অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
হেমন্ত ঋতু ও বাংলা সাহিত্যে হেমন্তের প্রভাব - আলী রেজা

 য় ঋতুর বাংলাদেশ। হেমন্ত একটি ঋতু। বিশেষ রূপ-লাবন্য আর স্নিগ্ধতায় ভরা প্রকৃতি উপহার দিয়ে হেমন্ত আমাদের প্রেয়সী ঋতু হয়ে ওঠেছে। হেমন্ত আসে শরতের পরে। শরৎ প্রকৃতিতে যে সৌন্দর্যের সুচনা করে হেমন্ত সে সৌন্দর্যের পূর্ণতা দান করে। এই পূর্ণতা বাঙালির ঘরে ঘরে আনন্দ বয়ে আনে। বিশেষ করে বাংলার কৃষকের আঙিনা ভরে দেয় সোনালি শস্যে। তাই বলা যায় ‘ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি’ নিয়ে আসে হেমন্ত। হেমন্তের আবেশ ও আমেজ তাই মানবমনকে পুলকিত, আন্দোলিত ও আশান্বিত করে। হেমন্ত শুধু একটি ঋতু বা কালপর্ব নয়। এ হচ্ছে পূর্ণতা ও স্বচ্ছলতার শুভাগমন। হেমন্ত ফসল তোলার ঋতু। কৃষাণ-কৃষাণীর দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে মাঠের ফসল ঘরে আসবে। ফসলের গন্ধে ভরে উঠবে সারা বাড়ি। কন্যা-জায়া-জননীর ব্যস্ততা দিনরাত। আর  উঠোনে ছড়ানো সোনালি ধান । সাথে আনন্দের বন্যা। সাথে ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব। কৃষকের স্বচ্ছলতার হাসি নিয়ে আসে এই হেমন্ত। হেমন্ত শুধু সোনালি শস্যে কৃষকের ঘর ভরে দেয় না; সাথে সাথে ভরে দেয় কৃষাণ-কৃষাণীর হৃদয়। হৃদয় ভরে ওঠে অনাবিল নৈসর্গিক আনন্দে। 
     পূর্ব ঋতু শরৎ কাশফুলের শুভ্রতা ও হালকা শিশিরের কোমলতা দিয়ে ব্যক্তির মানস গঠন করে। আর হেমন্ত সেই মানসে এনে দেয় পূর্ণতা। এই পূর্ণতা প্রেম, ভালবাসা, আবেগ ও উচ্ছ্বাসের পূর্ণতা। তাই বলা যায় শরতে-হেমন্তে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষক যখন হেসে ওঠে তখন পুরো বাংলাদেশ হেসে ওঠে। বাংলার কৃষকের উঠোন-আঙিনা যখন সোনালি শস্যে ভরে যায় তখন পুরো বাংলাদেশ স্বচ্ছলতায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তাই আমরা অপেক্ষায় থাকি হেমন্তের। গ্রামীণ বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে হলে আমাদের দেখতে হবে শরৎ-হেমন্তের রূপ।
     ঋতু পরিক্রমায় হেমন্ত আসে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস মিলে। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত সাজিয়ে তোলে সোনার বাংলাকে। কত কবির কত কবিতা, কত শিল্পীর কত গান এই হেমন্ত নিয়ে। আর এই সব কবিতা ও গানে আমাদের প্রাণের সুর বেজে ওঠে। আমরা প্রাণিত হই বাংলার রূপ বর্ণনার কাব্য ও গানে। আমাদের নিসর্গ ও নির্জনতার কবি, রূপসী বাংলার পথঘাট আর জলাঙ্গীর কবি জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর পর আবার দ্বিতীয় জীবন নিয়ে এই বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছেন। বিভিন্ন রূপে দেখতে চেয়েছেন বাংলার রূপবৈচিত্র্য। তবে তিনি অবশ্যই ফিরে আসতে চেয়েছেন হেমন্তে। এই ‘কার্তিকের নবান্নের দেশ’ই যেন কবির কাঙ্ক্ষিত বাংলা। তাই বাংলা আর হেমন্ত- এ দুয়ের সখ্যতা যেন আবহমান কাল ধরে। 
     আবহমান কাল ধরে বাংলার কৃষক প্রকৃতির বৈরী আচরণকে সহ্য করে টিকে থাকে। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরায় তছনছ হয়ে যাওয়া অনেক সাধের ফসলের মাঠটিকে আবার ফুল-ফসলে সাজিয়ে নেয় বাংলার কৃষক। হেমন্ত সে সুযোগ এনে দেয় কৃষকের জীবনে। ফসলের গন্ধে বিভোর করে দেয় কৃষকের মন। শুধু কৃষক নয়। কৃষকের সঙ্গে জেগে ওঠে সারা বাংলাদেশ। বাঙালিমাত্রই মুগ্ধতায় মোহিত হয়ে ওঠে ফসলের গন্ধে। ফসল বাঙালিকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। ফসল বাঙালিকে উল্লাসে মেতে উঠার শক্তি জোগায়। ফসল বাঙালিকে হাসতে শেখায়। ফসল বাঙালিকে ভালবাসতে শেখায়। আর হেমন্ত বাঙালিকে এই ফসল ভরা মাঠ উপহার দেয়।
     ফসলভরা মাঠের হাসি দেখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবেগে উদ্বেলিত হয়েছেন। সুর ও ছন্দে আন্দোলিত হয়ে উঠেছে কবিগুরুর হৃদয়। হেমন্তের ফসলভরা মাঠ কবিকে মোহিত করেছে। তাই কবির কাব্যভাষার প্রকাশ : ‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি/ আমি কী দেখেছি মধুর হাসি সোনার বাংলা...।’ অগ্রহায়ণ বা হেমন্তের ফসলভরা ক্ষেতে যে মধুর হাসি কবিগুরু দেখেছেন সে হাসি আসলে বাংলা মায়ের হাসি। প্রতিটি বাঙালির হাসি। এ হাসি বাধভাঙ্গা। এ হাসি নৈসর্গিক। এ হাসি চিরন্তন। কবিগুরুর সংগীতের এই পংক্তিই বলে দেয় হেমন্ত বাঙালির জীবনে দারুণ সুখ, সমৃদ্ধি ও স্বচ্ছলতার বার্তা নিয়ে আসে। হেমন্তের প্রকৃতি একটি পূর্ণরূপ নিয়ে হাজির হয় বাংলায়। গ্রীস্ম ও বর্ষা জীবনকে প্রায়ই অতীষ্ট করে তোলে। জীবনের ছন্দপতন ঘটায় প্রতিনিয়ত। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অস্থির করে দেয় মন। ঝড়-বন্যার কবলে পড়তে হয় মাঝে মাঝেই। বাংলার কৃষকের আতঙ্কের সীমা থাকে না। তখন শরৎ আসে সুখের বার্তা নিয়ে। তারপর হেমন্ত আসে। সুখে ভরিয়ে দেয় জীবনকে।
   ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা...’। কবি কল্পনার এ বসুন্ধরা আসলে হেমন্তের এই বাংলা। কারণ হেমন্ত ধনধান্য আর পুষ্পে ভরে দেয় বাংলার মাঠ-ঘাট প্রান্তরকে। শরতে গজিয়ে ওঠা উদ্ভিদ হেমন্তে ডানা মেলে, রূপ ছড়ায়। শুধু মাঠভরা ফসল নয়, বাড়ির উঠোন-আঙিনা ও আশপাশ ভরে ওঠে নানা রঙের ফুল আর শাক-সব্জিতে। তখন পল্লী জননীর সে কি রূপ! এই রূপ দেখেই হয়তো কবি লিখেছেন ‘ এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী।’ কিংবা  

হায়রে আমার মন মাতানো দেশ
হায়রে আমার সোনাফলা মাটি
রূপ দেখে তোর যেন আমার হৃদয় ভরে না
তোরে এতো দেখি তবু আমার পরান ভরে না।

     হেমন্তের প্রকৃতি অপূর্ব মায়াময়। এ প্রকৃতি শুধু মানব হৃদয়ে আনন্দের বান ডেকে আনে না। এ প্রকৃতি জীববৈচিত্র্যের আধার। এ সময় পাখিরা নির্ভয়ে বাসা বাঁধে গাছের ডালে। প্রজাপতি রঙিন ডানা মেলে উড়ে চলে ইচ্ছেমতো। নানা রঙের ফড়িং উড়ে চলে। বসে ডালে ডালে। আনন্দ দেয় শিশু-কিশোর মনে। দোয়েল-শালিকের অবাধ বিচরণ দেখা যায় ডালে ডালে, ফসলের মাঠে, কৃষকের আঙিনায়। হেমন্ত সকলের জন্য নিশ্চিন্ত নির্ভরতার ঋতু। ঝড়-বৃষ্টি নেই; নেই প্রচণ্ড তাপদাহ। এতো সহনীয় সময় অন্য কোন ঋতু আমাদের জন্য নিয়ে আসে না। হেমন্তের গোধূলিলগ্ন যেন এক মায়াময় মুহূর্ত। দিনাবসানের এই দৃশ্য কবিমনকে আন্দোলিত করে, প্রেমিক মনকে জড়িয়ে দেয় সুখের আবেশে। তাই হেমন্তের প্রকৃতি রূপ-মাধুরী আর প্রেম-প্রণয়ের অনাবিল আবেশ নিয়ে হাজির হয় এই বাংলায়।
     হেমন্তের আর একটি দৃষ্টিনন্দন, আমোদ আর সামাজিক সৌন্দর্যের বিষয় হলো এর বহুমাত্রিক চিরায়ত লোকজ উৎসব। উৎসবগুলো আবহমান বাংলার চিরকালীন মানবিক সম্পর্কের ধারক ও বাহক। এই লোকজ উৎসবগুলো জ্ঞাতি সম্পর্কের বন্ধন অটুট করে আর সামাজিক সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করে। উৎসবগুলো বাঙালি জাতিস্তত্বার পরিচয়বাহী এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক জীবনের খোড়াক। নবান্ন উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। এটা শুধু কৃষি পরিবারের বিষয় নয়। এটা গ্রামীণ বাংলার একটি সামাজিক উৎসব। বাঙালির ঐতিহ্য বলে এ উৎসব এখন গ্রামীণ জনপদের সীমা অতিক্রম করে শহরে প্রবেশ করেছে। নবান্ন উৎসব কোন বিশেষ দিনের বিষয় নয়। নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দের বহির্প্রকাশ এই নবান্ন উৎসব। যৌথ পরিবারের নাড়ী ছিড়ে যারা জীবিকার তাগিদে শহরে বাস করছে তারাও নাড়ীর টানে ফসলের একটু গন্ধ নেওয়ার জন্য, ছেড়ে যাওয়া পরিবারের লোকদের একটু হাসিমুখ দেখার জন্য ছুটে আসে গ্রামে। নানা নানি আর দাদা দাদিরা আয়োজন করে নানা স্বাদের বাহারি পিঠা। শিশুরা তাদের শেকড় খুঁজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। ইষ্টি কুটুমরা চলে আসে দাওয়াত পেয়ে। এ সবই হেমন্তের মায়াময় প্রকৃতির অবদান। 
     হেমন্তে শিশু-কিশোরদের মধ্যে পড়ে যায় খেলাধুলার ধুম। নানা লোকজ খেলায় মেতে ওঠে শিশু-কিশোরের দল। শরৎ- হেমন্তের শান্ত স্থির আর ঝির ঝির বাতাসবাহিত আকাশে নানা রঙের ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ করে সবাই। গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, লুকোচুরি- আরও কত নাম না জানা বানানো খেলা। ফড়িং আর প্রজাপতির সাথে শিশুদের মিতালি। এ যেন এক ভিন্ন জগৎ। ফসলের গন্ধে মোহনীয় আবেশ মাঠে মাঠে। রবীন্দ্রনাথ তাই হেমন্তের আর এক নাম দিয়েছেন শস্যলক্ষ্মী। আর এই শস্যলক্ষ্মী হেমন্ত সুখ, সমৃদ্ধি আর আনন্দের অমৃতধারার সুধা ঢেলে দিয়ে লাজুক বধুর মতো শীতের কুয়াশায় ঘোমটা টেনে বিদায় গ্রহণ করে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষায় :

হায় হেমন্ত লক্ষ্মী তোমার নয়ন কেন ঢাকা
হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূসর রঙে আঁকা।

আলী রেজা
কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ