অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
গাল-গল্প (০১) - কবির চৌধুরী

 

 ছর আট আগে এক তুষারময় সন্ধ্যায় বন্ধুবর আব্দুল মান্নান মিঠু এবং আমার প্রিয় কবি, সুলতানা শিরিন সাজির বাসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনার জন্যে আমরা কয়েকজন সমবেত হয়েছি। ফেব্রুয়ারি মাস, আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের মাস। কিছুদিন আগে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে অটোয়া থেকে বাংলা জার্নাল ‘আশ্রম’ প্রকাশিত হয়েছে। নতুন আশা- নতুন উদ্দীপনা। সেই উদ্দীপনা থেকেই বিশেষ করে বন্ধুবর আব্দুল মান্নান মিঠুর পীড়াপীড়িতে ‘আশ্রম’-এর পক্ষ থেকে ‘মহান মাতৃভাষা দিবস’ পালন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানটিকে সুন্দর করার জন্যই সেদিনের সেই আলোচনার আয়োজন। আলোচনার শেষে আমরা যখন যার যার বাসায় চলে যাচ্ছি তখন আমার এক সুহৃদ বলেন- ‘পত্রিকা প্রকাশ করছেন ভাল কথা, তবে একটি কাজ করবেন-নিজে কখনও কোন কলাম লিখবেন না।’       


সেদিন সন্ধ্যায় সম্পাদক-প্রকাশক হিসেবে লেখালেখি নিয়ে সুহৃদ বন্ধুবরের সাথে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। তাঁর কথার মধ্যে যুক্তি ছিল। বন্ধুবরের কথা ছিল, সম্পাদক-প্রকাশক অনেক সময় তাঁর মতামতটি পাঠকের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। তাঁহার কথা আমি রাখতে পারিনি। বিভিন্ন কারণে গত আট বছরে বহুবার আমি আমার প্রিয় কলাম ‘গাল-গল্প’ লিখেছি। আমার যুক্তি ছিল- এই প্রবাসে অনেক লেখকই আছেন যারা গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখেন কিন্তু লৌকিকতার কারণে চোখের সামনে সংঘটিত বিষয় আসয় নিয়ে সরাসরি কিছু লিখতে চান না। তবে তাঁহারা তাঁদের সৃষ্টি গল্প উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের এসব অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেন।        

প্রায় চার দশক থেকে কানাডায় আমরা নতুন আবাসভূমি তৈরি করছি, আমরা সবাই চাচ্ছি আমাদের এই নতুন আবাসভূমি যেন আমাদের মনমত হয়, সুন্দরভাবে বসবাস যোগ্য হয়। সব সমাজেই সব সময় ভাল জিনিষের সাথে খারাপ জিনিষের সংমিশ্রণ হয়। সেটাই স্বাভাবিক। ভালোর সাথে খারাপের এই মিশ্রণকে রুখতে পারে একটি পত্রিকা। একটি ভাল কলাম। আমরা যদি দশক দেড়েক আগের কানাডা থেকে বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় ‘সাপ্তাহিক দেশে বিদেশে’-এর নজরুল ইসলাম মিন্টুর ‘টরন্টোর চালচ্চিত্র’ পড়ি তাহলে সেই সত্যটাই দেখতে পাই। কানাডায় নতুন গড়ে উঠা বাঙালি সমাজে নজরুল ইসলাম মিন্টুর ‘সাপ্তাহিক দেশে বিদেশে’ পত্রিকা এবং তাঁর লেখা ‘টরন্টোর চালচ্চিত্র’-এর ভূমিকা অতুলনীয়।   

টরন্টো এবং মন্ট্রিয়লের মত অটোয়াতেও এখন প্রচুর বাংলাদেশিদের বসবাস। হিসেব করলে হাজার সাত তো হবেই। আমরা সকলেই নিজের মতো করে আমাদের দ্বিতীয় আবাসভূমি তৈরি করছি। আমাদের এই গোছানোকে যদি খুব কাছ থেকে সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়, তা হলে দেখা যাবে ধীরে ধীরে আমরা আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আর এই দূরে সরে যাওয়ার লক্ষণগুলো একজন লেখক খুব পরিষ্কারভাবে দেখতে পারেন। যেমন দেখেছিলেন উত্তর আমেরিকার পাঠকনন্দিত লেখক ড. মীজান রহমান। আমাদের এই জীবন সংগ্রামের দেখা না দেখা অতি প্রয়োজনীয় কিছু বাস্তব সত্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ডরভয়হীন ভাবে লিখে গেছেন।   

প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে অটোয়া থেকে কয়েকটি গল্প কবিতা দিয়ে প্রকাশিত ‘আশ্রম’-এ এখন অনেকেই লিখতে উৎসাহি নন। বিশেষ করে স্থানীয় বিষয় আসয় নিয়ে। তাই বাধ্য হয়েই আমাকে আবার আমার প্রিয় কলাম ‘গাল-গল্প’ লিখতে কম্পিউটারের কীবোর্ডের কীগুলোতে আঙুল রাখতে হল…  

কবির চৌধুরী
অটোয়া, কানাডা
১৯-১০-২০১৭
ashram@live.ca