উত্তরণ - জয়তী চক্রবর্তী
সুব্রতার রোজ বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায় কিছু করার নেই অফিস শেষে সংসারের বাজার সেরে প্রত্যেক জনের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্র ওষুধপত্র কিনে তারপর বাস ধরে বাড়ি আসতে দেরী হয়ে যায়। ঘরে ঢুকে দেখে শ্বশুরমশাই এর গম্ভীর মুখ, শাশুড়ির নানা ধরনের অভিযোগ অনুযোগ তার সাথে একমাত্র ছেলে বিতানের চলে যাওয়া নিয়ে বিলাপ যা ক্লান্ত সুব্রতাকে আরও ক্লান্ত করে তো। একমাত্র মেয়ে নহলী শুধুমাত্র বোঝে মাকে তাই একাদশ শ্রেণী পাঠরতা নহলী যখন এক কাপ গরম চা এনে হাজির হয় তখন সব দুঃখ ক্লান্তি উড়ে যায় সুব্রতার তাই চায়ে চুমুক দিয়ে শ্রান্ত মনকে সুস্থ করে রাতের বাকি কাজ সামলে খাওয়া দাওয়া সেরে মেয়ের সাথে বিছানায় গিয়ে চলে যায় ঘুমের দেশে। সুব্রতা স্বপ্ন দেখে কোথায় যেন বেড়াতে যাচ্ছে ওরা সবাই। সে তার শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে ট্রেনে যেই চেপেছে সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন ছাড়ে গাড়ি আর চাপতে পারে না বিতান, দৌড়াতে থাকে গাড়ির পেছনে পেছনে এবং এক সময় মিলিয়ে যায় সে, হাত বাড়িয়ে ও ধরতে পারে না সুব্রতা। বিতান মিলিয়ে যেতেই বিছানায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতেই সম্বিত ফিরে পায় মনে পড়ে যায় বিতান তো আর নেই তাদের সাথে। এই কঠিন বাস্তব জীবনে সে থেমে গেছে অনেক আগেই শুধুমাত্র ফটো হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দেওয়ালে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সুব্রতা ভাবে তাকে থমকে দাঁড়ালে চলবে না, স্বয়ং যমরাজ এলেও ফিরিয়ে দিতে হবে। একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ এখন তার তত্ত্বাবধানে তাই শুয়ে পরে আবার কিন্তু ঘুম সে তো আসতেই চায় না আর ক্লান্ত মন চলে যায় সুদূর অতীতের দিকে-
গরীব ঘরের মেয়ে হলেও ওরা ভদ্র পরিবার। তিন বোনের মধ্যে ওই ছিল বড় তবে সুন্দরী না হলেও তিন জনেই সুশ্রী। বাবা সে রকম স্থায়ী কাজ কিছু না করলেও মায়ের সাথে তিন বোন পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সেলাই এর কাজ করে সংসারটা কোনমতে চালাতো। পৈতৃক বাড়ির একটা ছোট্ট দুই কামরার অংশ বাবা ভাগে পেয়েছিল তাই রক্ষে। যাইহোক পাঁচজনের এই সংসারে অভাব থাকলেও শান্তি ছিল আর মায়ের চিন্তা ছিল একটু উপযুক্ত ছেলে পেলেই এক এক করে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া। সেই ভাবনা মতনই আত্মীয় স্বজনদের সহযোগিতায় বিতানের মতন ভালো ছেলে পেয়েও যায়। বিতানদের বাড়ি থেকে একটু তাড়া ছিল কারন ওর ঠাকুমা একমাত্র নাতির নাত বৌ দেখে তারপর ওপারে যেতে চান, সেইমতন মিতভাষী সুব্রতার বিয়ে হয়ে যায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার আগেই। সাধারণ ঘরে যেরকম শ্বশুর বাড়ি হয় সেরকমই পেয়েছিল সে, নতুন কোনো গল্প ছিল না তবে বিলাসিতা না থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল আর যেটার অভাব ছিল না তা হলো পেট ভরে ভাতের। শাশুড়ি নিজের করেই নিয়েছিল তাকে সুব্রতার পড়াশোনার দিকটা তিনি স্নেহের চোখে দেখেছিলেন বলেই বিয়ের পর শুধু মাধ্যমিক পরীক্ষাই নয়, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও পাশ করেছে। সেই সময়ই চলে এলো নহলী তাদের একমাত্র আদরের কন্যা। এরপর দুটো বছর শান্তিতেই ছিল ওরা, তারই মাঝে চলে যায় বিতানের ঠাকুমা যিনি শুধু নাতির বিয়ে দেখেই যান নি, দেখে গেছেন নাতির কন্যাকেও। জীবন কখনও মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী চলে না সুব্রতারও না তাই ভাবতেই পারেনি সুস্থ মানুষ অফিসে গিয়ে ফিরে আসবে না। অফিসে গিয়ে বিতান বুকে ব্যাথা নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে সহকর্মীরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় আগেই সব শেষ, তার সাথে শেষ হয়ে যায় সুব্রতার নিজের ভালো থাকার দিনগুলো। বাড়ির চরিত্রগুলো একটু একটু করে বদলাতে থাকে সেটাই স্বাভাবিক কারণ বিতান তাদের একমাত্র সন্তান। বিতানের অফিস পাশে না দাঁড়ালে অন্ধকারে তলিয়ে যেত সে। সকলের একান্ত চেষ্টায় ঐ অফিসেই একটা কাজ হয়ে যায় সুব্রতার। এই কাজ আর নহলীর জন্যই বোধহয় এখনও বেঁচে আছে সে।
সকালে মেয়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো সুব্রতার। নহলীই এখন তার একমাত্র বন্ধু তাই দুঃখ সুখের সব কথাই দুইজনে দু'জনকে প্রাণ খুলে বলে আনন্দ উপভোগ করে। আজ রবিবার কাজেই কোনো কাজের বিশেষ তাড়াহুড়ো নেই তাই শাশুড়ি মা ও শ্বশুরমশাইকে চা দিয়ে মেয়ের ও নিজের চা নিয়ে বারান্দায় বসলো দু'জনই। বিতানদের এই ছোট্ট বাড়িটা বিতানের বাবা বানিয়েছিলেন চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর। সামনে ছোট্ট একটু বাগান, সেই দিকে তাকিয়ে গরম চা-তে চুমুক দিয়ে গত রাতের স্বপ্নের কথাটা মেয়েকে বললো সুব্রতা। এবার বলতে একটু দ্বিধা বোধ করছিল কারন এই ভয়ঙ্কর স্বপ্নদৃশ্য যতবার দেখা দেয় তার জীবনে ততবারই সে বলে ওকে। নহলী বড়ো হয়েছে মায়ের অবস্থা বোঝে সবই, কতই বা বয়স ছিল মায়ের যখন বাবা চলে যায়, তাহলে কী মা বাবাকে আজও ভুলতে পারেনি না কী অন্য কিছু-। যাক সে কথা, নহলীর তো বাবাকে মনেই নেই, মা-ই তার বাবা মা সব। তাদের কথা ভেবে মা তো অন্য কোথাও বাঁধা ও পরেনি তবে কেন মা একই স্বপ্ন প্রায়ই দেখে। চা খেতে খেতে আরেকটা ভাবনা আসে নহলীর মা কী তবে একাকীত্বে ভুগছে। মানুষ যতদিন পৃথিবীতে থাকার অধিকার পায় সে চায় আনন্দে থাকতে কিন্তু সেটা যদি না থাকে তবে আর কিছু ভাবতে পারে না সে। তারপরও একটা দুশ্চিন্তা থেকে যায় তার মনে সে ও একদিন উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরে যেতে পারে তখন মায়ের কী হবে, দাদু ঠাকুমা চিরদিন থাকবে না।
কালের প্রবাহে দেখতে দেখতে কেটে যায় নিম তেতো দিনগুলো। একে একে চলে যায় সুব্রতার শ্বশুর শাশুড়ি। সেদিনের একাদশ শ্রেণীতে পড়া নহলী আজ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে বাইরে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। এই বাড়িতে সে হয়তো আর দু’মাস কিন্তু মায়ের ভাবনাটাই তাকে খুব ভাবাচ্ছে। একা একা কী করে থাকবে মা তার মধ্যে মায়ের সেই স্বপ্ন তাকে ও অসহায় করে তুলছে। অতি সাধারণ পরিবারের অতি সাধারণ কাহিনী হয়তো এটাই হয়। পাঠক পাঠিকারা এই কাহিনী জানে তা-ই এই গল্প তারা শুনতে চায় না যতক্ষণ না গল্পের মধ্যে অসাধারণত্বর আস্বাদ গ্রহণ করতে পারে। সেই ঘটনাই ঘটিয়েছিল গল্পের মধ্যচল্লিশের নায়িকা সুব্রতা।
নিজের জন্য এবার কিছু করা বা নিজের কথা এবার একটু ভাবা দরকার একথা বুঝেছিল সে নহলীর বাইরে চলে যাবার দিন স্থির হবার পর থেকেই কিন্তু কীভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে সেটাই বুঝতে পারতো না আর তার সাথে একটাই ভাবনা এই ফাঁকা ঘরে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব।
একরাতে আবার ঘুমের মধ্য দিয়ে সেই পুরনো স্বপ্ন বার হয়ে আসে তবে এবারে একটু ভাবে সেই ট্রেনে সে ও নহলী ওঠে আর চলন্ত ট্রেনে তারই হাত ধরে ওঠে একজন তবে এতটাই আবছা যে সে বিতান না অন্য- সেটাই বুঝতে পারছিল না। একটা হতাশা কেমন করে যেন তার চারিদিকে ঘিরে ধরছিল। রোজকার নহলীর কাছে স্বপ্নের এই পরিবর্তনের কথা জানাতেই বুদ্ধিমতী কন্যা বুঝতে পারলো সবটা। মা যে আর একা থাকতে চায় না সেটা বুঝতে বেশী সময় নেয়নি সে। নিজের কাজকর্মের সাথে সাথে খুঁজতে থাকে মায়ের স্বপ্নের দেখা মানুষটিকে। কিছুদিন পরিশ্রমের পর খুঁজে পায় সেই মানুষটিকে নিজের ঘরে খবরের কাগজ রাখার টেবিলের নীচটাতে তবে ভদ্রলোককে নয়, তার বিঞ্জাপন যার উপর লাল কলমে গোল করে দাগ কাটা। কাগজগুলো গুছিয়ে রাখতে গিয়েই চোখে পরে নহলী- বিপত্নীক বয়স ৫৪, একা থাকেন, সরকারি কাজে নিযুক্ত মানুষটির একটি বন্ধু বা সাথীর দরকার অবশ্যই বৈধতার সাথে অর্থাৎ সম্মানের সাথে বিয়ে করে- এই বিঞ্জাপনটা মা-ই প্রথমে দেখেছিল খবরের কাগজে তাই হয়তো চেতনার অন্তর থেকে মায়ের মনে উদ্বেলিত হয়েছিল এক বাসনা। ক্লান্তিতে ভরা এই একাকী জীবনে তারও প্রয়োজন এক সাথীর এতে অন্যায় তো কিছু নেই। লজ্জায় হয়তো বলতে পারেনি নহলীকে।
নহলী তার কাজ করেছিল অর্থাৎ নিজ দায়িত্ব পালন করতে এতটুকু পিছিয়ে যায়নি। বাইরে পড়তে যাবার আগেই মায়ের সেই স্বপ্নে দেখা বন্ধুর সাথে নতুন সম্পর্কের বন্ধনে বেঁধে উত্তরণ ঘটিয়েছিল মায়ের স্বপ্ন। প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের অপ্রীতিকর মন্তব্যতে কান না দিয়ে এক নারী দিয়ে গেল আর এক নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান যা এক সময় কোনো ভাবেই পেতো না অতি সাধারণ নারী বিধবা হলে তো নৈব নৈব চ।
জয়তী চক্রবর্তী। পশ্চিম বর্ধমান
-
গল্প//উপন্যাস
-
26-10-2020
-
-