শামসুর রাহমান: স্বপ্ন শাসিত কবিতা - ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ
১। কবি শামসুর রাহমান সম্পর্কে বলা হয় পঞ্চাশের দশকে আধুনিক বাংলা কবিতা চর্চার পর্বে তিনি ছিলেন একজন নিরীক্ষাধর্মী লেখক। কবিতার দীক্ষা তাঁর প্রাগ্রসর মনের চারণভূমিকে যে মাত্রায় কর্ষণ করেছিলো সেখানে নিত্যসত্যের উৎসারণ তাঁর কবিসত্তার চূড়ান্ত উৎকর্ষের একটি দিক। এ যাত্রায় তাঁর কবিকর্মের শৈল্পিক বীক্ষণ অনুপুঙ্খ এক জাগ্রত আধুনিক বিনম্র কবিমনের শিল্পচেতনার অতলান্তিক ব্যঞ্জনা নতুন সুরে উদ্ভাসিত। এ পর্বে কাব্যধারার নতুন এক শৈল্পিক বিভা শামসুর রাহমানের হাত থেকে বিরামহীন দক্ষতায় ওঠে আসে আমাদের কবিতার অঙনে।ঋদ্ধতায় পরিব্যাপ্ত হয় তাঁর কবিতার দীপ্তিময় জগৎ এক উদ্ভাসিত আলোকে। শামসুর রাহমান হয়ে ওঠেন বাংলা কবিতার অবিসংবাদিত একচ্ছত্র অধীশ্বর।
২। প্রসঙ্গ যেহেতু তাঁর স্বপ্নশাসিত কবিতা,সুতরাং স্বপ্ন অনুশাসিত কবিতা কল্পনা ও বাস্তবতার সংমিশ্রণে কবিতার মৌলিক উৎকর্ষকে শৈল্পিক বিভায় আলোকিত করে তুলে। শামসুর রাহমানের কবিতায় এ স্বপ্নের বহুমাত্রিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
এ 'স্বপ্ন' প্রতীকী হিসেবে যেমন ওঠে এসেছে, তেমনি নানাসময় নানাভাবে কাব্যরীতির প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কবিতার ক্ষেত্রে উপমায়, উৎপ্রেক্ষায়, চিত্রকল্প,রূপকল্প,ইত্যাদির ভাবধারায় জীবন-মৃত্যু এবং আলো-আঁধারের মাঝখানে 'স্বপ্ন' ব্যবহৃত হয়ে কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবসত্যের ব্যাপকতাকে বৃদ্ধি করেছে শৈল্পিক চেতনায় এবং জীবন বাস্তবতার আলোকে। শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বপ্নের ব্যবহার জীবনসত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতীকী উপস্থাপনে বিশ্লেষিত হয়েছে। এ ধারায় শামসুর রাহমানের কবিতায় 'স্বপ্ন' প্রসঙ্গ এবং তাঁর স্বপ্নশাসিত কবিতার সংক্ষেপিত আলোচনার প্রাসঙ্গিক উপস্থাপন করা গেলো।
৩। বাংলা কবিতায় আধুনিকতার উন্মেষ ঘটে ১৯১৪-১৯৩৯এর মাঝখানে ২৫ বছরের সময়ের মধ্যে। এর ভেতর আমরা দু'টো বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করি। প্রথম এবং দ্বিতীয়। এ কঠিন সময়ের মধ্যে সাহিত্যের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের বিষয়টি ছিলো স্বাভাবিক। কবিতায় তা ওঠে এসেছে বাস্তবতার আলোকে। কবিতায় বস্তুনিরপেক্ষতার বিচারে স্বপ্ন-কল্পনার বিমূর্ত প্রতিবেদন চিত্রিত হয়েছে নিরঙ্কুশ জীবন বাস্তবতার অতুলস্পর্শে। শিল্পীর মেধাবী তুলিতে নতুন জীবনের স্পর্শ বিম্বিত হয়েছে কবিতার নিপুণ পঙক্তিতে। এ ধারায় আধুনিকতার শিল্পোৎকর্ষের ব্যাপক উপস্থাপনে অসাধাররণ শিল্পরূপের পরাকাষ্ঠা লক্ষ করা গেছে বুদ্ধদেব বসুর(১৯০৮-১৯৭৪) 'বন্দীর বন্দনা'(১৯৩০) বিষ্ণু দের(১৯০৯-১৯৮২)'উর্বশী ও আর্টেসিস'(১৯৩৩), সুধীন দত্তের(১৯০১-১৯৬০)'অর্কেস্ট্রা'(১৯৩৫), জীবনানন্দ দাশের 'ধূসর পাণ্ডুলিপি '(১৯৩৬),অমিয় চক্রবর্তীর(১৯০১-১৯৮৬) ' খসড়া '(১৯৩২) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে।
উল্লেখ্য শার্ল বোদলেয়ার(১৮২১-১৮৬৭) তাঁর "Les Fleurs du Mal "(1857)কাব্যগ্রন্থে আধুনিক কবিতার নীরিক্ষিত এবং মৌলিক উৎকর্ষের প্রাথমিক সূচনার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এ ধারায় কবিতায় আধুনিকতার বীক্ষিত রূপটির প্রাথমিক উৎসর্জন এবং শিল্পিত রূপের নান্দনিক বীজটি প্রথম উপ্ত হয়েছিলো বলে মনে করা হয়।
৪। তিরিশের আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ, সঙ্গ-নিসঙ্গতার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১), এবং কুশলী কবি সুধীন দত্ত(১৯০১-১৯৬০)। তিরিশ উত্তর জীবন বাস্তবতায় নগরসভ্যতার যে ছবি শামসুর রাহমান কবিতার জমিনে নিপুণ হাতে শৈল্পিক বুনটে বিন্যস্ত করেছেন, তাতে তাঁর নাগরিক কবিসত্তার উদ্ভাস লক্ষ করি।
বস্তুনিরপেক্ষতার আলোকে তাঁর কবিতায় উৎসর্জিত হয়েছে বহির্জগৎ এবং প্রতিবেশ বাস্তবতা। প্রতিবেশের সামগ্রিক সদাচারকে অশেষ নিষ্ঠতায় এবং নিজস্বতায় অন্তর্লোকে ধারণ করে আধুনিক বাংলা কবিতার অবিরোধী সৌধ নির্মাণ করেছেন শামসুর রাহমান। এভাবেই তাঁর কবিতায় দ্যুতিত হয়েছে সমকালীন জীবন সৃষ্টির বীক্ষিত চলচ্চিত্র।
৫। বস্তুত মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সকল কবির কবিতায় 'স্বপ্ন' প্রসঙ্গ বিদ্যমান সত্য। এ ধারায় বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪),রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১),কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), জীবনানন্দ দাশ(১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীনদত্ত (১৯০১-১৯৬০), অমীয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত(১৯০৩-১৯৭৬), বুদ্ধদেব বসু(১৯০৮-১৯৭৪), সোপেনহ্যার(১৭৮৮-১৮৬০), কিটস্(১৭৯৫-১৮২১), এজরা পাউন্ড (১৮৬৫-১৯৭২), জেমস জয়েস(১৮৮২-১৯৪১), টি এস এলিয়ট(১৮৮৮-১৯৬৫) প্রমুখ কবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৬। শামসুর রাহমানের কাব্যচেতনায় এলিওয়টের মতো অস্তিত্ববাদের দৃশ্যমান চিত্র ওঠে এসেছে, আবার কখনো এ 'স্বপ্ন' অস্তিত্ববাদের বিষয়টিকে বিশ্লেষণে সহায়তা করেছে। টি এস এলিয়টের কবিতায় অস্তিত্ববাদের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। এলিয়টের উচ্চারণ:
"... Our only health is disease...
And that to be restored,
our sickness must grow worse "... (Four Quarters)
শামসুর রাহমানের কবিতায় 'স্বপ্ন' এসেছে মানুষের সুখ-দুঃখ,আশা-নিরাশা, ব্যথা-বেদনা,আনন্দ-উল্লাসের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ব্যবহৃত হয়েছে বারবার প্রতিবেশের মূল্যায়নে, জীবনবাস্তবতার বৈচিত্র্যময় দৃশ্য পরম্পরায় কবিতার অন্তর্লোকে অস্তিত্ববাদের চেতনাকেও নিশ্চিত করেছে।
৭। বস্তুত "স্বপ্ন" প্রসঙ্গ অনেকটা Cryptic । শামসুর রাহমানের কবিতাসমগ্র ১, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০০৮ এ সন্নিবিষ্ট ও সংস্থাপিত ১৬টি কাব্যগ্রন্থে ৬০৬টি কবিতা সন্নিবদ্ধ রয়েছে। তাঁর প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থে "স্বপ্নের" বহুমাত্রিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। "প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে"(১৯৬০) শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে ৩৯টি কবিতার মধ্যে "স্বপ্ন "ব্যবহৃত হয়েছে ২৩ বার। এ ধারায় "দুঃসময়ের মুখোমুখি"(১৯৭৩)র ৩৯টি কবিতায় ১১, "একধরনের অহংকার"(১৯৭৫)এ ৫২ টি কবিতায় ২৮, "বিধ্বস্ত নীলিমা"(১৯৬৭)য় ৪৬ টি কবিতায় ৪১,"রৌদ্র করোটি"তে(১৯৬৩), ৪৫ টি কবিতায় ৪১, "নিজ বাসভূমে " (১৯৭০), ৫৮ টির মধ্যে ১৭, "বন্দীশিবির থেকে"(১৯৭২), ৩৮ টি কবিতার মধ্যে ২টি, "শূন্যতায় তুমি শোকসভা"তে (১৯৭৭) ৪১ টির মধ্যে ৫০, "বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে"(১৯৭৭), ৪৬টির মধ্যে ৮২ টি,"ইকারুসের আকাশ"(১৯৮২), ১৯ টির মধ্যে ৩০, "কবিতার সঙ্গে গেরস্থালী"(১৯৮৩)-৩৯টির মধ্যে ২৭, "আমার কোন তাড়া নেই"(১৯৮৪)-২৩টির মধ্যে ১৫,"হোমারের স্বপ্নময় হাত"(১৯৮৫)-২৬ টির মধ্যে ৩২,"ধূলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ "(১৯৮৫)-৩৬টিতে পাই ২৩, এবং "আমরা ক'জন সঙ্গী"(১৯৮৬), সর্বশেষ ১৬ সংখ্যক কাব্যগ্রন্থের ৩৬ টি কবিতায় "স্বপ্ন" ব্যবহৃত হয় মাত্র ৮ বার। শামসুর রাহমানের ১৬টি কাব্যগ্রন্থের ৬০৬ টি কবিতায় "স্বপ্ন"প্রসঙ্গ কিংবা "স্বপ্নের " প্রায়োগিক ব্যবহার উপস্থাপিত হয়েছে কম-বেশি ৪৬১ বার।
৮। শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বপ্ন ও কল্পনার সংস্থিতি নতুন শিল্পচিত্রেরই Synthesis বিজ্ঞাপিত করেছে। কবিতায় অদৃশ্যমান "স্বপ্ন"কে জীবনবাস্তবতায় তুলে এনে সমাজ,মানুষ,সময়,প্রতিবেশের ক্ষয়িষ্ণু নগর জীবনের আসন্ন ব্যঞ্জনা প্রতীকী উদ্বোধকের আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি ক্রমাগত স্বপ্নকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। সকল স্বপ্নের মধ্যে নগর সভ্যতার স্বপ্ন ও আলোকিত মানুষের স্বপ্ন কবির অন্তর্গত মানবিক মূল্যবোধের মৌলিক কবিসত্তার স্বাতন্ত্র্য ধারাকে প্রকাশ করে। এখানে কবি এক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের নিজস্বতাকে কবিতার ভেতর স্বপ্ন ও কল্পনার মাধ্যমে জীবনের অন্যরূপকে উপগত করতে পেরেছেন। এসকল "স্বপ্ন" কবিতায় বিজ্ঞাপিত হয়েছে তাঁর কাব্যচেতনার প্রণত আদর্শিক অভিযোজন (Adaptation) হিসেবে।
৯। শামসুর রাহমান "স্বপ্ন" দেখেছেন, স্বপ্নকে শিল্পের অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠাপন করে অনুদ্ধত ভঙ্গিতে জীবনকে খোঁজেছেন একটি আদর্শের ভেতর। এ ধারয় "স্বপ্ন"কে সাথি করে এ অভিক কবি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন অস্তিত্ববাদের অনুগামী ধারায় সূক্ষ্ম প্রয়োগের মাধ্যমে যা এলিয়টের কবিতায়ও স্বচ্ছতার সাথে উপস্থাপিত হয়েছে।শামসুর রাহমানের আন্তঃসাহিত্যের প্রতীতি অনুপুঙ্খ চর্চায় যে মৌলিক ভিত্তি ও প্রারম্ভিক উদ্দিপনতা তাঁর কবিতায় সার্বিক দ্যুতিময়তায় প্রযুক্ত হয়েছে।
বৈশ্বিক অনুপ্রাণগত উপলব্ধির ধারায় তাঁর কবিতায় বিনম্র এবং অনুদ্বিগ্ন উপস্থাপন ভৌগলিক সীমাকে অত্যুজ্জ্বলভাবে অতিক্রমেরর প্রয়াস,"স্বপ্ন" কাব্যকলার শিল্পোৎসর্জন,প্রেম-পরিণয় ও নারীর শাশ্বত সত্তার চিরাভ্যস্ত মানবিক উদ্ভাসন,জীবনবাস্তবতায় সুব্যক্ত করে তুলেছেন।
১০। বস্তুত নির্জনতার কবি শামসুর রাহমান নিরন্তর স্বপ্ন দেখেছেন। কবি অনন্তকাল স্বপ্ন শূন্যতায় থাকতে চান নি। বর্ণিক কবি জীবনকে অনুসন্ধান করেছেন স্বপ্নের ভেতর। তাই স্বপ্নকেই আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন বারবার। কবির স্বপ্নের প্রতি যৌক্তিক দুর্বলতা স্বাভাবিক। কবিও যেন তাঁর আত্মার প্রতিকৃতির প্রচ্ছায়াকে স্বপ্নের উপযোগীতায় জীবনবাস্তবতার স্বচ্ছ ক্যানভাসে উপস্থাপন করে কবিতার শৈল্পিক উৎকর্ষের বিভঙ্গকে বিভাবিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কবির নিজেরই উচ্চারণ:
"বলে এ জীবন ভাঙা হাঁটু গেড়ে
বসে গৃহকোণে আর মাথা রাখে
স্বপ্নহীন ক্ষুধিত দেয়ালে"
(কমা সেমিকোলনের ভিড়ে)
১১। বোদলেয়ারের(১৮২১-১৮৬৭) কবিতায় স্বপ্ন এসেছে জীবনের বিমূর্ত ছবিকে মূর্ত করে, কখনো বেদনার নির্যাস নিয়ে,কখনোবা বিপন্ন মানবতার দুঃখময় স্মৃতির বৈচিত্র্যময় স্বাতন্ত্র্যকে মেলে ধরতে।এ ধারায় তাঁর উচ্চারণ:
"Your feet are as slender as your hands, and your hips...
White women with envy...
...Where you floating dreams are full of humming birds and always.
Like yourself, full of grace" (To a Malabar Woman)
অনুবাদ -বুদ্ধদেব বসু
" তোমারই হাতের মতো সুকুমার তোমার পা দু'টি,জঘনে জাগাও ঈর্ষা ব্যক্ত করে
শ্বেতাঙ্গীরর ত্রুটি;...
দাও গা এলিয়ে স্নেহে বারান্দার নরম মাদুরে; পাখির কূজনে পূর্ণ তোমার স্বপ্নেরা ভাসমান এবং পুস্প রূপে নিরন্তর তোমারই সমান।" (কোন মালাবারের মেয়েকে)
১২। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা এলিয়টের কবিতার বিভঙ্গ বিশ্লেষণে লক্ষ করি,তাঁর জীবন-যন্ত্রণা সৃজনশীল মনীষীতার উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছিল।যে বৃত্ত ভেঙ্গে ফেলার ইচ্ছে থেকে যন্ত্রণাকাতর এলিয়ট জীবনবাস্তবতায় কম্পিত অনুধ্যানে খোঁজেছেন জীবনকে,জীবনের মৌলিক সত্যকে।"The Hollow Men"শীর্ষক কবিতায় ওঠে এসেছে জীবনের অসুন্দর চিত্রপট।নিরাশায় বিপর্যস্ত কবি আলোর সন্ধানে বিপন্ন এবং হতাশায় মুহ্যমান,তবুও খোঁজেছেন জীবনসত্যকে,যেখানে বোদলেয়ার,শামসুর রাহমান একই ধারায় অসুন্দরের ভেতর সুন্দরকে অন্বেষণ করেছেন।তাঁর এ কবিতায় Super Natural প্রসঙ্গকে প্রতীকী চেতনায় উপস্থাপনের পাশাপাশি তাঁর স্বপ্নের অদৃশ্যমান সৌন্দর্যের পরিবর্তনে কোন প্রভাবই কার্যকর নয়।যেখানে সৌন্দর্যের পরিবর্তন হওয়া সম্ভব,সে অবস্থান এখন অতিক্রান্ত। কেননা সে পৃথিবীতে চলমান বাস্তবতায় জীবন্ত মনুষের বসবাস।
১৩। যে স্বপ্ন এলিয়ট কলল্পনায় নিয়ে এসে মূর্ত করে উচ্চারণ করেছেন:
"Eyes I dare not meet in dreams
In death's dream kingdom
These do not appear;
There, the eyes are..." (The Hollow Men-1925)
কবিতায় উপস্থাপিত স্বপ্নের দৃশ্যমান পৃথিবী অনেকটাই Occult nameless, বা "Death's dream kingdom". এলিয়টের অস্তিত্ববাদের আড়ালেই নিহিলিস্টিক চেতনার সর্বাত্মক অভিজ্ঞান এ কবিতায় অভিযোজিত হয়েছে। এখানে কবি অনেক সত্য অন্বেষণ করেছেন,হয়তো পেয়েছেন,হয়তো এখানে কিছুই ছিলোনা।কিছুই নেই। "The Hollow Men"কে প্রখ্যাত সমালোচকরা গ্রহণ করেছন"Marks the dead centre in Eliots Poetry" হিসেবে।
১৪। "বিধ্বস্ত নীলিমায়(১৯৬৭) ব্যবহৃত "স্বপ্ন" কবির স্বপনচারী সত্তার উন্মেষ, কবির অজস্র কবিতায় এর বহুমাত্রিক উপস্থাপন,বস্তুত কবিতার আঙ্গিক সৌন্দর্যের শৈল্পিক মূল্যবোধ এবং সাহিত্যিক মূল্যের বিভঙ্গ বিশ্লেষণে শামসুর রাহমানের আধুনিক জীবনমস্কতাকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। ঋষি কবি জীবন আর স্বপ্নের মাঝে যে সমন্বয় তৈরি করেছেন, সেখানে স্বপ্নের ভেতর জীবনের অন্যরূপ খোঁজার পাশাপাশি স্বপ্নহীন মানুষ জীবনকে জয় করতে পারে না এ প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে স্বপ্নের সাথে জীবনের তাত্ত্বিক সম্পর্কের তাৎপর্যকে দার্শনিক চেতনায় স্পষ্টীত করে তুলেছেন। স্বপ্নকে তিনি নান্দনিকতায় নিরন্তর অন্তরে লালন কররেছেন।" স্বপ্নকল্পনাবোধ উজ্জ্বল"। এ স্বপ্নভঙ্গের অভিমানও কবির নিঃসঙ্গতায় শৈল্পিক বৈভবকে দ্যুতিত কররেছে নিঃসন্দেহে।তাঁর কবিতায় বাস্তব সত্যের বিজ্ঞাপিত যৌক্তিক ব্যবহার জীবনঘনিষ্ঠতায় ওঠে আসলেও স্বপ্নই যেন শামসুর রাহমানের শৈল্পিক চেতনার প্রিয় অনুষঙ্গ। কবির কোমল উচ্চারণে সে সুর অনুরণিত হতে দেখা যায়:
"দেখি প্রত্যহ দুঃখের তটে
ভাসে স্বপ্নের রূপালি নৌবহর...
কী করে বাঁচাই স্বপ্নের মায়াতরী?"
(শুধু একটি ভাবনা)
"স্বপ্নহীনতায় সকাল হলো ধূ ধূ
স্বস্তি নেই খাটো মাঠের মুক্তিতে।...
তিনটি সাদা ঘোড়া স্বপ্ন তিনজন।"
(তিনটি ঘোড়া)
বস্তুত কবি শামসুর রাহমান স্বপ্নহীনতায় বাঁচতে চাননি।
১৫। এভাবেই এ ধারায় শামসুর রাহমানের কবিতায় ক্রমাগত ওঠে এসেছে আধুনিক কবিতার সুবিন্যস্ত নান্দনিক অঙ্গবিন্যাস ও 'Texture' এবং 'Perfect impersonal' চেতনার দ্যোতিত বিস্তৃতি। তাঁর স্বপ্ন আলোর ধারায় উদ্দীপ্ত হয়ে শিল্পীর সাথে জীবনের, জীবন ও সৃষ্টির সাথে পাঠকের এক নিবিড় সম্পর্ক বিনির্মাণের সম্ভাব্য প্রেক্ষিতকে প্রত্যাশা করেছে।
এরূপ কিছু দৃশ্য বিষ্ণুদের (১৯০৯-১৯৮২) কবিতায়ও লক্ষ করা যায়।
' তবুও তোমার যাওয়া আসার পথেই
অন্তত এক আধটা স্বপ্ন দিয়ো' (ছত্তিশগড়ি গান)
১৬। স্বাপ্নিক মানুষ আবহমান কাল থেকে স্বপ্নের অতলান্তিক মহিমা প্রায়োগিক জীবনে লালন করে সময়ের বাস্তবতায় বিশ্বাসের সাথে স্বীকার করেছে।এরই নন্দিত প্রতিচিত্র উদ্ধৃত হয়েছে শামসুর রাহমানের 'সম্পাদক সমীপেষু' কবিতায়।
'চেতনপুরে ফুলের চারায় ধরল নতুন কলি
ছেঁড়া জামায়,জুতোর গর্তে করছি স্বপ্ন জড়ো
স্বপ্ন-আভায় স্বর্গ হলো চেনা ময়লা গলি'
শামসুর রাহমান স্বপ্নকে বেঁচে থাকার অবলম্ব হিসেবে প্রশ্রয় দেন নি। কবি জানতেন স্বপ্নের নিমিত্ত শুধুমাত্র যাপিত জীবনে বেঁচে থাকার প্রত্যাশাকে জাগিয়ে রাখে।কবি স্বপ্নের প্রয়োজনকে জীবনের জন্য মেনে নিলেও নিঃশঙ্ক ছিলেন না। তিনি বারবার বিনীত অনুধাবন করেছেন জীবন বাস্তবতায় স্বপ্নের অনাহত স্থিতি অসম্ভব। মানুষের জীবনে প্রবল আবেগ আর বাস্তবতার মাঝখানে স্বপ্নের অবভাস তাঁর মতে সাময়িক। তাঁর কবিতায় স্বপ্নের সাথে মৃত্যু হাঁটে।
রূপকের আড়ালে স্বপ্নের পাশে ব্যবহৃত 'হাঁস' শব্দটি তেমনি মৃত্যুকে ইঙ্গিত করে উচ্চারিত হয়েছে বারবার। পরাবাস্তববাদের সূক্ষ্মচেতনা এই 'হাঁস' মৃত্যু এবং ধ্বংসকে চিত্রকল্পময় করে তুলেছে। নির্দ্বিধায় কবির উচ্চারণ:
'রাস্তার লোকটা সেই তিনটি নিস্তব্ধ হাঁস রেখে চলে গেল...
এখ্খুনি নিয়ে যা তোরা, আমার স্বপ্নের শবগুলি...
(তিনটি হাঁস এবং পিতামহ)
এভাবে অজস্র কবিতায় তাঁর স্বপ্ন এসেছে কখনো কোমল উজ্জ্বল হয়ে, কখনো মৃত্যুচেতনায় পরিবৃত হয়ে। যেমন 'স্বপ্নে দেখি, নৈরাজ্যে অস্থির...
চতুর্দিকে মুণ্ডুহীন মানুষের অখণ্ড স্বরাজ।'(অপচয়ের স্মৃতি)
এরূপ 'স্বপ্ন' আমরা পাশ্চাত্য কবিদের মধ্যেও লক্ষ করি। বোদলেয়ার(১৮২১-১৮৬৭) এর কবিতায় রাজহাঁস প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে পারি। সমকালীন ঐতিহাসিকতাকে 'রাজহাঁসের' প্রতীকী মেটাফর হিসেবে ব্যবহার করে কবিতায় তুলে এনেছেন।
'I saw a Swan who had just escaped from his cage.
Rubbing the parched roadway with his webbed feet.
He was trailing his white plumes on the raw ground. (The Swan,1959-63) কবিতাটি উৎসর্গ করা হয় ভিক্তর উগোকে।
বোদলেয়ারের স্বপ্ন শাসিত কবিতাগুলোর একটি হচ্ছে 'BEAUTY'(1857)
'I am beautiful,
O mortals, as a dream in stone,
And my breast, on which every man has bruised himself in his turn...'
১৭। বস্তুত যে স্বপ্ন শামসুর রাহমানের মগজে খেলা করে তারই কল্পনার বিস্তৃত 'Nostalgic' অনুবৃত্তি জীবন বাস্তবতায় দৃশ্যমান অথচ ক্ষতবিক্ষত। স্বপ্নচারী কবির স্বপ্নপ্রীতি কবিতায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী পারম্পর্যে এক অনন্য স্বাতন্ত্র্যে উপস্থাপিত। 'স্বপ্ন' প্রীতি কবির মগ্নচৈতন্যের স্বাভাবিক এবং মেধাবী পর্যবেক্ষণের উপলব্ধিজাত শিল্পের অনুষঙ্গ, কবিতায় তা বিজ্ঞাপিত এবং ব্যবহৃত সত্য। আমরা নির্দ্বিধতায় মনে করতে পারি স্বপ্নলোকে কবির বিরামহীন বিচরণ তাঁর কবিতার মৌল উৎকর্ষকে পরিমিতিবোধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত শিল্পসফলতার অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। কবির অনুসন্ধিৎসু চিত্ত পরম্পরাগত 'স্বপ্নের' নীল সাঁকো বেয়ে যে পৃথিবীকে খুঁজছে তার অপরোক্ষ পরিচয় 'বিধ্বস্ত নীলিমা'র প্রথম কবিতায় সংস্থিত। শামসুর রাহমানের শিষ্ট উচ্চারণ:
'যেতে চাই, আকৈশোর মগ্নতায়, অতি সন্তর্পণে
স্বপ্নের নীলাভ সাঁকো বেয়ে
কবিতায় অন্তঃপুরে যেতে চাই।' (কবিতার অন্তঃপুরে)
১৮। শামসুর রাহমানের কবিতায় সংশ্লেষিত চিত্রকল্প ইহুদি চিত্রকর শাগাল(১৮৮৭-?)এর পরাবাস্তববাদী চিত্রকর্মেরই বিষয়রূপ।এধারায় শামসুর রাহমানের কবিতায় পরাবাস্তববাদের চিত্র বিদ্যমান সত্য। বস্তুত স্বপ্ন ও বাস্তবের সরল সমীক্ষণের ক্ষেত্র হলো মগ্নচৈতন্য। কিন্তু সকল অবস্থায় প্রেক্ষিত বিবেচনায় কবির মগ্নচৈতন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রায় উদ্দীপিত হতে পারেনি। তবে তাঁর কবিতায় জীবনবাস্তবতার নির্দিষ্ট ও কঠিন অনুষঙ্গগুলোর শৈল্পিক বৈভব সমুচ্চতায় বিঘোষিত হতে দেখা যায়। তাঁর কালজয়ী কবিতার পঙক্তিতে বিজ্ঞাপিত হয় স্বপ্ন-বাস্তবতার অবিরোধ দৃশ্যমান প্রতিচিত্র। চলমান সংবেদনশীল মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপাকে স্বপ্ন আর কল্পনা হয় পরাজিত। শামসুর রাহমান তাঁর কাব্যের শিল্পোৎকর্ষের সমুদ্ভাসকে মননযোগ্য করে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে পরিমার্জিতকরণের মাধ্যমে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর কবিতায় 'স্বপ্ন' এসে নন্দিত শিল্পের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে নিঃসন্দেহে। তাঁর এক অনিন্দ্য উচ্চারণ:
"যেতে চাই... স্বপ্নের নীলাভ সাঁকো বেয়ে,
'কী যেন পুড়ছে ভয়ানক,...সভ্যতার বিশ্বস্ত দলিল হয়তোবা।'
'আমি বটে এক জাতস্বাপ্নিক স্বপ্নের ঘোরে
মায়াজাল বুনি বন্ধ ঘরে।' " (মধ্যজীবনের বৃত্তান্ত)
১৯। এ স্বপ্নদ্রষ্টা কবি 'স্বপ্ন'কে ভালবেসে বলতে পেরেছেন "স্বপ্ন অভিভাবকের মতো আমার জীবনে। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি।" কবি যেন এ স্বপ্নের অতলান্তিকতায় অদৃশ্যমান বিস্তৃতি থেকে তারুণ্যের স্বপ্নময় সত্তা ধারণ করে পৌঁছে গেছেন ইতিহাস-ঐতিহ্য ও দীপ্তোজ্জ্বল সভ্যতা আর সংস্কৃতির জগতে, যেখানে ঋষির স্বপ্নই কবিতাকে শাসন করতে নির্দ্বিধ ছিলো।
২০। আমরা মনে করি তাঁর স্বপ্ন মূলত কবিতার শিল্পসত্যের সাথে জীবনঘনিষ্ঠতায় বাস্তব সত্যের সংমিশ্রণ। 'স্বপ্নকল্পনাবোধ' এবং বাস্তবসত্যের উপলব্ধি জীবনসত্যের দৃশ্যমান ও লব্ধ অনুধ্যান তাঁর কবিতায় স্বাতন্ত্র্য অভিযাত্রায় শৈল্পিক সৌধ বিনির্মাণ করেছে।
বস্তুত শামসুর রাহমান এ ধারায় সমকালের একজন দ্যোতিত সত্তার আলোকিত এক প্রধান কবি।যাঁর কবিতায় 'স্বপ্নবিহার ও প্রতিবেশ-চেতনা' যুগপৎ শৈল্পিক বিভায় উদ্ভাসিত।
(দ্র. প্রবন্ধটি তুলনায় বড় হয়ে যাওয়ায় তথ্যসূত্র সংযুক্তি করা গেলো না।)
ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ
শ্রীমঙ্গল, বাংলাদেশ
-
নিবন্ধ // মতামত
-
24-10-2020
-
-
অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪