অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও আমাদের স্বাধীনতা - এস ডি সুব্রত

দর্শ গ্রহ আমাদের এই সাধের পৃথিবী। অপরুপ রুপে বৈচিত্র আর হাসি গানে ভরা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হচ্ছে মানুষ। মা মাটি আর মাতৃভূমি হচ্ছে মানুষের অত্যন্ত আরাধ্য। মানুষের যত অনুভুতি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আর অনুপম অনুভূতি হচ্ছে ভালবাসা। সে ভালবাসার সর্বোত্তম বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে দেশ মাতৃকার প্রতি ভালবাসা। আমাদের যে স্বাধীনতা যুদ্ধ তা হচ্ছে মাতৃভূমির জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ইতিহাস। এটা অকুতোভয় সাহসের ইতিহাস। এ ইতিহাস  মহান ত্যাগের ইতিহাস। বাঙালি, বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে ততদিন অক্ষয় হয়ে থাকবে এ ইতিহাস। এ যুদ্ধের পেছনে রয়েছে অনেক ইতিহাস।  এ যুদ্ধের রয়েছে একটা প্রেক্ষাপট, রয়েছে  বঞ্চনার ইতিহাস, শোষনের ইতিহাস। দাবিয়ে রাখার জঘন্য ইতিহাস। আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যার মধ্য দিয়ে আমরা পাই একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ,একটি নতুন মানচিত্র আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এর জন্য ত্রিশ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছিল, সম্ভ্রম হারিয়েছিল অগণিত মা বোন। রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল সবুজ  শ্যামল প্রান্তর। এ স্বাধীনতা র পেছনে সবচেয়ে বড় ভুমিকা রেখেছিল এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মৃত্যুকে তুচ্ছ ভেবে কাঁধে তুলছিল অস্ত্র দেশ মাতৃকার জন্য। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা শেষ হয়েছিল ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এ যার পরিসমাপ্তির মাধ্যমে আমরা লাভ করি স্বাধীন বাংলাদেশ। 
     আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল নানা বিধ ঘটনা, বিরুপ পরিস্থিতি, অসম অর্থনৈতিক বন্টন আর প্রশাসনিক কর্মকান্ডের বঞ্চনার চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে গেলে ইতিহাস জানতে হয়। ব্রিটিশ শাসকেরা প্রায় দুশো বছর শাসন ও শোষণ করেছে এই ভারতীয় উপমহাদেশ। তাদের হাত থেকে স্বাধীন হতে হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে, জেল জুলুম খেটেছে,  নির্বাসনে গিয়েছে। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে ঠিক করা হয়েছিল ভারতবর্ষের যে অঞ্চল গুলোতে মুসলমান বেশি সেরকম দুটি অঞ্চল নিয়ে দুটি দেশ এবং বাকি অঞ্চল নিয়ে একটি দেশ গঠন করা হবে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট যে এলাকা দুটিতে মুসলমান বেশি সে দুটি এলাকা নিয়ে দুটি দেশ না হয়ে হয় একটি দেশ নাম যার পাকিস্তান। ১৫ই আগস্ট একটা দেশ ভারত গঠিত হয়। পাকিস্তান নামে যে দেশটি গঠন হয় তার দুটি অংশ দু প্রান্তে দুই হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। একটা পুর্ব পাকিস্তান আর একটা পশ্চিম পাকিস্তান। দুই হাজার কিলোমিটার এর ব্যবধানে অবস্থিত দুই প্রদেশের  মাঝে অন্য এক ভিন্ন দেশ ভারত। দু'  প্রদেশের   মধ্যে যে কেবল দুই হাজার কিলোমিটার এর ব্যবধান  ছিল তা নয়। দু' প্রদেশের মানুষের মধ্যে ছিল বিশাল ব্যবধান-  চেহারা, ভাষা, খাবার,  পোশাক,  সংস্কৃতি সবই ছিল ভিন্ন। কেবল মিল ছিল ধর্মের। শুধু মাত্র ধর্মীয় মিল ব্যাতিত অন্য কোন মিল ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বাসস্থান হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে প্রভাব  বজায় রেখেছিল পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল চারটি প্রদেশ --পাঞ্জাব,  সিন্ধু,  বেলুচিস্তান এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আর পূর্ব পাকিস্তান ছিল একটি প্রদেশ।
     শুধু মাত্র ধর্মীয় মিল ব্যাতিত অন্য কোন মিল ছিল না। শুরু হয়.শোষন  বঞ্চনা।  এতোসব বৈপরীত্যের মধ্যে দুটি অংশকে টিকিয়ে রাখার জন্য  যে ধরনের মন মানসিকতা,  উদারতা, ভালবাসা, আন্তরিকতা দরকার ছিল তা পাকিস্তানি তথা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে ছিল না। তখন পাকিস্তান নামে যে দেশটি সৃষ্টি হয়েছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল চার কোটি।
     পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ  বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু ১৯৪৮ সালেই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয়।  ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হয়ে পূনরায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে।  এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সমাজ যার পরিনতিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম বরকত রফিক  সফিক ও নাম না জানা আরো শহীদের রক্তের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলা ভাষা যা স্বাধিকারের রাজনৈতিক গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ভাষা আন্দোলন কে বাঙালি জাতিয়তাবাদের উত্থান হিসেবে ধরা হয়।
     ১৯৫৪ সালের ১০ই মার্চ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গ যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন করলে পাকিস্তানী তথা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী তা মেনে নেয়নি। মাত্র আড়াই মাসের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রী সভা ভেঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। নির্বাচন বানচাল করতে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয়।
     ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ জারি করে দাবি করেছিলেন যে সামরিক শাসকরা জনগণের জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। ১৯৬০ সালে আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর প্রদত্ত ভোটে ১৫ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন আইয়ুব খান।
     ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ রুখে দাঁড়ায়। ১৯৬২ সালে গোপনে ছাত্রদের সংঘটিত করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমদ।
     ১৯৬৩ সালের অক্টোবরে সংবাদ পত্রের কণ্ঠরোধ করার জন্য জারি করা হয় ' প্রেস এন্ড পাবলিকেসন্স অর্ডিন্যান্স'। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবাদী ও সত্যনিষ্ঠ ভুমিকার জন্য ইত্তেফাক পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয় এবং এর সম্পাদক মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।
     ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান যে কতটা অরক্ষিত তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
     ১৯৬৬ এর  ছয়দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯ এর গন অভ্যুত্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচ্য।
     ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি  বাঙালি দের প্রতি জাতিগত বৈষম্য তুলে ধরে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলনে।
     ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য সুপারিশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর একাডেমিক কাউন্সিল যার মুলকথা ছিল  সকল আঞ্চলিক ভাষা একত্রিত করে যৌথভাবে একটা মহান পাকিস্তানি ভাষা উদ্ভাবন করা। সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবী  মহলের প্রতিবাদের মুখে পিছু হটে সরকার।
     ১৯৬৮ সালে  বাঙালি জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগ দিয়ে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম এর নেতৃত্বে কিছু সামরিক সদস্য পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান সরকার সামরিক বেসামরিক ২৮ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন শেখ মুজিবুর রহমান সহ ৩৫ জনকে গ্রেফতার করে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায়। এর প্রতিবাদে শুরু হয় গত আন্দোলন যা সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।
     ১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবিকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৬৯ এর ৪ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় শাসন থেকে বাঙালিদের স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে ৪টি ছাত্র সংগঠনের  ৭ জন নেতা প্রণয়ন করেন ১১ দফা কর্মসূচি। এই আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকার সামরিক শাসন জারি করে। তখন ২০শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এ পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি মতিউর রহমান মৃত্যু বরন করেন।
     পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল পরিবর্তনের মুখোমুখি হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন পেয়ে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলে। ৩১৩ আসন বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদেও আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রধানমন্ত্রী হবার বিরোধিতা করেন  পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী খান ভুট্টো। তিনি দুই প্রদেশের জন্য দুই জন প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব করেন। অবাস্তব আর অভিনব এ প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানে  ক্ষোভের সঞ্চার হয়। অবশেষে ৩ মার্চ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই নেতা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির সাথে ঢাকায় এক বৈঠকে মিলিত হল। বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি।
     ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এ ভাষণ বাঙালিকে স্বাধীনতার পথে উদ্ধুদ্ধ করে প্রবলভাবে। এ ভাষণ বাঙালিকে উজ্জিবিত করে মুক্তি সংগ্রামের পথে। ৭ই মার্চ এর ভাষণ  কেবল কোন দলীয় নেতার ভাষন বা নির্দেশ ছিল না। ছিল একজন জাতীয় নেতার ভাষণ।   
     ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর পূর্বেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তান যখন ক্ষোভে ফুঁসে উঠছিল ঠিক তখনই ইয়াহিয়া খান সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা শুরু করেন। অন্যদিকে গোপনে চলে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার পূর্ব প্রস্তুতি। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে ঢাকায় পাঠানো হয় বেলুচিস্তান এর কসাই হিসাবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনতে থাকে‌।
     ১০ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান তাদের সকল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি যাত্রী বহনের নামে সাদা পোশাকে সামরিক সেনা পাঠাতে থাকে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে  পাকিস্তানী জাহাজ এম ভি সোয়াত নোঙর করে চট্রগ্রাম বন্দরে। তখন বন্দরের নাবিক ও শ্রমিক মাল খালাস করতে অস্বীকৃতি জানায়। ইস্ট পাকিস্তান এর সৈনিকরা তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে বাঙালি হত্যার সংকেত দিয়ে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। 
     ২৩ মার্চ ১৯৭১ পল্টন ময়দানে জয় বাংলা বাহিনীর এক কুজকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি শহরে পাকিস্তান দিবস বর্জন করা হয়। এবং পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায়।
     ২৪ শে মার্চ সামরিক শাসকগণ  হেলিকপ্টারে অপারেশনের পরিকল্পনা সমস্ত সেনানিবাসে হস্তান্তর করে। এই নির্দেশ নামা অপারেশন সার্চ লাইট নামে পরিচিত।   ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুরু করে বাঙালি নিধন যজ্ঞ- অপারেশন সার্চ লাইট। ঐ দিন রাতে ঢাকায় পাকিস্তান আর্মিতে কর্মরত সকল বাঙালি আর্মি অফিসার হত্যা  বা গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়। ঢাকা পিলখানা রাজারবাগ পুলিশ লাইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,  চট্টগ্রাম ইবিআরসিসহ সারা দেশে সামরিক আধাসামরিক সৈন্যদের হত্যা করা হয়।
     ২৫ মার্চ কালো রাতের হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে বিশ্ববাসী না জানতে পারে সেজন্য ২৫ মার্চের আগেই সকল বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সাংবাদিক সাইমন ড্রিঙ্ক তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ঢাকা অবস্থান করে এবং ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা বিশ্ববাসীর কাছে  এই গণহত্যার খবর পৌঁছে দেয়।
     ঐদিন রাত ১২টা ৩০মিনিটে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে বন্দী হবার পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃবৃন্দের করনীয় বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেন এবং অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন।
     টেক্সাসে বসবাসরত মুক্তি যুদ্ধ বিষয়ক নথি সংগ্রাহক মাহবুবুর রহমান জামাল বলেন- বিভিন্ন সূত্র ও দলিল থেকে পাওয়া তথ্য মতে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
     ২৫ মার্চ ঢাকার হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল- এ  অবরুদ্ধ সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে ঘোষনা দেওয়া হয় যে "শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি জণগনকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ঘোষনা দিয়েছেন।"
     ১৯৮২ সালে সরকারি ভাবে প্রকাশিত পুস্তক থেকে জানা যায় যে শেখ মুজিবুর রহমান একটা ঘোষনা পত্র লিখেন ২৫  মার্চ মাঝরাতে বা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে  যা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। কিন্তু সীমিত সংখ্যক মানুষ সে ঘোষনা পত্র শুনেছিল। তাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র, চট্টগ্রাম থেকে ঘোষনা পাঠ করেন যা গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। ফলে বিশ্ববাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জানতে পারে।
     ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পরিকল্পিত গণহত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে শুরু হয় প্রতিরোধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ পাকিস্তানের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করতে গড়ে তোলে মুক্তি বাহিনী। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে পাক হানাদার বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তোলে।   ১০ এপ্রিল একাত্তর নির্যাতিত সাংসদগণ আগরতলায় একত্রিত হয়ে সরকার গঠন করেন। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামে বৈদ্যনাথতলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে শপথ গ্রহণ করে। শপথবাক্য পাঠ করান স্পীকার ইউসুফ আলী।
     ডিসেম্বর এর শুরুতে যখন পাকিস্তান বাহিনীর পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে তখন স্বাধীনতা যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রুপ দিতে পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারতে বিমান হামলার মাধ্যমে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এরপর ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় বাহিনী আর আমাদের মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণে হতোদ্যম পাকবাহিনী যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত নেয়। এর পূর্বে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে তখন জাতিকে মেধাহীন করতে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এদেশের প্রখ্যাত  বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। অবশেষে ঢাকায় রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১  সালে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ বিরতির পরিবর্তে আত্ম সমর্পণ করে। আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে সেনাপ্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী এবং মিত্র বাহিনীর পক্ষে জেনারেল ওরোরা। পরবর্তীতে কুটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
     এভাবেই জাতির জনকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ও আপামর জনতা নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল লাল সবুজের পতাকার প্রিয় বাংলাদেশ।

এস ডি সুব্রত
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ