাষা-পরিক্রমা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভাষার প্রয়োগবিধি, ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, ভাষা সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে মর্যাদা প্রদানসহ সারা পৃথিবীর যাবতীয় ভাষাবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত ও পরিস্থিতি সম্বন্ধে গবেষণা এবং একাডেমিক লেখাপড়া নিশ্চিত করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। ভিন্নভাষী মানুষের জন্য বাংলা শেখানোর আর বাংলাভাষীদের জন্য পৃথিবীর অন্য ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিদেশগামী কর্মীদের সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা শিখিয়ে প্রশিক্ষিত জনবল রফতানির কাজে রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে পারে এই প্রতিষ্ঠান; এতে সরকারের রেমিটেন্স যেমন বাড়বে, তেমনই রাষ্ট্রের সুনামও বৃদ্ধি পাবে। এজন্য স্বতন্ত্র ও আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট নির্মাণও করা যেতে পারে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-আইন-শৃঙ্খলা-ব্যবসা- সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রচলন এবং বাংলা ব্যবহারবিধি (বানান ও উচ্চারণরীতি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্যও দরকারি পদক্ষেপ গ্রহণে দায়িত্ব পালন করতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি এই বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া, নিয়মিতভাবে জার্নাল প্রকাশের মাধ্যমে বর্তমানে মানবিকবিদ্যা, সামাজিক বিজ্ঞান, প্রকৃতি বিজ্ঞান, এবং ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ জনসমাজে তুলে ধরার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। 
     জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার গবেষণা কর্মের আওতার মধ্যে থেকে মানবসম্পদ তৈরি ও ব্যবহার নীতিমালা প্রণয়নে রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে পারে। কেবল শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে বসিয়ে পাঠ দান করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়; কাদেরকে পড়াতে হবে, কেন পড়াতে হবে, কতোটা পড়ানো যায়- এসব বিষয় ঠিক করে তবেই পাঠদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বিশ্ববিদ্যালয়। আবার তাদের এই চিন্তা কেবল তাদের নির্দিষ্ট কর্মপরিসরের মধ্যে আবদ্ধও রাখবে না তারা; তা ছড়িয়ে দেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পেক্ষাপটের উদার উঠানে। অন্যদিকে, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষাপরিকল্পনার বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দিতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়; সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বরূপ ও প্রকৃতি পর্যালোচনা করে, শিক্ষার পরিবেশ এবং কাঠামো ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সুপারিশমালা প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করতে পারে।
     প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব নিয়ে কথার আর ভাবনার ঝড় উঠেছে এখন দুনিয়াজুড়ে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার আসন্ন প্রভাব বিষয়েও কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে। মানুষের এই উদ্বিগ্নতাকে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন গবেষণাগারগুলো দিনরাত কাজ করে চলেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তার কর্মপরিধির মধ্যে অবস্থান করেও, এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি তার একাডেমিক পরিসরের প্রকৃতি বিজ্ঞান, গণিত, জীববিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞানক্ষেত্রকে চিন্তাদরোজায় প্রবেশ করিয়ে, বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৃতি ও বিজ্ঞানকর্মিদেরকে কাজে লাগিয়ে প্রাসঙ্গিক আবিষ্কারে অবদান রাখতে পারে। উদ্ভিদ এবং প্রাণিবিষয়ক বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব তৈরির জন্য প্রত্যাশিত পদক্ষেপ গ্রহণ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অতি জরুরি প্রসঙ্গ। জীবজন্তু এবং মৎস্য সম্বন্ধীয় চিন্তাভাবনায় যুক্ত হওয়ার দাবি রাখে নতুন নতুন পরিকল্পনা ও পরীক্ষণ। এছাড়া খাদ্য-পুষ্টি-স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চিন্তায়ও সহযোগিতা করতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ইউনিট। মোদ্দাকথা হলো- জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়নে বিচিত্রভাবে এবং ব্যাপক পরিসরে ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রয়োজনীয পদক্ষেপ আর জনবল নিয়োগ করে চমৎকার এক অভিযাত্রা শুরু করতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যেই এমএএস (মাস্টার্স ইন অ্যাডভান্স স্টাডিজ) কোর্স প্রবর্তনের মাধ্যমে, এমফিল/ পিএইচডি প্রোগ্রাম সম্প্রসারণ করে গবেষণার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারণের ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিচিত্র বিষয়ে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে এখানে; তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞগণ সম্পৃক্ত রয়েছেন। এছাড়া কম্পিউটার ও প্রযুক্তি সুবিধা কীভাবে জাতীয় অগ্রগতি প্রসারণে সহায়তা করতে পারে, সে বিষয়েও দায়িত্ব পালন করছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয়, তাকে বিশ্বপরিসরে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এবং জাতিকে তার প্রাপ্য সুযোগ প্রদান করতে এখন দরকার সবমহলের সহযোগিতা; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও এই উন্নয়নযাত্রায় যোগ দিয়েছে; ভর্তি, পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ, ই-ফাইলিংসহ নানান বিষয়ে প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ করছে।
     বর্তমানে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি অতি-উচ্চারিত প্রসঙ্গ হলো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। অগণন অশিক্ষিত মানুষের কাছে আইনের শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। আবার জনগোষ্ঠীকে অবগত না করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাও কঠিন। আর সে কারণে, আইনের প্রচলিত অবস্থা, আইন সেবা পরিস্থিতি, আইনের প্রয়োগ প্রভৃতি বিষয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা হতে পারে, হতে পারে জনমুখি প্রচার-ব্যবস্থার প্রবর্তন। আর অনায়াসে সে কাজের দায়িত্ব নিতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সারাদেশের অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাছাই করে নির্বাচিত কেন্দ্রকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা যায় প্রচারমূলক কার্যক্রম; আর এভাবে জনগণের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব আইন বিষয়ক সাধারণ ও অতিপ্রয়োজনীয় ধারণা। কেবল আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য পাঠক্রম আর অধিভুক্ত কিছু আইন কলেজে এই চিন্তার ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতির বৃহৎ চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করতে হতে পারে প্রাসঙ্গিক কর্মপরিকল্পনা। 
     জাতীয় উন্নয়নকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় রেখে, বিশ্বপরিসরে চিন্তাভুবনের বিচিত্র বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার, ওয়ার্কশপ প্রভৃতির আয়োজন করতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন বৈদেশিক সংস্থার সাথে যুক্ত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠান; কোনো কোনো শিক্ষক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনারে যুক্ত হয়ে মত-বিনিময় করছেন। ভবিষ্যতে এর পরিধি আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়। 

ড. ফজলুল হক সৈকত
শিক্ষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা, বাংলাদেশ