অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
নজরুলকাব্যে গণচেতনা: একটি সমীক্ষা - আলী রেজা

সাহিত্যে গণচেতনার প্রতিফলন ঘটে স্বাভাবিক নিয়মেই। কারণ একজন সাহিত্যিক তাঁর লেখার শক্তি দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন। সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন সার্থক করতে হলে লেখায় থাকতে হয় গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। তাহলেই সাহিত্য সমাজকে পাল্টে দিতে পারে। কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯- ১৯৭৬) তাঁর কাব্যসাহিত্যে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাই গণচেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর কাব্যভাণ্ডার। নজরুলকাব্য গণচেতনায় উদ্ভাসিত হয়েছে একটি বৈরী সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনলে দেখা যায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে সংঘটিত রুশ বিপ্লব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রেরণা জোগায়। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান নিয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রামের পথ প্রশস্ত হয়। এ সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে তাত্ত্বিক ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের বৌদ্ধিক নেতৃত্ব দেন দার্শনিক কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫)। বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের এ সংগ্রাম বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ নামে প্রচারিত হতে থাকে।
     অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঞ্চিত শ্রেণি যখন একত্রিত হয় তখন তাদের মধ্যে এক ও অভিন্ন চেতনা দানা বাঁধতে থাকে। এই অভিন্ন চেতনাই গণচেতনা। গণচেতনা সব সময়ই রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হওয়ার প্রেরণা জোগায়। বাংলাসাহিত্যে এই গণচেতনার মশাল জ্বালিয়েছেন অনেকেই। তবে কাজী নজরুল ইসলাম ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বতন্ত্র। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক- সকল যুগেই দুর্বলেরা সবলদের দ্বারা নির্যাতিত ও শোষিত হয়েছে। তাই সকল যুগেই শ্রেণিসংগ্রাম ছিল। মানবসভ্যতার ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামেরই ইতিহাস। ব্রিটিশ ভারতে কোম্পানির শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের ফলে কৃষক-শ্রমিক-সিপাহী-জনতার বহু বিপ্লব ও বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ব্রিটিশবিরোধী এ সব আন্দোলন-সংগ্রাম ভারতীয় জনগণের মনে এক গণচেতনার জন্ম দেয়। এই গণচেতনাই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মুক্তির মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে। গণচেতনাকে একটি লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করার জন্য ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। পরবর্তীতে গণচেতনার আর একটি ভিন্ন ধারা হিসেবে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় মুসলিম লীগ। প্রথমদিকে শাসকশ্রেণির তাবেদারি করার ফলে এ দুটি রাজনৈতিক সংগঠন গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হলেও জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যৌথ আন্দোলনের মুখেই ১৯৪৭ খিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার অখণ্ড ভারতবর্ষকে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত করে দিয়ে চলে যায়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সেই অগ্নিঝরা কালপর্বে বাংলাসাহিত্যে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম।সাহিত্যের মাধ্যমে কবি নজরুল রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির মন্ত্র শোনান। শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষকে প্রতিবাদমুখর করে তোলেন। নজরুলকাব্যের শ্রেণিচেতনা গণমানুষকে উজ্জীবিত করে তোলে। নজরুলের বিদ্রোহী বাণীর ঝঙ্কারে উজ্জীবিত হয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বলেন :‘ আমরা যখন যুদ্ধে যাবো, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো, তখনও তাঁর গান গাইবো।’
     বাংলাকাব্যে গণচেতনা বা মানবসংলগ্নতার বলিষ্ঠ বাণী উচ্চারিত হয়েছিল চণ্ডীদাসের সেই অমর পংক্তিতে- ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ চণ্ডীদাসের এই মানবতাবাদী মন্ত্রবাক্যের পথ ধরে বাংলাকাব্যে গণচেতনার একটি গতিপথ তৈরি করলেন নজরুল। তিনিও বলিষ্ঠ ভাষায় উচ্চারণ করলেন- ‘ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেও গণচেতনার স্রোতে সামিল হতে চেয়েছিলেন। তিনিও আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে বলেছিলেন : ‘ মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক’ কিংবা ‘মানবের মাঝে আমি বাচিবারে চাই।’ কবিগুরুর এ মানবচিন্তা সকল মানুষের মানবিকচেতনাকেও শাণিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ উপর থেকে নিচে তাকিয়েছেন আর কাজী নজরুল নিচে থেকে উপরে তাকিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘আমার মাথা নত করে দাও হে/ তোমার চরণধূলার প’রে’  আর নজরুল বলেছেন- ‘চির উন্নত মম শির।’ দু'জনের দৃষ্টিই মানুষের দিকে। একজন উপর থেকে দেখেছেন নিচের মানুষকে আর একজন নিচে থেকে দেখেছেন উপরের মানুষকে।  দু’জনের চেতনায়ই লক্ষ্য করা যায় সর্বমানবের মহামিলনের আকুতি। তবে নজরুল যে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র সে কথা আগেই বলা হয়েছে। নজরুল গণচেতনার বাণী নিয়ে এসেছেন ঝড়ের মতো; ঘা মেরেছেন শোষক শোষিত সবাইকে। নজরুলের এই শক্তিমান আবির্ভাবকে স্বীকৃতি দিয়ে কবিগুরু ‘ধূমকেতু’র জন্য আশীর্বাদ বাণী পাঠিয়েছিলেন : ‘ আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/ দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন/ ... জাগিয়ে দে রে চমক মেরে/ আছে যারা অর্ধচেতন।’ কবিগুরুর আশীর্বাদ সার্থক হয়েছিল। ‘ধূমকেতু’ যেমন ঘুমন্ত গণমানুষকে জাগিয়েছিল তেমনি শাসকের সিংহাসনকেও কাঁপিয়েছিল। সুতরাং নজরুলকাব্যের মূলমন্ত্র গণচেতনা। 
     গণমানুষকে নজরুল শোষণ, নির্যাতন ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উজ্জীবিত করেছেন। ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা নজরুলকে খণ্ডিত করতে পারেনি। নজরুল সকল দেশের, সকল কালের, সকল মানুষের। সকল মানুষকে নিয়েই নজরুলের কাব্যসাধনা। যুগযন্ত্রণা প্রেমিক নজরুলকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। আর সেই বিদ্রোহের বাণী তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জনমানুষের চেতনায়। পরাধীনতা কবিকে সবচেয়ে বেশি দ্রোহী করেছিল। তাই পরাধীনতার বিরুদ্ধে কবি গেয়েছিলেন শিকল ভাঙার গান। পরাধীন ভারতে নজরুলের জন্ম, পরাধীন ভারতেই তাঁর কাব্যসাধনা আর পরাধীন ভারতেই তাঁর বাকরুদ্ধ নীরবতা। তবে পরাধীনতার বিরুদ্ধে ভারতীয় গণমানুষের চেতনায় তিনি যে ক্ষোভ-বিক্ষোভের  আগুন জ্বালিছিলেন তাতেই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙেছিল। অগ্নিবীণা (১৯২২), বিষের বাঁশী (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪), ফণিমনসা (১৯২৭), সন্ধ্যা (১৯২৯), প্রলয়শিখা (১৯৩০) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের নানা কবিতায় কবি সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির কবল থেকে মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। পরাধীন ভারতে শাসকশ্রেণির কারসাজিতে যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছিল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শত শত হিন্দু-মুসলিম আত্মাহুতি দিচ্ছিল তখন নজরুল হিন্দু ও মুসলিমকে একই মায়ের সন্তান বলে মানবমুক্তির যে বাণী উচ্চারণ করেছিলেন তাহলো : ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’ কবি নজরুল তাঁর কাব্যে গণমানুষের শোষণ-বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরে সমাজবিপ্লবের নির্দেশনা দিয়েছেন। পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সর্বহারার জয়গান গেয়েছেন। পুঁজিবাদী ধনিক শ্রেণির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেছেন ‘তোমার অট্টালিকা/ কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইঁটে আছে লিখা।’ নজরুলকাব্যে সবচেয়ে বেশি মহিমান্বিত হয়েছে শ্রমজীবী মানুষ। সর্বহারা, শ্রমজীবী ও বিত্তহীন যারা তাদের শক্তি ও সামাজিক মর্যাদাবোধের কথা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কাব্যে। অন্ত্যজ সম্প্রদায় ও ব্রাত্যজনদের কথা বলতে গিয়ে নজরুল আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছেন ‘ ... তাদের কথা শোনাই তাদের/ আমার চোখে জল আসে।’ গণমানুষের প্রতি কবি নজরুলের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ এতোই বেশি ছিল যে, কবি গণমানুষের হৃদয়কে জাতি-ধর্মের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’ বলে কবি হয়েছিলেন মানবপুজারী। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভণ্ডামী কবি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন। বগলে, বুকে-পিঠে গ্রন্থ-কেতাব বয়ে বেড়ানো মোল্লা-পুরুতরা যখন নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষকে অমর্যাদা করতেন তখন তিনি তাদেরকে ছেড়ে কথা বলতেন না। অবহেলিত মানুষকে সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে কবি তাদের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর ভাষায় : ‘...জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ-ভজনালয়/  ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়।’ ‘আসিতেছে শুভদিন...’ বলে কবি বঞ্চিত, নির্যাতিত ও অবহেলিত মানুষকে দৃঢ়স্বরে অভয় দিয়েছেন। আশার বাণী শুনিয়েছেন। যেদিন বঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফুটবে, যেদিন ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’, যেদিন গণমানুষ মুক্তি পাবে অত্যাচারীর হাত থেকে সেদিন ভগবান উর্ধ্বে বসে হাসবেন আর অত্যাচারী শয়তান নিচে পড়ে কাঁপবে। এ ক্ষেত্রে কবির কাব্যভাষা : ‘মহামানবের মহাবেদনার আজি মহা উত্থান/ উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান।’ সুতরাং নজরুল গণচেতনার কবি। নজরুল গণজাগরণের কবি। তাই নজরুলের কাব্যভাষা গণজাগরণেরই ভাষা। ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত’ কিংবা ‘জয় নিপীড়িত প্রাণ/ জয় নব অভিযান/ জয় নব উত্থান’-  নজরুলের এ সব পংক্তি গণজাগরণেরই মন্ত্রবাক্য। 

আলী রেজা
কবি ও কথাসাহিত্যিক
টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ