অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকাগুলো - লাবণ্য কান্তা

মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত প্রথম উপন্যাস ‘ রাইফেল রোটি আওরত’ আনোয়ার পাশার একটি অনন্য উপন্যাস। ১৯৬৬ সালের ১লা নভেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তিনি আল-বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হন এবং পরে নিহত হন।  ‘ রাইফেল রোটি আওরত ’ উপন্যাসটি রচিত হয় ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত। পুরো উপন্যাস জুড়ে রয়েছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আশ-পাশের এলাকার বিবরণ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক  এলাকার নীলক্ষেতের তেইশ নম্বর বিল্ডিং এর চিত্র এঁকেছেন তাঁর এই উপন্যাসে তা ছিলো পঁচিশে মার্চের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম রাত। ঘটনাপ্রবাহ যদিও বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তবুও এ যেন রক্তে রঞ্জিত সমগ্র বাংলা মায়ের তথা পুরো বাংলাদেশের কথাই উঠে এসেছে দৃশ্য কল্পনায়। যেকোনো পাঠকের হৃদয়ে টগবগ করে ফুটে উঠবে রক্ত; এই উপন্যাসের গুরুগম্ভীর রক্তাক্ত কথার এমনি দৃশ্যকল্প। এই উপন্যাস তাঁর লেখক জীবনের শেষ রচনা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধু ইতিহাসের রচিত প্রথম উপন্যাস । এই উপন্যাস একটি সার্থক সাহিত্য  হলেও তা একাধারে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল। 

একটি পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিলো বটে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট। সেই পাকিস্তানে এই উপন্যাসের নায়ককে তার নাম লুকোতে হয়েছিলো। নাম লুকিয়েই তিনি পাকিস্তান আমলে বেঁচেছিলেন আর পঁচিশে মার্চের রাতে বাঁচতে পেরেছিলেন খাটের তলায় লুকিয়ে। সেই কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল এবং বাসস্থানে যারাই ছিলেন তারা কেউ আশাই করেননি যে ছাব্বিশে মার্চের সকালটুকু তারা দেখতে পাবেন। তবুও কেউ কেউ বেঁচে ছিলেন সুদীপ্ত শাহীন তাদেরই একজন যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত এলাকার তেইশ নম্বর বিল্ডিঙের চতুর্থতলায় বসবাস করতেন। মাথার ওপর ছাদ, ছাদের ওপর অগিণিত লাশ, পানির ট্যাংকিতে ভাসমান লাশ, সিঁড়িতে অচেনা-অজানা মানুষের লাশ, লাশ আর লাশ; শুধুই লাশ। এই এতো এতো লাশের মাঝেও সুদীপ্ত শাহীন তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের কালরাতের পরের দিনের উদিত সূর্য তিনি দেখতে পেরেছিলেন সে তাঁর সৌভাগ্য ছিলো। তাঁর রচনায় তিনি সেই কালরাত্রিতে বেঁচে যাওয়াকে এইভাবে উল্লেখ করেছেন যে, “ জীবিতদের নিয়ে বিস্ময়ের অন্ত ছিলো না।” অর্থাৎ যারা সেইরাতের অমানবীয় ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে গেছেন তারা কীভাবে বেঁচে আছেন তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার এক কালজয়ী ইতিহাস আনোয়ার পাশার এই ‘ রাইফেল রোটি আওরত’ গ্রন্থটি। পঁচিশে মার্চের বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে লাশের স্তূপ পেরিয়ে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে যে অভাবনীয় অনুভূতি অনুভব করেছিলেন তিনি তার কোনওরকম বর্ণনা হয় না। লিখতে লিখতে তিনি একটি জায়গায় বলছেন, “ চল গুহ ঠাকুরতা স্যারের দুঃসংবাদ শুনলাম। একটু দেখি গিয়ে। কিন্তু কি আর দেখবেন, দেখার কিছুই ছিলো না। ছিলো শুধু রক্ত, রক্তের ছাপ, রক্তের বন্যা। পাকিস্তান সেনাপতি চেয়েছে কাউকে আধমরা করে রাখা চলবে না বাঙালী তবে আবার বেঁচে উঠে হাঙ্গামা করবে। একেবারে সব মেরে লাশ বানিয়ে দাও।  সৈনিকদের শকুনদৃষ্টিতে সে রাতে তাই আহত বলতে কিছু ছিল না, ছিল কেবল লাশ। সে রাতে আহত- নিহত নির্বিচারে সকলকে পুঁতে দিয়ে অভূতপূর্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তানীরা। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ও তাঁর পুত্রসহ অন্য দুজনের লাশ টেনে নিয়ে গিয়ে যখন জগন্নাথ হলের গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল তখন কী গুহ ঠাকুরতা অব্যাহতি পেতেন ওদের হাতে ? বেঁচে যাওয়া শিশু পুত্রটি মায়ের পিছে পিছে এসে জিজ্ঞেস করছে আব্বা, ভাইয়া এরা সবাই এখানে শুয়ে আছে কেন আম্মা ?” 
সেইসব রক্তাক্ত এবং বীভৎস দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে শহিদ মিনার হয়ে লাশের স্তূপ পেরিয়ে, রক্তের বন্যায় ভেসে ভেসে সুদীপ্ত জগন্নাথ হলে গিয়ে যা দেখছিলেন, তার কলমের ভাষায় তা যেভাবে উঠে এসেছিল, __ “ সমস্ত জীবনটাকেই একটা তীব্র বিদ্রোপ বলে মনে হল। সদ্য পুঁতে দেওয়া নারী-পুরুষের কারো হাতের আঙ্গুল, কারো পায়ের কিয়দংশ মাটি ফুঁড়ে বেরুনো বৃক্ষশিশির মত মাথা তুলে থাকতে দেখলেন। কত শব এইখানে পুঁতেছে ওরা ? ঢাকা শহরে কত মানুষ মেরেছে জানোয়ারের দল ? টিক্কা খাঁ আদেশ দিয়েছিল বাঙালীদের তোমরা হত্যা কর, তাদের দোকানপাট লুট কর, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দাও, তাদের মেয়েদের ধর্ষণ কর।”
বর্তমানে জহুরুল হক হল, তৎকালীন ইকবাল হলের অবস্থা কি হয়েছিলো ? কত ছাত্র  লাশ হয়েছিলো সেই হিসেব তখনো কেউ করতে পারেনি, এখনো হয়নি, আর ভবিষ্যতেও কখনোই হবে না। কারণ __ কত লাশ পুকুরে পচে গেছে, কত কামানের আগুনে ভস্ম হয়ে গেছে, কতো মাটিচাপায় হারিয়ে গেছে। ইকবাল হলের মসজিদের ছাদে বিশ-তিরিশটা শব পড়ে থাকতে দেখেছেন সুদীপ্ত। তার মাথার ওপর ছাদে ঠিক তেমনি বিশ- তিরিশটা শব। নীচের ফ্ল্যাটে মরে পড়ে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ ফজলুর রহমান ও তার ভাগনে কাঞ্চন। তারপর সুদীপ্ত তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসাটি ছেড়ে দিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন। পরবর্তীতে আবার যখন তিনি কয়েকদিন পরে তার সেই নীলক্ষেতের বাসায় ফিরবেন বলে যখন গেটের কাছে এলেন, তখন পাকিস্তানী সৈনিকেরা তাঁকে কুত্তা বলে গাল দিয়েছিলো। কি করেনি পাকিস্তানী সেনারা ? হত্যা, ধর্ষণ, লুট, জ্বালাও পোড়াও সবশেষে বাঙালিকে তারা কুত্তা বলেও গাল দিয়েছে। 
লেখকের ভাষায় সেই সকালের কথা, __ “ হায় হায়, আস্ত নরদেহ আগুনে ঝলসে রোষ্ট হয়ে আছে। প্রথমে আগুন জ্বলিয়ে দাও, তারপর লোকজন রাস্তায় বেরুলে কারফিউ ভঙ্গের অপরাধে গুলি কর নির্বিচারে। অদ্ভুত কারণ দেখিয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনী। রেললাইন অতিক্রম করে তাদের নীলক্ষেত  আবাসিক এলাকার গেটের কাছে পৌঁছতেই একটা মিলিটারী জীপ এসে সুদীপ্তের সামনে দাঁড়াল। সুদীপ্ত একবার মনে মনে আল্লাহকে ডাকলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে সামনে সদ্য পাতা গজানো দেবদারু গাছটিতে চোখ বুলিয়ে নিলেন। চলে যাবার সময় যদি জীবনে এসেই থাকে তবে তৈ্রি হয়ে নেওয়াই ভালো। মনকে তৈ্রি করে নিলেন। দেবদারুর সারা অঙ্গ ভরে বাংলার রূপ। এই রূপের পাথেয় নিয়ে পরকালের যাত্রাকে মধুময় করা যায় না ? ঘরের মধ্যে রাতের অন্ধকারে ইঁদুরের মতো মরে পড়ে থাকাটা তিনি যে এড়াতে পেরেছেন সেইজন্য নিজের নিয়তিকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। এখন এই উজ্জ্বল সকালে দেবদারু গাছের ছায়াতে মরে যেতে আর আপত্তি নেই।”

কিন্তু না, সেই যাত্রাতেও সুদীপ্ত সেই তখনো প্রাণে বেঁচে গেলেন। খাকি মূর্তির সামনে কলেমাটা পড়তে ভুল করেননি এবং নামটাও মিছে করে বলেছিলেন। মাঝেমাঝে সুদীপকে ভাবতে হয়েছিলো যে মধ্যযুগীয় মানসিকতা বিশ্ববিদ্যালয়েও এতো প্রশ্রয় পায়; মধ্যযুগীয় প্রভুতোষণকে সুদীপ্ত ঘৃণা করতেন। তাই তিনি তাঁর রচনায় বলেছেন, ___ “ ঐ একটা সমাবেশ ঘটেছিল বটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে __ আচার্য মোনায়েম খান, আর উপাচার্য ওসমান গনি। আচার্য বললে মোনায়েম খান চটতেন। __ আমারে কি তোমরা হিন্দু ঠাওরাতেছ। মুসলমানদের আচার্য কওয়া বড়ই দুষের কথা। এই যে কুটি কুটি ( কোটি কোটি) টাকা খরচ কইরা তোমাদের আচ্ছা কইরা শিক্ষা দিবার লাইগ্যা এই যে বিল্ডিং বানাইয়া দিছি তা কি এমনি কাফের হওনের লাইগ্যা ? কেন তোমরা আমারে চ্যাঞ্চলর কইতে পার না। চ্যান্সলর কথাটা মোনায়েম খান ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারতেন না, কিন্তু অই পদের গৌরবটুকু ভোগ করতেন ঠিকই।
কতটা মূর্খও ছিলো তারা আনোয়ার পাশা তাঁর রচনায় তার প্রমাণটুকুও রেখেছেন স্থূলজ্ঞানে। সেই জগন্নাথ হলের ছাত্রটি হল ছেড়ে পালাতে চেষ্টা করছিলো। তার বাড়ি টাঙ্গাইল, সে ঢাকা ছেড়ে পালাতে পারলেই বেঁচে যাবে বলে যাওয়ার পথে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে ধরা পড়ে গেলো। তার নাম বিজনবিহারী সেনগুপ্ত। পাক সেনারা তার নাম জানতে চেয়ে যখন প্রশ্ন করলো, তখন সে বললো, বিজনবিহারী আর সেনগুপ্ত বলার প্রয়োজন পড়েনি। পাক সেনারা ভেবে নিলো সে বিহারী। তাই সেই ছাত্রটি প্রাণে বেঁচে গেলো। এইভাবে কতো বাঙালির প্রাণ বেঁচেছে আবার শুধুমাত্র নামের জন্যই কতো বাঙালির প্রাণ গেছে। সেইসব অলিখিত নাম আজ আর কোথাও ভাসে না, আছে শুধু ইতিহাস রক্তাক্ষরে লেখা। তাই আজও বাঙালি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গান গায়, “ তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না।”  
বাঙালি নিধন প্রস্তুতির পূর্বে পাঞ্জাবীরা তাদের স্ত্রীদেরকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এমন নারীবর্জিত জীবনে ক্যান্টনম্যান্টের বন্দি নারীদেরকে শহরের বিভিন্ন বাসায় আটকে রেখে তাদের দেহ ভোগ করেছে, কাউকে ধর্ষণ করেছে এবং পরে সেসব নারীর যৌনাঙ্গে বেয়নেট ঢুকিয়ে হত্যা করেছে। তাদের এমন অমানবিক নির্যাতনের ফলে অনেক মেয়ে পাগল হয়ে অজানার পথে পা বাড়িয়েছিলো। অনেকে আত্নহত্যা করেছিলো, আবার কিছু সাহসী নারী সেই সুযোগে কিছু পাকসেনাকে হত্যা করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম করেছিলো। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার তেইশ নম্বর বিল্ডিঙের যে করুণকথা আনোয়ার পাশা ‘ রাইফেল রোটি আওরত ’ উপন্যাসে বর্ণনা করেছেন তার ইতিহাস কতো যে ভারী তা পাঠকমাত্রই অনুমান করা যায়। তেইশ নম্বর বিল্ডিঙের করুণ কথা লেখকের ভাষায় __
“ প্রলয় গর্জনে যখন সুদীপ্তর ঘুম ভেঙ্গেছিল তখন কত রাত ? ঐ মুহূর্তে তিনি ঘড়ি দেখেননি। কী শব্দ রে বাবা! টা-টা-টা-টা... পট-পট-পট-পট...গুড়ুম-দ্রুম হুড়ুম। একিসঙ্গে এতো শব্দের মিশ্রন সুদীপ্ত কখনো শুনেননি। উত্তরদিকের বারান্দায় গিয়ে দেখেন পশ্চিমদিকের রেল কলোনিতে আগুন। উত্তর পূর্ব কোণেও আগুন আর সবদিক থেকে ভেসে আসছে অসহায় মানুষের আর্ত চিৎকার। সুদীপ্ত কয়েকবার ফজলুর রহমানের নাম ধরে ডাকলেন। চারপাশে গুলি ছুটছে। সুদীপ্ত  ক্ষীণ আওয়াজ কারো কানে গেল না।
সুদীপ্ত কয়েকবার ফজলুর রহমানের নাম ধরে ডাকলেন। চারপাশে গুলি ছুটছে। সুদীপ্ত’র  ক্ষীণ আওয়াজ কারো কানে গেল না। খাটের নিচে বস্তায় এক মণ চাল ছিল। সুদীপ্ত সেই বস্তাটিকে সামনের দিকে টেনে আড়াল করে ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীসহ খাটের নিচে ঢুকে পড়লেন। তেইশ নম্বরের খুব কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। তাদের কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন সুদীপ্ত।  সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে তারা গুলি করতে করতে এগিয়েছিল। প্রথমেই ছাদের উপরে বেধড়ক বুলেটবাজি। একপক্ষের বুলেটবাজিতে অসহায় বাঙালি মরছে। অতঃপর সুদীপ্তর দরোজায় ধাক্কা পড়ল। সৈনিকদের গুলিতে ড্রয়িংরুমের দরোজার ছিটকিনি ভেঙ্গে দরোজা  খুলে গেল। 
সুদীপ্ত স্ত্রী সন্তানসহ খাটের তলায় লুকিয়েছিলেন। বিছানায় কাউকে দেখতে না পেয়ে খাটের কোণে শেল মেরে আগুন ধরিয়ে দিলো পাক সেনারা। ড্রয়িংরুমে তাদের স্পর্শ করবার মতো কিছু ছিলো না, ছিলো সারি সারি বই। সেই বইয়ের সেলফে তারা আগুন ধরিয়ে দিলো।  সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে একটি কাঁথার ওপর পড়ে আছে একটি কন্যা শিশু। শিশুটির গলায় গুলির দাগ। দু’তলার সিঁড়ির দৃশ্যটাই ছিল মর্মান্তিক। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সুদীপ্ত মূর্ছা যাচ্ছিলেন। দেয়ালের গায়ে স্ত্রীলোকের মাথার চুল। একগোছা চুল মনে হচ্ছে দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়েছে। ঠিক তার সামনেই দু’ধাপ পেরিয়ে রক্তের ধারা জমাট বেঁধেছে। ওই দু’মাসের শিশুকন্যাটির সাথে এই রক্তের যোগ আছে।  যুবতী মায়ের কোল থেকে শিশুটিকে ছিনিয়ে নিয়ে যুবতীকে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বর্বরের দল। মা যেতে চায়নি, তখনি মাথার চুল ধরে টানতে শুরু করলে চুল ছিঁড়ে আসে মাংসসহ আর তা ছুঁড়ে মারে দেয়ালের গায়। এবং তখনি মনে হল ডঃ ফজলুর রহমানের ভাগ্যেও তাহলে কি তবে ... না, তা হতে পারে না। তাদের মতো তিনিও লুকিয়ে বাঁচতে পারেন না ? আশাটাকে বুকে চেপে সুদীপ্ত ভেতরে গেলেন। শয়ন কক্ষের সামনে বারান্দায় কাঞ্চনের লাশ পড়ে আছে। দেয়াল আলমারির পাশে কাত হয়ে পড়ে আছেন ডঃ ফজলুর রহমান।অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, ডঃ জ্যোতির্ময় গুঠাকুরতা, ডঃ মুকতাদিরসহ আরো অনেককেই তারা ভালো মানুশ সেজে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। সাদেক সাহেবকে তো মেরেছে স্ত্রীর সামনেই গুলি করে।” 
“তেইশ নম্বরে প্রবেশ করলেন সুদীপ্ত, কিন্তু এগুতে পারলেন না, সিঁড়িতে রক্তের দাগ। হ্যাঁ, এই  দাগ তো থাকারই কথা। এতোক্ষণ যেন ভুলেছিলেন সুদীপ্ত। তার ঘরে যেতে হলে এই রক্ত মাড়িয়ে যেতে হবে। হ্যাঁ, এই রক্তই গতকাল পায়ে মাড়িয়েছেন। না মাড়িয়ে উপায় কী ছিল ? ঘর থেকে বেরুতে রক্ত না মাড়িয়ে উপায় ছিল না। পাকিস্তানী জল্লাদের খুন করার কায়দাটা ভারি চমৎকার। ঠিক ঘর থেকে বেরুবার মুখে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে। যেন তার রক্ত অন্যদের শুধু নয় আত্নীয়দের পায়ে পায়েও দলিত হয়। বুক ফেটে কান্না এল সুদীপ্তর। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। দু’হাতে  চোখ ঢেকে সিঁড়িতেই বসে পড়লেন। কয়েক বছরই তো এই সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামা করেছেন, কখনো এর উপরে বসার কথা মনে হয়নি। সুদীপ্ত শিশুর মত কিছুক্ষণ কাঁদলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন তেইশ নম্বর বিল্ডিং থেকে। বাইরে বেরুনো কাকে বলে সেটা বারান্দায় বেরিয়েই টের পেলেন সুদীপ্ত। গত ছত্ত্রিশ ঘন্টা এই বারান্দায় তারা কেউ পা দিতে পারেননি। বারান্দায় পা দিলেই ইকবাল হলের মসজিদের ছাদে মরা মানুষের সারি সারি লাশগুলো দেখা যাচ্ছিল। এখনো দেখা যাচ্ছে। কাক শকুনে খেয়ে নেবার পর সেখানে কঙ্কাল পড়েছিল আঠারোই এপ্রিল পর্যন্ত।”
“ ইকবাল হল পেছনে ফেলে সলিমুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে সুদীপ্ত গিয়েছিলেন জগন্নাথ হলে। জগন্নাথ হলের লাশগুলো পুঁতে ফেলেছিল কিন্তু ইকবাল হলের ক্যান্টিনের কাছে স্তূপীকৃত লাশগুলো ওরা সরায়নি। ওরে বাবা, কী বিরাট গর্ত ইকবাল হলের দেয়ালের গায়! কামান দাগিয়েছে ওইখানে। দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বিল্ডিঙে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস কর্মচারিগণ থাকেন। ওদের বিল্ডিঙ্গের দেয়াল যে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। জগন্নাথ হলের দেয়ালের গায় অমনি কামানের দাগ। এ হলের অবস্থা কি হয়েছিলো। কিছু বলার জন্য কেউ কী বেঁচে আছে ? কিন্তু মরে গিয়েও তো অনেক কথা বলা যায়, যেমন বলছেন এই মেয়েটি। সামাজিক মর্যাদার কোন ধাপের এ মেয়ে তা এখন বুঝবার কোন উপায় নেই। কেন না অঙ্গে বস্ত্র অলংকার কিছু নেই। তবে উলঙ্গ শরীরে অলংকারের চিহ্ন আছে। কানের মাকড়ি খুলে নেবার ধৈর্য তাদের ছিল না। কান ছেঁড়া দেখেই তা বুঝা যায়। চুরি খোলার সময় হাতের মাংস চিরে ছিঁড়ে গেছে আর মুখের মধ্যে দাঁতে লেগে আছে কাঁচা মাংস। সম্ভ্রম রক্ষার শেষ চেষ্টায় অসহায় নারী প্রাণপণে কামড়ে ধরেছেন বর্বরের দুর্গন্ধ দেহ। পেটের অবস্থা দেখে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে রমণী সন্তান সম্ভবা ছিলেন। পাষন্ডরা গুলি করেছিল পেটের সন্তান থাকার সেই জায়গায়। তলপেটে, আরেকটা বুকে। ওই শবের পাশে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না সুদীপ্ত। মা গো তোমার লজ্জা আমরা ঢাকব কি দিয়ে ?
কোথায় এলেন তিনি। এইখানে শহীদ মিনার ছিল না ? সেটা কোথায় ? কোন চিহ্ন নেই। তবু চিহ্ন আছে। পড়ে আছে বালি-সিমেন্টের স্তূপ। ডিনামাইট দিয়ে গোড়াসুদ্ধ নির্মূল করে দিয়েছে বাঙ্গালীর প্রতীক সেই প্রাণপ্রিয় শহীদ মিনার। এই তো ক’দিন আগে এইখানে শপথ নিয়েছিলেন তাঁরা – ঢাকার শিল্পী-সাহিত্যিকেরা। কবি বন্ধু শামসুর রাহমানের কণ্ঠে সুদীপ্তদের সকলের দৃপ্ত শপথ বেজে উঠেছিলো ___ আমরা লেখনীকে আজ দেশের স্বাধীনতা –সংগ্রামের হাতিয়ার করবো।” 
অথচ সেই প্রিয় শহীদ মিনার গুড়িয়ে দিয়েছিলো হায়েনা শকুনের দল। সেই গুঁড়িয়ে দেয়া শহিদ মিনারের শপথ নিয়ে যারা বুক বেঁধে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের মাঝে সুদীপ্তও ছিলেন। নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিনলিপি গুনেছেন প্রাণটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে। একটি স্বাধীন সূর্যের আভায় উদ্ভাষিত একটি নতুন পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে নতুন দিনের গানের জন্য অপেক্ষায় কতো কতো রাত কেটে গেছে তাঁর ।  
সবশেষে তিনি বলেছেন, “ পুরোনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় হয়েছে। আহা তাই সত্য হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় , নতুন একটি প্রভাত। সে আর কতো দূর? বেশি দূর হতে  পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো! মা ভৈঃ! কেটে যাবে।” 
রাত কেটেছিলো, অন্ধকার কেটে গিয়ে একটি নতুন প্রভাত এসেছিলো কিন্তু স্বাধীন পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার গান তিনি গাইতে পারলেন না। বিজয়ের মাত্র দুইদিন আগে তাঁর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলো পাক সেনাদের দল। আজ আনোয়ার পাশা বেঁচে আছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে, আপন হাতের অক্ষরে খচিত ‘ রাইফেল রোটি আওরত-এ ’। মা ভৈঃ কেটেছিলো বাঙালির জীবনে তবুও মা ভৈঃ এসে ছিনিয়ে নিয়েছিলো কতো আরো স্বাধীনচেতা জীবন। 

লাবণ্য কান্তা। ঢাকা